মামাবাড়ি ছিল বাঘাযতীনে। তখন হাওড়া যাবার জন্য
এই পথে মূলত 5 GARIA চলত।
আর যাদবপুর থেকে পাওয়া যেত 8B।
দুটো রুটেই ছিল দোতালা বাস। মাঝে মাঝে, বেশ
কয়েকটা এক চোখ কানা বাস পাওয়া যেত। ওগুলো, দোতালা বাসেরই একতলা সংস্করণ!
যখনকার কথা বলছি, তখন সবে
ঢাকুরিয়ার ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হয়েছে। পথে পড়ত, লেভেল ক্রসিং!
এখনও মনে আছে, হাওড়া
থেকে আসবার সময় ক্রসিংটা পেরিয়েই রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে আবার সোজা ছিল।
আসবার সময় ডানদিকে ।
দোতালা বাসে চেপে এলে এই বাঁক নেবার সময়, বাসটা
কেতরে চলত।
উড়ি ত্তারা! কি ভয় লাগত। অথচ, বাসের ফুট
বোর্ডে ঝুলে থাকা লোকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকতো না।
তখন, কত আর বয়স হবে? এই ১৬ বা
১৭। কিন্তু, মেয়েদের
ব্যাপারে কৌতূহল তুঙ্গে। জয় ফার্মেসির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সম্মিলিত
উদ্বাস্তু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের হাঁ করে দেখতাম, আমার
স্কুলে যাওয়ার পথে।
উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়- তবে কোনো
মেয়েই মাথায় লম্বা ছিল না! সবই আ্যভারেজ ! মাঝেই মাঝেই দোতালা বাস গুলো এসে
মেয়েদের ঢেকে দিত! অজান্তেই দাঁত কিড়মিড় করতাম!
সরস্বতী পুজোর কয়েকদিন আগে, একটা মেয়ে
হঠাৎ করে একটা ছোট্ট চিরকুট ছুঁড়ে দিল আমার দিকে! প্রথমে একটু
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে,
তারপর তুললাম চিরকুটটা! সাত রাজার এক ধন আমার কাছে।
প্রথমে, একটা
চুমু খেলাম চিরকুটটাতে! তারপর, আস্তে আস্তে খুললাম।
লেখা আছে:- এই লম্বু বাঁদর! রোজ রোজ আমার দিকে
তাকিয়ে হাঁ করে কি দেখিস রে? জবাব দিবি কিন্তু!!!!!
উত্তেজনায়, সেদিন বিকেলে লণ্ঠনের চিমনী
পরিষ্কার করা, ফিতে
সাইজ করে কাটা, কেরোসিন তেল ভরা, ( তখন
ইলেকটিরি স্বপ্ন) সসসব ভুলে গেলাম। দাদু আর ছোটমামার কি বেদম বকা!
কিচ্ছুটি গায়ে লাগল নি কো! রাতে হাঁসের ডিমের ডালনা ছিল, ভাত কম খাওয়াতে
দিদিমা আমার
কপালে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল জ্বর এসেছে কিনা আমার!!!!
পরের দিন খুব ভোরে উঠে লিখে ফেললাম চার শব্দের
জবাব:- তোকে খুব ভালো লাগে!
স্কুলে যাবার সময় মেয়েটাকে দেখতে পেয়েই অন্য
মনস্ক ভাবে আলতো করে ফেলে দিলাম ছোট কাগজটা!
খুলে তক্ষুনি পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি
হাসল! দিল্ একদম তর্ র্ র্ র্! এই ভাবেই চলছিল চিরকুটের দেয়া - নেয়া
। সঙ্গে, ঠোঁটের
কোণে মুচকী হাসি । সাবান মাখার মাত্রাটা বেড়ে গেছিল আমার।
একদিন বিকেলে ফেরার পথে, আর একটা
চিরকুট পেলাম! লেখা:-
“পরশু সরস্বতী
পুজোর পরে দোতালা বাসে চড়ে বেড়াতে যাবি? কোনোদিন চড়ি নি! সারাদিনের
ছুটি সেদিন আমার! যদি হ্যাঁ হয়, তবে মাথা ডান দিকে হেলাবি আর এখান থেকে
চড়া যাবে না, সোজা
গড়িয়া বাস স্ট্যান্ডে চলে যাবি দুপুর বারটার সময়! ভোগ
খেয়ে বেড়াতে যাবো! আমার কাছে জমান ১০ টাকা আছে। তোর কাছে কিছু আছে? না থাকলেও
ক্ষতি নেই! চলে আসবি কিন্তু!”
সম্মোহিতের মত ডেস্পারেট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে
ঘাড়টা ডান দিকে হেলিয়ে দিলাম।
দিন যেন আর কাটতে চায় না! তবে, সরস্বতী
পুজোর ভার টার পেয়ে নিজেকে খুব লায়েক মনে হচ্ছিল। খিচুড়ি, বাঁধাকপির
তরকারি আর আলু বখরার চাটনি! এই ছিল ভোগ!
তবে অঞ্জলি দেবার সময় “ কুচ যুগ
শোভিত মুক্তাহারে”
বলতে বলতে মূর্ত্তির বুকের দিকে
তাকাতে পারতাম না ভয়ে। পাছে, পাপ হয়!!!! তবে, অবাধ্য চোখ ওইদিকেই বারবার
করে যেত আর কেমন যেন সিটকে যেতাম।
সেদিন যেন আরও বেশি করে চোখ যাচ্ছিল।
গড়িয়া যেতেও তো টাইম লাগবে। বিজয়গড় থেকে হেঁটে বাঘাযতীনের মোড় তারপর বাস
ধরে সোজা গড়িয়া বাসষ্টাণ্ড!
ভাড়া দিতাম না! কনডাক্টর টিকিট চাইতে
এলেই, একটা
১০ পয়সা দিয়ে গম্ভীর
মুখে বলতাম :- একটা হাওড়া!
মুখ ভেংচে কনডাক্টর
বলত:- এটা গড়িয়া যাবে,
হাওড়া নয়! যাও! নেমে যাও!
দোতালা বাসের ফুট বোর্ডটা ছিল বেশ চওড়া!
বাঁদিকে, ঘুরেই
একতলার বসার জায়গা। বাঁ দিকেই ছিল লেডিস সিট! ( ওই জন্যই বোধহয় মহিলাদের বামা বলা
হয়)
আর সোজা উঠে গেছে দোতালা ওঠবার বাঁ দিকে ঘোরান
সিঁড়ি!
আমি ফুট বোর্ডেই দাঁড়িয়ে থাকতাম।
পদ্মশ্রী সিনেমার সামনে ছিল আশাপূর্ণা দেবীর দোতালা
বাড়ী! ওখানেই সাধারণত নামতে হত মানে নেমে যেতে হত। তারপর হাঁটতাম।
কিন্তু সেদিন আর নো রিস্ক! বাসন্তী রঙের
পাঞ্জাবী আর সাদা ধূতি (দাদু পরিয়ে দিতেন)। পকেটে
একটা কড়কড়ে বড় নতুন পাঁচ টাকার নোট ( দিদিমার দেওয়া)সঙ্গে কিছু
খুচরো পয়সা।
ভোর বেলা অত ঠাণ্ডার মধ্যেও,মাথায়
সাবান দিয়ে চুলটা
ফুরফুরে করে নিয়েছি। তখন অত শ্যাম্পুর চল ছিল না! পুকুরে
নাইতে হত। বড়
নতুন লাক্স সাবানটা ঘষে ঘষে আদ্ধেক করে দিলেও মনে হচ্ছিল, আরও সাবান
দিলে হত!
ভোগ খেয়েই কোঁচা সামলে, হাঁটা
লাগালাম লায়েলকা মাঠের পাশ ধরে। বিজয়গড় শিক্ষা নিকেতনের পাশেই
ছিল গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী! ফ্রিতে বিখ্যাত গায়কদের গান
শোনার লোভ দমে গেছিল সাক্ষাতের উত্তেজনায়।
প্রায় দৌড়ে হাঁটার সময় মনে হল- মেয়েটা হাফ সোল
মারল না তো? এবার
কিন্তু উত্তেজনাটা ভয়ে পালটাল। মোড়ে আসতেই বাস। তবে, একতলা!
উঠতেই মুখ চেনা কনডাক্টর হেসে বলল:- এই বাস কিন্তু, হাওড়া নয়
গড়িয়া যাবে। আজও পদ্মশ্রীতে সিনেমা দেখবে নাকি?
বুক চিতিয়ে বললাম:- না কাকু, আজ টিকিট
কাটবোই! আর আজ গড়িয়াতে নামবো।
কনডাক্টর কাকু বলল, না থাক!
ট্র্যাডিশন ভাঙ্গবে কেন?
তোমার এই দুষ্টুমিটা আমাদের ভালো লাগে! কয়েকজন তো চিনে
ফেলেছে তোমায়! নতুন আরও একটা ভয় ঢুকল মনে! যদি, চেনা কনডাক্টর কাকু বেরোয়? সাড়ে
সব্বোনাশ! তার ওপর মেয়েটার আসার চান্স কতখানি কে জানে?
স্ট্যান্ডে নেমে, মনটা
ফুলেল তেল হয়ে গেল! মেয়েটা,
বাসন্তী শাড়ী পরে খোঁপায় একটা গোলাপ
গুঁজে দাঁড়িয়ে এদিক- ওদিক তাকাচ্ছে কাঁদ কাঁদ মুখে। তখন একটু এগুলেই, বারবধূদের
বাড়ীগুলো ছিল। তারপরেই সামনে একটা কাঠের পুল। জায়গাটা খারাপ!
ঘড়িতে সাড়ে বারটা দুপুর।
আমি এগিয়ে যেতেই একগাল হাসি! মুখ থেকে
যেন দিনের বেলাতেই পূর্ণিমার আলো ঝরে পড়ছে, শুক্লা
বসন্ত পঞ্চমীর দিনে। সেই এক আকাশ জ্যোৎস্নাতে আমার মনটা উথাল – পাথাল!
পুরুষ্টু বুক দুটো ফেটে বেরিয়ে আসছে। গলায় একটা ঝুটো মুক্তোর মালা, উপত্যকার
ভেতর দিয়ে গোপনে চলে গেছে,
কামনার দিকে।
------------------
চল, এবার বাস বাছি! বলল, মেয়েটি!
সার দিয়ে চার খানা ৫ নং বাস দাঁড়িয়ে । সব নীল রঙের! ফুট বোর্ড গুলো কালচে লাল।
ও বলল:- কালো ধোঁয়া যে বাস দিয়ে বেরুবে, সেই বাসে
উঠবো না কিন্তু!
টাইম জেনে, একটা
প্রায় নতুন বাসের দোতালায় একেবারে সামনের সীটে বসলাম দুজনে। লম্বু
হবার ফলে, মাথাটা
নিচু করেই সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ও কাড়াকাড়ি করে জানলার পাশে বসে আমার
বাঁ হাতটা নিয়ে ওর ডান হাতটা রাখল। তখনও বাসে কেউ নেই! আমার কি যে হলো!
শরীরে একটা ৪৪০ ভোল্ট! এদিক ওদিক তাকিয়ে টকাস করে ওর গালে একটা চুমু খেলাম।
লজ্জায় লাল হয়ে, প্রশ্রয়ের
হাসি হেসে বিড়বিড় :- যা:! তুই না ভারী অসভ্য! তবে কিন্তু বেশ লাগল। এবার আর
দুষ্টুমি করিস না!
আস্তে আস্তে দোতালাটা ভর্তি হয়ে গেল।
আমাদের পাশের সীটে এক বৃদ্ধ তাঁর বছর ৭/৮ এর নাতিকে নিয়ে বসেছেন। তখন, বাসগুলো
ধোওয়া হত। ঠাণ্ডা হাওয়ার ভয়ে সামনের কাঁচ দুটো পুরো বন্ধ। তবে পাশের
জানলাটা হাফ খোলা!
নীচের তলায় টিং টিং করে
বাস ছাড়ার ঘণ্টি । বাসের এঞ্জিন স্টার্ট হতেই বাসটা একটু কেঁপে উঠল।
তারপর, ডিপো
থেকে বেরিয়ে একটু কেতরে ডান দিকে বাঁক নিয়ে সোজা বড় রাস্তায়!
সামনে ড্রাইভার নেই,
অথচ বাস চলছে, এ এক অসাধারণ অনুভূতি! প্লেনে
তখনো উঠি নি, তবে
কেন যেন মনে হল, এটাই
প্লেন। পাশে, সুন্দরী কিশোরী!!!!!
স্বর্গীয় ব্যাপার সাপার!
কিশোরী বলল:- আমি যা ভাবছি, তুইও কি
সেটা ভাবছিস!!!!!!
মুখ দিয়ে সাহিত্য বেরিয়ে এলো! বিয়ে বাড়ীতে শোনা
একটা মন্ত্রর মানে
বুঝে নিয়েছিলাম। উত্তর দিলাম :-যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং
হৃদয়ং মম।
বুঝলও না মনে হয়! একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আমাকে
জিভ দেখাল।
পাশের বৃদ্ধটি কান পেতে শুনছিলেন আমাদের
কথোপকথন মনে হল।
হেসে বললেন:- মা! ছেলেটি বলল- তোমার আর আমার
হৃদয় এক। তা বাছারা! তোমরা দেখছি প্রেমিক
যুগল! বেশ লাগছে দুটিতে! বেড়াতে বেরিয়েছো?
আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললাম- হ্যাঁ
- কোন
ক্লাসে পড়?
- আমি ক্লাস
ইলেভেন আর ও ক্লাস টেন।
- কি নিয়ে
পড়ছো?
- দুজনেই
সায়েন্স।
- বেশ, বেশ! এক
স্কুল নয় নিশ্চয়ই!
- না! আমি, বিজয়গড়
শিক্ষা নিকেতন আর ও সম্মিলিত উদ্বাস্তু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
- তোমার তো
সামনেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা! মন দিয়ে পড়ছো তো?
- হ্যাঁআআ!
- ঠিক আছে, সরস্বতী
পুজোর দিন পড়তে নেই আর হাতে খড়ি দিতে নেই! দেবী আনন্দ উপভোগ করেন। তাই এগুলো বারণ!
এটা অনেকেই জানে না।
- আপনিও কি
বেরিয়েছেন?
- হ্যাঁ!
নাতিকে নিয়ে কোলকাতা দেখাবো, দোতালা বাসে চড়ে।
বলতে, বলতেই পদ্মশ্রী সিনেমার কাছে বাসটা
বাঁক নিলো বাঁ দিকে। আর মেয়েটি এসে পড়লো আমার কাঁধে!
একটু হেসে সামলে নিল চন্দনা! বৃদ্ধ
ভদ্রলোক একটু কি উদাস? হঠাৎ
ভদ্রলোক বললেন:-
ওই দ্যাখো আশাপূর্ণা দেবী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ব্যালকনিতে। ঠিক সেই সময়েই
বাসটা বেরিয়ে গেল,
দেখা আর হলো না! কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কনডাক্টর এলেন। আমাকে
দেখেই চমকে উঠলেন!
- একি! তুমি? সঙ্গে এ
কে?
যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই
সন্ধে হয়! কনডাক্টর কাকু আমাদের দুটো বাড়ী পরের সজল কাকু। বিয়ে থা করেন নি! সংসারে
নিবেদিত প্রাণ! বাসটা হঠাৎ ব্রেক কষল! সজলকাকু, হাতটা বাসের ছাদে হাত দিয়ে টাল
সামলালেন। এই কায়দাটা বাসের দোতালায় করতে হত। ওখানে কোনো রড থাকতো না।
রামগড়ের মোড়ে বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ- দিকে
গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের বাড়ী! বেশ কিছু গায়ক- গায়িকা দাঁড়িয়ে
রয়েছেন। ওনাদের দেখতেই ভীড়!
আমতা আমতা করে বললাম- কাকু, আমরা
বেড়াতে বেড়িয়েছি, দোতালা
বাসে! আর ও হলো চন্দনা! বাঘাযতীন আই ব্লকে থাকে।
-তোর
সাথে কি করে পরিচয় হল?
-
মানে! এই যাতায়াত করতে করতে!!!!!
-
পারিসও তোরা! তা কোথায় যাবি?
-
হাওড়া!
-
তারপর?
-দেখি, কি করা
যায়!
-
হুম! আমার একটা কথা শোন! তোরা হাওড়ায় নেমে, এক কামরার
ট্রামে শিবপুর পর্যন্ত ঘুরে আয়! ভাল লাগবে।
চন্দনা একটা আধুলি বের করে বলল- টিকিট দেবেন
কাকু!
সজলদা হেঁসে বললেন- আমি অতখানি পাষাণ নই!
তোরা ওই পয়সায় হাওড়ায় কিছু খেয়ে নিস। আর হ্যাঁ! তোরা কিন্তু সন্ধে লাগার
আগেই ফিরে আসবি। আমি তোদের কথা বাস গুমটিতে বলে আসব। আমার নাম বলবি!
ফেরার টিকিটের পয়সা লাগবে না! বুঝলি?
বাস এগিয়ে চলেছে। বাঁদিকে, ঝক ঝকে হলুদ
রঙের গাঙুলিবাগান টেনামেন্টস স্কিমের লম্বা বাড়ি।
চন্দনা মাথা নীচু করল।
কারণটা জানি! ও তো ওখানেই থাকে! বাধ্য হয়ে
কাকুকে মিথ্যে কথাটা বলতে হল।
বৃদ্ধ বললেন- একি? মাথা নীচু
করছ কেন, এই
মেয়ে
চোখ কচলাতে কচলাতে, চন্দনা
বলল- চোখে কি একটা যেন পড়ল!
বৃদ্ধ কি বুঝলেন কে জানে! চুপ করলেন।
সামনেই বিদ্যাসাগর ষ্টপেজ। এবারেও বাঁ দিকে ঝুঁকে চলল বাস। একটা বট গাছের ডাল
ছিঁড়ে কয়েকটা পাতা ঝরে পড়ল চন্দনার গায়ে।
বিদ্যাসাগরে থামতেই, হই হই করে
বেশ কয়েকটা মেয়ে উঠে পড়ল বাসে।
ওরা ওপরে উঠে,দাঁড়িয়ে রইল, সিঁড়ির
ধাপের মুখটাতে। দোতালায় ষ্টাণ্ডিং নিষেধ । শুধু কনডাক্টর আসতে পারত।
একটা মেয়ে চেঁচিয়ে বলল- আ্যই চন্দনা! কোথায়
যাচ্ছিস রে! সাথে ওটা কে?
ঘাড় ঘুরিয়ে চন্দনা বলল, আরে
বৈশাখী!!!! তোরা আবার কোথায় চললি?
পঞ্চানন তলা! তা বললি না, তোর সাথে
ছেলেটা কে?
চন্দনা মুচকি হেসে আবার জিভ বের করল।
প্যাণ্ডেল থেকে গান ভেসে আসছে- বনতল ফুলে ফুলে
ঢাকা!
আমাদের পেছনের সিটের দুজন বাঘাযতীনে নেমে গেলে, দুটো মেয়ে
এসে বসল পেছনে! বসেই একটা টোকা মারল চন্দনাকে।
এটা সেই ছেলেটা?
- হুম
- এর বাবা
মা তো উড়িষ্যায় থাকে!
- জানলি কি
করে?
- বা! আমার
দাদা তো এর ক্লাসমেট! জানবো না?
- ও
- তা , শেষে তুই
এই হাড়গিলেটাকে পছন্দ করলি!!!!
- হাড়গিলেটাই
দেখলেন, আমার
লাবণ্য দেখলেন না?
– আমি বলে উঠলাম।
- ও বাবা, এ দেখছি
ভালো বাংলা বলে!!!
- শিখেছি
তো! অন্নদা শঙ্করও বাংলা শিখেছিলেন! তাতে কি?
- আরে বাবা, সব বলেই
গোল! নাঃ! আপনার হবে!
বাস শুদ্দু ছেলে- মেয়ে গুলো হেসে উঠলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দোতালাটা
সব আমাদের
বয়েসী! খালি, ওই বৃদ্ধ চুপচাপ, একটা
ছোট্ট হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে।
সজল কাকু এসে সবার কাছে টিকিট চাইছে, আর মুচকি
মুচকি হেসে যাচ্ছে!
এর মধ্যেই ঢাকুড়িয়া লেভেল ক্রসিং এ বাস দাঁড়িয়ে
পড়ল। লেভেল ক্রসিংএ দাঁড়িয়ে থাকাটা বোরিং জিনিস। বাদাম বিক্রি করছিল একটা
মধ্যবয়স্ক লোক। চন্দনা
কয়েকটা প্যাকেট কিনে নিল। তবে, বেশী ভুগতে হলো না! টুকটাক করে খেতে খেতে আর চারপাশ দেখতে
দেখতে পৌঁছে গেলাম হাওড়া!
নেমে, দুজনে হাঁটা লাগালাম এক কামরার
ট্রামের দিকে।
খুব তেষ্টা পেয়েছে, চল
কোকাকোলা খাই! চন্দনা বলল।
আট আনা দিয়ে দু বোতল কিনে আস্তে আস্তে খেতে
লাগলাম।
খুব বেশী ভীড় নেই ষ্টেশন চত্তরে। কয়েকটা সেকেলে
ঘোড়ার গাড়ী দাঁড়িয়ে।
চন্দনা বলল- তুই আমাকে ভুলবি না তো?
- হঠাৎ এই
প্রশ্ন!!!
- না ধর,আমি মরে
গেলাম, তখন?
- ধ্যাৎ!
খুব সুচিত্রা উত্তমের ছবি দেখছিস বুঝি আজকাল?
- না রে না!
আমার আজকাল কেন জানি মনে হয় এরকম! তাছাড়া আমরা তো ব্রাহ্মণ নই! তোর বাড়িতে মেনে
নেবে?
- মা- বাবা
মানবে না, তবে
দাদু- দিদা আছে! নো চিন্তা!
- শোন, আমি একটা
বক্স ক্যামেরা এনেছি! ফোটো তুলব।
- সে কি রে? দারুণ তো!
*************************
নে, পোজ দে! ছবি তুলি!
সেটা না হয় হলো! আমাদের দুজনের একটা ফোটো হবে
না?
দাঁড়া, দাঁড়া! কাউকে খুঁজতে হবে।
বলতে বলতে দেখি, সজল কাকু দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে চা
খাচ্ছেন। ওনার বাস ছাড়ার টাইমের দেরী আছে।
আমরা গিয়ে আব্দার করাতে, ফোটো তুলে
দিলেন। এবারে বললেন- শোন! পেছনে এক ভদ্র লোক বসে তোদের
দেখছিলেন। আমি যখন তোদের কাছ থেকে পয়সা না নিয়ে চলে এলাম ,তখন ডেকে
বললেন
আপনি ওদের চেনেন?
ছেলেটাকে চিনি, মেয়েটাকে নয়!
হুম! মেয়েটা আমার বন্ধুর মেয়ে। বলে
গম্ভীর হয়ে গড়িয়াহাট নেমে গেছিলেন। আমি বলি কি তোরা এই বাসে ফিরে চল! সন্ধে
হওয়ার আগেই ফিরে যেতে পারবি!
