দিয়ালাতে - প্রকাশিত
রাধানগর তোলপাড়! হাটে সবাই আলোচনা করছে। এরা কারা?কেনাবেচা
বন্ধ হবার জোগাড়। সবাই দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
রোববার, বুধবার আর শুক্রবার হাটের দিন। আশপাশের চার, পাঁচটা গ্রাম থেকে মানুষ জন আসে। সব তো আর টিভিতে দেখানো বা খবরের কাগজে ছাপা হয় না! তাও আবার, খবরের কাগজ আসে বিকেলবেলা আর টিভি তো অর্দ্ধেক দিন দেখাই যায় না, লোডশেডিং এর জ্বালায়। তা, ওই হাটের দিনই যা একটু খবর ভালো করে পাওয়া যায়!
হারাধনের কথাই ধরা যাক! সবাই ওকে চেপে ধরল একদিন!
-তুর যে দশ দশটা ছেলে ছেল , সেটা তো বলিস নি রে হারা!
- যাঃ! বাবা!!! এই খবর কুনে পেলে?
- ওই যে, পান্তু বাবুর নাতিটা সুর করি পড়তিসিল!
- কি?
- ছাই! অত্তো কি আর মনে থাকে? একটা বই থিকা পড়তিছেল! হারাধনের দশটি ছেলে! তারপর সব আ্যকডা আ্যকডা করি মরি গেল! ওইটুক্কুন মনে রয়িসে।
করিম চাচা বলল- তা তুই বিহা করলি, খবরও তো দেস নাই! তোর বাপ ছেল মোর ছুড্ডুবেলার বন্ধু!
হারাধন একদম রেগে কাঁই!
মুই তো বিহাই করি নি। মোর আবার ছেলে আসবি কনে?
তালে, পান্তু বাবুর নাতিটা বই থেকে মিসিমিসি কি পড়তিছেল?
উত্তেজনায় নারাণখুড়ো হারাধনকে, মারতে যায় আর কি!!!!!! করিম চাচা আটকে বলল-তালি যে ওরা বইত্ ছাপিসে, সেটা ভুল, হারা?
হাজারবার ভুল, এক্কেরে নিয্যস খাঁটি কথা!
উত্তেজনা আর একটু গড়াত হয়তো, কিন্তু দাদুর জন্য, হাটে হুঁকোর তামুক কিনতে আসা নাতি রতন সব খুলে বলাতে, গণ্ডগোলটা মিটল।
আজকের উত্তেজনাটা চরমে!!! যাত্রার পোশাক পরে দুটো বাচ্চা ছেলে। খালি গায়ে মাথায় চুড়ো করে চুল বাঁধা, হাতে তীর ধনুক। একেবারে হবাহু একরকম দেখতে দু্জন। হাট লাগোয়া হাই-ইস্কুলের বারান্দায় একটা বেঞ্চের ওপর বসে আছে। অং বং চং করে কি সব কথা বলছে, নিজেদের মধ্যে। ওদের সাথে, এক বুড়ো মত সাধুও এসেছে। মাথায় জটা। খালি গায়ে,গলায় পৈতে। মুখে বিশাল সাদা দাড়ী। খেলার মাঠে একটা বড় গাড়ীর মত কি যেন একটা দাঁড় করান। ভোলা, স্বচক্ষে দেখেছে, কোনো শব্দ না করে , ওই বিদঘুটে গাড়ীটা আকাশ থেকে আস্তে মাঠে নেমেছে।
দেখেই ভোলা উত্তেজনায় দৌড়ল হাটে! রবিবার বলে ইস্কুল নেই। ভোলার ওই ইস্কুলের পাশে একটা ছোটো খাবারের দোকান আছে। হাটবারে, দোকানটা রমরমিয়ে চলে। অন্যান্য দিন, ইস্কুলের ছেলেরা আর মাষ্টারমশাইদের দৌলতে ভালোই বিক্রী হয় ভোলার।
তা, বাংলা বলছে বটে ছেলে দুটো, কিন্তু কেমন যেন!!!!!!!!!!!
কিরকম? নারান খুড়ো জিজ্ঞেস করল।
-আরে! চলোই না। গিয়ে দেখবে চল। পণ্ডিতস্যার হাটে এসেছিলেন, কি সব কিনতে। সাথে,তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হলো।
ভোলার দোকানের ঘুঘনি, তখন ওই দুটো ছেলে বেশ আরাম করে চেটে পুটে খাচ্ছে। আর সাধু মিচকি মিচকি হেসে ,চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ভোলার কর্মচারী রামু আস্তে বলল- সাধুবাবাও, ৬ প্লেট ঘুঘনি, ১৫ টা পেঁয়াজী আর ২৫ টা ফুলুরী সাঁটিয়েছেন।
পণ্ডিতস্যার এগিয়ে গিয়ে বললেন- দয়া করে বলবেন, আপনারা কারা?
সাধু একটু তাকিয়ে, বললেন- কস্তং?
প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও, সেটা বুঝতে দিলেন না পণ্ডিতস্যার । নারানখুড়ো তাঁর দিকে তাকাতেই, বললেন
আমি কে, সেটা সংস্কৃততে জিজ্ঞেস করছেন উনি। পাড়াগাঁয়ে সংস্কৃততে কথা হয় না! বললেও লোকেরা বুঝবে না! একটু ইতস্তত করে পণ্ডিতস্যার বললেন-মহাশয়, আমি এই বিদ্যালয়ের সংস্কৃত-শিক্ষক!
-আরে বলবে তো! আমি বাংলা জানি! আমাকে কৃত্তিবাস বাংলা শিখিয়েছিল! বললেন সাধু!
হাঁফ ছাড়লেন পণ্ডিতস্যার । জটলার সবার চোখ গোলগোল! নারান খুড়ো ফিসফিস করে বললেন-এরা উগ্রপন্থী নয় তো? পণ্ডিতস্যার অভয় দিলেন!
মনে হচ্ছেনা! তবে একটু কোথাও গোলমাল আছে। বের করছি দাঁড়ান!
পণ্ডিতস্যার বললেন-
তা স্যার! আপনারা কোত্থেকে আসছেন, আর এই দুটো ছেলেই বা কারা! ও হ্যাঁ, কৃত্তিবাস কে?
ধ্যূস! কৃত্তিবাসকে চেনো না! আরে ওই যে তোমাদের বাঙ্গালী কবি!রামায়ণ লিখেছিল। কোত্থেকে আসছি বললে, আর একটা রামায়ণ লিখতে হবে আমাকে। ঘাড়ে আজকাল খুব ব্যাথা! এত ধকল সইবে না।
ওও! আচ্ছা, কৃত্তিবাসকে মনে পড়েছে। আচ্ছা, বিশ্রাম নিন। পরে না হয় ধীরে সুস্থে বলবেন!
রামচন্দ্র কে চেনো তো?
আপনি কোন রামচন্দ্রের কথা বলছেন? আমাদের হেডমাষ্টারমশাই রামচন্দ্র দেবনাথ?
উফ্! রামচন্দ্র, মানে রামায়ণের রামচন্দ্র! আর ওই যে স্যার বললে, স্যারের মানে কি? হেডমাষ্টার আবার কি? কৃত্তিবাস তো শেখায় নি আমাকে!
স্যার হচ্ছে একটা ইংরেজী শব্দ। কৃত্তিবাস ইংরেজী জানতেন না! তাই বোধহয় আপনাকে শেখান নি! সন্মানীয় লোকেদের বা শিক্ষককে বলা হয়। হেডমাষ্টার, ইংরেজীতে প্রধানশিক্ষককে বলা হয়।
বুঝলাম! আমি বাল্মিকী আর ওরা হলো লব আর কুশ। রামচন্দ্রের দুই যমজ ছেলে।
উরি ব্যাস্! তা কলিযুগে আপনারা এখানে? তাও এই অজ পাড়াগাঁয়ে!!!!!!
এসব শুনে,সারা জটলা উত্তেজিত। পটলার মা, পটলাকে খুঁজতে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ভীড়ের মধ্যে।প্রথমেই জোকার দিল, মানে উলু উলু! সবাই একসাথে পারুক না পারুক জোকার দিল। নারান খুড়ো ছুটলেন শঙ্খ আনতে। ছুটতে গিয়ে পাথরে ঠোক্কোর খেয়ে পড়ে গেলেন মাটীতে।
-ঘোর কলিযুগ হে! ঘোর কলি! সীতা বলল- সব্বাই আজকাল ইংরেজী শিখছে, গুরুদেব! এদের একটু শেখাবার ব্যাবস্থা করুন। বাল্মিকী বললেন।
-তা কোলকাতা থাকতে, এখানে ইংরেজী শেখাবেন?
-আরে! তুমি দেখছি অজমূর্খ!
পণ্ডিতস্যার গায়ে মাখলেন না কথাটা! ভরসা একটাই, এর মানেটা চট করে কেউ বুঝবে না এখানে। নইলে, ছাগলের মত মূর্খ কথাটা যথেষ্ট আপত্তিকর!
দুঃখের কথা আর কি বলি!!!- বাল্মীকি বললেন।
সীতা তো আমাকে রোজ বলতে লাগল। ওর নাকি সমাজে কোনো সন্মান থাকছে না। ইংরেজী শেখাতেই হবে লব আর কুশকে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কি ফরফর করে ইংরেজী বলে! তা, সীতা মা একবার পুষ্পক করে লণ্ডন গিয়েছিল। সেখানে দ্যাখে কি, ২/৩ বছরের ছেলে- মেয়েরাও ইংরেজী বলছে। লব –কুশ পারে না! কি দুঃখ! কি দুঃখ!
তারপর,ওই যে তোমাদের টিন বলে কি যেন আছে না!!!!!! বাল্মীকি আর একটা চা নিয়ে,একটু একটু করে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে জিরোতে লাগলেন।
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল! পান্তুবাবুর নাতি, রতন বলল- টিনটিন? লব –কুশ লাফিয়ে উঠে ,জোরে চীৎকার করে বলল- হ্যাঁআআআআ! ওই টিনটিন, ফ্যানটম, স্পাইডারম্যান। তারপর, হ্যারি পটার। ওই গুলোই তো পড়তে চাই।
এদিকে, খবর পেয়ে ইস্কুলের আরও কয়েকজন মাষ্টারমশাই চলে এসেছেন।
বাল্মীকি আবার শুরু করলেন।
সীতার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে লব কুশ কে বেরিয়ে পড়লাম, পুস্পক রথে।প্রথমেই বাধা। কোলকাতার বিমান পোতাশ্রয়ে নামতে পারছি না!
বাংলা স্যার, শশীবাবু জিজ্ঞেস করলেন- বিমান পোতাশ্রয় মানে এ্যারপোর্ট তো?
কি জানি বাপু! তোমাদের ওই ভাষা আমি বুঝি না! খালি,প্যাচাল পাড়ো!
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি বলুন।
আমি, বিমানের সারথীকে বললাম, রাস্তায় নামিয়ে দিতে। সারথী পাশের একটা নির্জ্জন সরণীতে নামিয়ে নিল, বিমানটাকে।
তারপর? তারপর? শশীবাবু জিজ্ঞেস করলেন। এটা সবারই মনের কথা।
সারথী তো প্রায়ই আসে, কোলকাতায়। ওর নাম-মকরধ্বজ। আজকাল, খুব মন্দা চলছে রামচন্দ্রের। তাই মাঝে মাঝেই ভাড়া খাটায় এই পুস্পক বিমান। ও জানত, ওকে নামতে দেওয়া হবে না কোলকাতার বিমান পোতাশ্রয়ে। লব-কুশ বায়না ধরেছিল নতুন নতুন বিশাল বিমান দেখার জন্য।
আর?
তারপর, রথের মত সারণী বেয়ে চলল বিমানটা!
আরি ব্যাস। মাটীতেও চলতে পারে?
পারে বৈকি!
এর টেকনিক্যাল ব্যাপারটা জেনে নিতে হবে, বললেন বিজ্ঞানস্যার বিজনবাবু।
ক্কি! ক্কি বললে?
ও কিছু না! আপনি চালিয়ে যান!
-ছাই! আমি কি চালাতে জানি না কি?
- না না! আপনি কথা জারী রাখুন!
