কথা তো বলার জনই - ব্লগে প্রকাশিত
বাঙালীর একটা বদ- অভ্যাস আছে। ডাক নামকে
বিকৃত করার। একটা স্নেহ মাখা অবজ্ঞার সঙ্গে ডাক নামকে ওলট পালট করে দেয়, এই জাতটা।
বাঙালী বোধহয়, মনে করে- এই অবজ্ঞা পরে,
ছেলেটাকে বড় করে তুলবে।
তা, ফটিক, ফইটক্যা বা ফটকে হয়েছিল কিনা
জানা নেই, তবে উনি একজন সত্যিকারের বড় মাপের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তীকালে।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে খাটো না
করেই বলা যায়, বেঙ্গল- কেমিক্যাল, যে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, সেটা এই ফটিকের জন্যই।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একবার চিঠি দিয়ে,
ফটিক সম্বন্ধে কৃত্রিম অভিযোগ করেন রবীন্দ্রনাথকে।
তিনি, ফটিকের ভালো নাম দিয়ে লিখেছিলেন:-
আপনি, ফটিকের বইয়ের
এত প্রশংসা করছেন, যে বেঙ্গল- কেমিক্যাল অসুবিধায়। প্রশংসার দরুণ বেঙ্গল-
কেমিক্যাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কারণ, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সব কাজ- কর্ম শিকেয়
তুলে, কেমিস্ট্রি ছেড়ে গল্প লেখায় মত্ত হবে।
রবীন্দ্রনাথ এই চিঠির উত্তরে যে চিঠি (
১৮ ই অঘ্রান, ১৩৩২)লেখেন, তার শেষাংশ ছিল এই রকম:-
“যে সব জন্ম সাহিত্যিক
গোলমালে ল্যাবরেটরির ভেতর ঢুকে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন. তাদের
ফের জাতে তুলব। আমার এক একবার সন্দেহ হয়, আপনিও বা সেই দলের একজন হবেন, কিন্তু আর
বোধহয়, উদ্ধার নেই।
যাই হোক, আমি রস
যাচাইয়ের নিকষে আঁচড় দিয়ে দেখলাম আপনার বেঙ্গল- কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই
কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা”
রবীন্দ্রনাথ, একবার ফটিককে বলেছিলেন-
তুমি এত রস কোথা থেকে পাও?
ফটিকের উত্তর ছিল- আপনি ভুলে যাচ্ছেন,
আমি রসায়নের ( কেমিষ্ট্রি) লোক।
রবীন্দ্রনাথ ফটিক সম্বন্ধে একজায়গায়
বলেছিলেন:-
“তিনি মূর্ত্তির পর মূর্ত্তি গড়িয়াছেন।
এমন করিয়া গড়িয়াছেন যে মনে হইল ইহাদিগকে চিরকাল চিনি।”
একজন লেখকের এর চেয়ে বড় প্রশস্তি কি আর
হতে পারে?
বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, শ্লেষ বা ব্যঙ্গের
লক্ষ্য- সন্ধানে দক্ষতা এবং সেই সঙ্গে অনায়াস ভঙ্গিতে কৌতুককর পরিস্থিতি সৃষ্টি
করার অতুলনীয় ক্ষমতা ফটিকের ভালো রকমই ছিল।
এই সব দুর্লভ গুণের অধিকারী হয়ে তিনি
বাংলা সাহিত্যের প্রশস্ত অঙ্গনে রসের ঝরণা ছুটিয়ে পাঠকদের “ হাড্ডি পিলপিলিয়ে”
দিয়েছিলেন।
তার রচনার মধ্যে দিয়ে কটাক্ষ করেছেন,
আঘাত হেনেছেন, কিন্তু এই রসিকতা শুধু বিষের দহন আনে নি, এনেছে বিশুদ্ধ কৌতুক রস।
পাঠকদের দুর্ভাগ্য, তাঁরা Zআন্তি পারে নি।
যে কোনো তারযন্ত্রে, তারটাকে বেঁধে
সুরেলা করতে হয়। এই ফটিক, ২১ টা সুরে বাঁধা তার লাগিয়েছিলেন, যা বাংলা সাহিত্যের
সেতারকে আরও সুরেলা করে তুলেছিল। সেই তারের ঝংকারে,সুরের মূর্চ্ছনা তো বটেই, ঝলসে
উঠেছিল বিদ্যুৎতের দীপ্তি।
বিয়াল্লিশ বছরে
পা দিয়ে,একসময় ফটিক যে কলম তুলে কাগজে আঁচড় কেটেছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসেছিল,
সোনার ফসল।
ভালো ল্যাংচা খেতে গেলে বর্দ্ধমানের শক্তিগড়
যেতেই হবে। ১৮৮০ সালের ১৮ ই মার্চ (
অন্যমতে, ১৬ ই মার্চ), ফটিকের জন্ম এই শক্তিগড়ের কাছে ব্রাহ্মণ পাড়ায়। শক্তিগড়, এই
ফটিকের জন্যই আরও বিখ্যাত হয়ে আছে।
ফটিক নামের আড়ালে, এই মানুষটি কে?
বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছেন!
হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন, ইনি ৺ রাজশেখর বসু। একটা ছদ্মনামও ছিল-
পরশুরাম।
আগে, জেনে নেই রাজশেখর বসু নামটা কেন
হয়েছিল ফটিকের।
বড় ভাই, শশীশেখরের স্মৃতিচারণ থেকে
জানতে পারি:-
“দ্বার ভাঙ্গা থেকে ঘুরে এসে চন্দ্রশেখর
( পিতা) বললেন : - ফটিকের নাম ঠিক হয়ে গেছে।মহারাজ লক্ষ্মীশ্বর সিংহ ( শ্রোত্রিয়
ব্রাহ্মণ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দ্বিতীয় ছেলের নামও একটা শেখর হবে নাকি? কি শেখর
হবে?
আমি বললাম:- ইওর হাইনেস, যখন তাকে
আশীর্বাদ করেছেন, তখন আপনিই তার শিরোমাল্য- আমি আপনার সামনেই তার নামকরণ করলাম, রাজশেখর।”
ঠিকঠাক ভাবে বলতে গেলে, এই নামকরণটা
সার্থক হয়েছিল। জীবনের রঙ্গমঞ্চে তিনি, গ্রীক ট্র্যাজেডির নিঃসঙ্গ নায়ক ছিলেন।
ঋষিসুলভ জীবনজিজ্ঞাসার সঙ্গে
ক্ষত্রিয়সুলভ তিতিক্ষা তাঁর জীবনকে এক রাজকীয় আভিজাত্যে প্রচ্ছদায়িত করে রেখেছিল।
এক্ষেত্রে, তিনি সত্যিই রাজশেখর।
আমরা এটা জানি, বাঙালী কবি বা লেখকের
গায়ে একটা অগোছালো ঢিলেঢালা চাদর থাকে।
এই চাদরটি তিনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
কবিস্বভাব থাকলেও তিনি ছিলেন, অসাধারণ বিষয়নিষ্ঠ বা বস্তুনিষ্ঠ।
প্রতিটি কাজের নিঁখুত
ছক তৈরি করেই তিনি কাজে নামতেন। এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। আজকালকার এম.বি. এ. ডিগ্রিধারীরা তাঁর
ধারকাছ দিয়েও যেতে পারবেন কিনা, সন্দেহ আছে।
বেঙ্গল কেমিক্যালকে পূর্ণভাবে গড়ে তোলার
কাজই হোক বা “চলন্তিকা” অভিধান, রামায়ণ- মহাভারতের অনুবাদই হোক, সেই সব রচনার কাজ
, সব কিছুই তিনি প্ল্যান- মাফিক করতেন।
যে কোনো সফল বৈজ্ঞানিকের একটা গুণ থাকা
দরকার, সেটা হল- একান্ত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা।
রাজশেখর সেটা অনায়াসে করতে পারতেন। তাই
তাঁর এই ক্ষমতাকে নিজের জীবন আর কাজে
প্রয়োগ করে, একজন সফল লেখকের পাশাপাশি, প্রযুক্তিবিদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
সংসারধর্মই হোক বা সাহিত্য কর্ম, যখনই
সার্থক শিল্প হয়ে ওঠে, তখন সেই সবের সঙ্গে অঙ্কের বা গণিতের কোন পার্থক্য থাকে না।
ভালো সাহিত্য কর্ম আর ভালো অঙ্ক
সমার্থক। Muse of the Universe কে যদি ঠিক
ভাবে ভাবা যায় তবে সেটা বিচিত্র অঙ্কের ঐকতান। বিশ্বজাগতিক নিয়মের অঙ্কই তো ছন্দ।
মানুষের
জীবনকেও তাই অঙ্কের নিয়মে ছকে নিয়ে তার মধ্যে থেকে এসেন্স অফ লাইফ বা জীবন নির্যাস
সংগ্রহ করেছেন রাজশেখর।
একটি শিশু যেমন
হামাগুড়ি দিয়ে সারা বাড়ীতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, একটা লাল পিঁপড়কেও মুখে পোরে তার
স্বাদ জানার জন্য তখন পিঁপড়ের হুলের তীক্ষ্ণ কামড় পেয়েও তাকে ছাড়ে না, কৌতুহলের
জন্য, রাজশেখরও সেই রকম কৌতুহলের অধিকারী ছিলেন।
রাজশেখর বসুর জবানীতেই শোনা যাক,কেন তিনি
ছদ্মনাম নিয়েছিলেন! ( ডঃ সুশীল রায়ের
সঙ্গে সাক্ষাৎকার)
“ পরশুরাম একজন স্যাকরা।
পৌরাণিক
পরশুরামের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। স্বনামে গল্প ছাপানোতে আমার একটু সংকোচ
ছিল। বন্ধু- বান্ধব সহ একটা ছদ্মনামের
চিন্তা করছিলাম। দৈবক্রমে সেই সময় তারাচাঁদ পরশুরাম নামে একজন কর্মকার, আমাদের
পার্শি বাগানের বাড়ীর “উৎকেন্দ্র” র মজলিসে উপস্থিত হয়। হাতের কাছে তাকে পেয়ে তার
নামটাই নিয়ে নেই। এই নামের পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য নেই। পরে, আরও লিখবো
জানলে ও-নাম হয়তো নিতাম না।”
এবারে,
“উৎকেন্দ্র” র মজলিসের ব্যাপারে, কিছু বলি। পৈত্রিক বাড়ী, ১৪ নং
পার্শি বাগান লেনে বসতো “উৎকেন্দ্র” র বৈঠক।“উৎকেন্দ্র” র নামটা তৈরি
হয়েছিল- উৎকট + কেন্দ্র এই দুটো শব্দ অনুসারে। “উৎকট” এই নামটার প্রথম অক্ষর উৎ
এবং কেন্দ্র নিয়ে । এতে, রাজশেখর ছাড়াও থাকতেন তাঁর চার ভাই, জলধর সেন,
ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন সাহা, রঙীন হালদার, প্রেমাংকুর আতর্থী, যতীন
সেনের মত, সেই কালের জ্ঞানী- গুণীরা। অশ্লীল
এবং যৌন – আলোচনাও বাদ যেত না। এখানেই রাজশেখর বসুর গড্ডালিকার গল্পগুলো পাঠ করা
হত।
জলধর সেন, তা “ ভারতবর্ষ” পত্রিকায় ছাপান। পরে,
এটা বই আকারে প্রকাশিত হলে, রাজশেখর প্রথম এই “পরশুরাম” নামটা ব্যবহার করেন। তখন
তাঁর বয়স ৪২ বছর। এদিক দিয়ে পরবর্তী কালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির
সঙ্গে মিল আছে।
তাঁর প্রথম রচনা “ দেশে- বিদেশে” বইটাও মুজতবার
৪২ বছরে প্রকাশিত হয়। আমার ব্যত্তিগত পর্য্যবেক্ষণ হলো- বিশাল মাপের সাহিত্যিকদের
কোনো না কোনো ভাবে একটা অদ্ভূত মিল থেকেই যায়।
এখন কথা হচ্ছে, রাজ শেখর বসুর জনপ্রিয়তার উৎস
কোথায়?
মৌলিক পরিকল্পনার উদ্ভাবনী শক্তি হাস্যরস সৃষ্টির
প্রথম এবং প্রধান কথা । রাজশেখর বসুর তা সহজাত কবচ- কুণ্ডলের মতই ছিল। এছাড়া, তাঁর
হাস্যরস সৃষ্টির পেছনে কাজ করত একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব। কোনো কৃত্রিমতা তাঁর রচনাকে
কোনোভাবেই স্পর্শ করে নি। তাই তিনি বাংলা
সাহিত্যে বিরাজ করেছেন, রাজকীয় মহিমায়।
এটার কারণ “বোধহয়” তিনি নিজেই বলে গিয়েছেন। ডঃ
সুশীল রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, তিনি একবার বলেছিলেন:-
“জীবনে আমি খুব কম লোকের সঙ্গে
মিশেছি। তাই আমার অভিজ্ঞতাও খুব কম। গ্রাম বেশী দেখি নি। কর্মসূত্রে যাদের সঙ্গে
মিশেছি, তারা সবই ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ক্লাস।”
আমার মনে হয়, ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ক্লাসের
সঙ্গে তাঁর যে কথপোকথন হত, তাতেই তাঁর গল্পের ঝুলি ফুলে ফেঁপে যেত। শান্ত, গম্ভীর,
এবং সংযমী-বিদগ্ধ এই রস সাহিত্যিক, তাই রসিকতার সামান্য সুযোগ পেলেই তার
সদ্ব্যবহার করতেন।
১৯২২
সালে,পরশুরাম ছদ্মনামে, তাঁর প্রথম রচনা- শ্রীশ্রী সিদ্ধেশরী লিমিটেড। প্রকাশিত
হয়েছিল, জলধর সেন সম্পাদিত “ ভারতবর্ষ” পত্রিকায়।
প্রথম রচনার কথা বলতে গিয়ে, তাঁর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন (ডঃ
সুশীল রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে):- “আমার
প্রথম রচনা অবশ্য- কবিতা ছিল। শিশুদের হাম বা ডিপথেরিয়া হওয়ার যে একটা প্রাকৃতিক
নিয়ম আছে, ঠিক সেই প্রাকৃতিক নিয়মেই আমি দু- একটি কবিতা লিখি, কিন্তু সেটা পোনেরো
– ষোল বছর বয়সেই চুকে যায়। বাল্যের কবিতা রচনার কথা বাদ দিলে বেঙ্গল কেমিক্যালসেই
আমার সাহিত্য – চর্চার আরম্ভ। এখানেই তার হাতে খড়ি, বলতে পারা যায়। অবশ্য মূল্য – তালিকা