চন্দনা দেখলাম খুব একটা ঘাবড়ালো না! বলল-
আমি মাকে বলে এসেছি! ও যে আমার সঙ্গে আছে, সেটা মা জানে! বাবা জানে না! ঠিক
আছে!সজলকাকু তুমি যখন বলছ তখন ফিরেই যাই! বেকার অশান্তি বাড়িয়ে কি লাভ?
আবার সেই দোতালার সামনের সিট! কিন্তু এবার
চন্দনার মুখে প্রতিপদের চাঁদও নেই!
গাঙ্গুলী বাগানে নেমে গেল, আমাকে
নামতে নিষেধ করে।
পরের বেশ কয়েক দিন আর দেখা নেই! মনে অসহ্য
যন্ত্রণা! দশদিন পর বৈশাখী এসে একটা চিঠি দিল আমার হাতে।
খুলে পড়তে শুরু করলাম।
শোন
সেদিন, বাবার কাছে বকা খেলেও মা সব সামলে
নিয়েছিল। এমনিতে আর কিছু হয় নি! ছবিগুলো প্রিন্ট হয়ে এসেছে। মা নিজেই সব করে দিল।
আমার, কেন জানি না খুব জ্বর হয়েছে। শরীর
দুর্বল। তাই বেরুচ্ছি না। তোর তো সামনেই পরীক্ষা। ভালো করে পড়বি! কিছু একটা
তোকে হতেই হবে। সেটা রাজনীতি হোক( যেটা তুই খুব ভালবাসিস) বা অন্য কিছু।
তোকে ৭ বছর সময় দিলাম। তারপরে, একসঙ্গে থাকবো! বাবা রাজী।
এবার তোর পালা, অবশ্য পরে করলেও চলবে।
বাবা- মার সাথে পুরী যাচ্ছি। স্কুলে পরীক্ষার
সিট পড়েছে। তাই আমাদের ছুটি। শরীরটা চাঙ্গা করে এসে, তোর সাথে ঘুরতে যাবো আবার!
ভালো থাকিস!
পু:- তোর চুমু খাবার কথা কাউকে বলিনি! ওটা
আমার!
------------
পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এবার জেদ
ধরে গেছিল। ভাল রেজাল্ট করতেই হবে।
পরীক্ষার শেষের দিন বৈশাখী দেখা করতে এলো আমার
সঙ্গে, সেন্ট
লরেন্স স্কুলে। ওখানেই আমার সিট পড়েছিল।
বাবার গাড়ী নিয়ে এসেছি। সোজা চল চন্দনার বাড়ী।
ওর মা তোকে ডেকেছে। বৈশাখী বলল।
সারারাস্তা বৈশাখী চুপ। কিছু বলতে গেলেই ইশারা
করে ড্রাইভার দেখিয়ে নিঃস্তব্ধ ।
নামিয়ে দিয়ে বৈশাখী চলে গেল। বাড়ী টা খুঁজে বেল
বাজালাম।
এক মহিলা দরজা খুলেই আমাকে দেখে হাউমাউ করে
কেঁদে বললেন: ছবি দেখেই তোমাকে চিনলাম বাবা!
কেন যে ওকে সমুদ্রে ছাড়লাম। সমুদ্রেই চলে গেল
মেয়েটা
চন্দনাআআআআআ!!!!!!! ৫০ বছর হয়ে গেল। তুই কোথায়
আমি জানি না! শুনেছি,
সমুদ্র সব ফিরিয়ে দেয়!!!
আজও মনে মনে ভাবি, তুই আমার
ফেসবুকে, অরকুটে, মনে, পত্রিকায় সব জায়গায়
আছিস। জানি, তুই
এই চিঠিটা পড়ছিস।
মনে ঝড়ের সমুদ্র!
কবে ফিরবি রে?
....................................
****শারদীয়া সংখ্যা- দমকা হাওয়া
পত্রিকায় – রাণাঘাট, প্রকাশিত
2 comments:
Mon kaharap kore dilen sesta te...
Ghana Da
Daroon Ei Lekha ta ki Dotala Bus ebong boite ache?
Ami Apner Facebook Post Follow kori jodi friendlist e add kore nen to khub valo lagbe
Post a Comment