Tuesday, March 31, 2015

আবার হরি-২



গতকালের ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে, আশে পাশের  চাষীদের মুখে হাসি । এবারে, আম বেশ বড় সাইজের আর মিষ্টিও হবে ।
ভয় একটাই, এবারে আমের যা ফলন, তাতে আলুর ভাগ্য না হয় ।

হরির দোকান, এই ভোরবেলাতেও ঝক্কাস ভাবে জমজমাট । তবে,  গোপলার মুখে লোডশেডিং । এমনিতে মুখে খই ফোটে আর কানে খাটো ।

অনেক খুঁচিয়ে শেষে যেটা পেলাম :-

আজ সকালে  ওর বৌ আস্তে করে নাকি মধুর কাছে পাঁচশো টাকা চেয়েছিল । মধু রেগে বলে :- কইসি না, যা কবা- জোরে কবা ।
জোরে বলতেই মধু বলল :- ইস্! আগের কথাটাই ভালো ছিল !

রেগে গিয়ে বৌয়ের জোরে জবাব :- বাপের বাড়ী চলে যাব !

যাও গিয়া ! কেডা বারণ করসে ?

টাকা দাও !

ক্যান ?

গাড়ী ভাড়া !

ঠিক আসে ! এই দিলাম।

ফেরার ভাড়া কোই ?

তুমি আবার ফেরবা ?









Saturday, March 28, 2015

পোড়া পেট


খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার দুর্বলতা সর্বজনীন । এই বয়সে এসেও, সেই দুর্বলতাটা ভয়ঙ্কর ভাবে বিদ্যমান । খেতে বসলে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না আমার ।

আমার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে জল খাওয়া বা কচকচ করে মাংস চিবোনোর  শব্দ শুনে আমার দিকে অনেকেই ( এর মধ্যে আমার “উনিও” আছেন ) ভুরু কুঁচকে তাকান ।

একবার তো পার্ক স্ট্রীটের “স্কাইরুমে” ( এখন ঘচাং ফু হয়ে গেছে ) গিয়ে বলেই দিয়েছিলাম- ও ঠাহুর !!! ঝুলে ( স্যুপ) কদু ( লাউ) দিসো ক্যা?

আশ্চর্য জনক  ভাবে উত্তর এসেছিল :- মিঁঞা,  ধইর‌্যা ফেলসেন দেহি ।

তারপর থেকেই আমার “কনফি” তুঙ্গে । এই সব নাক উঁচুপনাকে – আমি তাচ্ছিল্যর চোখেই দেখি এখন ।





ফেসবুকের বন্ধুদের বাইরেও কয়েকটা বিয়ে,  এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে– খাওয়াটা জব্বর হয়েছিল ।


আজ একটু খাওয়া দাওয়া নিয়ে অন্য কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি ।

প্রথমেই বলবো – আজ  থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগেকার কথা ।

যাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ– তাঁরা আবার বারিন্দির এবং স্বয়ং গৃহকর্তা আবার ডাক্তারও বটে ।

মাটীতে কলাপাতায় পরিবেশন আর মাটীর ভাঁড়ে  জল ।

পদগুলোও বেশ উঁচুমানের । শেষ হয়ে এসেছে খাওয়া, তখন গৃহকর্তার মনে পড়ল শাকটা দেওয়া হয় নি, প্রথম পাতে ।

উনি যথারীতি উচ্চগ্রামে হাঁক ( বারিন্দিররা আবার পেছনে ভর দিয়ে কথা বলেন- বরিন্দের প্রাচীন প্রবাদ)  দিলেন :- ওরে শাকটা নিয়ে আয় !!!!

নামকরা খাইয়েরা আপত্তি তুলে বললেন :- ওটা আর দিতে হবে না । এখন তো গলা পর্যন্ত  মিষ্টান্নে ভর্তি ।

প্রথামত শাক পেটের   নীচে থাকার কথা ।

ডাক্তার আবার হাঁক দিলেন বরিন্দ টোনে :-

ওরে, শাক গুলো একটা বালতীতে গুলে নিয়ে আয়, সঙ্গে গরুকে ইনজেকশান  দেওয়ার মোটা কাঁচের সিরিঞ্জ ।  শাকটা সকলের পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দি । অতিথি সৎকারে ত্রুটি যেন না হয় ।

আপত্য কারীরা সহ সব নিমন্ত্রিতরা দুড়দার করে উঠে দৌড়ে পালিয়েছিলেন সেবার ।

-
পরের একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি আপাতত ।

মালদায় গাজল বলে একটা আধা শহর আছে । ইংলিশ বাজার ( শহর এই নামেই পরিচিত) শহর থেকে ছাব্বিশ কিমি দূরে ।

গাজোল থেকে আলাতোড় গ্রাম আরও দশ কিমির মত ।

সম্পন্ন গৃহস্থ । ছেলে ডাক্তার । সেই ছেলের বৌভাতে আমরা নিমন্ত্রিত ।

গৃহস্থ খুব সজ্জন ব্যক্তি । আবার তথাকথিত “ ভদ্রসমাজে” মেলামেশা নেই বলে, একটু কুণ্ঠিত আর নার্ভাস থাকেন । সেরকম প্রথাগত “ শিক্ষা” নেই তবে টাকার গরমও অনুপস্থিত  ।

একমাত্র ছেলেকে ডাক্তারী পড়িয়েছেন, বৌমাও ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ।

আমরা খেতে বসেছি । গৃহস্থ হাত জোড় করে এসেছেন আমাদের সামনে ।

বিনয়ের সঙ্গে বললেন :- বাড়ীতে তো কিছু খেতে পান না, এখানেই ভালো ভালো খাবার খান ।

=====================




এই পোড়া পেটের জন্যই এত জ্বালা । সে আপনি, মধুমেহর রোগীই হন বা স্থূলকায় বা কায়া--- খেতে আপনাকে হবেই হবে ।

হতে পারে পদ কম বেশী, বা তাদের পরিমাণ বৃহদাকার থেকে ক্ষুদ্র,--খাওয়া ছাড়া যায় না ।

ইদানীং কালে, টিভিতে আবার রান্না শেখানো হয় । লো ফ্যাট, জিরো ক্যালোরী কত রকম বিজ্ঞাপনী বাহার সেসব রন্ধন প্রণালীর ক্লাসে ।

কি সুন্দর সাজানো গোছানো বাসনপত্তর , মড্যুলার কিচেন- দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

সে সব কিচেন নিজের ঘরে আনতে গেলে দেখেছি- চিকেন হয়ে যেতে হয়, আমার মত অবসর প্রাপ্ত বা মধ্যবিত্ত লোকের ।

টিভির ব্যাপার ছেড়ে এবারে নিজের কথায় আসি ।

শুধু খেলে তো হবে না, তার আগে রান্না করতে হবে । আবার রান্না- শুরুর আবার শুরু আছে ।

এখানে আবার ভাষার মুশকিল ।

দক্ষিণ বঙ্গের লোক বলবেন- আনাজ কোটা । উত্তরে – তরকারী কাটা । কেউ কেউ আবার কুটনো কোটাও বলেন । ফলে, ভাষার কোনো নির্দ্দিষ্ট কোটা না থাকলেও সব্জীগুলো কেটে ,সাইজে আনতে হবে – এটাই হলো মোদ্দা কথা ।

রীতি মত আয়োজন লাগে ।  আগে, নানারকম বঁটি ছিল ।  এখন এই বঁটির চল কমে এসেছে । একদম বিলুপ্ত প্রজাতি না হলেও প্রায় সে পথেই । বলা যায় বঁটির অন্তর্জলী যাত্রা সমাসন্ন ।

বঁটির আবার অনেক রকম তরিবত আছে । যে কেউ কিন্তু বঁটিকে বাগে আনতে পারবেন না ।

এর অনেক রকম ফন্দী- ফিকির বহাল।

সেকালে কথায় ছিল :-

“আমি কুটি চালতা আর তুমি কোটো লাউ

গতর খাকি বউকে দাও এঁচোর মোচার ফাউ”

একটা চিঁড়ের দানা বা জিরের দানার সাইজে নারকোল কোরা যায় বঁটি দিয়ে- ---একেবারে মাদারী কা খেল !!!

তাই নানা আকারের কিচেন নাইফ । বহোত না- ইনসাফি বঁটির ওপর, কিন্তু মেনে নিতেই হয় কারণ এটাই নাকি চলমান দস্তুর ।
এবারে সব্জী যে কাটবেন, তার আবার রকমফের আছে ।

ডুমো- ডুমো, ঝিরি-ঝিরি, ফালা- ফালা, পাতলা-পাতলা, লম্বা- লম্বা, এসব না জানলে ব্যঞ্জন হবে না । মানে মুখতব্য হবে না । কারণ, যে সব সব্জী দিয়ে তরকারী হবে, সেগুলো যাতে একসাথে সেদ্ধ হয়, তাই এই সব নামকরণের সমীকরণ ।

ফ্যাচাংও প্রচুর !!! রান্নার সঙ্গে আবার  ভাষার গভীর যোগ আছে ।

আমরা যারা উত্তরবঙ্গীয়, তারা বলি ফিচা । সেটা বললে আবার অনেকেই বোঝে না । বলুন- ল্যাজা বা ন্যাজা, অমনি আর ল্যাজ উল্টিয়ে কেউ দেখবে না, এঁড়ে না বকনা !! ওই মাছের ল্যাজাই সই ।

দিক্কত কি একটা ? সাঁতলানো বলুন – অনেকেই চোখ কপালে তুলে বলবেন ।

আমরা তো জানি- এটা “আংশানো” । কি সব ঢং রে বাবা !

ব্যস, হয়ে গেল !!

ডালে, কেউ দ্যান সম্ভার, কেউ কেউ আবার সম্বাড়া বা সম্বার ।

সে যাই হোক, ডাল তো রাঁধতেই হবে । কোনো উপায় নেই ।

ডাল খাওয়াটাও আবার রকমারি । কেউ আগে খান, কেউ বা শেষে ।

ডাল, ভাজা, শুকতো, শাক, মাছের ঝোল- এগুলো সব গেরস্ত মেনু । এবেলা ওবেলা চলে ।

ধনে পাতা দেওয়ার চল বেড়েছে । লাউ, বাঁধাকপি তে চলবে, কিন্তু পুঁইশাকে নৈব নৈব চ । বারিন্দির বাউনরা আবার হলুদ খেতেন না , খেলে নাকি সেটা অশুদ্ধ রান্না ।

এই ফাঁকে পুরীর মন্দিরের ভোগের কথা বলি----- পেঁয়াজ রসুনের কথা তো বাদই দিলাম, পুঁই শাক, সজনে ডাঁটা, উচ্ছে, কপি, চিনি আর শাদা মিহি নুনের নো অ্যাডমিটান্স ।

বাই চান্স যদি মিশে যায়, তবে সব ফেলে দিতে হবে ।

 ফিরে আসি রোজকার খাবারে । রোববার বা ছুটির দিনে আবার পাঁঠার মাংস ।

এরও সহবত আছে । অনেকেই আবার বৃথা মাংস খান না । তাই কসাই কালির উদ্ভব হয়েছিল এককালে । মাকালীর ছবি টাঙানো থাকতো কসাইয়ের দোকানে । আবার অনেকে হালাল করা মাংস ছাড়া খাবেন না ।

এই মাংস রান্নার আবার অনেক , মেকদার আছে।  ধনে, জিরে বাটা বা দই হিং দিয়েও হয়, আবার পেঁয়াজ রসুন দিয়েও হয় ।

অঞ্চল বিশেষে আবার খাওয়ার এটিকেট বহাল ।

অনেকেই শুঁটকি মাছ বা নোনা ইলিশ ( শুঁটকি ইলিশের নামান্তর ) খান । লইট্টা কাঁটাছাড়া সুস্বাদু মাছ ।

শুঁটকি হিসেবেই এর প্রচলন বেশী ।

শুঁটকিরও আবার অ্যাঁবসাতা ( এখানে কড়া অর্থে) আছে ।  এর নাম সীধল বা শিদল ।

অনেক কট্টর শুঁটকি প্রেমী আবার একে পছন্দ না করলেও “ রসা” বা আংশিক পচা এবং ভিজে ভিজে মাছ দারুণ জনপ্রিয় ত্রিপুরা, কুমিল্লা, সিলেট আর চট্টগ্রামে ।

পুঁটি মাছের শিদলের প্রচুর দাম ।

খাওয়া কি আর দামের জন্য আটকায়? রসনা তৃপ্তি বলে একটা কথা আছে না !!!

একটা ছড়াই আছে :-

“ লইট্টা কুলশ্রেষ্ঠ লাউখ্যা জনার্দন প্রভু
ইল্ শা ঘ্রাণমাত্রেণ, ভোজনে সাড়ে সাত পোয়া” ।

তবে, খাওয়ার ব্যাপারে ঝক্কাস উদাহরণ হচ্ছেন জনজাতি বা আদিবাসীরা । এঁরা সর্বভুক । পিঁপড়ের ডিম কিন্তু এঁদের ডেলিক্যাসী অনেক জায়গায় ।

এছাড়া আরও অনেক খাদ্য তালিকা আছে এনাদের । এই ব্যাপারে কিন্তু আমরা অনেকেই উদাসীন ।

মেঠো ইঁদুরের মাংসের প্রচুর কদর । গেঁড়ি, গুগলি, শামুক তো আছেই ।

শেষে বলি, এই উপমহাদেশে যেমন বৈচিত্র আছে বিভিন্ন মানুষের, সেই রকমই প্রচুর ধরণ আছে রান্না ও খাবারের ।

খালি টিভি দেখলে চলবে ? 

=== তথ্য ঋণ :-“ চিত্রিত পদ্মে” , অরুণ নাগ
+++++++++++এটা অনেক পুরোনো একটা প্রকাশিত লেখা 

Thursday, March 26, 2015

একটা পাবদা মাছ আর দুটো কাঁচালঙ্কা

 সোনা ব্যানার্জ্জীকে আজকাল আর কেউ মনে রাখে নি মালদা শহরে । চিরকুমার এই সোনাদা আদতে ছিলেন রাজশাহীর লোক ।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, কার্ল মার্কসের ভক্ত- এই আদ্যপান্ত ভদ্রলোক কথা একটু বেশী বলতেন ।

ইংরেজী, প্রাথমিক স্তর থেকে উঠিয়ে দেবার পর তিনি পার্টির বিরাগভাজন হয়ে ব্রাত্য হয়ে পড়লেও- লড়াই জারি রেখেছিলেন ।

উপার্জন বলতে ছিল- স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাপ্য একটা অনিয়মিত মাসিক ভাতা ।

তবু, হাসি বজায় রাখতেন মুখে ।

আশ্রয় বলতে ছিল :- ছোট ভাইদের করা
 একটা বরাদ্দ ঘর । ছাদ ফুটো হওয়ার কারণে, বর্ষাকালে ছাতা মাথায় বিছানায় বসে থাকতেন ।

এটা দেখে- সাধারণ মানুষই এগিয়ে আসে  ঘরটা মেরামত করতে । খুব কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন সেই কালে, তবে করারও কিছু ছিল না তাঁর ।

শীতে কষ্ট পেতেন । লেপ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল ওয়াড় সমেত ।

সোনাদার আনন্দ দ্যাখে কে ! ঘুমিয়ে নাকি খুব আরাম তাঁর ।

প্রায়ই দুপুরবেলা তিনি “নেমতন্ন” পেতেন কোনো না কোনো উপলক্ষে ।  তিনি সবিনয়ে বলতেন- ওই নেমতন্ন রাতে করা যায় না ?

কারণে বলতেন :- রাতে পেট ভরে ভাত খেলে ঘুমটা ভালো হয় ।

একবার আমার বাড়ীতে ছেলের জন্মদিনে পায়েস খেয়েছিলেন ।

পুরোটা খেয়ে আমার স্ত্রীকে বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন :- একটু জল দাও তো বৌমা ।

জল দিয়ে, পায়েসের অবশিষ্টাংশ খাবার পর তাঁর  উক্তি ছিল:- দুধের তৈরি যে কোনো জিনিস খেয়ে, ওই বাটিতেই জল খেলে, ভালো হজম হয় ।

ক্রিকেট খেলার খুব ভক্ত ছিলেন । আমার ভাড়া বাড়ী কাছে হওয়াতে, তিনি  এসে টিভিতে খেলা দেখতেন সারাদিন বসে ।

সেই যেবার  রবি শাস্ত্রী অডি গাড়ী পেল, সোনাদার কি আনন্দ !!!!

পরের দিন দুপুর বেলা খাওয়ার কথা বলা হলো ।

তিনি রাজী হলেন না ।

বাজারে দেখা হলো তাঁর সাথে ।

 দু টাকায় একটা পাবদা মাছ আর দুটো কাঁচা লঙ্কা  ফ্রি তে নিয়ে হাঁটা দিয়েছেন বাড়ীর দিকে ।

জিজ্ঞেস করলাম  - রান্না করে খাবেন আজ ?

 হ্যাঁ – ভারত জিতলে আমি বাড়ীতে নিজের হাতে ভোজ খাই !


++++++++++++
আজ সোনাদার কথা মনে পড়ছে খালি !

 












Wednesday, March 25, 2015

জীবন

ক্ষী জ্বালা বলুন তো ?
এই পেটের জন্য যত ঝামেলিস, তাই না ? সকালে ওঠো রে, বাজারে যাও রে । কত্তা বা গিন্নির মুখ ঝামটা খাও রে ।
এদিকে গ্যাস ফুইরেবে ফুইরেবে কোচ্চে , গ্যাস দিচ্চে না । বলি, স্ন্যাপ ডিল বা অ্যামাজনে তো আর গ্যাস পাওয়া যায় না , তাই গণ্ডগোলিস ।
তাই, বাবা বাছা করে ডেলিভারি বয়কে দশ টাকা বেশি বকশিশ কবুল করে , গ্যাস চাওয়া !
তাও কি দ্যায় ! কত রকম বাহানাক্কা !
ইদিকে গিন্নি হলে, কত্তার হুকুম – চা করো ! আর কত্তা হলে, গিন্নির হুকুম – আমি আর সংসার সামলাবো না ! তুমিই করো সব !
মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনটাকে ও এল এক্সে বেচে দি মাইরি !
ল্যাটা চুকে যায় !
তাপ্পর মনে পড়ে :- ও হরি ! চাল বাড়ন্ত ! ক্কি হবে?
তালে আর কি ! চলো, বাইরে খেয়ে আসা যাক ! ফেরার পথে নয় চাল কিনে আনা যাবে ।
ইদিকে মাসের শেষ ! টাকা, টিপে টিপে খরচ কোত্তে হয় ।
থাক্ ! ওই তো আটা আছে, চলো রুটি বানানো যাক !
এই মাইরি, রুটি খেলে মাঝরাতে পেট খালি খালি লাগবে ! চলোই নি, পিগি ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেই !
ইল্লি আর কি, অত গুলো পাঁচ টাকার কয়েন জমিয়েছি কি সাধে ? তাছাড়া, ওই খুচরো নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলে ভাববে – নিকিরি !
ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যাবো, কুচ পরোয়া নেহী !
আগের বিল শোধ করতেই সব জ্যাম- এ আবার কোথাকার খাঞ্জা খাঁ রে ! 
তালে কি হবে ?
যাও চাল নিয়ে এসো !
অ্যাতো রাতে ?
সবে তো সন্ধে, যাও যাও দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে নিয়ে খেয়ে নি !
=-========
এই ভাবেই চলে নিরন্তর জীবনের স্রোত ! তবু আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকবো !
জীবন জিন্দাবাদ !

পাগল

সকালে, জামসেদপুরের প্রখ্যাত ও বরিষ্ঠ কবি বারীন ঘোষালের Barin Ghosal এই আপডেটটা চোখে পড়ল ।
দুনিয়ার পাগলরা এক হও। চলো আমরা পাগলদের কমিউন তৈরি করি । সেয়ানা পাগলরা বাদ।
বলি, আলাদা করে পাগল কোথায় তৈরি হয় মশাই ?
সবাই তো বাই ডিফল্ট পাগল । পাগলামি যদি না থাকে, তবে সেই মানুষটা সুস্থ নয় ।
কথায় বলে না ?
পাগলা খাবি কি, ঝাঁঝেই মরে যাবি !
পাগলাদের ফেভারিট খাবার হলো ক্ষীর !
কেন?
ওই যে বলে- পাগলা, ক্ষীর খা !
কতরকমের যে পাগল, এই দুনিয়াতে !
কাজ-পাগল
বৌ- পাগল
সিনেমা- পাগল
গান -পাগল
মেয়ে –পাগল
বই –পাগল
করে করে :- সাহিত্য পাগল ।
আর এক পাগল কবি তারপদ রায় বলে গিয়েছেন :- পাগল চেনার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো মোড়ে দাঁড়ানো ।
যদি দ্যাখেন , ট্র্যাফিক পুলিশ ছাড়া আর কেউ ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করছে, সে নির্ঘাৎ পাগল ।
পাগলরা, অন্তত আমি দেখিনি- একসঙ্গে থাকে !
থাকলেও বেশীক্ষণ নয় ।
কারণ ?
পাগলেও নিজের ভালো বোঝে ! বুইলেন কিনা !
পাগলরা কোনোদিন সেয়ানা হয় না, হলে সে পাগল নয় ।
গান পাগল মান্না দে গেয়েছিলেন :-
যখন কেউ আমাকে পাগল বলে তার প্রতিবাদ করি আমি
যখন তুমি আমায় পাগল বলো , ধন্য যে হয় সে পাগলামি
ধন্য আমি ধন্য হে পাগল তোমার জন্য হে
সলিল চৌধুরীর সুরে নিচের গানটার কথা:-
পাগল হাওয়া
কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে
ফুলেরও বনে হাজারও রঙের মেলায়
সুরভি লুটের খেলায়
তারে নাহি পেলে
অত কথা কি ? কবিদের গুরুঠাকুর রবি দাদু তো বলেইছেন :-
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে. পাগল আমার মন জেগে ওঠে॥

তাই বলি, এত পাগল- ধুনবে কে ?

Sunday, March 22, 2015

মনের ছিটমহল -৭



 ভারতে অর্থনৈতিক বর্ষ শেষ হয় মার্চে । শেষের দিকে প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে সবারই !
ছুটি ছাটা পাওয়া খুবই কষ্টকর । তখন সদ্য নতুন বেচুবাবুর চাকরি । কটকে পোষ্টেড ।
সলিল মুখার্জ্জী (  খাস কোলকাতার কাঁকুলিয়াতে বাড়ী ) এবং কমল তরফদার (বালুরঘাট) আমার সহকর্মী । জোৎস্নাময় দাসগুপ্ত আমাদের ওপরওয়ালা ।

বালেশ্বরে, মা-বাবা থাকেন- ভাই বোন সহ ।

 আমার টার্গেট যা ছিল- সেটা পূরণ করে ফেলেছি । জোৎস্নাদার কাছে ছুটির দরখাস্ত  দিতেই বললেন :- এখনই তোর ছুটির দরকার পড়লো?
 মানে, বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে । যাই, ঘুরে আসি ।

তুই গিয়ে কি উপকার করবি ?

আমি, আবার কি করবো ! দেখি আসি ঐ দেশটাকে । আমার তো জন্মস্থান, তাই নষ্টালজিয়া ।

ঠিক আছে, আমাদের জন্য একটা করে পতাকা আনিস ওই দেশের, বুঝলি ?
হ্যাঁ বলতেই  দশদিনের ছুটি মঞ্জুর ।

অফিসের বাকি ষ্টাফেরা ওডিয়া । আমি, সদ্য জন্মানো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যাবো শুনে তারাও উত্তেজিত ।

সেদিন রাতেই পুরী এক্সপ্রেস ধরে সোজা কোলকাতায় । মাঝে আর বালেশ্বরে নামি নি, যেটা হরহামেশাই করতাম ।

বাবা বাধা দিতে পারেন – ভয় পেয়ে ।
বাঘাযতীনে, পরিমলদা জুটে গেল দলে । পরিমলদারও নতুন চাকরি- কাটছি মাটি দেখবি আয় ( সি.এম.ডি.এ) আপিসে । ছোটমামার বন্ধু ।
 ছোটমামাতো ছিলই, আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ।  তখন জাষ্ট এম.বি.বি.এস পাশ করেছে  বা করবে করবে, সেই সময় ।
আর ছিল সত্যদা । আমরা সবাই বন্ধুর মত ।

বাস থাকলেও আমরা একটা গাড়ী ভাড়া করে গিয়েছিলাম বসিরহাট দিয়ে টাকী পর্যন্ত।

রিফিউজী ক্যাম্পে ভর্তি সব লোকজন । প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক ।  পৌঁছতে রাত হওয়ায় সেখানে খাবার নেই কোনো দোকানেই । অনেকেই অসুখে ভুগছেন ।  স্থানীয় প্রশাসনের ভয়, যে কোনো রোগ মহামারী আকার ধারণ করতে পারে ।
আরও একটা ভয়- অনেক রাজাকারও ভয়ে ওপার থেকে শরণার্থী সেজে এসেছে । সেটাও মাথাব্যাথার কারণ প্রশাসনের কাছে ।

এদিকে কেউ প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছে । একটা ঘটনা শুনলাম ।  এক আত্মীয়ের কাছে ওপার থেকে লুকিয়ে আনা গয়না রেখেছিলেন এক শরণার্থী ।

পরের দিন সকালে সেই গয়না বেচে টাকা করার জন্য ওগুলো চাইলে- বেমালুম অস্বীকার করেন সেই আত্মীয় ।

সব হারানোর শোকে তখন সেই  ভদ্রলোক পাগল । স্বেচ্ছাসেবকরা গিয়ে আড়ং ধোলাই দিতেই শুড়সুড় করে বের হয় গয়না গুলো ।

এরকম কত ঘটনা যে এখনও অজানা ।
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তখন আকাশছোঁয়া বসিরহাট আর টাকীতে । তার জের, কোলকাতাতেও ।

আবেগ ছাড়িয়ে সকলেরই তখন বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ।
এপারে তখন নতুন করে শরণার্থীদের ওপর ক্রোধ, ঘৃণা ।
তার মধ্যে আবার ওপার থেকে আসা ৪৭ য়ের লোকজনও আছে ।
২৪ বছরেই এক নতুন  রাষ্ট্রের জন্ম- সকলেই ভালো ভাবে নেয় নি জীবন জীবিকার কারণে ।
তখনও লোকে জানে না, নতুন করে ট্যাক্স বসতে চলেছে, সারা ভারতের নাগরিকদের ওপর ।
========

একটা দোকানে ডিম আর পাঁউরুটি ছিল । সেঁকা রুটি আর ওমলেট দিয়ে পেট ভরালেও  ভাতের অভাব বোধ করছিলাম আমরা সকলেই ।

মুক্তি যোদ্ধাদের তরফ থেকে একটা সাদা কাগজে ষ্টাম্প মেরে ওপারে যাওয়ার অনুমতি মিলছিল ।

 খুব একটা বেগ না পেলেও সেটা যোগাড় করা গেল ।

রাতে থাকবো কোথায়- এই নিয়ে চিন্তা !
অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজনের বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা হলো কোনো রকমে । তখনকার দিনে তিনি  ত্রিশ টাকা নিয়েছিলেন এক রাত থাকার জন্য ।

তখন তো আর প্যাকেজড্ ড্রিকিং ওয়াটার ছিল না ।
নলকূপের জলই ভরসা ।

ডাক্তার ছোটমামার খুঁতখুঁতানি  জল খাবার ব্যাপারে ।  একটু কর্পূর যোগাড় করে জলে খানিকক্ষণ ফেলে রেখে ঐ জল খাওয়া ।

মন্দের ভালো ।






(চলবে)



মনের ছিটমহল -৬

মনের ছিটমহল -৬
+++++
প্রত্যেক মানুষের একটাই জীবন এবং সেই জীবনে অভিজ্ঞতা হয় প্রচুর । অতীতের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে সেই সব কথা , মননে এবং মস্তিস্কে ।
কখনও বা চাপা পড়ে থাকে, সাধারণ ভাষায় যাকে বলে ভুলে যাওয়া । মনে পড়ে যায়, কখনও কেউ উস্কে দিলে ।
বাচ্চা বয়স থেকে কৈশোর বেয়ে যৌবন তারপর প্রৌঢ়ত্ব এবং বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা একটা অবশ্যম্ভাবী ক্রম ।
আনন্দ, শোক, দুঃখ সব মিলে মিশে একটা মানুষ মিলিয়ে যায়, কালের গহ্বরে ।
পেছনে পড়ে থাকে অজস্র বন্ধু, আত্মীয় পরিজন ।
যাঁরা কীর্তিমান, তাঁদের কথা লেখা থাকে ইতিহাসে । যারা অখ্যাত তারা থাকে কিছু মানুষের স্মৃতিতে ।
তারপর সেই মানুষগুলোও যখন হারিয়ে যায়, মহাকালে সবাই একজন করে নেই মানুষ হয়ে যায় ।
এই উপমহাদেশে কত নেই মানুষ হারিয়ে গেছে, মহাকালের গহ্বরে ।
ঘটমান বর্তমানে আমরা বুঝতে পারি না অনেক কিছুই । ইতিহাসের সাক্ষী থেকেও বুঝতে পারি না তার মহত্ব বা দোষ গুণ ।
বুঝতে পারিনা কখন ইতিহাসের সমান্তরালে হাঁটছি আমরা আর ধীরে ধীরে হয় ভালো নয় খারাপের ছাপ আমাদের ওপর পড়ছে ।
আমি ইতিহাসবিদ নই তবু কুঁজো হিসেবে মাঝে মাঝে চিৎ হবার শখ তো জাগেই ।
আজকাল চোখ বন্ধ হলেই মনে হয়, অন্ধকার এক লেভেল ক্রসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
সামনে দিয়ে ঝমঝম করে ছুটে যাচ্ছে মেল ট্রেন। ইঞ্জিনটা কখনও ডাবলু পি ষ্টীম ক্যানাডিয়ান, কখনও বা ডিজেল বা হালের ঝকঝকে ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ।
কামরা গুলো শনশন করে বেরিয়ে যায়, আলো আর আঁধার; পিচকিরি দিয়ে ছিটিয়ে।

অনেকবার চেষ্টা করেছি, কটা কামরা আছে দেখতে, কিন্তু গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার সারা জীবনভর হয় নি।
তাই আর গোনাও হয় না।অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে, ট্রেন চলে যাবার পর। তখন হু হু করে মন। ধূ ধূ করা কাকে বলে, হাড়ে হাড়ে বুঝি।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশানেই আজকাল আ্যালপ্রাজোলাম খাই। তা প্রায় নয় বছর হয়ে গেল। ঘুমের ওষুধের মৃদু ঝাঁকুনিতে, শরীর টা মনে হয় ট্রেনের কামরাতেই আছে।
ডাবলু পি ষ্টীম ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনে টানা মেল ট্রেনটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনেই একটা কামরা! প্রতিটা জানলায় জ্বলছে আলো।
-----
রাতের খাবারে ছিল- বড় বড় কই মাছের ঝোল, ডাল আর আলু ভাজা । সানকীতে রাখা লাল চালের ভাত থেকে এক মনমাতানো সুগন্ধ । পাশে আর একটা কাঁচের বড় সুন্দর রেকাবীতে রাখা বেশ কয়েকটা দানাদার ।
সাতক্ষীরায় এসে দানাদার না খাওয়া আর দোজখে যাওয়া নাকি একই ব্যাপার।
খাও খাও বাপজানেরা , যশুরে কই । মাথা মোটা হয় এদের । আমাদেরও তো লোকে বলে যশুরে কই ।
হা হা করে প্রাণ খোলা হাসি হাসান সাহেবের ।
বোজসো ! এবারে তো ধান ভাল করে রুইতেই পারি নাই ! কষ্ট করে খাও ।
গোবিন্দের রান্না করা মশুর ডালটা বেশ ঘন। ওপরে কাঁচা সরষের তেল হালকা করে ছেটানো । কুচি করা পেঁয়াজ আর দুটো করে কাঁচালঙ্কা সানকির এক পাশে রাখা ।
ডাল দিয়ে ভাত মেখে মুখে দিতেই জিভে অমৃতের স্বাদ । সারাদিন পেটে ভালো করে ভাত পড়ে নি কারও সেরকম ভাবে ।
ছোটমামা মুশুরের ডাল খেতে খুব ভালোবাসে । একটু করে মাখা ভাত মুখে দিচ্ছে আর কচর মচর করে পেঁয়াজ চিবোনোর শব্দ ।
আমাদের চার সানকি ভাত নিমেষেই উধাও প্রত্যেকের পেটের ভেতর ।
জলিল ভাই আমাদের খাওয়া দেখে বলল :- ভয় নেই । প্রচুর ভাত আছে।

(চলবে)

Saturday, March 21, 2015

মনের ছিটমহল -৫



আমার ইংরেজি জ্ঞান ছিল – প্রশ্নাতীত ।  স্কুল থেকেই এই প্রতিভার বিস্ফোরণে স্কুলের  সবাই থরথর করে কাঁপতো !

অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন হেড স্যার ( প্রয়াত প্রবোধ মিত্র) – অর্জুনের টিপ খুব সুন্দর ছিল ।

 উত্তরে লিখেছিলাম :- অর্জুন হ্যাজ গুড ফিঙ্গারটিপ

এটা দেখে হেড স্যার দিন তিনেক ইস্কুলে আসেন নি ।

দপ্তরী যজ্ঞেশ্বর দা বলেছিল -  হেড স্যার, মনে লয় হার্ট ফেল করসে । কি যে তোরা সব লেখস ।

শান্তি বলেছিল :-  অর্জুন হ্যাভ ওয়েন্ট টু ফরেষ্টের মত ব্যাপারটা । শান্তি খুব গল্প টল্প পড়তো । তাক মত লাগিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছিল ।

 আরও দিন চারেক পর হেড স্যার এলেন ইস্কুলে, তবে আমাদের ক্লাসে ইংরেজী পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।

অজুহাত ছিল :- ওনার পিতৃদত্ত প্রাণ একটাই ।
পারলাখেমুণ্ডির রাজবাড়ীর কাছেই ছিল আমাদের ভাড়া বাড়ী । প্রতি ঘন্টায় সেখানে  ঢং ঢং করে ঘন্টি বাজিয়ে জানান দেওয়া হতো সময়টা সারা শহরে ।

একবার রাত বারটার সময়, ঘন্টিওয়ালা তেরবার ঘন্টা বাজিয়ে ছিল ।

পরের দিন তলব রাজার – ঘন্টিওয়ালকে

নির্ভয়ে জবাব দিয়েছিল সে :- হঁ !  মু তেরটা বজইথিলি , সিনা গোটিয়ে ছেপ দেইকি পোছি দেইথিলি ।

( হ্যাঁ ! আমি তেরবারই বাজিয়ে ছিলাম, কিন্তু একটা থুথু দিয়ে মুছে দিয়েছি )

================
জলিল ভাইয়ের আম্মীজান , ভুল ইংরেজী শুনে হার্টফেল করেন নি- তবে ঘনঘন রাজাকারদের মেরে ফেলা মৃতদেহ দেখে  হার্টফেল করে মারা গিয়েছিলেন  । সহ্য করতে পারেন নি, এই অত্যাচার ।

 মাগরীবের নামাজের পর হাসান সাহেব বলেছিলেন – বাংলাদেশ হওয়াতে তিনি খুশী ঠিকই, কিন্তু ভাঙা দেশ আর জোড়া লাগবে না ।

অখণ্ড ভারতের জন্য স্বাধীনতা সৈনিকদের আশা আকাঙ্খা নিমেষে ধূলিস্যাৎ করেছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ ই অগাষ্ট ।

আরও অজানা বিপদ কোথায় যে লুকিয়ে আছে, কে জানে !
 চলো ! রাত হয়ে গেছে ! খেয়ে নেওয়া যাক

আমার মনে পড়ছিল সেই তেরটা বাজানোর অজুহাত ।

থুথু দিয়ে কি সব মোছা যায় ?


(চলবে)



মনের ছিটমহল -৪





মার্চ মাস প্রায় শেষ । অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া । নামেই বসন্ত । অজানা আতঙ্ক সারা সাতক্ষীরা শহর জুড়ে ।

তবু সূর্য ডুবছে । মনে হলো অনিচ্ছা সহকারেই চলে যাচ্ছে অস্তাচলে । একটা মলিন আলো জ্বলে উঠলো ঘরে ।

হাসান সাহেবের ঋজু আশী বছরের দেহটা থেকে চল্লিশ ওয়াটের আলো ঠিকরচ্ছে বলে মনে হলো ।

দূরের মসজিদ থেকে এষার আজান ভেসে আসছে ।  ম্রিয়মান সেই আজান । মনে হয় কেঁদে যাচ্ছে পরিবার পরিজনদের মৃত্যুতে ।

একটা থমথমে আবহাওয়া, সারা ঘর জুড়ে ।

হাসান সাহেব, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন :- যাই, এষার আজান আদা করে আসি ।

জলিল ভাই বললেন – আব্বা খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদা তো করেনই, উপরন্তু ভোরবেলা, মানে আপনারা যাকে ব্রাহ্মমুহূর্ত বলেন – সেই সময়ে তাহাজ্জুত্ নামাজও আদা করেন । খুব কম লোকই করেন এটা ।

পরিমলদা বললেন – তাহলে, মোট ছটা  ! বাকি নামাজগুলো কি ?

ফজর, জোহর, আসর, এষা, মগরীব  ।


এই সময় একজন ঢুকলেন । গায়ে চাদর আর পরণে ধুতি । গলায় কণ্ঠিমালা ।

আমাদের দেখেই বললেন :- নমস্কার মেহমানরা ।  বড় সাহেব, ডাকি পাটাচেন আপনাদের রান্না করি দেবার জন্য । আমি গোবিন্দ । জেতে বৈরাগী  !
মানে ?

বৈরাগী হলো গে- মড়া নিয়ে যাবার সময়, যারা আগে আগে যায় খোল কত্তাল বাজিয়ে ।

হিন্দুও কমি আসিছে । আর বাকী বৈরাগীরা তো  চলে গ্যাসে দেশ ছাড়ি ইণ্ডিয়াতে ।

বড় সাহেব আমারে রাখি দেসেন । দু বিঘা জমিও খয়রাত করসেন আমারে । ওই খান সেনাদের হাত থেকেও বাঁচাচেন ।

উনি না থাকলে আমার বড় মাইয়াটারে খুবলে খাইতো খান সেনারা । মাগো !
জলিল ভাই ইতি মধ্যে আবার ঢুকলেন  ঘরে ।
আসলে, আমার আম্মী নাই । আমার বৌটারও শরীল খারাপ । বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না । রান্না করার কেউ নাই ।  গোবিন্দ ভাই দুবেলা রেঁধে দিয়ে যাচ্ছে, এই কয় দিন ।
আব্বা তাই একটু মজা করেই বলেছেন । তাছাড়া, হিন্দুরা মেহমান হয়ে এলে আমাদের সিধে দেওয়াই রেওয়াজ ।

ব্রাহ্মণরা তো ছোট লোক দের হাতে খেতো না । তাই ওরা সিধে দিতো ।

ছোট লোক শব্দটা কানে খট্ করে লাগলো ।

কিন্তু, তার তো দরকার ছিল না । আমরা তো দুপুরে হোটেলেই খেয়েছি । সেখানেই খেতাম ।

পাগল নাকি ? রাতে আর সেই হোটেল খোলা পাবে না ভাই ।  খান সেনারা আসার পর থেকেই স্বাভাবিক জীবন বন্ধ সব । আস্তে আস্তে হবে ।  শুনছি শ্যাখ সাহেবের কুনো খবর নাই । হারামীরা মাইরাই ফালালো কিনা কে জানে !
++++++++++++++

(চলবে)



Friday, March 20, 2015

মনের ছিটমহল -৩






 আমার জীবনটা বড়ই অদ্ভূত, জানেন ? কোনোদিন কোথাও থিতু হতে পারি নি । এমন কি, মা- বাবার সাথেও না !

এই জীবন সায়াহ্নে এসে হিসেব করে দেখছি, মা- বাবার সঙ্গে থেকেছি কুল্লে  ষোলো বছর । এটাও কিস্তিতে ।

প্রথম বারো বছর টানা, রাজশাহী ( কিছুই মনে নেই ঠিক ভাবে বলতে গেলে) বেনারস, মহিষাদল, পারলাখেমুণ্ডি
তারপর কলেজ জীবন ( পারলাখেমুণ্ডি আর বালেশ্বর মিলিয়ে) চার বছর ।

কটকের র‌্যাভেনশ্যতে পড়েছি- ওয়াই এম সি এ তে থেকে ।

প্রাথমিক শিক্ষা বেনারসে । সেটার কথা ঠিক মনে নেই । তারপর স্কুলের শিক্ষা মামার বাড়ী, বাঘাযতীন কলোনি ( এখন “জাতে” উঠে – পল্লী) থেকে ।

পাতি বাংলা স্কুল – বিজয়গড় শিক্ষানিকেতন ।

 তারপর, খালি দৌড় দৌড় ! মাঝে মধ্যে মা- বাবার সঙ্গে টানা  থেকেছি কখনও ৪-৫ দিন, কখনও বা এক দিন ।

যদি না হতো, তবে দেখে লিতাম !

ও ! ওই ঘটনাটা বলি নি না ?

মালদায়, তখন ইংরেজবাজার পৌরসভায় ড্রাইভার নেওয়া হবে । পুরপিতা, চেনা শোনা এবং বাংলার অধ্যাপক ।
কথায় কথায় বলতেন – অপদার্থ ।

পরে বিধানসভার  সদস্য হয়েছিলেন । নাম বললে, হয়তো মালদার ( মানে- মালদহ বা ইংরেজবাজার, টাকাওয়ালা বড়লোক নয়) পুরোনোরা চিনতে পারবেন।  প্রয়াত প্রভাত আচার্য্য । বড় ভালো মানুষ ছিলেন- মনের দিক থেকে ।

 যখন কোলকাতায়, সেবার ট্রাম উঠিয়ে দেবার কথা হয়েছিল, তখন তিনি ইংরেজবাজার শহরে বাতিল ট্রামগুলো এনে চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন  বিধানসভায়
প্রায় ১০ মিনিট ধরে জ্বালময়ী বক্তৃতা দিয়ে বিধানসভা সরগরম করে রেখেছিলেন
 কু লোকে বলে ঐ ১০ মিনিটে নাকি ১০০ বার অপদার্থ বলায়, বিধান সভার রেকর্ড থেকে ঐ শব্দগুলো বাদ গেছিল ।

মাণিকের বাবা এসে ধরল – ওর ছেলেকে পৌরসভায় ড্রাইভার হিসেবে ঢুকিয়ে দিতে হবে ।

অনুরোধে লোকে ঢেঁকি গেলে । তা, এটা তো চাকরীর ব্যাপার ।
গেলাম প্রভাতদার কাছে ।

অপদার্থ ! আমার কি করার আছে ?

না, মানে আপনি বললে চাকরীটা হয়ে যাবে !

অপদার্থ !  চেয়ারম্যান বললে সব সময় হয় না !

না না- এসব চালাকি করবেন না ! আপনি আমাদের শহরে ট্রাম চালাবেন বলছেন, আর এতো সামান্য চাকরি  ! কি যে বলেন !

অপদার্থ ( এবারে গ্যাস খেয়ে আকাশে), আচ্ছা ওকে ইন্টার ভিউতে পাঠিয়ে দেবে অমুক দিন, অমুকটার সময় ।

মাণিক তো গেল যথা সময়ে ।

বেরিয়ে এলো কাঁচুমাচু মুখ করে ।

কি রে ! কি প্রশ্ন করল ?

 একটাই তো পুছ করল !
কি ?

ফুয়েল মানে কহ ।

তুই কি বললি ?

 সানকিয়ে ( ভয় পেয়ে) চুপ করে ছিলাম । আচ্ছা, রামকিসনোদা – ফুয়েল মানে কি ?

তেল ! এটা বলতে পারলি না ?

ওওওওওওওওওওওও ত্যাল ? শা........... জানলে দেখে লিতাম্ !


কি যে দেখতো, কে জানে ! তবে চাকরিটা হয়েছিল । ওর ছেলেমেয়েরা এখন ভালো লেখাপড়া শিখে প্রতিষ্ঠিত । মাঝে মাঝেই ফোন করে খবরাখবর নেয় । অনুরোধও করে মালদা যেতে । খরচ –খরচা সব ওর ।

 যা বলছিলাম্ ( বুড়ো হওয়াতে খেই হারিয়ে ফেলি ) !

এই রাজনৈতিক নেতারা দেশটাকে – দেখেই লিয়েছিলেন ।

( চলবে)



মনের ছিটমহল-২



পশ্চিম বাংলার, আর পাঁচটা মফঃস্বল শহরের মতই সাতক্ষীরা ! অবিভক্ত বাংলায় প্রথমে এটা ২৪ পরগণার মহকুমা ছিল, পরে খুলনার মহকুমাতে আসে তারপর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে জেলার মর্যাদা পায় ।
ফলে, কথার টান সেই ২৪ পরগণার মতই । সাধারণ লোকে বলতো- ৬ গণ্ডা ( গণ্ডা =৪) পরগণা বা কেউ কেউ বলতো- ৬ হালি পরগণা ( হালি মানেও চার)।
তখন বেশ পরিস্কার ছিমছাম শহর । যুদ্ধে, এই শহরের খুব একটা ক্ষতি হয় নি, বললেই চলে ।
তবে, খুলনা যাওয়ার রাস্তা খান সেনারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াতে, ভারতের সৈন্যবাহিনী মেরামত করতে ব্যস্ত ।
মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লোকেরা শহরে তাদের প্রয়োজনের জন্য আসা যাওয়া করছে ।
আমাদের হেলিকপ্টার চালকরা কাছারির সামনে নিয়ে গেল । সেখানে, তখন মাত্র গেটাকয়েক খাবার হোটেল খোলা ।
চালক সহ আমরা ঢুকে পড়লাম একটা হোটেলে । খিদেতে পেটের নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার উপক্রম ।
হোটেলের নামটা, যতদূর মনে আছে- সেলিম হোটেল বা ঐ রকমই কিছু । পাশেই একটা ষ্টেশনারি ষ্টোর্স ।
নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মনোহর ভাবে সাজানো সেই মনোহারি দোকানে । অনেক খানি জায়গা জুড়ে বিরাট বড় দোকানটা ।
টিনে ভরা বিলিতি হরলিক্স থেকে জন প্লেয়ারর্স সিগারেট সব আছে ।
আমরা ঢুকতেই, দোকানের একটি লোক সালাম দিয়ে বলল :- আসেন চ্যার । ইণ্ডিয়া থিকি আসচেন মনে হচ্চে ।
আমরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই জবাব এলো – কিন্তু, এটা মুসলমানদের হোটেল । আপনারা কি এখানে খাবেন ? হিন্দু হোটেল গুলা সব বন্ধ । কি যে করি !
হেসে উড়িয়ে দিলাম । বললাম – আমরা এসব মানি না । তবে, একটা মুশকিল !
কি?
আমাদের কাছে তো ইণ্ডিয়ার টাকা ! পাকিস্তানি টাকা তো নাই !
সে – হয়ি যাবে । চিন্তা করেন কেন ? আগে খান , তারপর ওসব হবে । কি খাবেন- মাছ না মাংস, ভাতের সাথে ? একটা কথা- আমরা কিন্তু গরুর মাংস রান্না করি না ।
সে ঠিক আছে, তবে আমরা মাছই খাবো !
আচ্ছা, ইলিশ খাবেন তো ?
নিশ্চয়ই ! দ্যান্, দ্যান্ ।
এর মধ্যেই, উর্দ্দি পরা চারজন সর্দার ঢুকলেন হোটেলে । প্রত্যেকের কোমোরে রিভলভার ঝুলছে ।
রোটি হো গয়া ভাই ? সুবে আকে অর্ডার দিয়া থা ! খয়াল হ্যায় আপকা ?
জি জি, খেয়াল আছে, সাথে মোর্গাও বানিয়েছি ।
সর্দাররা হাসি মুখে বসতেই আমাদের ৮ জনকে দেখল ।
আপ চার লোগ ভারতসে আয়েঁ হ্যায় কেয়া ?
জি হাঁ !
ঠিক হ্যায়, লেকিন শাম হোনে সে পহলে নিকল যাইয়ে ! বর্ডার পঁহুচনা জরুরি হ্যায়!
কিঁউ জি ?
রাস্তে পর ইহাঁ উঁহা মাইন হ্যায়, খান সেনা লোগোঁকা কারোয়ার । বহোত খতর নাক চিজ সব !
হামলোক সোঁচতে হ্যায়, ইধর এক রোজ ঠহরেঙ্গে !
তো ঠিক হ্যায় ! লেকিন কহাঁ ?
ও তো মালুম নেহি ! ই সাইকেল ওয়ালে লোগ বতায়েঙ্গে !
দরাজ হাসি হেসে বললেন ওদেরই একজন :- কোই বাত নেহি ! আপলোগ হমারে ক্যাম্প মেঁ ভি ঠহর শকতে হ্যায় ।
জি সুক্রিয়া । দেঁখতে হ্যায় !
ঠিক হ্যায় ।
---
খাবার সব দিয়ে গেল ! সুবাস আসছে ইলিশ মাছের । ভাত মেখে মুখে তুলতেই, হঠাৎ সেই বাসী মৃতদেহদের বোঁটকা গন্ধ ভেসে এলো নাকে । কেন যে এলো, কে জানে ।
তাকিয়ে দেখি, মামা আর বন্ধুরাও খেতে পারছে না ।
কোনো রকমে খেলাম ।
খেয়ে হাত ধুয়ে টাকা দিতে গেলে, দোকানদার হাত জোড় করে বলল – নিতে পারবো না ।
কেন ?
জি, আপনারা আমাদের মেহমান, তার ওপর আমাদের বন্ধু । একদিন টাকা না নিলে না খেতে পেয়ে এন্তেকাল হবে না আমার ।
ওই মিলিটারিদের কাছ থেকেও টাকা নাও না ?
কি যে বলেন ! খান সেনারা খেয়ে টাকা দিত না, এরা দ্যায় । তবে, প্রথম দিন আমি নিজে নেই নি !
অনেক জোরাজুরি করলেও নিল না টাকা ।
-
বোঁটকা গন্ধটা সরানোর জন্য পাশের দোকানে সিগারেট কিনতে গেলাম ।
দোকান মালিক- জলিল আহমেদ ( আসল নামটা বললাম না, হয়তো তিনি আছেন এখনও )।
তিনি বললেন :- আপনারা আজ রাতে এখানে থাকবেন শুনলাম, সেলিম বলল ।
আমাদের বাসায় থাকবেন?
সম্মতির জন্য তাকালাম হেলিকপ্টার চালকদের দিকে । তারা ইশারায় সম্মতি জানালো ।
জলিল সাহেব আমাদের বললেন :- জানি, আমাকে আপনারা বিশ্বাস করবেন না, তবে, একটা কথা বলি । আমার আব্বা এখানে নাম করা লোক । প্রায় ৮০ বছর বয়স।
যেদিন দেশভাগ হলো, সেদিন থেকে উনি কথা বন্ধ রেখেছিলেন । বাংলাদেশ হবার পর থেকে কথা বলছেন । আমার আব্বাকে অন্তত দেখে যান । দরকার হলে কোনো হিন্দু বাসায় রাখার ব্যবস্থা করবো আপনাদের ।
লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল ।
দোকান বন্ধ করে আমাদের নিয়ে চললেন জলিল সাহেব । আমাদের সকলের থেকে বয়সে বড় বলেই মনে হলো তাঁকে ।
হেলিকপ্টার চালকদের বলে দিলেন – কাল আসবি তোরা । ওরা টাকা নিয়ে চলে গেল। আমরাই দিলাম ।
সিগারেট খেতেও ইতস্তত বোধ করছি আমরা ।
নিজেই সিগারেট এগিয়ে দিলেন ।
ওই যে সংস্কৃত ভাষায় আছে না – প্রাপ্তেষু ষোড়ষে ----
পরিমলদা বলল – আপনি সংস্কৃত জানেন ?
দরাজ হাসি দিলেন ।
পরে বলবো ওসব কথা । এখন চল তোমরা আমার বাসাতে ।
কখন যে আমরা “ তুমি” হয়ে গেছি বুঝতেও পারি নি ।
-
বাসায় ঢুকেই হাঁক দিলেন বাবাকে ।
আব্বাজান দ্যাখো, কাদের এনেছি !
পরিচয় হলো ওনার সাথে । শরবত, চা সব এলাহি ব্যাপার ।
তারপর হাসান সাহেব বললেন :- রাতে তো এরা খাবে । জলিল, এক কাজ কর এদের জন্য চাল , ডাল, মাছ, মশলা, প্রাইমাস ষ্টোভ, হাঁড়ি- কড়াই আর যা সব লাগবে, দিয়ে দে । আমাদের হাতের রান্না ওনাদের খাওয়ানো উচিত হবে না !
মাথায় হাত, আমাদের সকলের ।

----
পড়ার সুবিধের জন্য আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি নি
-

(চলবে)

মনের ছিটমহল – ১



না, এবারে ক্রিকেট নয় । নিজের কিছু অনুভূতি/ অভিজ্ঞতার কথা বলছি।
দেশ ভাগ হবার পর, এপারে যখন আসি, সেই বয়সে কেন দেশ ছেড়ে আসা হয়েছিল- সেটা বোঝার মত বুদ্ধি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না এবং এখনও নেই ।
এখন, শুধু এটুকু বুঝতে পারি, ১৯৪৭ য়ের আগে ভারতে ছিলাম, আর তার পরে আবার ভারতে এসেছি ।
বারবার, প্রহসন বলেই মনে হয়েছে আমার ।
বাবা, কাকা, মাতামহ সবাইকে বিমর্ষ দেখেছি দেশ ছেড়ে আসার কারণে ।
এমন নয়, যে ওপার বাংলাতে গোলাভরা ধান , পুকুরভরা মাছ, বা বিশাল স্বচ্ছল অবস্থা ছিল আমাদের ( শোনা কথা ) ।
মোটামুটি খেয়ে পরে বাঁচার অবস্থা অবশ্য ছিলই , নাটোরের আগদীঘা গ্রামে, দেবোত্তর সম্পত্তির কারণে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, তখন রাগ হতো “মুসলমান দের ওপর এই মুষল পর্বে ।
মালাউন নামটা তখনই প্রথম শুনি ।
কারণ, বাবা- কাকা- মাতামহরা সংগ্রাম করছেন এক নতুন জায়গায় এসে সংগ্রাম করছেন বেঁচে থাকার জন্য সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে । এই সংগ্রাম তখন ঘরে ঘরে ।
এখানকার বাঙালিরা আমাদের মানিয়ে নিতে পারে নি- এটাও সত্যি কথা ।
আর কেনই বা মেনে নেবে ? তাই, আমাদের রাগ এদের প্রতিও ।
রুজি- রোজগারে টান পড়লে না মানাটাই স্বাভাবিক ।
তার ওপর সংস্কৃতির দুস্তর ব্যবধান ।
আমরা যে ভাষাই বলি না কেন- সেটা, শাখামৃগর কিচির মিচির মনে হতো এদেশীয়দের কাছে ।
কেউ কেউ গালাগালিও ভাবতো !
মানসিক ব্যবধান বিরাট হয়ে দাঁড়াচ্ছিল , তাচ্ছিল্যের বহিঃপ্রকাশে ।
সে সময় সন্ত্রাস বাদ ছিল না, কিন্তু এই মানসিক অত্যাচার দুঃসহ সন্ত্রাসবাদের চেহারাই নিয়েছিল তখন ।
তবু, সেই যুগে শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার লোকেরও কোনো খামতি ছিল না ।
আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি- শুভ বুদ্ধি বারবার হেরেছে অশুভ শক্তির কাছে ।
উদ্বাস্তু বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছে- ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে । সেখানেও একই অবস্থা ।
ধীরে ধীরে বিশ্বস্ত লোকেদের কাছে শুনে, ইতিহাস পড়ে মাথায় আসল কারণটা ঢোকে ।
তখন তো কিছুই করার উপায় নেই ।
আমার মত অনেকেরই বিদ্বেষ টা পুরোপুরি না হলেও ৯৮% কাটে,১৯৭১ য়ে ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, এপারের বাঙালিদেরও উদ্ধুদ্ধ করেছিল ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে পরেই টাকী দিয়ে ঢুকেছিলাম, আমার ছোটমামা এবং আরও কিছু এদেশীয় বন্ধুর সঙ্গে ।
সবে আত্মসমর্পণ করেছে- পাকিস্তানি সৈন্যরা ।
চারিদিকে ছড়িয়ে নারকীয় দৃশ্য । কোথাও হাতকাটা, মাথাকাটা পচা মৃতদেহ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, কোথাও বা অসহায় শিশু বসে আছে মৃতা মায়ের পাশে ।
অসহ্য পরিস্থিতি ।
পেটে মোচড় দিচ্ছে, বমি হবার উপক্রম ।
বাহন বলতে – হেলিকপ্টার । সাইকেলের পেছনের বড় কেরিয়ারে বস্তা বাঁধা ।
সেই কেরিয়ারে বসে এক একজন করে সাইকেল প্রতি । কত টাকা নিয়েছিল, এখন আর মনে নেই ।
এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় চলতে চলতে সাইকেল চালক দিয়ে চলেছে ধারাবিবরণী । তেমন “আলোকপ্রাপ্ত নয় তারা ।
মুসলমান সেই চালকের প্রশ্ন ছিল- ধর্ম যদি একই হয় তবে পচ্ছারা ( পশ্চিমারা) আমাদের এই ভাবে মারল কেনে ?
এদের পথ দেখাছে- এখানকার রাজাকাররা । জানেন এটা ?
উত্তর ছিল না আমাদের মুখে ।
পরে জেনেছি (কিছুটা ইতিহাস পড়ে আর অনেকটা জনাব হুমায়ুন কবীরের উপন্যাস- এক জীবনের কথা পড়ে) – তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে “মুসলমান বাঙালিরা চাকরী পেত ১ % , তাও মুচলেকা দিয়ে ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনীতে একই বৈষম্য ছিল ।
অথচ – তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাদের সরকারী চাকরীতে অবস্থান ছিল, ৩০-৩৫ % মত। রাজার মত ব্যবহার তাদের !
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও ধর্ম এক করতে পারে নি একটা জাতিকে ।
সেই আমলের পাকিস্তান ছিল – একটা অজানা পাখির মত, যার দুটো ডানা আছে, দেহটাই নেই।
সেই অদেখা দেহটার মাংস খেতে তখন ব্যস্ত তারা।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিলই দেশভাগের কারণে ।
এমন কয়েকজনের সঙ্গে তখন দেখা হয়েছিল বাংলাদেশে, তাঁরা হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে আনন্দিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে জিততে পেরে ।
একটা অলীক স্বপ্নও দেখেছিলেন – স্বাধীন “ বাংলাস্তানগড়বেন দুই বাংলা মিলিয়ে ।
সেটা অসম্ভব ছিল । গঙ্গা- যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে ।
যাই হোক – আমরা পৌঁছলাম সাতক্ষীরা শহরে কোনো রকমে ।খিদে পেয়েছে ।

( চলবে)