তৈরি করা বা বিজ্ঞাপন লেখাকে যদি কেউ
সাহিত্য বলে গ্রাহ্য করে! কেন না, শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেডের আগে আমার
যা-কিছু বাংলা রচনা তা এছাড়া আর কিছু না।”
শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড লেখা প্রকাশিত হবার
পর,রাজশেখর বসু বলেছিলেন, লেখাটি পড়ে পাঠকদের ধারণা হয়েছিল, এই
রচনা কোনো উকিলের।
এই “শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড” এর
গল্পে, আমরা ব্যঙ্গের প্রাথমিক চকিত স্পর্শ পেয়েছিলাম। ভণ্ডামি আর মিথ্যাচারের
বিরুদ্ধে, বক্তব্য সেখানে তির্যক রেখায় অঙ্কিত হয়ে ছিল।
স্বদেশী কোম্পানী বা বাংলার যৌথ ব্যবসা গুলো
মোটামুটি ভাবে চিরকালই জাল- জুয়াচুরির আখড়া ( “এই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে”)।
বাঙালীর এই জাতীয় চরিত্রের মজ্জাগত প্রবৃত্তির
বিরুদ্ধেই হাস্য- রসাত্মক দৃষ্টি ভঙ্গিতে আক্রমণ করেছিলেন, রাজশেখর বসু।
ব্রহ্মচারী আ্যণ্ড ব্রাদার – ইন – ল, জেনারেল
মার্চ্চেন্টসের শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী, অটল, গণ্ডেরিরাম- এই সব চরিত্রকে আজও আমরা
বাস্তব জীবনে দেখতে পাই। মানুষ ঠকানোর ব্যবসা এদের দীর্ঘকালের।
ব্যঙ্গের প্রয়োজনে কিছু অতিরঞ্জনের ছোঁয়া থাকলেও,
কখনই তা বাস্তবকে ছাড়িয়ে যায় নি।
গণ্ডেরিরাম ব্যবসা করে ভেজাল ঘিয়ের। চর্বি, চিনা
বাদাম তেল মিশিয়ে যে বস্তুটি সে উৎপাদন করে, তার নাম দিয়েছে- “ঘই”।
নিরামিষ ভোজী, ফোঁটা- কাটাওয়ালা, ভজন-পূজনে
সমর্পিত প্রাণ গণ্ডেরিরাম এই পাপ কাজ করেন কি করে?
অটলের এই প্রশ্নের জবাবে গণ্ডেরিরাম উত্তর
দিচ্ছে:-
“ পাপ? হামার কেনো পাপ হোবে? বেওসা তো করে
কাসেম আলি। হামি রহি কলকাত্তা! ঘই বনে হাথরাসমেঁ। হামি না আঁকসে দেখি, না নাকসে
শুঁখি। হনুমানজি কি কিরিয়া। হামি তো স্রিফ্ মহাজন আছি। রূপয়া দে কর খালাস।”
এই সংলাপে হাসি চেপে রাখা দায় হয়।
“শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড”
র
প্রসপেক্টাসটিও চরম ভাবে শ্লেষাত্মক।
“যাত্রীদের নিকট হইতে যে দর্শনী
ও প্রণামী আদায় হইবে, তাহা ভিন্ন আরও নানা প্রকারে অর্থাগম হইবে। দোকান, বাজার,
অতিথি শালা, মহাপ্রসাদ বিক্রয় হইতে প্রচুর আয় হইবে। এতদ্ভিন্ন by product
recovery এর ব্যবস্থা থাকিবে। ৺ সেবার ফুল হইতে সুগন্ধি তৈল প্রস্তুত হইবে, এবং
প্রসাদী বিল্বপত্র মাদুলিতে ভরিয়া বিক্রিত হইবে। চরণামৃতও বোতোলে প্যাক করা হইবে।
বলির নিহত ছাগ সমূহের চর্ম ট্যান করিয়া উৎকৃষ্ট “ কিড- স্কিন” প্রস্তুত হইবে এবং
বহুমূল্যে বিলাতে চালান যাইবে। হাড় হইতে বোতাম হইবে। কিছুই ফেলা যাইবে না।”
আমরা রাজশেখর পূর্ব ত্রৈলোক্যনাথের, ডমরু- চরিতেও আমরা এই ধরণের বাঙালীর যৌথ ব্যবসার সন্ধান পেয়েছি।
উদ্ভট হাস্যরসের পরিবেশন, আমরা দেখি- বিরিঞ্চি
বাবা, মহাবিদ্যা, কচি সংসদ, চিকিৎসা সংকট, উলট পুরাণ ; এই সব গল্পে।
ভণ্ডামি, জোচ্চুরি,ভাববিলাস, সমাজ বিরোধিতাকে
তীব্র ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে।
এটা আমাদের অজানা নয়, ব্যঙ্গ অনেক সময়েই রূপকের
মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় । যেমন, একটা উদাহরণ হাতের সামনেই আছে:- রবীন্দ্রনাথের,
“তোতা কাহিনী” । এটাও রূপক ধর্মী ব্যঙ্গ।
“উলট পুরাণ” গল্পটিতে পাই রূপকের মধ্যে পূর্ব-
পরিকল্পিত আক্রমণ । এটিকে, রাজনৈতিক
ব্যঙ্গ বা ইংরেজিতে বলা যায়- পলিটিকাল স্যাটায়ার।
“বিরিঞ্চি বাবায়” পাই গুরুগিরির ভণ্ডামির মুখোস
টান মেরে খুলে ফেলা, “কচি- সংসদ” গল্পে পাই তরুণ সমাজের উৎকট ভাববিলাসিতা আর
ন্যাকামির হাস্যকর স্বরূপ সম্মুখে আনা,”চিকিৎসা সঙ্কটে” মানুষের হাস্যোদ্দীপক
আচরণ, “মহাবিদ্যায়” পাই চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যার মহিমা কীর্তন।
এই সবেতে, আমরা একটা জিনিস দেখতে পাই- সেটা হল,
আহাম্মুকি-অপদার্থতা-ভণ্ডামি- কাপুরুষতার শাশ্বত রূপ।
কোনো একটা সীমিত কালে আটকে নেই এই সব চরিত্র। সব
চরিত্র যেন চেঁচিয়ে বলছে :- “দুনিয়া বুরা মুই সাচা হয়ে কি করবো”। অসাধারণ মন্তব্য
।
রাজশেখরের গল্পে আমরা দেখতে পাই, সুনিপুণ মনের
উজ্জ্বল প্রকাশ । কবিতাতেও তিনি, তাঁর সংযম সিদ্ধ রসিকতা বোধ- বিদ্যা আর wit দেখিয়েছেন।
তিনি লিখছেন:-
মাননীয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকগণ
এবং আর সবাই যাঁদের এপাড়ায় বাস,
মন দিয়ে শুনুন আমার অভিভাষণ,
আজ আমাদের আলোচ্য-Eat more grass ।
কবিতাটার উপসংহারে তিনি বলছেন :-
এদের দেখে শিখুন। যদি আপনারও
চান
এই অতি আরামের আদর্শ যাত্রা,
তবে আজ থেকেই উঠে পড়ে লেগে যান,
সব কমিয়ে দিয়ে বাড়ান ঘাসের
মাত্রা।
এবারে, দেখি তাঁর ব্যক্তিগত
জীবন :-
রাজশেখরের পড়াশোনা- দ্বারভাঙ্গা স্কুল, পাটনা
কলেজ, প্রেসিডেন্সী কলেজ। এম. এ - রসায়নে
( তখন এম এস সি ছিল না ) প্রথম হলেন, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে
। তারপর
ওকালতি পাশ করলেও বেশীদিন ওকালতিতে মন লাগে নি । বাবা, চন্দ্রশেখর তখন তাঁর ছেলেকে
তুলে দিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের হাতে ( ১৯০১) ।
সেই থেকে তিনি আমৃত্যু বেঙ্গল কেমিক্যালেই থেকে
গেলেন। ১৯০৪ থেকে ১৯৩৩, এই ত্রিশ বছর ছিলেন ম্যানেজার আর বাকী ১৯৬০ পর্যন্ত ( ২৭
বছর) – ডিরেক্টর ।
নিজে রিসার্চ করে, কসমেটিকসের কেমিক্যালস্
আবিষ্কার করা, লোক দিয়ে করান, সেই সবের ব্র্যান্ড নেমিং- মোট কথা, জুতো সেলাই থেকে
চণ্ডীপাঠ,সবই করতেন তিনি ।
বাড়ীতেও একটা ছোটোখাটো ল্যাবরেটরী করেছিলেন ।
অফিস থেকে ফিরে এসে, তিনি এখানেও নানা রকম
ছোট খাট পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতেন ।
সারাটা জীবন এক সুশৃঙ্খল কর্মপদ্ধতির কঠিন বন্ধনে
নিজেকে বেঁধে নিয়েছিলেন । সব হিসেব নিকেশ করেই চলতেন । না, হলে- ভেবে দেখুন তো
!!!!!! রামায়ণ- মহাভারত –চলন্তিকা অভিধান- সাহিত্য- অফিস, কিভাবে সব একসঙ্গে
সামলানো যায় ????? ভাবাই যায় না !!!!!!! এই প্রসঙ্গে, একটা কথা না বললেই নয়! তাঁর
লিখিত নির্দেশ ছিল:- মৃত্যুর পর যেন “ বল
হরি, হরি বোল” বলে মৃতদেহ না নিয়ে যায় ! কিন্তু, তাঁর প্ল্যানের সঙ্গে মহাকালের প্ল্যান মেলে নি । সে কথা পাঠক মাত্রেই পরবর্তীতে
বুঝতে পারবেন ।
অপ্রয়োজনীয় কথা তো বলতেনই না, সময়ও খরচ করতেন না
!
একটা মজার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :-
একবার পেন্সিল কাটতে গিয়ে, আঙ্গুল কেটে যায় ।
আয়োডিন লাগিয়ে বেঁধে রাখলে- প্রচুর লোকে প্রশ্ন করবে আর তার উত্তর দিতে হবে জেনে
তিনি বড় করে একটা বিজ্ঞাপন লিখে টেবিলে রেখেছিলেন!
“পেন্সিল কাটতে গিয়ে আঙ্গুলটা
একটু কেটেছে। ভয়ের কোন কারণ নেই ”।
রাজশেখর বিয়ে করেছিলেন- পটলডাঙ্গার দে পরিবারে ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি কবি বিষ্ণু দে- এই পরিবারেরই সন্তান ।
রাজশেখরের স্ত্রীর নাম ছিল মৃণালিনী
। একমাত্র
মেয়ে প্রতিমার বিয়ে দিয়েছিলেন, রাসায়নিক অমর পালিতের সঙ্গে।
ক্যানসারে (মতান্তর আছে ) অমর মারা যান ১৯৩৪ সালে । সেই শোক সামলাতে না পেরে ,
মেয়ে তার ঠিক এক ঘণ্টা পরেই মারা যান- হার্ট ফেল করে। এদের একই সঙ্গে সৎকার করা হয়
।
প্রতিমা রেখে গিয়েছিলেন, দুটি শিশু সন্তান ।
ছেলেটা ছিল, জন্ম থেকেই বোধ শক্তিহীন ।
নাতনী আশাই, স্বামী- ছেলে নিয়ে ছিলেন,
রাজশেখরের শেষ জীবনের সাথী । মৃণালিনী মারা যান ১৯৪২ সালে। রাজশেখরের বয়স তখন ৬২ ।
আগেই বলেছি, রাজশেখরের প্রথম বই “ গড্ডালিকা” বের
হয় তাঁর ৪২ বছর বয়েসে।
মোট বই – ২১ টি । দুখানা তাঁর মারা যাবার পর প্রকাশিত ।
১ টা অভিধান, ৯ টা গল্পের বই, ৫ টা অনুবাদ মূলক
বই, ৩ টা প্রবন্ধ, ২ টা বিজ্ঞান আর ১ টা
কবিতার বই ।
“ গীতা” বইটি তিনি আগে লিখলেও
ছাপান নি । কারণ, ছোট ভাই গিরীন্দ্রশেখর মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে শ্রীমদ্
ভগবদ্ গীতার ওপর একটা বিরাট বই লিখেছিলেন । গিরীন্দ্রশেখর বলেছিলেন – দাদা
রাজশেখরের “ গীতা”র পাণ্ডুলিপি সাহায্য নিয়ে ছিলেন ।
রাজশেখর তাই পাণ্ডুলিপির ওপর বড় করে লিখে রেখে
ছিলেন :- “ ছাপা হবে না” ।
প্রতিমা ( মেয়ে) মারা যায় রাজশেখরের ৫৪ বছর বয়সে
। স্ত্রী তার ৮ বছর পর । তার পরও তিনি ১৮ বছর ধরে, সমস্ত শোক বুকে রেখে- সাহিত্য
চর্চা করেছেন, নাতি নাতিনীকে বুকে করে আগলে বড় করেছেন। ভাল বিয়ে দিয়েছিলেন নাতনীর।
নিজেই নিজের চিকিৎসা করতেন । রক্তচাপ বেড়েছিল, চারবার অজ্ঞানও হয়েছিলেন । শেষে
১৯৬০ সালের ২৭ শে এপ্রিল, দুপুর বেলা হৃদরোগে তিনি মারা যান ।
প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি রাজশেখরের, পারিবারিক
ঐতিহ্য গত টান তো ছিলই আর রোমান্টিক
সাহিত্যের প্রতিই টানেই তাঁকে কালিদাসের “
মেঘদূত” কাব্যের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
আগেই বলেছি, তিনি কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলেন । ফলে,
যে কাজেই তিনি মন দিতেন, তাতে হালকা ভাবে
করতে তাঁর মন উঠতোই না । তাঁর বৈজ্ঞানিক
মন, সব খুঁটি- নাটি না জানা পর্যন্ত শান্তি পেত না ।
ল্যাবরেটরিতে একটা রাসায়নিক দ্রব্যকে পরীক্ষা
করার জন্য, যে সতর্কতা আর পর্যবেক্ষণ দরকার হয়, ঠিক সেই ধরণের সতর্কতা তিনি
সাহিত্য- সৃষ্টির জন্য প্রয়োগ করতেন।
রামায়ণ লেখার সময়, পণ্ডিত অমরেন্দ্র মোহন
তর্কতীর্থ যে তাঁকে সাহায্য করতেন, সেটা তিনি ভূমিকাতেই লিখেছিলেন।
দ্বিতীয় সংস্করণে সাহায্য কারী হিসেবে, অধ্যাপক
দুর্গামোহন ভট্টাচার্য্য কাব্য পুরাণ সাংখ্যতীর্থের নাম আছে।
এছাড়াও রাজশেখর, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের
বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ এবং অন্যান্য লেখকদের অনুবাদও যত্ন সহকারে পড়েছিলেন
আর,“যজ্ঞ” ব্যাপারটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝতে রামেন্দ্র সুন্দরের “ যজ্ঞ কথা” এবং
অন্যান্য বইও মন দিয়ে পড়ে, অনুসরণ করেছিলেন।
ঠিক, এমনটি করেছিলেন মহাভারত রচনার সময়
। দেশী-
বিদেশী পণ্ডিতদের লেখা প্রায় সব বই পড়ে তার নির্য্যাস নিয়ে ছিলেন ।
রাজশেখরের, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা আর শিল্প সরস
সহৃদয়তার ফলে আমাদের লাভ হয়েছিল প্রচুর ।
কারণ, তিনি এই দুটো মহাকাব্যের কোন গুলো বর্জনীয়
আর কোনগুলো গ্রহণ যোগ্য, সাধারণ পাঠকের কাছে “বাল্মীকি- ব্যাসের রচনার”
সমগ্র, সতর্ক, জাগ্রত এবং নির্ভুলভাবে
তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ।
নিজস্ব কথ্য ভাষারীতিতে মূল রামায়ণ মহাভারতের
রচনাকালের ঘটনার পরিচয় দিতে গিয়ে, যে সব তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন- তা শুধু মানান
সই নয়, অত্যন্ত সুখশ্রাব্য এবং কাব্যগুণে ভরা ।
রামায়ণ- মহাভারতের দুটো সুন্দর ভূমিকা লিখেছেন । কিন্তু, এই দুটোর রচনা –ছকে বেশ কিছু
স্বাতন্ত্র আছে ।
রামায়ণে তিনি বাল্মীকির কিছু কিছু শ্লোকদ্ধার করে
দিয়েছেন। রাজশেখর লিখছেন :-
“বাল্মীকির রচনায় কাব্য রসের
অভাব নেই। প্রাচীন সমাজচিত্র, নিসর্গ বর্ণণা, এবং কৌতুকাবহ প্রসঙ্গও অনেক আছে যা,
কৃত্তিবাসাদির গ্রন্থে পাওয়া যায় না । এই গ্রন্থে, বাল্মীকির বৈশিষ্ট্য যথাসম্ভব
বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এবং তার রচনার সঙ্গে পাঠকের কিঞ্চিৎ সাক্ষাৎ পরিচয়
হবে-, এই আকাঙ্খায়, স্থানে স্থানে নমুনা স্বরূপ মূলশ্লোক স্বচ্ছন্দ অনুবাদ সহ
দেওয়া হয়েছে। পাঠকের যদি রুচি না হয়, তবে পড়বার সময় উদ্ধৃত শ্লোকগুলি অগ্রাহ্য
করতে পারেন ।”
মহাভারতের কোনো মূলশ্লোক, খুব জনপ্রিয় বা পরিচিত
কিছু ছাড়া, তিনি বইয়ের মধ্যে দেন নি । কিন্তু,একটা বিস্তৃত পরিশিষ্টের মধ্যে-
স্থান, ব্যক্তি পরিচয়াদি দিয়েছেন- যা মহাভারতে নেই । এখানেও রাজশেখরের বৈজ্ঞানিক
এবং রসিক চিত্তের একটা সুন্দর সমাবেশ পাই ।
রামায়ণ এবং মহাভারতের একটা ছোট্ট তুলনা করলে দেখা যায় :-
১। মহাভারতের সংস্কৃত, রামায়ণের
থেকে বেশ কঠিনতর এবং কিছু জায়গায় দুর্বোধ্য ।
২। মহাভারতে ব্যক্তি এবং
স্থানের সংখ্যা,রামায়ণের থেকে অনেক অনেক বেশী ।
সাধারণ পাঠকের পক্ষে মনে রাখা বা বোঝা বেশ
কঠিন। এইজন্য, রাজশেখরের সম্পাদনার
ক্ষেত্রে অনেক যত্ন নিয়েছিলেন।
এই জিনিসটা তিনি
বেঙ্গল কেমিক্যালের বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও, ব্যবহারকারীদের কথা মাথায়
রেখে করেছিলেন ( To associate
the product Brand Name with the consumers , so that they can
easily identify)!!!!!
উদাহরণ দিলেই বোঝার সুবিধে হবে, সাথে রাজশেখরের
রসিক মনের নমুনাও পাবেন।
টুথপেষ্ট
রদোকেন্ – রদ= দাঁত, কেন্ =
কেনো।
সাবান = নদীর সংকেত দিয়ে, যেমন- ঈরা,যমুনা,শিপ্রা ।
এইরকম দৃষ্টিতে তাকিয়েই তিনি আম পাঠককে রামায়ণ
এবং মহাভারত, বোঝাতে চেয়েছিলেন ।
মহাভারতের ভূমিকায় তিনি লিখছেন :-
“এতে মূল গ্রন্থের সমস্ত আখ্যান
এবং প্রায় সমস্ত উপাখ্যান আছে। কেবল, সাধারণ পাঠকের যা মনোরঞ্জক নয়, সেই অংশ
সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে ।
যেমন, বিস্তারিত বংশতালিকা,
যুদ্ধ বিবরণের বাহুল্য, রাজনীতি,ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ক প্রসঙ্গ, দেবতাদের
স্তুতি ও পুনরক্ত বিষয় । স্থল বিশেষে নিতান্ত নীরস বিষয় পরিত্যক্ত হয়েছে । এই
সারানুবাদের উদ্দেশ্য- মূল রচনার ধারা ও বৈশিষ্ট্য যথা সম্ভব বজায় রেখে, সমগ্র
মহাভারতকে উপন্যাসের ন্যায় সুখপাঠ্য করা ।”
এই উদ্দ্যেশ্য যে পূরণ হয়েছে, সেটা যে পাঠক
রাজশেখরের মহাভারত পড়েছেন/ পড়বেন, তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য ।
বিজ্ঞান তপস্বীর বিস্তৃত জ্ঞানের যে গাণিতিক
সংহতি ও শৃঙ্খলা – পরিমিত ও গূঢ়ার্থ ভাষণের যে নৈপুন্য, তার মোটামুটি পরিচয়
তাঁর রচনা সমগ্রের মধ্যে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ও ছড়ান থাকলেও, রামায়ণ- মহাভারতের দুটি
ভূমিকার মধ্যে একুনে ( ৭ + ১৪= ২১ ) পাতার মধ্যে যেমন ভাবে লেখা হয়েছে, সেটা
তুলনাহীন।
“চলন্তিকা” অভিধানের রচনা
রীতিটির, প্রাধান্য ও পথিকৃতের গৌরবও রাজশেখরের প্রাপ্য । কারণ, শব্দ- সম্ভারের
নতুন নতুন উদ্ভব যদি পরিশোধিত ও সম্পাদিত না হয় তবে তা পুরোনো হয়েও যেতে পারে।
বাংলা পরিভাষা সংগ্রহ ও সৃষ্টির জন্য রাজশেখর
সসবময় চেষ্টা করতেন । ১৯৪৮ সালে, তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গঠিত “ বাংলা
পরিভাষা সংগ্রহ ও পরিভাষা কমিটির” সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন রাজশেখর । সম্পাদক
ছিলেন- চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, সহ- সম্পাদক- প্রমথনাথ বিশী, সদস্য- সুনীতি কুমার
চট্টোপাধ্যায়, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য্য ও চিন্তাহরণ চক্রবর্তী ।
বাংলা ভাষার বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য বাংলা পরিভাষার বহুল প্রচারে আগ্রহী থাকলেও,
তিনি জোর করে এই কাজকে গ্রহণীয় মনে করেন নি ।এই ভাবে জোর করে বাংলা পরিভাষা
ব্যবহারের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না।
তিনি লিখছেন :-
“যদি প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য
সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ আমরা গ্রহণ করি, তবে মাতৃ ভাষার পরিপুষ্টি
হবে, বিকার হবে না । অপ্রয়োজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়োজনে হয় না । যদি বলি- ওয়াইফের
টেম্পারটা বড়ই ফ্রেটফুল হয়েছে, তবে ভাষা জননী ব্যাকুল হবেন ।
যদি বলি, মোটোরের ম্যাগনেটটা
বেশ ফিনকী দিচ্ছে , তবে আমাদের আহরণের শক্তি দেখে ভাষা জননী নিশ্চিন্ত হবেন ।”
চলন্তিকার পাতায় পাতায় তাই অজস্র ইংরেজী শব্দ
স্থান পেয়েছে ।
তাই বলছিলাম, চলন্তিকার পরে আরও নানা প্রামাণ্য
অভিধান রচনা হলেও , রাজশেখর বসু এই সবের পথিকৃৎ।
পরিশেষে :-ঋষি সুলভ নির্লিপ্ততায়, রাজশেখর
মেনে নিয়েছিলেন, তাঁর জীবনের সব কিছু
।
সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
বলেছিলেন :-“তাঁর (রাজশেখর ) মনোভঙ্গি গঠিত হয়েছে বস্তুতন্ত্র সুলভ বিজ্ঞান
বুদ্ধির দ্বারা ।”
দুঃখ একটাই- এই
আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি রাজশেখরের
অমূল্য সম্পদকে বারবার অবহেলা করেছে। তাই তাঁর প্রতি অক্ষম ও অপটু হাতে,
অকিঞ্চিৎকর শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে পেরে এই অধম কৃতার্থ বোধ করছে।
( সমাপ্ত)
তথ্য ও প্রভূত ঋণ স্বীকার:-
আলিপুর দুয়ার থেকে প্রকাশিত
“ রাজশেখর বসু ( পরশুরাম)
স্মরণিকায়” , ১৯৮৩ তে প্রকাশিত প্রবন্ধ সকল।
১। সর্বশ্রী বিমলেন্দু
বিষ্ণু, কমলেশ রাহা রায়, ডঃ জোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী, মিহির রঞ্জন লাহিড়ী, ডঃ হরিপদ
চক্রবর্তী, ডঃ সুরঞ্জন দত্তরায়, অর্ণব সেন, পবিত্র ভূষণ সরকার।
২। সংসদ বাংলা চরিতাভিধান।
৩। ইন্টারনেট।
কথা তো বলার জন্য – তে প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment