Sunday, March 22, 2015

মনের ছিটমহল -৭



 ভারতে অর্থনৈতিক বর্ষ শেষ হয় মার্চে । শেষের দিকে প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে সবারই !
ছুটি ছাটা পাওয়া খুবই কষ্টকর । তখন সদ্য নতুন বেচুবাবুর চাকরি । কটকে পোষ্টেড ।
সলিল মুখার্জ্জী (  খাস কোলকাতার কাঁকুলিয়াতে বাড়ী ) এবং কমল তরফদার (বালুরঘাট) আমার সহকর্মী । জোৎস্নাময় দাসগুপ্ত আমাদের ওপরওয়ালা ।

বালেশ্বরে, মা-বাবা থাকেন- ভাই বোন সহ ।

 আমার টার্গেট যা ছিল- সেটা পূরণ করে ফেলেছি । জোৎস্নাদার কাছে ছুটির দরখাস্ত  দিতেই বললেন :- এখনই তোর ছুটির দরকার পড়লো?
 মানে, বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে । যাই, ঘুরে আসি ।

তুই গিয়ে কি উপকার করবি ?

আমি, আবার কি করবো ! দেখি আসি ঐ দেশটাকে । আমার তো জন্মস্থান, তাই নষ্টালজিয়া ।

ঠিক আছে, আমাদের জন্য একটা করে পতাকা আনিস ওই দেশের, বুঝলি ?
হ্যাঁ বলতেই  দশদিনের ছুটি মঞ্জুর ।

অফিসের বাকি ষ্টাফেরা ওডিয়া । আমি, সদ্য জন্মানো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যাবো শুনে তারাও উত্তেজিত ।

সেদিন রাতেই পুরী এক্সপ্রেস ধরে সোজা কোলকাতায় । মাঝে আর বালেশ্বরে নামি নি, যেটা হরহামেশাই করতাম ।

বাবা বাধা দিতে পারেন – ভয় পেয়ে ।
বাঘাযতীনে, পরিমলদা জুটে গেল দলে । পরিমলদারও নতুন চাকরি- কাটছি মাটি দেখবি আয় ( সি.এম.ডি.এ) আপিসে । ছোটমামার বন্ধু ।
 ছোটমামাতো ছিলই, আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ।  তখন জাষ্ট এম.বি.বি.এস পাশ করেছে  বা করবে করবে, সেই সময় ।
আর ছিল সত্যদা । আমরা সবাই বন্ধুর মত ।

বাস থাকলেও আমরা একটা গাড়ী ভাড়া করে গিয়েছিলাম বসিরহাট দিয়ে টাকী পর্যন্ত।

রিফিউজী ক্যাম্পে ভর্তি সব লোকজন । প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক ।  পৌঁছতে রাত হওয়ায় সেখানে খাবার নেই কোনো দোকানেই । অনেকেই অসুখে ভুগছেন ।  স্থানীয় প্রশাসনের ভয়, যে কোনো রোগ মহামারী আকার ধারণ করতে পারে ।
আরও একটা ভয়- অনেক রাজাকারও ভয়ে ওপার থেকে শরণার্থী সেজে এসেছে । সেটাও মাথাব্যাথার কারণ প্রশাসনের কাছে ।

এদিকে কেউ প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছে । একটা ঘটনা শুনলাম ।  এক আত্মীয়ের কাছে ওপার থেকে লুকিয়ে আনা গয়না রেখেছিলেন এক শরণার্থী ।

পরের দিন সকালে সেই গয়না বেচে টাকা করার জন্য ওগুলো চাইলে- বেমালুম অস্বীকার করেন সেই আত্মীয় ।

সব হারানোর শোকে তখন সেই  ভদ্রলোক পাগল । স্বেচ্ছাসেবকরা গিয়ে আড়ং ধোলাই দিতেই শুড়সুড় করে বের হয় গয়না গুলো ।

এরকম কত ঘটনা যে এখনও অজানা ।
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তখন আকাশছোঁয়া বসিরহাট আর টাকীতে । তার জের, কোলকাতাতেও ।

আবেগ ছাড়িয়ে সকলেরই তখন বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ।
এপারে তখন নতুন করে শরণার্থীদের ওপর ক্রোধ, ঘৃণা ।
তার মধ্যে আবার ওপার থেকে আসা ৪৭ য়ের লোকজনও আছে ।
২৪ বছরেই এক নতুন  রাষ্ট্রের জন্ম- সকলেই ভালো ভাবে নেয় নি জীবন জীবিকার কারণে ।
তখনও লোকে জানে না, নতুন করে ট্যাক্স বসতে চলেছে, সারা ভারতের নাগরিকদের ওপর ।
========

একটা দোকানে ডিম আর পাঁউরুটি ছিল । সেঁকা রুটি আর ওমলেট দিয়ে পেট ভরালেও  ভাতের অভাব বোধ করছিলাম আমরা সকলেই ।

মুক্তি যোদ্ধাদের তরফ থেকে একটা সাদা কাগজে ষ্টাম্প মেরে ওপারে যাওয়ার অনুমতি মিলছিল ।

 খুব একটা বেগ না পেলেও সেটা যোগাড় করা গেল ।

রাতে থাকবো কোথায়- এই নিয়ে চিন্তা !
অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজনের বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা হলো কোনো রকমে । তখনকার দিনে তিনি  ত্রিশ টাকা নিয়েছিলেন এক রাত থাকার জন্য ।

তখন তো আর প্যাকেজড্ ড্রিকিং ওয়াটার ছিল না ।
নলকূপের জলই ভরসা ।

ডাক্তার ছোটমামার খুঁতখুঁতানি  জল খাবার ব্যাপারে ।  একটু কর্পূর যোগাড় করে জলে খানিকক্ষণ ফেলে রেখে ঐ জল খাওয়া ।

মন্দের ভালো ।






(চলবে)



No comments: