Friday, April 10, 2015

নাম এবং ছবি না দেওয়ার সর্তে





 সকাল, সাড়ে দশটা হবে ! একটা কল এলো সেল ফোনে , অজানা নম্বর থেকে ।

ওপার থেকে ভারি গলায় প্রশ্ন :-

-       কি রে রামকেষ্ট গলা চিনতে পারছিস ?
-       মোটেই না !
-      এই মরেচে ! বলি, বিজয় গড় শিক্ষা নিকেতনের কথা ভুলে গেলি ?
-       ভুলে গেলেই ভাল হতো !
-      কেন?
-       ঐ দু বার ফেল করার বিভীষিকা কে আর মনে রাখতে পারে, বলুন !
-       ল্লে ! আমি তোকে তুই বলছি, আর তুই আপনি ?
-      চিনি নি তো এখনও ।
-       আমি অমুক চন্দ্র অমুক !  তোর থেকে দু কেলাস এগিয়ে গিয়েছিলাম, তুই গাড্ডু মারাতে ।
-      অ্যাই ব্যাস্ ! শুনেছিলাম, তুই আম্রিগা না বিলেত – কোথায় যেন থাকিস ?
-      হতভাগা, এখনও সাবকন্টিনেন্ট গুলো চিনলি না ? ভূগোলে তুই বরাবরই কাঁচা থেকে গেলি দেখছি !
-       ভূগোলে আমি কোনোদিনই থাকি নি, বাজে কথা বলিস না !
-       তুই দেখছি, সেই একই থেকে গেলি !
-      রতনে রতন চেনে রে ! যাক্, বল কেমন আছিস ?
-       তোর সঙ্গে যে দরকার ছিল রে  ঘনা !
-      একদিন আয় আমার বাড়ীতে
-      না, আজই যাবো, অমুককে নিয়ে ।
-      চলে আয় !
-      তোর ফ্ল্যাটের কাছাকাছি ভালো রেস্তোরাঁ আছে ?
-      আছে আছে, বার কাম রেষ্টুরেন্টও আছে !
-       নাঃ ! এখনও তুই রেষ্টুরেন্ট বলিস ?
-      কি করবো বল ? রেষ্টুরেন্ট, মামলেট, কবিরাজী-  এসব খাস বাংলা শব্দ, ভুলি কি করে ?
-      হুম, এখনও পুজোর মার্কেটিং না শপিং করিস ?
-       মার্কেটিং ই বলি ।
-      তুই ব্যাটা, নাঃ থাক, আমি আসছি তোর বাড়ী । ডিরেকশানটা বল্

বললাম


ঘন্টা দুয়েক বাদে একটা মোটোর গাড়ী এসে দাঁড়ালো বাড়ীর সামনে ।

দু জনেই বেরিয়ে সটান আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটে । একথা, সে কথার পর বলল:-

-      শোন্ আমার আজ জন্মদিন ! চল, তোর বৌকে সঙ্গে নে । বাইরে খাব । চাস তো বিয়ারও খাওয়াতে পারি । খাবি তো?
-      কি যে বলিস, চ চ শিগ্গির ।

তৈরি হয়ে নিয়ে, আমার উনি সহ বন্ধুর গাড়ীতে উঠে পড়লাম ।

ওই বন্ধু এতক্ষণ কিছু বলেনি ! এবারে মুখ খুলে বলল :-
-      বুজছস, রামকেষ্ট ! ওরে আমি কইলাম, তুই অহনে দমদমায় থাকস, মালদায় আর না ।
-      এহে ! একটা গিফ্ট কিনতে পারতাম !
-       দরকার নাই, হ্যার জিনিসের অভাব ? তয় আমি একটা গিফ্ট কিনসি !
-       কি রে ?
-      আম্রিগায়, ওগুলা খুব দামী !
-       আরে, বলবি তো !
-       কমু অনে ! আগে তো খাইয়া লই ! ক্ষুধা পাইসে ।

যা হোক বিয়ার লাঞ্চ হলো আমাদের ।
শেষে অপর বন্ধুটি বের করল একটা জুতোর বাক্স ।  প্রবাসী  বন্ধুটির হাতে দিল বাক্স টা ।

-      ধর্ !
-      কি ?
-      জুত্তা !
-       শ্যাষে, তুই আমাকে জুতো দিলি ?
-      কস্ কি রে ! তোগো দ্যাশে জুত্তা খুব দামী, তাই দিসি !
-      দামী হোক, তাই বলে জুতো ?
-      আরে বলদা নতুনই দিসি, পুরানো তো আর দেই নাই !









Thursday, April 2, 2015

আবার হরি -৪




সকালে, হরির দোকানে যাওয়াটা আমার কাছে এল.এস.ডি. র নেশার মত । শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন না হোক, পশ্চিমবঙ্গ দর্শন তো হয়ই ।

নানা কিসিমের লোক, নানা ভাষ্য-টিকা, রকমারি মতামত সব মিলিয়ে একেবারে হিন্দি সিনেমার ফিউশন গানকেও ছাড়িয়ে যায়।

নাগেরবাজারের আগের ষ্টপেজ সাতগাছি থেকে - একটু এগোলেই বিবেকানন্দ পল্লী ।

ঢোকার মুখেই হরির দোকান ।

কোনোরকমে মাথায় একটা ছাউনী, আর কাঠের তক্তা পেতে বসার জায়গা ।

ফেরী করে বেড়ানো মাছওয়ালা থেকে শুরু করে সব্জী বিক্রেতা, স্বঘোষিত রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে- কে নেই সেখানে ?

কুড়ি বছর আগে যখন এখানে ফ্ল্যাট কিনি, তখন আমাদেরটা ছিল তিন নম্বর ফ্ল্যাট বাড়ী। কান ঘেঁষে আছে দু নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট ।

নব্বই শতাংশ উদ্বাস্তু এই অঞ্চলে । আস্তে আস্তে পাল্টেছে ম্যাট্রিক্স ।

বাঙালি ছাড়া এই এলাকায়, আগে কেউ আসতো না, এখন সেটা পাল্টে গেছে । গুজু, মাড়ওয়াড়ি, সিন্ধ্রি সব মিলিয়ে মিনি ভারতবর্ষ ।

জায়গার নামও পাল্টাচ্ছে । আগে যেটা ছিল কলোনী, সেটা এখন পল্লী । লাহা কলোনী , তাই এখন লাহা এ্যাভিনিউ ।

বাঙাল ভাষার দাপট অস্তমিত হলেও গোধূলি বেলার মত পুরোনো লোকেদের মুখে এখনও বর্তমান ।

জায়গার নাম পাল্টালেও প্রাচীন লোকেরা ভোলে না । এই এক জ্বালা নতুন প্রজন্মের কাছে ।

হরির বাড়ীটা ভেঙে এখন ফ্ল্যাট বাড়ী হচ্ছে । নানা লোকের আনাগোনা কেনার জন্য ।

একজন এসে জিজ্ঞেস করল :- দাদা, বোলতে পারবেন জী, ইয়ে জয় হিন্দ পল্লী কাঁহা পর মিলেগা?

হরি চা দিতে গেছে অন্য দোকানে ।

মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে সবাই !

সোত্তর বছরের কালুদা , চেঁচিয়ে বলল – বুজসি, ওডা হাগড়া পট্টি !

মানে ?

আরে ওই যে হরিরা ড্রেইনের ধারে বইয়া হাগতো না- সেই থিকা তো হাগড়া পট্টি !

হরি, ফিরে এসে শুনেই ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে গেল !

কি কইলেন ? হাগড়া পট্টি ?

হ !

নাম পাল্টাইসে, জানেন না । ওইটা এখন গিয়া জয় হিন্দ পল্লী ! হাগড়া পট্টি কইলে আমাগো ফ্ল্যাট তো আর বিকাইবো না !

ঠিহ আসে ! উয়ারে – পটি পল্লী কমু হনে, ইবার থিকা !


(পাঠক,কিছু সংস্কৃত ভাষার জন্য দুঃখিত )

আবার হরি-৩


আজ সকালে হরির দোকানে সবাই কেমন যেন বিষণ্ণ । ইলেকট্রিক মিস্ত্রি নীলু বেশী কথা বলে, কিন্তু আজ তার মুখে অদৃশ্য সেলোটেপ ।
এদিকে ওয়ার্ডে প্রার্থীরা বেরিয়েছেন পরিক্রমায় ।
শাসক দলের নয়, এমন একজন প্রার্থী দাঁড়িয়ে পড়লেন চা খেতে । অল্প কিছু সাঙ্গোপাঙ্গো সাথে ।
এককালে বাঘে গরুতে, একসাথে জল খেতো তাঁর দাপটে । এখন তিনি নিজেই ভিজে বেড়াল ।
নীলুকে অনুরোধের স্বরে বললেন – দুটো ফ্যান লাগাস তো, আমাদের নির্বাচনী কার্যালয়ে । ভাড়া নেবো ।
তারপর কি ভেবে আবার বললেন – ঠিক আছে, আপাতত একটাই ফ্যান লাগা ।
মধুর উত্তর :- নীলু, শুধু মুণ্ডিটা লাগিয়ে দে আগে –তারপর বুঝে শুনে পাখাগুলো লাগাবি ।
প্রার্থী ভদ্রলোক রেগে গেলেও বহিঃপ্রকাশ করলেন না । আগে হলে, রোওয়াবটা বোঝা যেত ।
আমাকে বললেন :- কেমন আছেন ?
বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা হয়ে বললাম – ভালো, আপনি ?
এই তো, আছি একরকম । যা সন্ত্রাস চারিদিকে !
হ্যাঁ – আর বলবেন না ! আচ্ছা, ওই দশ বছর আগে আপনি ওমুক ওয়ার্ডে আনকনটেসটেড হয়ে জিতেছিলেন না ?
হঠাৎ ওনার তাড়া দেখলাম, চলে যাওয়ার । মঞ্চ থেকে নিস্ক্রমণ হয়ে গেল তাঁর ।
হরির মঞ্চে আগমন ।
বোজছস্ নীলু, বিরটিস রা আবার আইলেই ভালো
কেন ?
অগো আমলে দল ছিল না ! কত্ত কাজ করসে , ক দেহি ?
তুমি দেখেছিলে নাকি ?
না তয়, হুনসি তো !
এবারে নীলুর মাষ্টার ষ্ট্রোক :-

তালে মোঘল আমল এলেই ভালো । আর ঝামেলা থাকে না ।

Tuesday, March 31, 2015

আবার হরি-২



গতকালের ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে, আশে পাশের  চাষীদের মুখে হাসি । এবারে, আম বেশ বড় সাইজের আর মিষ্টিও হবে ।
ভয় একটাই, এবারে আমের যা ফলন, তাতে আলুর ভাগ্য না হয় ।

হরির দোকান, এই ভোরবেলাতেও ঝক্কাস ভাবে জমজমাট । তবে,  গোপলার মুখে লোডশেডিং । এমনিতে মুখে খই ফোটে আর কানে খাটো ।

অনেক খুঁচিয়ে শেষে যেটা পেলাম :-

আজ সকালে  ওর বৌ আস্তে করে নাকি মধুর কাছে পাঁচশো টাকা চেয়েছিল । মধু রেগে বলে :- কইসি না, যা কবা- জোরে কবা ।
জোরে বলতেই মধু বলল :- ইস্! আগের কথাটাই ভালো ছিল !

রেগে গিয়ে বৌয়ের জোরে জবাব :- বাপের বাড়ী চলে যাব !

যাও গিয়া ! কেডা বারণ করসে ?

টাকা দাও !

ক্যান ?

গাড়ী ভাড়া !

ঠিক আসে ! এই দিলাম।

ফেরার ভাড়া কোই ?

তুমি আবার ফেরবা ?









Saturday, March 28, 2015

পোড়া পেট


খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার দুর্বলতা সর্বজনীন । এই বয়সে এসেও, সেই দুর্বলতাটা ভয়ঙ্কর ভাবে বিদ্যমান । খেতে বসলে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না আমার ।

আমার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে জল খাওয়া বা কচকচ করে মাংস চিবোনোর  শব্দ শুনে আমার দিকে অনেকেই ( এর মধ্যে আমার “উনিও” আছেন ) ভুরু কুঁচকে তাকান ।

একবার তো পার্ক স্ট্রীটের “স্কাইরুমে” ( এখন ঘচাং ফু হয়ে গেছে ) গিয়ে বলেই দিয়েছিলাম- ও ঠাহুর !!! ঝুলে ( স্যুপ) কদু ( লাউ) দিসো ক্যা?

আশ্চর্য জনক  ভাবে উত্তর এসেছিল :- মিঁঞা,  ধইর‌্যা ফেলসেন দেহি ।

তারপর থেকেই আমার “কনফি” তুঙ্গে । এই সব নাক উঁচুপনাকে – আমি তাচ্ছিল্যর চোখেই দেখি এখন ।





ফেসবুকের বন্ধুদের বাইরেও কয়েকটা বিয়ে,  এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে– খাওয়াটা জব্বর হয়েছিল ।


আজ একটু খাওয়া দাওয়া নিয়ে অন্য কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি ।

প্রথমেই বলবো – আজ  থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগেকার কথা ।

যাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ– তাঁরা আবার বারিন্দির এবং স্বয়ং গৃহকর্তা আবার ডাক্তারও বটে ।

মাটীতে কলাপাতায় পরিবেশন আর মাটীর ভাঁড়ে  জল ।

পদগুলোও বেশ উঁচুমানের । শেষ হয়ে এসেছে খাওয়া, তখন গৃহকর্তার মনে পড়ল শাকটা দেওয়া হয় নি, প্রথম পাতে ।

উনি যথারীতি উচ্চগ্রামে হাঁক ( বারিন্দিররা আবার পেছনে ভর দিয়ে কথা বলেন- বরিন্দের প্রাচীন প্রবাদ)  দিলেন :- ওরে শাকটা নিয়ে আয় !!!!

নামকরা খাইয়েরা আপত্তি তুলে বললেন :- ওটা আর দিতে হবে না । এখন তো গলা পর্যন্ত  মিষ্টান্নে ভর্তি ।

প্রথামত শাক পেটের   নীচে থাকার কথা ।

ডাক্তার আবার হাঁক দিলেন বরিন্দ টোনে :-

ওরে, শাক গুলো একটা বালতীতে গুলে নিয়ে আয়, সঙ্গে গরুকে ইনজেকশান  দেওয়ার মোটা কাঁচের সিরিঞ্জ ।  শাকটা সকলের পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দি । অতিথি সৎকারে ত্রুটি যেন না হয় ।

আপত্য কারীরা সহ সব নিমন্ত্রিতরা দুড়দার করে উঠে দৌড়ে পালিয়েছিলেন সেবার ।

-
পরের একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি আপাতত ।

মালদায় গাজল বলে একটা আধা শহর আছে । ইংলিশ বাজার ( শহর এই নামেই পরিচিত) শহর থেকে ছাব্বিশ কিমি দূরে ।

গাজোল থেকে আলাতোড় গ্রাম আরও দশ কিমির মত ।

সম্পন্ন গৃহস্থ । ছেলে ডাক্তার । সেই ছেলের বৌভাতে আমরা নিমন্ত্রিত ।

গৃহস্থ খুব সজ্জন ব্যক্তি । আবার তথাকথিত “ ভদ্রসমাজে” মেলামেশা নেই বলে, একটু কুণ্ঠিত আর নার্ভাস থাকেন । সেরকম প্রথাগত “ শিক্ষা” নেই তবে টাকার গরমও অনুপস্থিত  ।

একমাত্র ছেলেকে ডাক্তারী পড়িয়েছেন, বৌমাও ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ।

আমরা খেতে বসেছি । গৃহস্থ হাত জোড় করে এসেছেন আমাদের সামনে ।

বিনয়ের সঙ্গে বললেন :- বাড়ীতে তো কিছু খেতে পান না, এখানেই ভালো ভালো খাবার খান ।

=====================




এই পোড়া পেটের জন্যই এত জ্বালা । সে আপনি, মধুমেহর রোগীই হন বা স্থূলকায় বা কায়া--- খেতে আপনাকে হবেই হবে ।

হতে পারে পদ কম বেশী, বা তাদের পরিমাণ বৃহদাকার থেকে ক্ষুদ্র,--খাওয়া ছাড়া যায় না ।

ইদানীং কালে, টিভিতে আবার রান্না শেখানো হয় । লো ফ্যাট, জিরো ক্যালোরী কত রকম বিজ্ঞাপনী বাহার সেসব রন্ধন প্রণালীর ক্লাসে ।

কি সুন্দর সাজানো গোছানো বাসনপত্তর , মড্যুলার কিচেন- দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

সে সব কিচেন নিজের ঘরে আনতে গেলে দেখেছি- চিকেন হয়ে যেতে হয়, আমার মত অবসর প্রাপ্ত বা মধ্যবিত্ত লোকের ।

টিভির ব্যাপার ছেড়ে এবারে নিজের কথায় আসি ।

শুধু খেলে তো হবে না, তার আগে রান্না করতে হবে । আবার রান্না- শুরুর আবার শুরু আছে ।

এখানে আবার ভাষার মুশকিল ।

দক্ষিণ বঙ্গের লোক বলবেন- আনাজ কোটা । উত্তরে – তরকারী কাটা । কেউ কেউ আবার কুটনো কোটাও বলেন । ফলে, ভাষার কোনো নির্দ্দিষ্ট কোটা না থাকলেও সব্জীগুলো কেটে ,সাইজে আনতে হবে – এটাই হলো মোদ্দা কথা ।

রীতি মত আয়োজন লাগে ।  আগে, নানারকম বঁটি ছিল ।  এখন এই বঁটির চল কমে এসেছে । একদম বিলুপ্ত প্রজাতি না হলেও প্রায় সে পথেই । বলা যায় বঁটির অন্তর্জলী যাত্রা সমাসন্ন ।

বঁটির আবার অনেক রকম তরিবত আছে । যে কেউ কিন্তু বঁটিকে বাগে আনতে পারবেন না ।

এর অনেক রকম ফন্দী- ফিকির বহাল।

সেকালে কথায় ছিল :-

“আমি কুটি চালতা আর তুমি কোটো লাউ

গতর খাকি বউকে দাও এঁচোর মোচার ফাউ”

একটা চিঁড়ের দানা বা জিরের দানার সাইজে নারকোল কোরা যায় বঁটি দিয়ে- ---একেবারে মাদারী কা খেল !!!

তাই নানা আকারের কিচেন নাইফ । বহোত না- ইনসাফি বঁটির ওপর, কিন্তু মেনে নিতেই হয় কারণ এটাই নাকি চলমান দস্তুর ।
এবারে সব্জী যে কাটবেন, তার আবার রকমফের আছে ।

ডুমো- ডুমো, ঝিরি-ঝিরি, ফালা- ফালা, পাতলা-পাতলা, লম্বা- লম্বা, এসব না জানলে ব্যঞ্জন হবে না । মানে মুখতব্য হবে না । কারণ, যে সব সব্জী দিয়ে তরকারী হবে, সেগুলো যাতে একসাথে সেদ্ধ হয়, তাই এই সব নামকরণের সমীকরণ ।

ফ্যাচাংও প্রচুর !!! রান্নার সঙ্গে আবার  ভাষার গভীর যোগ আছে ।

আমরা যারা উত্তরবঙ্গীয়, তারা বলি ফিচা । সেটা বললে আবার অনেকেই বোঝে না । বলুন- ল্যাজা বা ন্যাজা, অমনি আর ল্যাজ উল্টিয়ে কেউ দেখবে না, এঁড়ে না বকনা !! ওই মাছের ল্যাজাই সই ।

দিক্কত কি একটা ? সাঁতলানো বলুন – অনেকেই চোখ কপালে তুলে বলবেন ।

আমরা তো জানি- এটা “আংশানো” । কি সব ঢং রে বাবা !

ব্যস, হয়ে গেল !!

ডালে, কেউ দ্যান সম্ভার, কেউ কেউ আবার সম্বাড়া বা সম্বার ।

সে যাই হোক, ডাল তো রাঁধতেই হবে । কোনো উপায় নেই ।

ডাল খাওয়াটাও আবার রকমারি । কেউ আগে খান, কেউ বা শেষে ।

ডাল, ভাজা, শুকতো, শাক, মাছের ঝোল- এগুলো সব গেরস্ত মেনু । এবেলা ওবেলা চলে ।

ধনে পাতা দেওয়ার চল বেড়েছে । লাউ, বাঁধাকপি তে চলবে, কিন্তু পুঁইশাকে নৈব নৈব চ । বারিন্দির বাউনরা আবার হলুদ খেতেন না , খেলে নাকি সেটা অশুদ্ধ রান্না ।

এই ফাঁকে পুরীর মন্দিরের ভোগের কথা বলি----- পেঁয়াজ রসুনের কথা তো বাদই দিলাম, পুঁই শাক, সজনে ডাঁটা, উচ্ছে, কপি, চিনি আর শাদা মিহি নুনের নো অ্যাডমিটান্স ।

বাই চান্স যদি মিশে যায়, তবে সব ফেলে দিতে হবে ।

 ফিরে আসি রোজকার খাবারে । রোববার বা ছুটির দিনে আবার পাঁঠার মাংস ।

এরও সহবত আছে । অনেকেই আবার বৃথা মাংস খান না । তাই কসাই কালির উদ্ভব হয়েছিল এককালে । মাকালীর ছবি টাঙানো থাকতো কসাইয়ের দোকানে । আবার অনেকে হালাল করা মাংস ছাড়া খাবেন না ।

এই মাংস রান্নার আবার অনেক , মেকদার আছে।  ধনে, জিরে বাটা বা দই হিং দিয়েও হয়, আবার পেঁয়াজ রসুন দিয়েও হয় ।

অঞ্চল বিশেষে আবার খাওয়ার এটিকেট বহাল ।

অনেকেই শুঁটকি মাছ বা নোনা ইলিশ ( শুঁটকি ইলিশের নামান্তর ) খান । লইট্টা কাঁটাছাড়া সুস্বাদু মাছ ।

শুঁটকি হিসেবেই এর প্রচলন বেশী ।

শুঁটকিরও আবার অ্যাঁবসাতা ( এখানে কড়া অর্থে) আছে ।  এর নাম সীধল বা শিদল ।

অনেক কট্টর শুঁটকি প্রেমী আবার একে পছন্দ না করলেও “ রসা” বা আংশিক পচা এবং ভিজে ভিজে মাছ দারুণ জনপ্রিয় ত্রিপুরা, কুমিল্লা, সিলেট আর চট্টগ্রামে ।

পুঁটি মাছের শিদলের প্রচুর দাম ।

খাওয়া কি আর দামের জন্য আটকায়? রসনা তৃপ্তি বলে একটা কথা আছে না !!!

একটা ছড়াই আছে :-

“ লইট্টা কুলশ্রেষ্ঠ লাউখ্যা জনার্দন প্রভু
ইল্ শা ঘ্রাণমাত্রেণ, ভোজনে সাড়ে সাত পোয়া” ।

তবে, খাওয়ার ব্যাপারে ঝক্কাস উদাহরণ হচ্ছেন জনজাতি বা আদিবাসীরা । এঁরা সর্বভুক । পিঁপড়ের ডিম কিন্তু এঁদের ডেলিক্যাসী অনেক জায়গায় ।

এছাড়া আরও অনেক খাদ্য তালিকা আছে এনাদের । এই ব্যাপারে কিন্তু আমরা অনেকেই উদাসীন ।

মেঠো ইঁদুরের মাংসের প্রচুর কদর । গেঁড়ি, গুগলি, শামুক তো আছেই ।

শেষে বলি, এই উপমহাদেশে যেমন বৈচিত্র আছে বিভিন্ন মানুষের, সেই রকমই প্রচুর ধরণ আছে রান্না ও খাবারের ।

খালি টিভি দেখলে চলবে ? 

=== তথ্য ঋণ :-“ চিত্রিত পদ্মে” , অরুণ নাগ
+++++++++++এটা অনেক পুরোনো একটা প্রকাশিত লেখা 

Thursday, March 26, 2015

একটা পাবদা মাছ আর দুটো কাঁচালঙ্কা

 সোনা ব্যানার্জ্জীকে আজকাল আর কেউ মনে রাখে নি মালদা শহরে । চিরকুমার এই সোনাদা আদতে ছিলেন রাজশাহীর লোক ।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, কার্ল মার্কসের ভক্ত- এই আদ্যপান্ত ভদ্রলোক কথা একটু বেশী বলতেন ।

ইংরেজী, প্রাথমিক স্তর থেকে উঠিয়ে দেবার পর তিনি পার্টির বিরাগভাজন হয়ে ব্রাত্য হয়ে পড়লেও- লড়াই জারি রেখেছিলেন ।

উপার্জন বলতে ছিল- স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাপ্য একটা অনিয়মিত মাসিক ভাতা ।

তবু, হাসি বজায় রাখতেন মুখে ।

আশ্রয় বলতে ছিল :- ছোট ভাইদের করা
 একটা বরাদ্দ ঘর । ছাদ ফুটো হওয়ার কারণে, বর্ষাকালে ছাতা মাথায় বিছানায় বসে থাকতেন ।

এটা দেখে- সাধারণ মানুষই এগিয়ে আসে  ঘরটা মেরামত করতে । খুব কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন সেই কালে, তবে করারও কিছু ছিল না তাঁর ।

শীতে কষ্ট পেতেন । লেপ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল ওয়াড় সমেত ।

সোনাদার আনন্দ দ্যাখে কে ! ঘুমিয়ে নাকি খুব আরাম তাঁর ।

প্রায়ই দুপুরবেলা তিনি “নেমতন্ন” পেতেন কোনো না কোনো উপলক্ষে ।  তিনি সবিনয়ে বলতেন- ওই নেমতন্ন রাতে করা যায় না ?

কারণে বলতেন :- রাতে পেট ভরে ভাত খেলে ঘুমটা ভালো হয় ।

একবার আমার বাড়ীতে ছেলের জন্মদিনে পায়েস খেয়েছিলেন ।

পুরোটা খেয়ে আমার স্ত্রীকে বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন :- একটু জল দাও তো বৌমা ।

জল দিয়ে, পায়েসের অবশিষ্টাংশ খাবার পর তাঁর  উক্তি ছিল:- দুধের তৈরি যে কোনো জিনিস খেয়ে, ওই বাটিতেই জল খেলে, ভালো হজম হয় ।

ক্রিকেট খেলার খুব ভক্ত ছিলেন । আমার ভাড়া বাড়ী কাছে হওয়াতে, তিনি  এসে টিভিতে খেলা দেখতেন সারাদিন বসে ।

সেই যেবার  রবি শাস্ত্রী অডি গাড়ী পেল, সোনাদার কি আনন্দ !!!!

পরের দিন দুপুর বেলা খাওয়ার কথা বলা হলো ।

তিনি রাজী হলেন না ।

বাজারে দেখা হলো তাঁর সাথে ।

 দু টাকায় একটা পাবদা মাছ আর দুটো কাঁচা লঙ্কা  ফ্রি তে নিয়ে হাঁটা দিয়েছেন বাড়ীর দিকে ।

জিজ্ঞেস করলাম  - রান্না করে খাবেন আজ ?

 হ্যাঁ – ভারত জিতলে আমি বাড়ীতে নিজের হাতে ভোজ খাই !


++++++++++++
আজ সোনাদার কথা মনে পড়ছে খালি !

 












Wednesday, March 25, 2015

জীবন

ক্ষী জ্বালা বলুন তো ?
এই পেটের জন্য যত ঝামেলিস, তাই না ? সকালে ওঠো রে, বাজারে যাও রে । কত্তা বা গিন্নির মুখ ঝামটা খাও রে ।
এদিকে গ্যাস ফুইরেবে ফুইরেবে কোচ্চে , গ্যাস দিচ্চে না । বলি, স্ন্যাপ ডিল বা অ্যামাজনে তো আর গ্যাস পাওয়া যায় না , তাই গণ্ডগোলিস ।
তাই, বাবা বাছা করে ডেলিভারি বয়কে দশ টাকা বেশি বকশিশ কবুল করে , গ্যাস চাওয়া !
তাও কি দ্যায় ! কত রকম বাহানাক্কা !
ইদিকে গিন্নি হলে, কত্তার হুকুম – চা করো ! আর কত্তা হলে, গিন্নির হুকুম – আমি আর সংসার সামলাবো না ! তুমিই করো সব !
মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনটাকে ও এল এক্সে বেচে দি মাইরি !
ল্যাটা চুকে যায় !
তাপ্পর মনে পড়ে :- ও হরি ! চাল বাড়ন্ত ! ক্কি হবে?
তালে আর কি ! চলো, বাইরে খেয়ে আসা যাক ! ফেরার পথে নয় চাল কিনে আনা যাবে ।
ইদিকে মাসের শেষ ! টাকা, টিপে টিপে খরচ কোত্তে হয় ।
থাক্ ! ওই তো আটা আছে, চলো রুটি বানানো যাক !
এই মাইরি, রুটি খেলে মাঝরাতে পেট খালি খালি লাগবে ! চলোই নি, পিগি ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেই !
ইল্লি আর কি, অত গুলো পাঁচ টাকার কয়েন জমিয়েছি কি সাধে ? তাছাড়া, ওই খুচরো নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলে ভাববে – নিকিরি !
ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যাবো, কুচ পরোয়া নেহী !
আগের বিল শোধ করতেই সব জ্যাম- এ আবার কোথাকার খাঞ্জা খাঁ রে ! 
তালে কি হবে ?
যাও চাল নিয়ে এসো !
অ্যাতো রাতে ?
সবে তো সন্ধে, যাও যাও দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে নিয়ে খেয়ে নি !
=-========
এই ভাবেই চলে নিরন্তর জীবনের স্রোত ! তবু আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকবো !
জীবন জিন্দাবাদ !

পাগল

সকালে, জামসেদপুরের প্রখ্যাত ও বরিষ্ঠ কবি বারীন ঘোষালের Barin Ghosal এই আপডেটটা চোখে পড়ল ।
দুনিয়ার পাগলরা এক হও। চলো আমরা পাগলদের কমিউন তৈরি করি । সেয়ানা পাগলরা বাদ।
বলি, আলাদা করে পাগল কোথায় তৈরি হয় মশাই ?
সবাই তো বাই ডিফল্ট পাগল । পাগলামি যদি না থাকে, তবে সেই মানুষটা সুস্থ নয় ।
কথায় বলে না ?
পাগলা খাবি কি, ঝাঁঝেই মরে যাবি !
পাগলাদের ফেভারিট খাবার হলো ক্ষীর !
কেন?
ওই যে বলে- পাগলা, ক্ষীর খা !
কতরকমের যে পাগল, এই দুনিয়াতে !
কাজ-পাগল
বৌ- পাগল
সিনেমা- পাগল
গান -পাগল
মেয়ে –পাগল
বই –পাগল
করে করে :- সাহিত্য পাগল ।
আর এক পাগল কবি তারপদ রায় বলে গিয়েছেন :- পাগল চেনার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো মোড়ে দাঁড়ানো ।
যদি দ্যাখেন , ট্র্যাফিক পুলিশ ছাড়া আর কেউ ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করছে, সে নির্ঘাৎ পাগল ।
পাগলরা, অন্তত আমি দেখিনি- একসঙ্গে থাকে !
থাকলেও বেশীক্ষণ নয় ।
কারণ ?
পাগলেও নিজের ভালো বোঝে ! বুইলেন কিনা !
পাগলরা কোনোদিন সেয়ানা হয় না, হলে সে পাগল নয় ।
গান পাগল মান্না দে গেয়েছিলেন :-
যখন কেউ আমাকে পাগল বলে তার প্রতিবাদ করি আমি
যখন তুমি আমায় পাগল বলো , ধন্য যে হয় সে পাগলামি
ধন্য আমি ধন্য হে পাগল তোমার জন্য হে
সলিল চৌধুরীর সুরে নিচের গানটার কথা:-
পাগল হাওয়া
কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে
ফুলেরও বনে হাজারও রঙের মেলায়
সুরভি লুটের খেলায়
তারে নাহি পেলে
অত কথা কি ? কবিদের গুরুঠাকুর রবি দাদু তো বলেইছেন :-
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে. পাগল আমার মন জেগে ওঠে॥

তাই বলি, এত পাগল- ধুনবে কে ?

Sunday, March 22, 2015

মনের ছিটমহল -৭



 ভারতে অর্থনৈতিক বর্ষ শেষ হয় মার্চে । শেষের দিকে প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে সবারই !
ছুটি ছাটা পাওয়া খুবই কষ্টকর । তখন সদ্য নতুন বেচুবাবুর চাকরি । কটকে পোষ্টেড ।
সলিল মুখার্জ্জী (  খাস কোলকাতার কাঁকুলিয়াতে বাড়ী ) এবং কমল তরফদার (বালুরঘাট) আমার সহকর্মী । জোৎস্নাময় দাসগুপ্ত আমাদের ওপরওয়ালা ।

বালেশ্বরে, মা-বাবা থাকেন- ভাই বোন সহ ।

 আমার টার্গেট যা ছিল- সেটা পূরণ করে ফেলেছি । জোৎস্নাদার কাছে ছুটির দরখাস্ত  দিতেই বললেন :- এখনই তোর ছুটির দরকার পড়লো?
 মানে, বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে । যাই, ঘুরে আসি ।

তুই গিয়ে কি উপকার করবি ?

আমি, আবার কি করবো ! দেখি আসি ঐ দেশটাকে । আমার তো জন্মস্থান, তাই নষ্টালজিয়া ।

ঠিক আছে, আমাদের জন্য একটা করে পতাকা আনিস ওই দেশের, বুঝলি ?
হ্যাঁ বলতেই  দশদিনের ছুটি মঞ্জুর ।

অফিসের বাকি ষ্টাফেরা ওডিয়া । আমি, সদ্য জন্মানো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যাবো শুনে তারাও উত্তেজিত ।

সেদিন রাতেই পুরী এক্সপ্রেস ধরে সোজা কোলকাতায় । মাঝে আর বালেশ্বরে নামি নি, যেটা হরহামেশাই করতাম ।

বাবা বাধা দিতে পারেন – ভয় পেয়ে ।
বাঘাযতীনে, পরিমলদা জুটে গেল দলে । পরিমলদারও নতুন চাকরি- কাটছি মাটি দেখবি আয় ( সি.এম.ডি.এ) আপিসে । ছোটমামার বন্ধু ।
 ছোটমামাতো ছিলই, আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় ।  তখন জাষ্ট এম.বি.বি.এস পাশ করেছে  বা করবে করবে, সেই সময় ।
আর ছিল সত্যদা । আমরা সবাই বন্ধুর মত ।

বাস থাকলেও আমরা একটা গাড়ী ভাড়া করে গিয়েছিলাম বসিরহাট দিয়ে টাকী পর্যন্ত।

রিফিউজী ক্যাম্পে ভর্তি সব লোকজন । প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক ।  পৌঁছতে রাত হওয়ায় সেখানে খাবার নেই কোনো দোকানেই । অনেকেই অসুখে ভুগছেন ।  স্থানীয় প্রশাসনের ভয়, যে কোনো রোগ মহামারী আকার ধারণ করতে পারে ।
আরও একটা ভয়- অনেক রাজাকারও ভয়ে ওপার থেকে শরণার্থী সেজে এসেছে । সেটাও মাথাব্যাথার কারণ প্রশাসনের কাছে ।

এদিকে কেউ প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছে । একটা ঘটনা শুনলাম ।  এক আত্মীয়ের কাছে ওপার থেকে লুকিয়ে আনা গয়না রেখেছিলেন এক শরণার্থী ।

পরের দিন সকালে সেই গয়না বেচে টাকা করার জন্য ওগুলো চাইলে- বেমালুম অস্বীকার করেন সেই আত্মীয় ।

সব হারানোর শোকে তখন সেই  ভদ্রলোক পাগল । স্বেচ্ছাসেবকরা গিয়ে আড়ং ধোলাই দিতেই শুড়সুড় করে বের হয় গয়না গুলো ।

এরকম কত ঘটনা যে এখনও অজানা ।
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তখন আকাশছোঁয়া বসিরহাট আর টাকীতে । তার জের, কোলকাতাতেও ।

আবেগ ছাড়িয়ে সকলেরই তখন বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ।
এপারে তখন নতুন করে শরণার্থীদের ওপর ক্রোধ, ঘৃণা ।
তার মধ্যে আবার ওপার থেকে আসা ৪৭ য়ের লোকজনও আছে ।
২৪ বছরেই এক নতুন  রাষ্ট্রের জন্ম- সকলেই ভালো ভাবে নেয় নি জীবন জীবিকার কারণে ।
তখনও লোকে জানে না, নতুন করে ট্যাক্স বসতে চলেছে, সারা ভারতের নাগরিকদের ওপর ।
========

একটা দোকানে ডিম আর পাঁউরুটি ছিল । সেঁকা রুটি আর ওমলেট দিয়ে পেট ভরালেও  ভাতের অভাব বোধ করছিলাম আমরা সকলেই ।

মুক্তি যোদ্ধাদের তরফ থেকে একটা সাদা কাগজে ষ্টাম্প মেরে ওপারে যাওয়ার অনুমতি মিলছিল ।

 খুব একটা বেগ না পেলেও সেটা যোগাড় করা গেল ।

রাতে থাকবো কোথায়- এই নিয়ে চিন্তা !
অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজনের বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা হলো কোনো রকমে । তখনকার দিনে তিনি  ত্রিশ টাকা নিয়েছিলেন এক রাত থাকার জন্য ।

তখন তো আর প্যাকেজড্ ড্রিকিং ওয়াটার ছিল না ।
নলকূপের জলই ভরসা ।

ডাক্তার ছোটমামার খুঁতখুঁতানি  জল খাবার ব্যাপারে ।  একটু কর্পূর যোগাড় করে জলে খানিকক্ষণ ফেলে রেখে ঐ জল খাওয়া ।

মন্দের ভালো ।






(চলবে)



মনের ছিটমহল -৬

মনের ছিটমহল -৬
+++++
প্রত্যেক মানুষের একটাই জীবন এবং সেই জীবনে অভিজ্ঞতা হয় প্রচুর । অতীতের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে সেই সব কথা , মননে এবং মস্তিস্কে ।
কখনও বা চাপা পড়ে থাকে, সাধারণ ভাষায় যাকে বলে ভুলে যাওয়া । মনে পড়ে যায়, কখনও কেউ উস্কে দিলে ।
বাচ্চা বয়স থেকে কৈশোর বেয়ে যৌবন তারপর প্রৌঢ়ত্ব এবং বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা একটা অবশ্যম্ভাবী ক্রম ।
আনন্দ, শোক, দুঃখ সব মিলে মিশে একটা মানুষ মিলিয়ে যায়, কালের গহ্বরে ।
পেছনে পড়ে থাকে অজস্র বন্ধু, আত্মীয় পরিজন ।
যাঁরা কীর্তিমান, তাঁদের কথা লেখা থাকে ইতিহাসে । যারা অখ্যাত তারা থাকে কিছু মানুষের স্মৃতিতে ।
তারপর সেই মানুষগুলোও যখন হারিয়ে যায়, মহাকালে সবাই একজন করে নেই মানুষ হয়ে যায় ।
এই উপমহাদেশে কত নেই মানুষ হারিয়ে গেছে, মহাকালের গহ্বরে ।
ঘটমান বর্তমানে আমরা বুঝতে পারি না অনেক কিছুই । ইতিহাসের সাক্ষী থেকেও বুঝতে পারি না তার মহত্ব বা দোষ গুণ ।
বুঝতে পারিনা কখন ইতিহাসের সমান্তরালে হাঁটছি আমরা আর ধীরে ধীরে হয় ভালো নয় খারাপের ছাপ আমাদের ওপর পড়ছে ।
আমি ইতিহাসবিদ নই তবু কুঁজো হিসেবে মাঝে মাঝে চিৎ হবার শখ তো জাগেই ।
আজকাল চোখ বন্ধ হলেই মনে হয়, অন্ধকার এক লেভেল ক্রসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
সামনে দিয়ে ঝমঝম করে ছুটে যাচ্ছে মেল ট্রেন। ইঞ্জিনটা কখনও ডাবলু পি ষ্টীম ক্যানাডিয়ান, কখনও বা ডিজেল বা হালের ঝকঝকে ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ।
কামরা গুলো শনশন করে বেরিয়ে যায়, আলো আর আঁধার; পিচকিরি দিয়ে ছিটিয়ে।

অনেকবার চেষ্টা করেছি, কটা কামরা আছে দেখতে, কিন্তু গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার সারা জীবনভর হয় নি।
তাই আর গোনাও হয় না।অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে, ট্রেন চলে যাবার পর। তখন হু হু করে মন। ধূ ধূ করা কাকে বলে, হাড়ে হাড়ে বুঝি।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশানেই আজকাল আ্যালপ্রাজোলাম খাই। তা প্রায় নয় বছর হয়ে গেল। ঘুমের ওষুধের মৃদু ঝাঁকুনিতে, শরীর টা মনে হয় ট্রেনের কামরাতেই আছে।
ডাবলু পি ষ্টীম ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনে টানা মেল ট্রেনটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনেই একটা কামরা! প্রতিটা জানলায় জ্বলছে আলো।
-----
রাতের খাবারে ছিল- বড় বড় কই মাছের ঝোল, ডাল আর আলু ভাজা । সানকীতে রাখা লাল চালের ভাত থেকে এক মনমাতানো সুগন্ধ । পাশে আর একটা কাঁচের বড় সুন্দর রেকাবীতে রাখা বেশ কয়েকটা দানাদার ।
সাতক্ষীরায় এসে দানাদার না খাওয়া আর দোজখে যাওয়া নাকি একই ব্যাপার।
খাও খাও বাপজানেরা , যশুরে কই । মাথা মোটা হয় এদের । আমাদেরও তো লোকে বলে যশুরে কই ।
হা হা করে প্রাণ খোলা হাসি হাসান সাহেবের ।
বোজসো ! এবারে তো ধান ভাল করে রুইতেই পারি নাই ! কষ্ট করে খাও ।
গোবিন্দের রান্না করা মশুর ডালটা বেশ ঘন। ওপরে কাঁচা সরষের তেল হালকা করে ছেটানো । কুচি করা পেঁয়াজ আর দুটো করে কাঁচালঙ্কা সানকির এক পাশে রাখা ।
ডাল দিয়ে ভাত মেখে মুখে দিতেই জিভে অমৃতের স্বাদ । সারাদিন পেটে ভালো করে ভাত পড়ে নি কারও সেরকম ভাবে ।
ছোটমামা মুশুরের ডাল খেতে খুব ভালোবাসে । একটু করে মাখা ভাত মুখে দিচ্ছে আর কচর মচর করে পেঁয়াজ চিবোনোর শব্দ ।
আমাদের চার সানকি ভাত নিমেষেই উধাও প্রত্যেকের পেটের ভেতর ।
জলিল ভাই আমাদের খাওয়া দেখে বলল :- ভয় নেই । প্রচুর ভাত আছে।

(চলবে)