এবার লব এগিয়ে এলো। চুপচাপ শুনছিল কথা।
দাদু আর কথা বলতে পারছে না। অনেকদিন পর প্রাণভরে পেঁয়াজী, ফুলুরী আর ঘুঘনী খেয়েছে তো! তাছাড়া, আমি আর কুশ কিছু কিছু ইংরেজী কথা শুনে শুনে শিখেছি। কথা বলতে আপনাদের সুবিধে হবে।
আচ্ছা বলো! বলে, বিজনস্যার একটু দোটানায় পড়লেন। একে তুমি করে কি বলা ঠিক হবে! দেখতে না হয় ১২/১৩ বছর, কিন্তু ঠিকঠাক ভাবে বলতে গেলে, এদের বয়স প্রায় ৭ হাজার বছর। গ্যাঁজা চালাচ্ছে না তো! বিনে পয়সায় ঘুঘনি খাওয়ার লোভে?
কুশ বোধহয় থট রিডিং জানে। বিজনস্যারকে বলল- আপনাদের হাজার বছরে আমাদের এক বছর। আপনি আমাদের তুমিই বলবেন। শিক্ষক মানেই তো গুরুদেব।
বিজনস্যার খুশী হলেন। - তা তোমরা থাকো কোথায়?
বললেন বিজনবাবু।
ওই অনেকদূরে একটা গ্রহ আছে। সেখানে!
নামটা বলো
যমুনা গঙ্গা ছায়াপথের কথা জানেন তো স্যার। সেই ছায়াপথে।
যমুনা গঙ্গা ছায়াপথ? আমাদের তো আকাশগঙ্গা!
এবার লব বলল- ওই যে আপনারা যাকে আ্যন্ড্রোমিডা ছায়াপথ বলেন। আমরা বলি যমুনা গঙ্গা ছায়াপথ।
সে তো ২০ থেকে ৩০ লক্ষ আলোক বর্ষ দূরে। এত দূর থেকে এলে কি করে?
আমাদের রথের গতিবেগ মনের বেগে চলে। আলোর চেয়ে অনেক বেশী মনের গতিবেগ।
বাঃ! তুমি তো অনেক কিছু জানো!
দেখুন, স্যার আমাদের সবই শেখানো হয়। সংস্কৃতই আমাদের পড়ার মাধ্যম। শুধু আমরা ইংরেজী জানতাম না, তাই শিখতে এসেছিলাম কোলকাতায়।
শিখলে?
কেউ রাজীই হলো না, শেখাতে। কেউ জিজ্ঞেস করছে আপনাদের জাত কি! কেউ আবার বলছে, জাতি কি? কোথায় থাকেন? পাশপোর্ট আছে কিনা! শেখার জন্য কি ঝামেলা বলুন তো! পদবীও জিজ্ঞেস করছে সবাই! তা আমরা তো পদবী ব্যবহার করি না! যদিও পদবী হলো- ত্রাত্তৃবর্মা!
তাহলে, শিখবে কি করে?
এই সিডি আর বই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এইভাবেই শিখব।
এখানে নামলে কেন?
ওই যে ঘুঘনি, পেঁয়াজী আর ফুলুরীর গন্ধে! দাদু আর আমাদের অমৃত খেয়ে অরুচি ধরে গেছে! তাই নীচে নেমে খেয়ে নিলাম। এরকম জিনিস আমাদের ওখানে হয় না!
বাল্মীকি চুপচাপ শুনছিলেন সব কথা। এবার বললেন- তোমরা খুব ভালো, কিন্তু আমার মনে একটা ধন্ধ।
কি স্যার?
এই রামচন্দ্রের জন্মস্থান নিয়ে হৈ চৈ! এটা খুব খারাপ! আমিই তো রাম না হতেই রামায়ণ লিখেছি।
করিমচাচা আর শশীবাবুর হাত ধরে বাল্মীকি বললেন-তোমরা সব ভাই ভাই! ভায়েরা ঝগড়া করে? আর কোরো না! আমরা যাই। আর হ্যাঁ! ভোলা, তোমাকে আমি ৫০ টা স্বর্ণমুদ্রা দিলাম। তোমার যা দাম হয়েছে, সেটা কেটে নেবে। বাকী টাকায় এখানে বিদ্যালয়ের উন্নতি করবে। শশীবাবু আর বিজনবাবু দায়িত্ব নেবেন। আর জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামাবেন না! কেমন? চলি!
পুস্পকে চড়ে গেলেন ওরা! মনের বেগে মিলিয়ে গেল পুস্পক!
রোববার, বুধবার আর শুক্রবার হাটের দিন। আশপাশের চার, পাঁচটা গ্রাম থেকে মানুষ জন আসে। সব তো আর টিভিতে দেখানো বা খবরের কাগজে ছাপা হয় না! তাও আবার, খবরের কাগজ আসে বিকেলবেলা আর টিভি তো অর্দ্ধেক দিন দেখাই যায় না, লোডশেডিং এর জ্বালায়। তা, ওই হাটের দিনই যা একটু খবর ভালো করে পাওয়া যায়!
হারাধনের কথাই ধরা যাক! সবাই ওকে চেপে ধরল একদিন!
-তুর যে দশ দশটা ছেলে ছেল , সেটা তো বলিস নি রে হারা!
- যাঃ! বাবা!!! এই খবর কুনে পেলে?
- ওই যে, পান্তু বাবুর নাতিটা সুর করি পড়তিসিল!
- কি?
- ছাই! অত্তো কি আর মনে থাকে? একটা বই থিকা পড়তিছেল! হারাধনের দশটি ছেলে! তারপর সব আ্যকডা আ্যকডা করি মরি গেল! ওইটুক্কুন মনে রয়িসে।
করিম চাচা বলল- তা তুই বিহা করলি, খবরও তো দেস নাই! তোর বাপ ছেল মোর ছুড্ডুবেলার বন্ধু!
হারাধন একদম রেগে কাঁই!
মুই তো বিহাই করি নি। মোর আবার ছেলে আসবি কনে?
তালে, পান্তু বাবুর নাতিটা বই থেকে মিসিমিসি কি পড়তিছেল?
উত্তেজনায় নারাণখুড়ো হারাধনকে, মারতে যায় আর কি!!!!!! করিম চাচা আটকে বলল-তালি যে ওরা বইত্ ছাপিসে, সেটা ভুল, হারা?
হাজারবার ভুল, এক্কেরে নিয্যস খাঁটি কথা!
উত্তেজনা আর একটু গড়াত হয়তো, কিন্তু দাদুর জন্য, হাটে হুঁকোর তামুক কিনতে আসা নাতি রতন সব খুলে বলাতে, গণ্ডগোলটা মিটল।
আজকের উত্তেজনাটা চরমে!!! যাত্রার পোশাক পরে দুটো বাচ্চা ছেলে। খালি গায়ে মাথায় চুড়ো করে চুল বাঁধা, হাতে তীর ধনুক। একেবারে হবাহু একরকম দেখতে দু্জন। হাট লাগোয়া হাই-ইস্কুলের বারান্দায় একটা বেঞ্চের ওপর বসে আছে। অং বং চং করে কি সব কথা বলছে, নিজেদের মধ্যে। ওদের সাথে, এক বুড়ো মত সাধুও এসেছে। মাথায় জটা। খালি গায়ে,গলায় পৈতে। মুখে বিশাল সাদা দাড়ী। খেলার মাঠে একটা বড় গাড়ীর মত কি যেন একটা দাঁড় করান। ভোলা, স্বচক্ষে দেখেছে, কোনো শব্দ না করে , ওই বিদঘুটে গাড়ীটা আকাশ থেকে আস্তে মাঠে নেমেছে।
দেখেই ভোলা উত্তেজনায় দৌড়ল হাটে! রবিবার বলে ইস্কুল নেই। ভোলার ওই ইস্কুলের পাশে একটা ছোটো খাবারের দোকান আছে। হাটবারে, দোকানটা রমরমিয়ে চলে। অন্যান্য দিন, ইস্কুলের ছেলেরা আর মাষ্টারমশাইদের দৌলতে ভালোই বিক্রী হয় ভোলার।
তা, বাংলা বলছে বটে ছেলে দুটো, কিন্তু কেমন যেন!!!!!!!!!!!
কিরকম? নারান খুড়ো জিজ্ঞেস করল।
-আরে! চলোই না। গিয়ে দেখবে চল। পণ্ডিতস্যার হাটে এসেছিলেন, কি সব কিনতে। সাথে,তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হলো।
ভোলার দোকানের ঘুঘনি, তখন ওই দুটো ছেলে বেশ আরাম করে চেটে পুটে খাচ্ছে। আর সাধু মিচকি মিচকি হেসে ,চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ভোলার কর্মচারী রামু আস্তে বলল- সাধুবাবাও, ৬ প্লেট ঘুঘনি, ১৫ টা পেঁয়াজী আর ২৫ টা ফুলুরী সাঁটিয়েছেন।
পণ্ডিতস্যার এগিয়ে গিয়ে বললেন- দয়া করে বলবেন, আপনারা কারা?
সাধু একটু তাকিয়ে, বললেন- কস্তং?
প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও, সেটা বুঝতে দিলেন না পণ্ডিতস্যার । নারানখুড়ো তাঁর দিকে তাকাতেই, বললেন
আমি কে, সেটা সংস্কৃততে জিজ্ঞেস করছেন উনি। পাড়াগাঁয়ে সংস্কৃততে কথা হয় না! বললেও লোকেরা বুঝবে না! একটু ইতস্তত করে পণ্ডিতস্যার বললেন-মহাশয়, আমি এই বিদ্যালয়ের সংস্কৃত-শিক্ষক!
-আরে বলবে তো! আমি বাংলা জানি! আমাকে কৃত্তিবাস বাংলা শিখিয়েছিল! বললেন সাধু!
হাঁফ ছাড়লেন পণ্ডিতস্যার । জটলার সবার চোখ গোলগোল! নারান খুড়ো ফিসফিস করে বললেন-এরা উগ্রপন্থী নয় তো? পণ্ডিতস্যার অভয় দিলেন!
মনে হচ্ছেনা! তবে একটু কোথাও গোলমাল আছে। বের করছি দাঁড়ান!
পণ্ডিতস্যার বললেন-
তা স্যার! আপনারা কোত্থেকে আসছেন, আর এই দুটো ছেলেই বা কারা! ও হ্যাঁ, কৃত্তিবাস কে?
ধ্যূস! কৃত্তিবাসকে চেনো না! আরে ওই যে তোমাদের বাঙ্গালী কবি!রামায়ণ লিখেছিল। কোত্থেকে আসছি বললে, আর একটা রামায়ণ লিখতে হবে আমাকে। ঘাড়ে আজকাল খুব ব্যাথা! এত ধকল সইবে না।
ওও! আচ্ছা, কৃত্তিবাসকে মনে পড়েছে। আচ্ছা, বিশ্রাম নিন। পরে না হয় ধীরে সুস্থে বলবেন!
রামচন্দ্র কে চেনো তো?
আপনি কোন রামচন্দ্রের কথা বলছেন? আমাদের হেডমাষ্টারমশাই রামচন্দ্র দেবনাথ?
উফ্! রামচন্দ্র, মানে রামায়ণের রামচন্দ্র! আর ওই যে স্যার বললে, স্যারের মানে কি? হেডমাষ্টার আবার কি? কৃত্তিবাস তো শেখায় নি আমাকে!
স্যার হচ্ছে একটা ইংরেজী শব্দ। কৃত্তিবাস ইংরেজী জানতেন না! তাই বোধহয় আপনাকে শেখান নি! সন্মানীয় লোকেদের বা শিক্ষককে বলা হয়। হেডমাষ্টার, ইংরেজীতে প্রধানশিক্ষককে বলা হয়।
বুঝলাম! আমি বাল্মিকী আর ওরা হলো লব আর কুশ। রামচন্দ্রের দুই যমজ ছেলে।
উরি ব্যাস্! তা কলিযুগে আপনারা এখানে? তাও এই অজ পাড়াগাঁয়ে!!!!!!
এসব শুনে,সারা জটলা উত্তেজিত। পটলার মা, পটলাকে খুঁজতে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ভীড়ের মধ্যে।প্রথমেই জোকার দিল, মানে উলু উলু! সবাই একসাথে পারুক না পারুক জোকার দিল। নারান খুড়ো ছুটলেন শঙ্খ আনতে। ছুটতে গিয়ে পাথরে ঠোক্কোর খেয়ে পড়ে গেলেন মাটীতে।
-ঘোর কলিযুগ হে! ঘোর কলি! সীতা বলল- সব্বাই আজকাল ইংরেজী শিখছে, গুরুদেব! এদের একটু শেখাবার ব্যাবস্থা করুন। বাল্মিকী বললেন।
-তা কোলকাতা থাকতে, এখানে ইংরেজী শেখাবেন?
-আরে! তুমি দেখছি অজমূর্খ!
পণ্ডিতস্যার গায়ে মাখলেন না কথাটা! ভরসা একটাই, এর মানেটা চট করে কেউ বুঝবে না এখানে। নইলে, ছাগলের মত মূর্খ কথাটা যথেষ্ট আপত্তিকর!
দুঃখের কথা আর কি বলি!!!- বাল্মীকি বললেন।
সীতা তো আমাকে রোজ বলতে লাগল। ওর নাকি সমাজে কোনো সন্মান থাকছে না। ইংরেজী শেখাতেই হবে লব আর কুশকে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কি ফরফর করে ইংরেজী বলে! তা, সীতা মা একবার পুষ্পক করে লণ্ডন গিয়েছিল। সেখানে দ্যাখে কি, ২/৩ বছরের ছেলে- মেয়েরাও ইংরেজী বলছে। লব –কুশ পারে না! কি দুঃখ! কি দুঃখ!
তারপর,ওই যে তোমাদের টিন বলে কি যেন আছে না!!!!!! বাল্মীকি আর একটা চা নিয়ে,একটু একটু করে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে জিরোতে লাগলেন।
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল! পান্তুবাবুর নাতি, রতন বলল- টিনটিন? লব –কুশ লাফিয়ে উঠে ,জোরে চীৎকার করে বলল- হ্যাঁআআআআ! ওই টিনটিন, ফ্যানটম, স্পাইডারম্যান। তারপর, হ্যারি পটার। ওই গুলোই তো পড়তে চাই।
এদিকে, খবর পেয়ে ইস্কুলের আরও কয়েকজন মাষ্টারমশাই চলে এসেছেন।
বাল্মীকি আবার শুরু করলেন।
সীতার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে লব কুশ কে বেরিয়ে পড়লাম, পুস্পক রথে।প্রথমেই বাধা। কোলকাতার বিমান পোতাশ্রয়ে নামতে পারছি না!
বাংলা স্যার, শশীবাবু জিজ্ঞেস করলেন- বিমান পোতাশ্রয় মানে এ্যারপোর্ট তো?
কি জানি বাপু! তোমাদের ওই ভাষা আমি বুঝি না! খালি,প্যাচাল পাড়ো!
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি বলুন।
আমি, বিমানের সারথীকে বললাম, রাস্তায় নামিয়ে দিতে। সারথী পাশের একটা নির্জ্জন সরণীতে নামিয়ে নিল, বিমানটাকে।
তারপর? তারপর? শশীবাবু জিজ্ঞেস করলেন। এটা সবারই মনের কথা।
সারথী তো প্রায়ই আসে, কোলকাতায়। ওর নাম-মকরধ্বজ। আজকাল, খুব মন্দা চলছে রামচন্দ্রের। তাই মাঝে মাঝেই ভাড়া খাটায় এই পুস্পক বিমান। ও জানত, ওকে নামতে দেওয়া হবে না কোলকাতার বিমান পোতাশ্রয়ে। লব-কুশ বায়না ধরেছিল নতুন নতুন বিশাল বিমান দেখার জন্য।
আর?
তারপর, রথের মত সারণী বেয়ে চলল বিমানটা!
আরি ব্যাস। মাটীতেও চলতে পারে?
পারে বৈকি!
এর টেকনিক্যাল ব্যাপারটা জেনে নিতে হবে, বললেন বিজ্ঞানস্যার বিজনবাবু।
ক্কি! ক্কি বললে?
ও কিছু না! আপনি চালিয়ে যান!
-ছাই! আমি কি চালাতে জানি না কি?
- না না! আপনি কথা জারী রাখুন!
এবার লব এগিয়ে এলো। চুপচাপ শুনছিল কথা।
দাদু আর কথা বলতে পারছে না। অনেকদিন পর প্রাণভরে পেঁয়াজী, ফুলুরী আর ঘুঘনী খেয়েছে তো! তাছাড়া, আমি আর কুশ কিছু কিছু ইংরেজী কথা শুনে শুনে শিখেছি। কথা বলতে আপনাদের সুবিধে হবে।
আচ্ছা বলো! বলে, বিজনস্যার একটু দোটানায় পড়লেন। একে তুমি করে কি বলা ঠিক হবে! দেখতে না হয় ১২/১৩ বছর, কিন্তু ঠিকঠাক ভাবে বলতে গেলে, এদের বয়স প্রায় ৭ হাজার বছর। গ্যাঁজা চালাচ্ছে না তো! বিনে পয়সায় ঘুঘনি খাওয়ার লোভে?
কুশ বোধহয় থট রিডিং জানে। বিজনস্যারকে বলল- আপনাদের হাজার বছরে আমাদের এক বছর। আপনি আমাদের তুমিই বলবেন। শিক্ষক মানেই তো গুরুদেব।
বিজনস্যার খুশী হলেন। - তা তোমরা থাকো কোথায়?
বললেন বিজনবাবু।
ওই অনেকদূরে একটা গ্রহ আছে। সেখানে!
নামটা বলো
যমুনা গঙ্গা ছায়াপথের কথা জানেন তো স্যার। সেই ছায়াপথে।
যমুনা গঙ্গা ছায়াপথ? আমাদের তো আকাশগঙ্গা!
এবার লব বলল- ওই যে আপনারা যাকে আ্যন্ড্রোমিডা ছায়াপথ বলেন। আমরা বলি যমুনা গঙ্গা ছায়াপথ।
সে তো ২০ থেকে ৩০ লক্ষ আলোক বর্ষ দূরে। এত দূর থেকে এলে কি করে?
আমাদের রথের গতিবেগ মনের বেগে চলে। আলোর চেয়ে অনেক বেশী মনের গতিবেগ।
বাঃ! তুমি তো অনেক কিছু জানো!
দেখুন, স্যার আমাদের সবই শেখানো হয়। সংস্কৃতই আমাদের পড়ার মাধ্যম। শুধু আমরা ইংরেজী জানতাম না, তাই শিখতে এসেছিলাম কোলকাতায়।
শিখলে?
কেউ রাজীই হলো না, শেখাতে। কেউ জিজ্ঞেস করছে আপনাদের জাত কি! কেউ আবার বলছে, জাতি কি? কোথায় থাকেন? পাশপোর্ট আছে কিনা! শেখার জন্য কি ঝামেলা বলুন তো! পদবীও জিজ্ঞেস করছে সবাই! তা আমরা তো পদবী ব্যবহার করি না! যদিও পদবী হলো- ত্রাত্তৃবর্মা!
তাহলে, শিখবে কি করে?
এই সিডি আর বই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এইভাবেই শিখব।
এখানে নামলে কেন?
ওই যে ঘুঘনি, পেঁয়াজী আর ফুলুরীর গন্ধে! দাদু আর আমাদের অমৃত খেয়ে অরুচি ধরে গেছে! তাই নীচে নেমে খেয়ে নিলাম। এরকম জিনিস আমাদের ওখানে হয় না!
বাল্মীকি চুপচাপ শুনছিলেন সব কথা। এবার বললেন- তোমরা খুব ভালো, কিন্তু আমার মনে একটা ধন্ধ।
কি স্যার?
এই রামচন্দ্রের জন্মস্থান নিয়ে হৈ চৈ! এটা খুব খারাপ! আমিই তো রাম না হতেই রামায়ণ লিখেছি।
করিমচাচা আর শশীবাবুর হাত ধরে বাল্মীকি বললেন-তোমরা সব ভাই ভাই! ভায়েরা ঝগড়া করে? আর কোরো না! আমরা যাই। আর হ্যাঁ! ভোলা, তোমাকে আমি ৫০ টা স্বর্ণমুদ্রা দিলাম। তোমার যা দাম হয়েছে, সেটা কেটে নেবে। বাকী টাকায় এখানে বিদ্যালয়ের উন্নতি করবে। শশীবাবু আর বিজনবাবু দায়িত্ব নেবেন। আর জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামাবেন না! কেমন? চলি!
পুস্পকে চড়ে গেলেন ওরা! মনের বেগে মিলিয়ে গেল পুস্পক!
No comments:
Post a Comment