Tuesday, May 28, 2013

রোমন্থন

ভদ্রলোক সম্পর্কে যে খুব সবাই ভালো জানেন তা কিন্তু নয়তিনি সমরেশ,  সুনীল বা  হুমায়ুনের, মত জনপ্রিয় কোন লেখকও নন
হাতে গোনা যে কজন চেনেন, এই ভদ্রলোককে, তাঁরা খ্যাত নামা ঐতিহাসিক নামেই চেনেন । যখন, কলম ধরেন আমাদের মত পাঠকদের জন্য তখন, সেই লেখা পড়তে পড়তে একটা স্মৃতিমেদাতুর  হাসি মনে বুদবুদিয়ে ওঠে ।
আলী সাহেবের পর, এরকম মুজতবী কলম আমি অন্তত আর পাই নি । একজন রাশভারী ব্যক্তিত্ব যখন নিজের কথা লেখেন আত্মজীবনী হিসেবে, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় , ইনিই সেই ঐতিহাসিক ।
এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হবে তাদের মন আর মানসিকতা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারনার জন্ম হতে পারে।

লেখক এক জায়গায় বলছেন :-
আমার কাকা গেলেন কলকাতায়। সেখানে তিনি কাপড় কিনবেন। কলকাতার নিউমার্কেটে একটা দোকানে দোকানীর সাথে তিনি কথা বলছেন। দেখা গেল কাপড়ের দোকানদার তিনি নিজেও একজন বরিশালের মানুষ। আর যায় কোথায়? ঐ কাপড়ের দোকানদারও বুঝে ফেললেন যে আমার কাকা বরিশালের মানুষ। তাদের মাঝে দর কষাকষি শুরু হয়ে গেল।
কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ”দাম কত?” দোকানীর উত্তর এতকাকা বললেন, “দাম এত ক্যান? এই দামে তো নেওয়া যাবে না।দোকানীর উত্তর না নিলে না নিবেন, ঠেকলাম কিসে?”
এই হল বরিশালের মানুষের মন। একটা ইগো কাজ করে। আমরা যারা বরিশালের বিষয়টা আমাদের জন্য সহজ কিন্তু বাইরের অনেকেই হয়তো বিষয়টা ভুল বুঝতে পারে। যেমন ধরা যাক বরিশালের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম সবসময় খুব উঁচু। মনে হবে বুঝি রোম সভ্যতার পরই বরিশালের স্থান। জোয়ান বুড়া সবাই বরিশালের নামি ব্যক্তিত্বদের নাম মুখস্থ করে বসে আছে। একটু জিজ্ঞেস করলেই সব মুখস্থের মত বলে দেবে। আমাদের সময়ে ছাত্র মহলে প্রেমে ব্যর্থ যুবকদের বেশ কদর ছিল। তাদের কে কেমন জানি, একটু হিরো হিরো মনে হত। আর সে কারণেই বরিশালের সব যুবকরাই নিজেদেরকে রোমিও ভাবত। বুকের মধ্যে ভালোবাসা বেঁধে চিঠির সাথে ইটের টুকরা বেধে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে ঢিল দিত। আর সেই কখনো কখনো প্রেমিকার সামনে না পড়ে প্রেমিকার বাবার সামনে পড়লে তো বুঝতেই পার কি দুরবস্থা!! তবে আমরা সেই সব বীর যুবকদের নিয়ে গর্ব করতাম। বলতে গেলে প্রেম বিষয়টা বরিশালের একটা ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়েএকজন সফল প্রেমিকের ভাষায়, ” হ্যারে দেইখ্যা তপেরথমেই লাভে পড়িয়া গেলাম। হ্যার পর, নদীর ধারে দুই দিন ফলোকরলাম। তিনদিনের দিন একটু আন্ধার হইতেই ফোকাস মারলাম।
তিনি বরিশালের চাষি সম্বন্ধে লিখছেন :-
ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষি ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, “ক দেহি, মহারাণী ভিক্টোরিয়া এহন কি করতে আছে?
উত্তর, “হে কি আর আমাগো মত? পানি নাবতেই পান্তাভাত খাইয়া কাঁথা মুড়ি দিয়া উব্বুত।
বা, কোলকাতার হোস্টেলে প্লেন বিশেষজ্ঞকে আকাশে বিরাট একটা প্লেন দেখে , এটা কি ধরণের প্লেন যখন জিজ্ঞেস করা হয়, উত্তর আসে:- এয়ার ক্র্যাফট কেরিয়ার  !
অন্য জায়গায় লিখছেন :-  জেঠামশায়ের কথা- "একটু ইনডাইরেক্টলি কইয়া দিলাম আর কি !!!
জ্যাঠামশায় বরিশাল-কৃষ্টি সম্পর্কে অনেক কাহিনী শোনাতেন। ওঁদের ছোটবেলায় নাকি স্থানীয় ব্রাহ্মরকুসংস্কার-নিবারণী সভাস্থাপন করেন। জনহিতৈষী ব্রাহ্ম যুবকবৃন্দ প্রভাতফেরিতে বের হতেন, খোল-করতাল সহযোগে কুসংস্কার-নিবারণী কীর্তন করতে করতে,-(রাগ ভৈরবী, ঝাঁপতাল)
প্রভাতে উঠিয়া দেখ মাকুন্দ চো-ও-পা-আ।
বদন ভরিয়া বল ধোওপাআ, ধোওপাআ।

আবার লিখছেন :- হঃ, এরপর কইবেন "অগো বেঙ্গী, মগো বেঙ্গী আর জগদীশ্যা" আমার ছুডবেলার খেলার সাথী আছিল
“বরিশালী সংস্কৃতির সব চেয়ে লক্ষনীয় প্রকাশ প্রচণ্ড পৌরুষে ।
Machismo কাকে বলে ল্যাটিন আমেরিকার বাঘা বাঘা পুরুষ তথা মার্কিন গুণ্ডাবীর Rambo তা বরিশালবাসীর কাছে সাত জন্মে শিখতে পারে। এই machismo শুধু পুরুষ জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দামু কাকার দুই বৌ যখন সম্মিলিত শক্তি নিয়ে তাঁকে ঝাঁটাপেটা করতেন তখন সে দৃশ্য দেখলে অনেক পুরুষসিংহেরই পিতৃনাম বিস্মরন হত। আদর্শগত শুচিতা ভুলে নারী আন্দোলনকারিনীরা দামুরক্ষা সমিতিখুলতেন ।”
 



হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যায় ।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন । তাঁর বাঙাল নামায় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতি শ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙাল নামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)

“বাঙাল নামাঅথবা  “রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিতচর্চাগ্রন্থগুলোতো এখনো বাঙালির মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে যায় নি, নাকি?
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ বাঙাল নামার জন্য দুই বাংলার মানুষের অন্তরে যেন তিনি একটু বেশি পরিমাণেই আদৃত হয়ে আছেন।
নিউ ইয়র্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন :-
“দ্যাখো, আমি বরিশালের একজন মানুষ হিসেবে গর্বিতবরিশালের সেই সব স্মৃতি গুলো আমার জন্য শুধুই কোন নস্টালজিক বিষয় না। এই স্মৃতিগুলো আমার প্রতিদিনের জীবনের নিত্য খোরাক। আমি এই স্মৃতির মাঝেই প্রতিদিন বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি। একটা কথা বুঝতে হবে বরিশালের আলো-হাওয়ায় আমার শিরের শিরা-উপশিরায়। তাদের প্রতিদিনের জীবনের খুনসুটি, ইগো, যাই বল না কেন সব কিছুই কিন্তু আমি ধারণ করেই আমার এই যাপিত জীবন। আমার ছেলেবেলা কাটিয়েছি বরিশালে। আমার শৈশব স্মৃতি আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ নিয়ে কথা বললে এর শেষ করা যাবে না। শেরে বাংলা এক বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন। তবে আমার মনে হয় অনেক বরিশালিরাই হয়তো এই বিশাল মাপের মানুষকে সঠিক ভাবে চিনতে পেরেছিলেন। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি যে শেরেবাংলা কত দূরদর্শী ছিলেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বর্তমানে যে কোন রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে বিরল। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হবে তাদের মন আর মানসিকতা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারনার জন্ম হতে পারে।আমরা বলি বৃটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটা বিবাধের দেয়াল তুলে দিয়ে গেছে। আমি কিন্তু এটা বিশ্বাস করি না। বৃটিশ আসার আগেও হিন্দু-মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক খারাপ ছিল। আসল বিষয়টা হল ধর্ম মানেই এমন। আমরাটাই শ্রেষ্ঠ। তবে হ্যা, এই ধর্মকে কেন্দ্র কে আমাদের সাম্য কতটুকু ব্যাহত হয়েছে সেটা হল কথা। আমি বলব অনেকটুকুই। এই দেশ ভাগের কোন ফসল আমরা পাই নি। দেশ ভাগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উত্তর ভারতের মুসলমানদের। এখনো পর্যন্ত মারামারি কাটাকাটি লেগেই আছে। আমি কিছুদিন আগে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। ভাবতেই পারবেন না আমি সেখান থেকে কি যে ভালোবাসাটা পেয়েছি। একটা পাঞ্জাবীর দোকানে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার পর  বিল দিতে যাব। এই দেখে পাঞ্জাবী চায়ের স্টলের মালিক আমাকে কিছুক্ষণ তিরস্কার করলেন। তারপর চায়ের বিল দিতে আমাকে নিভৃত করলেন। আমরা তখন কেউ ভাবিনি যে আমি হিন্দু আর উনি মুসলমান। কথা হল সাধারন মানুষের ভালোবাসায় কে হিন্দু আর কে মুসলমান এই সব নেই। ধর্মকে মানুষ ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমরা এই সাধরণ মানুষরা কিন্তু এর করুণ শিকার ছাড়া আর কিছুই না। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য এই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সত্যটাতো একদম জলের মতই পরিস্কার
"বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের শরীয়ত-সুন্নাহ, পুজো-অর্চনা জীবনপ্রবাহ আর ইতিহাস মিলে গড়ে ওঠা ভাব-সংস্কৃতিই এখানে জীবন দর্শন। হিন্দু ব্রাহ্মণ কিংবা মুসলমান মৌলভী আর ব্রিটিশ সাহেবদের ভদ্র পোশাকি রাজনীতি অর্থনীতি অথবা প্রথাগত সমাজ সংস্কৃতির নগ্নরূপ এখানে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করেছে। মানবিক সম্পর্ক ফেলেছে সঙ্কটে। জনগণের ধর্মবোধ মানুষকে পৌঁছে দেয় মনুষত্ববোধের কাছে। সেখানে মানিয়ে চলার নামই উদারতা। মরুভূমির কঠোর ধর্মাচরণ নয়, দ্বীপের এই বাংলাদেশ পলিমাটির মননে জীবন্ত। এখানে ধর্ম তলোয়ারের জোরে নয়, পারস্য সভ্যতার নরম মেজাজে এসেছে। লালন ফকির আর আজমীরের মতো পীর ফকির দরবেশ আউলিয়াদের দরগায় হিন্দু-মুসলিম সব বাঙালীর ভ্রমণ আজও দৃশ্যমান। বাঙালী হিন্দু-মুসলিমের ধর্ম দর্শনে উন্মাদনার জায়গা ক্ষীণ, তবে সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে প্রথাগতদের বিরোধ ছিল। বাংলা সাহিত্যের ভিন্ন সুরে বাঙালী কেবলই আবেগের। সেখানে মনুষত্বের সংস্কৃতিরই আধিপত্য।"

অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী একজন ভারতীয় ইতিহাসবেত্তা যিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি দীর্ঘকাল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা বিষয়ে শিক্ষকতা করার পর বর্তমানে অক্সফোর্ডের সেইন্ট এন্টনী কলেজে এমিরিটাস ফেলো হিসেবে সংযুক্ত আছেন। তাঁর জন্ম ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, বাংলাদেশের বরিশালে, কীর্তিপাশায়, এবং সেখানেই তাঁর স্কুল জীবন অতিবাহিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে ছেড়ে তারা ভারতে চলে আসেনঅতঃপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন এবং উভয বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. ফিল. ডিগ্রী লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকেঁ সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান করে। জীবনের শুরু থেকেই তপন রায় চৌধুরী শিক্ষকতাকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় তাঁর বহু গ্রন্থ এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
=
আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার রইলো অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী
র প্রতি । পাঠকদের অনুরোধ- তাঁর বইটা পড়ে দেখুন ।
=
তথ্য :- ইন্টারনেটে প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকার এবং “বাঙাল নামা,  “রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিতচর্চা








Monday, May 27, 2013

রামদাস তপস্বী

প্রায় দুই শতাধিক বৎসর পর রামদাস বাবাজী, যোগনিদ্রা হইতে গাত্রোত্থান করিলেন!
যোগের প্রভাবে তাঁহার গৌরাঙ্গ কান্তি, অনিন্দ্যসুন্দর! দেখিলে, ত্রিংশ বৎসরীয় যুবার ন্যায় প্রতিভাত হইতেছে।
মৃত্তিকা গহ্বরে প্রোথিত পেটিকা হইতে দেহকে নিষ্ক্রামিত করিয়া শির উপরে নেওয়ার জন্য চেষ্টিত হইলে, কঠিন প্রস্তর সদৃশ কিছুতে মস্তক বাধাপ্রাপ্ত হইল। কিয়ৎক্ষণ চেষ্টা করিলেও যখন হইলো না, তখন রামদাস, যোগবলে মৃত্তিকার ওপরে নিজেকে প্রক্ষিপ্ত করিলেন।
রাত্রি ধরিত্রীর ওপর নামিয়া আসিয়াছে। রাকার ক্ষপা হইলেও চন্দ্রমার দর্শন না পাওয়াতে রামদাস বিব্রত হইলেন! চতুর্দিক আলোকজ্জ্বল কিন্তু, ইহার উৎস কি!, তাহা রামদাসের বোধগম্য হইল না।
রাজপ্রাসাদের ন্যায় চারিপার্শ্বে সুরম্য বাটীসকল দর্শনে সুখ বোধ হইতেছে! অকস্মাৎ একটি অশ্ববিহীন সকট সশব্দে রামদাসের নিকট দণ্ডায়মান হইলে, সকটের বাতায়ন হইতে এক ব্যক্তি, জিহ্বা ঈষৎ জড়িত অবস্থায় বিজাতীয় বঙ্গভাষায় রামদাসের প্রতি বাক্য প্রয়োগ করিল। রামদাস প্রথমে বুঝিতে পারিলেন না।
এই শালা! ধিনিকেষ্টর মত মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি করছিস বে! একটু হলেই শ্লা কেস খেতাম! শ্লা, খালি গায়ে আবার লাল কাপড় পরেছে! ফিল্ম শুটিং নাকি বে!
রামদাস এইরূপ মিশ্রিত যাবনিক বঙ্গ ভাষা শ্রবণ করিয়া, হতবুদ্ধি হইলেও মুহূর্তে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া কহিলেন- মহাশয়! এই স্থানটিতে আমি নবাগত নই, তথাপি এইসকল পরিবর্তন দেখিয়া আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমি বর্তমানে কোথায়?
-
শ্লা!!!! রাত দুটোর সময় হাতিবাগানে লাটক করছে! আ্যাই কি ভাষায় কথা বলছিস বে?
-
এই স্থান, হাতিবাগান?
-
আবে! সর তো! যেতে দে! পুলিস দেখলে কেস খাবো! সর বে!
রামদাস পথি পার্শ্বে সরিয়া গেলেন। পরে বুঝিলেন, ব্যক্তিগণের সকলেই সুরাপ্রভাবে এইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিয়াছে। সাতিশয় পিপাসার্ত বোধ করিতেছেন, রামদাস!! কিঞ্চিৎ ক্ষুধারও উদ্রেক হইতেছে। ইচ্ছায়া নিরঙ্কুশত্বাচ্চ!! মনে পড়িল! অর্থাৎ- ইচ্ছার নিয়ামক নাই। জল এবং খাদ্যের জন্য তিনি অত্যন্ত লালায়িত। তিনি বুঝিলেন, তাঁহাকে নিরন্তর ক্লেশ সহ্য করিতে হইবে। যোগনিদ্রা কালে এইসকল ক্লেশ অনুপস্থিত ছিল। অকস্মাৎ এক দিব্যপুরুষ তাঁহার নিকট দেবতার ন্যায় আবির্ভূত হইলেন। তিনি কহিলেন:- হে রামদাস! আপনি সিদ্ধপুরুষ। কলিকাতা শহরের বর্তমান অবস্থায় আপনার প্রয়োজন হেতু আপনার যোগনিদ্রা ভঙ্গ করিয়াছি। আপনার কতর্ব্যসমূহ আমি পরে নিবেদন করিব। এক্ষণে, আপনি এই তপোবন সুলভ ফল এবং সুশীতল জল গ্রহণ করুন। রামদাস ফল এবং সুশীতল জল গ্রহণ করিয়া, ক্ষুধানিবৃত্তি এবং পিপাসাশান্তি করিলেন।
ক্ষুধানিবৃত্তি ও পিপাসানিবৃত্তি হইলে পরে, সেই দেবোপম পুরুষ কহিলেন:-
হে, যোগরাজ! আপনার, অতি অদ্ভূত মনোহর মূর্ত্তি এবং প্রভূতমাধুরীপূর্ণ ভাবভঙ্গী দৃষ্টি নন্দন হইলেও আপনার বেশভূষা সাধকের। এইরূপ বেশভূষা, বর্তমানে, কিছু ব্যক্তি স্বীয়কে; দৈবজ্ঞ বলিয়া প্রচার করতঃ, ধারণ করে। উহারা তস্কর জাতীয়। এতদ্ অঞ্চলে এইসকল ব্যক্তিদের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। আপনাকে, আমি কিছু ইঙ্গরেজী বেশভূষা প্রদান করিতেছি। বর্তমানে এই জম্বুদ্বীপ ইঙ্গরেজী কবলমুক্ত। জম্বুদ্বীপের এই অঞ্চলটি,আপনি যাহাকে বঙ্গদেশ বলিয়া জানেন, তাহা দ্বিখণ্ডিত। বঙ্গদেশের পূর্বাঞ্চলটি বর্তমানে বাংলাদেশ নামক একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র।
দেবোপম পুরুষের দীর্ঘ ভাষণ শ্রবণে, রামদাস ক্লান্তি বোধ করিতেছিলেন। তিনি কহিলেন:-
হে মহাপুরুষ! আমি, অকন্টকে ও সুখে যোগনিদ্রায় সমাহিত ছিলাম। অপরাপর লোকে, যেরূপ পার্থিব সুখসম্ভোগের অভিলাষ করে, তাহা হইতে মুক্তি পাইতে এবং ব্রহ্মজ্ঞান লভিবার জন্য , আমি এই সাধনায় রত এবং তদ্বিষয়ে পূর্ণাভিলাষ পাইতে ইচ্ছুক! আমাকে এই চরম, সর্বজনপ্রার্থনীয়,অনির্বচনীয় সুখ হইতে কেন বঞ্চিত করিতেছেন?
দেবোপম পুরুষ কহিলেন:-হে তপস্বী! আপনি বিচলিত হইবেন না! যথাসময়ে আপনার অভিলাষ পূর্ণ হইবে। বর্তমানে আপনি ক্লান্ত! আমি যোগবলে আপনার শয়নের ব্যবস্থা করিতেছি। গভীর নিদ্রা সহকারে আপনি বাকী রাত্রিযাপন করুন। আমি, প্রভাতে আপনার কল্যবর্ত লইয়া আসিব। তৎপরে, আপনার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিব।
এই বলিয়া, দেবোপম পুরুষটি অন্তর্হিত হইলেন। রামদাস তপস্বীও সেই দেবোপম পুরুষের কৃত ব্যবস্থাতে গভীরভাবে নিদ্রাকর্ষিত হইয়া শয়ন করিলেন।
রভাতে রামদাস তপস্বীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিতে হইবে। সেই দেবপোম পুরুষটি পুনরায় আবির্ভূত হইলেন।
কহিলেন:- হে সাধু! আপনার বিপরীতে যে কক্ষটি দেখিতেছেন, তাহাতে প্রবেশ করুন। কক্ষটিতে, উষ্ণ এবং শীতল জলের, মলত্যাগের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থাদি উপস্থিত।
রামদাস কহিলেন:- মহাশয়, কিন্তু এই স্থানটিকে কি বলে?
-
ইহাকে ইঙ্গরেজীয় ভাষায় হোটেল কহে। যাহাকে আপনি সরাইখানা কহেন। বর্তমানে বঙ্গীয়গণ আর সরাইখানা শব্দটি ব্যবহার করেন না! হোটেল শব্দটিও সর্বজনসম্মতভাবে বঙ্গ ভাষায় স্থান করিয়া লইয়াছে। আর যে কক্ষটির কথা কহিলাম- তাহাকে বাথরুম বা টয়লেট কহে। উভয় শব্দই- ইংলণ্ডীয় যাবনিক!
রামদাসের তলদেশের চাপ অসহ্য হওয়াতে, সত্বর ওই বাথরুমে প্রবেশ করিলেন।
চাপমুক্ত হওয়ার পর, রামদাসের জলের প্রয়োজন। স্নানও করিবেন!!! কিন্তু তিনি বুঝিতে পারিতেছেন না, কোথা হইতে জল পাওয়া যাইবে!!!!!!! অগ্রভাগে একটি বর্তুলাকার শিরস্ত্রাণ সহ নালিকা রহিয়াছে। অন্যমনস্ক ভাবে সেই বর্তুলাকার শিরস্ত্রাণটি দক্ষিণাবর্তভাবে ঘুরাইতেই, ধারাপাতের ন্যায়, অবিরাম জল পড়িতে লাগিল। রামদাস, পরিচ্ছন্ন হইলেন। দন্তমার্জন করিতে হইবে! নিকটে দেখিতে পাইলেন একটি মুকুর! উহাতে, কঙ্কতিকা সহ আরও কিছু পদার্থ রহিয়াছে। বুঝিতে পারিতেছেন না কি করিবেন! অকষ্মাৎ দৈববাণী হইল! ( পরে জানিয়াছিলেন- উহা ইঙ্গরেজীয় ভাষায় টেলিফোন)
মহাশয়, আপনার সামনে একটি নাতিদীর্ঘ বর্তুলাকার, রক্তিম শিরস্ত্রাণ সহ পদার্থ রহিয়াছে। উহাকে টুথপেষ্ট কহে। আরও একটি অনতিদীর্ঘ বস্তু রহিয়াছে- উহাকে টুথব্রাশ কহে। টুথব্রাশ টুথপেষ্ট লইয়া দন্তমার্জন করুন। রামদাস আশ্চর্য হইলেন! নিম্ববৃক্ষের নাতিদীর্ঘ শাখার প্রয়োজন দন্তমার্জনে আর নাই!
এক্ষণে স্নান করিতে হইবে। উঠিয়া দেখিতে পাইলেন-অবিকল সেইরূপ আর একটি বর্তুলাকার শিরস্ত্রাণ! সেইটি আবার, দক্ষিণাবর্তভাবে আবর্তন করিতেই, ধারাপাতের ন্যায় তাঁহার মস্তকের উপর জল পতিত হইতে লাগিল!
অহো! বাথরুমের কি মহিমা!
নিকটে পুষ্করণী, দিঘী বা নদী নাই, তথাপি জলধারা! ইহারা কি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছে? যদি, তাহাই হয়, তা হইলে আর আত্মার হিতসাধনে কষ্ট করিয়া সাধনার প্রয়োজন কি?
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে, পুনরায় বামাবর্ত ভাবে বর্তুলাকার শিরস্ত্রাণটি  আবর্তন করিলেন।জলপ্রপাত বন্ধ হইল। রামদাস আনন্দে উচ্ছলিত হইলেন। এক্ষণে, গাত্রমার্জন করিতে হইবে! নিকটেই একটি কুলুঙ্গি সদৃশ থাকে কার্পাস বস্ত্র দেখিতে পাইলেন! উহা দ্বারাই গাত্রমার্জন সম্পূর্ণ হইল। ওই কার্পাস বস্ত্রটি ই পরিধান করিয়া তিনি বাথরুম হইতে নির্গত হইলেন!
নির্গত হইতেই রামদাস দেখিলেন, সেই দেবপোম পুরুষটি একটি অন্যরকমের কেদারাতে উপবেশন করিয়া আছেন। তাঁহার সন্মুখে একটি কাষ্ঠনির্মিত উচ্চাসন। তদুপরি বিভিন্ন স্ফটিক সদৃশ থালিকায় প্রভূত খাদ্যবস্তু! তবে, একমাত্র অণ্ড ব্যতীত সবই তাঁহার অজানা। স্ফটিক সদৃশ কিছু উচ্চ পাত্রে বিভিন্ন বর্ণের জলীয় পদার্থ রহিয়াছে। একটি থালিকায়, পীতবর্ণের গোলাকার ভর্জিত বস্তু রহিয়াছে! তাহার উপর পলাণ্ডু ও মরিচের ফালিকা শোভাবর্দ্ধন করতঃ, সুঘ্রাণে, কক্ষটি আমোদিত!
ত্রিকোণাকার বেশ কয়েকটি শুভ্র বস্তু দেখিতে পাইলেন। বাকীগুলি, খাদ্যগ্রহণ কালে জানিয়া লইবেন বলিয়া মনস্থ করিলেন। গতরাত্রে, ফলাহার করিয়া, ক্ষুন্নিবৃত্তি হইলেও, উদর পূর্ত্তি হয় নাই!
স্নানান্তে, অলক অবিন্যস্ত রহিয়াছে। তিনি অদূরেই দেখিলেন, একটি উচ্চাসনে মুকুর এবং কঙ্কতিকা! মুকুরের সন্মুখে, তিনি কঙ্কতিকা সহযোগে কেশ পারিপাট্য সমাপন করিলেন।
দেবপোম পুরুষটি আর একটি কেদারা রামদাসের সন্মুখে রাখিলেন। রামদাস অবাক হইয়া দেখিলেন- কেদারার তলদেশে চারিটি চক্র রহিয়াছে। বিস্ময় আর প্রকাশ করিলেন না। বুঝিলেন- আরও বিস্ময় বাকী রহিয়াছে।
দেবপোম পুরুষটি কহিলেন- প্রভু রামদাস! আপনি কি কুক্কুট মাংস ভক্ষণ করিবেন?
রামদাস কহিলেন- শাস্ত্রে, বিবিধ মাংসাদি ভক্ষণের উপর কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা নাই! তবে, উহা ইষ্টদেবতাকে নিবেদন করিয়া ভক্ষণ করিতে হইবে এবং স্ত্রীপশুর মাংস ভক্ষণ নিষেধ।
-
আপনি যদি এই বিষয়ে আলোকপাত করেন, তাহা হইলে দেবকুলও বাধিত হইবে।
-
বিভিন্ন শক্তিপূজাতে যে অষ্টবিধ মহামাংস নিবেদন করিবার প্রথা আছে, তন্মধ্যে প্রথমেই বিধান রহিয়াছে; গোমাংসের! তবে, বর্তমানে আমি ক্ষুধার্ত। কল্যবর্ত্য ভক্ষণ করিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি পূর্বক আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিব।
-
মহাশয়, কল্যবর্ত্য কহিলে কেহ বুঝিবে না! ইহাকে বর্তমানে বঙ্গীয় সমাজ ব্রেকফাষ্ট কহে।
প্রথমেই রামদাস বলিলেন- আমি পিপাসার্ত! কিরূপ পানীয় গ্রহণ করিতে পারি?
-
আপনি, আপনার সন্মুখে যে পানপাত্রগুলি দর্শন করিতেছেন,তাহাতে বিবিধ পানীয় রহিয়াছে। ইচ্ছামত পান করুন।
-
বুঝিলাম। কিন্তু এই স্ফটিক সদৃশ পানপাত্রগুলিকে বর্তমান বঙ্গীয় সমাজ কি নামকরণ করিয়াছে?
-
ইঙ্গরেজীয় ভাষায় ইহাদিগকে গ্লাস বলে। কিন্তু, ইহা সমধিক পরিচিত গেলাস হিসাবে।
-
কারণ?
-
উচ্চারণে জিহ্বার জড়তা হেতু! আপনি সম্যক রূপে অবগত আছেন, বঙ্গীয় সমাজ আলস্যপ্রিয়, সেইহেতু, জিহ্বাতেও আলস্য প্রতীয়মান!
-
হুম! ওই গ্লাসে পীত বর্ণের তরল পদার্থটি কি পানীয়!
-
হ্যাঁ! তপস্বী! উহা সহকার নির্য্যাস। ব্রেকফাষ্ট গ্রহণকালে নির্য্যাস অবশ্য গ্রহণীয়।
-
সহকারের অর্থ যে আম্র, তাহা কি বঙ্গীয় সমাজের বিদিত না, অবিদিত!
-
সাধারণ বঙ্গীয় সমাজ বর্তমানে সংস্কৃত ভাষায় পারঙ্গম নহে। ইঙ্গরেজীয় ভাষা শিক্ষা করিতে গিয়া, তাহাও সম্যক রূপে আয়ত্ত করিতে পারে নাই, আর মাতৃভাষাও সম্যক কহিতে পারে না! সংস্কৃতের দিন অস্ত গিয়াছে! কতিপয় লোক ইহাকে শিক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছেন বটে, তবে তাহাদের মানসিক ভারসাম্যহীন রূপে প্রতীয়মান করিতে সবাই সচেষ্ট।
-
কিছু বর্তমান বাংলা ভাষার উদাহরণ দিতে পারিবেন?
-
স্বচ্ছন্দে!
-
বলুন। অবগত হই!
-
প্রথমেই আমি শিক্ষিত বঙ্গীয় সমাজের বাংলার উদাহরণ দিতেছি। সম্যক শ্রবণ করুন।
-
যথা?
-
আমাদের এই পুওর ইণ্ডিয়াতে, কাল্টিভেশন আ্যাণ্ড ইনডাস্ট্রিয়ালাইজেশন সাইমেলটেনিয়াসলি মেনটেইন করা উচিত।
-
আমি তো মাত্র চারটি বাংলা শব্দ বুঝিতে পারিলাম। আমাদের, এই, করা এবং উচিত। বাকীগুলি মনে হয় ইঙ্গরেজীয় ভাষা। যোগনিদ্রায় যাইবার পূর্বে এই শব্দগুলি শুনিয়াছিলাম, এমত বোধ হইতেছে।
-
ঠিক, প্রভু! ইণ্ডিয়া অর্থ ভারত, কাল্টিভেশন অর্থ কৃষি, আ্যাণ্ড অর্থ এবং, ইনডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অর্থ শিল্পায়ন, সাইমেলটেনিয়াসলি অর্থ একসঙ্গে, মেনটেইন অর্থ পালন করা।
-
হুম! এযে কৃষরান্ন!!!!!!!!!
-
হ্যাঁ প্রভু! খিচুড়িই বটে! কৃষরান্ন অর্থাৎ খিচুড়ি খাইতে যেরূপ সুমধুর, সেইরূপ এই কৃষরান্ন স্বরূপ বাক্যগুলি অনর্থক কর্ণ কণ্ডুয়ন করে!!!!!
- হুম! বুঝিলাম!
রামদাস পানপাত্রের সহকার নির্য্যাস কিছুটা গ্রহণ পূর্বক বলিলেন।
-
মহোদয়! আপনি অপরাপর বর্তমান বঙ্গভাষার উদাহরণ দিন!
-
কাল যা কিচাইন হলো না মাইরী! বাড়ীতে বডি গ্যারেজ করেছি আর শালার বউ আমার ঘ্যাচাং করে ধরেছে! প্রচুর মাল টেনেছিলাম তো! কি কেলো!! আমি শালা খণ্ড ত। বউয়ের কাছে আর মাইরী পেঁয়াজী করতে পারলাম না! কোথায় শালা মাল খেয়ে- দিল বাগ বাগ হয়ে যাবে, তা নয়- হোল নাইট খালি ভ্যাদারাং ভ্যাদারাং শুনে লাইফটা হেল হয়ে গেল!
-
হুম। অর্থ বলুন!
-
হে তপস্বী! ইহার অর্থ কহিতে গেলে আমি নিজেই অযোগবাহ বর্ণ হইয়া যাইব। আপনি বরং মৎ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ইহার অর্থ বুঝিয়া লহেন।
-
হুম! বুঝিলাম। কিন্তু এইরূপ ভাষা প্রয়োগের কারণ?
-
শ্লা! গুষ্ঠি মারি তোর এই কারণের!!!
-
ইহা কি ভদ্রজনোচিত ভাষা?
-
না প্রভু! ইতরজনের ভাষা বা কহিতে পারেন- সুরাপানের প্রভাবের ফল!
-
আপনি কি প্রভাতেই সুরাপান করিয়াছেন?
-
কি করিতে পারিতাম প্রভু! ইঙ্গরেজীয় ভাষায় একটি প্রবাদ আছে- A man is known by the company he keeps!
-
আপনার প্রদত্ত্ব ক্ষমতাবলে ইহার অর্থ বুঝিলাম! কিন্তু, এ স্থলে যে Company শব্দটির প্রয়োগ করিলেন, তাহা কি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী?
-
নিকুচি করেছে ( স্বগতোক্তি) প্রভু, আপনি কি স্যাণ্ডউইচ ভক্ষণ করিবেন না?
-
স্যাণ্ডউইচ? অর্থাৎ-বালির ডাইনী?
-
এই গেঁড়েটাকে আমার ক্ষমতা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে!
-
কিছু কি কহিলেন?
-
না! না! ওই ত্রিকোণাকার বস্তুটি স্যাণ্ডউইচ! দুখানি ব্রেডের ভেতর কুক্কুট মাংসের পুরু স্তর!
-
বেড না ব্রেড!!!!!
-
পূর্বে, পর্তুগীজ প্রভাবে ইঙ্গরেজীয়রা ইহাকে লোফ কহিত। বর্তমানে ইহাকে ব্রেড কহিয়া থাকে! ( বুঝলিরে গেঁড়ে! উফ্)
রামদাস সেই দেবোপম পুরুষটিকে কহিলেন- প্রভু, আপনার শুভ নামটি জানিতে পারি কি?
-
আমি সোমদত্ত! এই নিন আমার কার্ড।
রামদাস চমকিত হইয়া , সেই আয়তাকার কাগজটি গ্রহণ পূর্বক, প্রথমে কিছু বুঝিতে পারিলেন না! পরে, সোমদত্ত প্রদত্ত ক্ষমতা বলে পড়িতে পারিলেন। চমৎকার ভাবে লেখা আছে:-
SOMDUTTA
Correspondent and Adviser to Lord Shiva
(Region:
West Bengal, India, Earth)
Cell # 0000420840 (Toll free)
রামদাস কহিলেন
-
মহাশয়, আপনার হস্তলিপি মনোহর, ইহাতে সন্দেহ নাই!
-
প্রভু, আপনার প্রমাদ হইতেছে। ইহা স্বীয় হস্তলিপি নহে! যন্ত্রগণকের দ্বারা মুদ্রিত।
-
অতীব আশ্চর্যের! এই যন্ত্রগণক কি?
-
প্রভু! আপনার ব্যাকরণ জ্ঞান প্রশ্নাতীত! পাণিণির প্রত্যাহার সূত্রের অবলম্বনে এই যন্ত্রগণক নির্মিত। এই যন্ত্রগণক; দেব, দেবর্ষি,ব্রহ্মর্ষি, যক্ষ,উরগ,প্রভৃতির দ্বারা প্রকীর্ত্তিত। যন্ত্রগণক,সত্য-পবিত্র-মঙ্গলপ্রদ-পরিচ্ছেদাতীত-কালত্রয়ে অধিকৃত-জ্যোর্তিময়-সনাতন। পণ্ডিতেরা এই যন্ত্রগণকের অলৌকিক কর্মসকল কীর্তন করিয়া থাকেন। যতিগণের আর সমাহিত হইবার প্রয়োজন পড়ে না।
-
তাহার পর?
-
ধ্যন এবং যোগবলের আর প্রয়োজন নাই। পণ্ডিতেরা এই যন্ত্রগণকের দ্বারা দর্পণতলগত প্রতিবিম্বের ন্যায় নিজেকে প্রত্যক্ষ করেন।
রামদাস দীর্ঘনিশ্বাসত্যাগ পূর্বক এই যন্ত্রগণকের প্রতি মোহাবিষ্ট হইয়া কহিলেন
-
সোমদত্ত, আমি বৃথাই যোগনিদ্রায় সমাহিত ছিলাম। এই সকল বৃত্তান্ত শুনিয়া এবং রসনাসুখকর এই সব খাদ্যসম্ভারে উদর পূর্ত্তি হইয়াছে। এক্ষণে, স্বীয় কর্তব্য কি?
সোমদত্ত কহিলেন
-
হে তপস্বী, আপনাকে প্রথমে বেশভূষা বদল করিতে হইবে। আমি, আপনার নিমিত্ত বর্তমান বঙ্গীয় সমাজ যে সকল বেশ পরিধান করে, তাহা লইয়া আসিয়াছি!
-
কি বার্তা শুনাইলেন!
-
হ্যাঁ প্রভু! বর্তমানে বঙ্গীয় সমাজ আর ধূতি, শাড়ী, মেরজাই পরিধান করেন না!
-
পরিবর্তে কি পরিধান করেন, তাঁহারা?
-
বর্তমানে, ইউনিসেক্স বেশ প্রকীর্তিত।
-
এই ইউনিসেক্স কি?
-
ইউনিসেক্স অর্থ- উভলিঙ্গ। এই সকল বেশ পরিধান করিলে, পশ্চাৎ ভাগ হইতে, কে মহিলা আর কেই বা পুরুষ; নির্ধারণ করিতে পারিবেন না! পুরুষগন মহিলাদের ন্যায় অলকরাজি বিস্তৃত করিয়া রাখেন আর মহিলারা পুরুষগণের ন্যায় দামসকল মস্তকে শোভিত রাখেন। আপনি, শাস্ত্রজ্ঞ-মেধাবী-বুদ্ধিমান- ত্রিগুণাতীত ও পরম প্রাজ্ঞ। আপনাকে আর অধিক কি কহিব?
-
হুম! ধূতি, শাড়ী, মেরজাই- তোমাদের দিন গিয়াছে!
-
না প্রভু! দিন যে চলিয়া গিয়াছে, এমত নহে! কেবল- বিবাহ, রবীন্দ্রজন্মদিনে, একলা বৈশাখে থুড়ি পয়লা বৈশাখে, দোলপূর্ণিমায় এবং কিছু কিছু বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে, শিক্ষক/শিক্ষিকা, অধ্যাপক/অধ্যাপিকাগণ এই সমস্ত পরিধান করেন। মনে রাখিবার জন্য ইঁহারা সর্বদা সচেষ্ট!
-
হুম! দাও কি লইয়া আসিয়াছ!
সোমদত্ত কহিলেন
-
প্রভু, আপনাকে একটি দুঃসংবাদ দি! এই কলিকাতা নগরে, ঘনা ভশ্চাজ নামক এক দুস্কৃতিকারী যন্ত্রগণকের দ্বারা আমাদের এই সকল কার্যকলাপ এবং বার্তাসকল লোকচক্ষে আনিবার নিমিত্ত লিপিবদ্ধ করিতেছে।
-
এই ঘনা ভশ্চাজটি কি রকম ব্যক্তি?
-
মহামূর্খ-চতুর। নিজেকে মহাপণ্ডিত ভাবে! গদ্য একদমই লিখিতে পারে না! অথচ আমাদের কথপোকথন লিপিবদ্ধ করিতেছে। তৎসম শব্দবহুল এই সকল কথপোকথন সঠিক লিপিবদ্ধ করিতে পারিবে কিনা, সন্দেহ আছে। তদুপরি, সুরাপ্রভাবে তাহার নয়নদ্বয় সর্বদা পঞ্চদল বজ্রপুষ্পের ন্যায় রক্তিম!!!! অতএব আমরা বর্তমান বাংলা ভাষায় কথপোকথন করিলে উত্তম হইবে।
-
এই ঘনা ভশ্চাজটিকে রোধ করা যাইবে না?
-
অসম্ভব! যন্ত্রগণকের অপার বলে, সে বলীয়ান! ইতমধ্যেই সে আমাকে দূরভাষে, পঞ্চদল বজ্রপুষ্পের অর্থ জিজ্ঞাসা করিয়াছে!
-
তুমি কি উত্তর দিলে?
-
কি আর বলব? বললাম- ওরে ঘনা!!! পঞ্চদল বজ্রপুষ্পের মানে হলো পাঁচ পাপড়ীর জবাফুল!
রামদাস বললেন:-
-
আচ্ছা! এই ঘনা ভশ্চাজের জীবিকা কি?
-
পুরুতগিরি!
-
বলো কি হে!
-
হ্যাঁ! ঠিকই বলছি! সরস্বতী আর লক্ষ্মী পূজোর সময়ে পুরুতের অভাব পড়ে! বুইলেন তো!
-
হুম!
-
তো সেই সময়, ব্যাটা সারা বছরের ইনকাম টা করে নেয়!
-
কি রকম?
-
আমি একবার গিয়েছিলাম, পূজো করাতে!
-
কি বলল?
-
বলল, দক্ষিণা কত?
-
কত দিতে হবে?
-
হাজার টাকা আর ঠিক আড়াই মিনিট পূজো করবো, রাজী?
-
তুমি রাজী হলে?
-
উপায় কি বলুন? কোনো পুরুতই তো আর রাজী হয় না!
-
তারপর?
-
ব্যাটা তো, সকাল ৮ টায় আসবে বলে, বেলা ১২ টায় এলো! এসেই ভুলভাল মন্ত্র পড়া শুরু! তো আমি বললাম- ঘনাদা আপনি মন্ত্রের মানে জানেন?
-
কি বলল?
-
বলল, হ্যাঁ জানি!
-
তো কি বলল?
-
বলবে আর কি? ব্যাটা চশম খোর! বলে কি- আরও পাঁচশ টাকা লাগবে!
-
কি বললে তুমি?
-
রাজী হলাম, ওর বিদ্যের দৌড়টা দেখতে!
-
শুরু করল! ওঁ বিষ্ণু, তদ্বিষ্ণুঃ পরমংপ্রদং, সদা পশ্যন্তি শুরয়, দিবীব চক্ষুরাততম্।
-
মানেটা কি বলল?
-
ওঁ বিষ্ণু= একটা বাঁশ, তদ্বিষ্ণুঃ পরমংপ্রদং= তার চেয়েও বড় বাঁশ পরমভাবে প্রদান কর, সদা পশ্যন্তি শুরয়= সব সময় দেখে শুনে দিবি, দিবীব চক্ষুরাততম্ = দিবি, দিবি, চক্ষুলজ্জা করবি না!
-
আমি বললাম, এটা কি হলো?
-
বলল, কি আর হবে? তোকে বাঁশ দিয়ে দেড়হাজার টাকা গাপ করে দিলাম! আমাদের ঋষি- মুনিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন।
আমার মা বলল- ঘনাদা, একটু ফল টল খেয়ে যান!
কি বলল জানেন?
কি?
বলল- কর্মণ্যে বাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন!
মা গদগদ হয়ে বলল- এর মানে কি, ঘনাদা?
কর্মে অকর্মণ্য হয়ে পড়লে মাকে আর ফল দেবে না!
মা খুশী হয়ে আরও পাঁচশ টাকা দিয়ে দিল!
বল কি হে!!!
তবে, আর বলছি কি? তবে. রামদাসবাবু, আর PNPC নয়, যান, এবার ড্রেস আপ করে নিন।
সোমদত্ত, রামদাসের দিকে প্রথমে একটি আট পকেটের ফেডেড জিন্সের ট্রাউজার এগিয়ে দিল!
রামদাস জিজ্ঞেস করলেন- কিভাবে পরিধান করিব?
-
আবার সাধু বাংলা বলে!!! ও! ও! ও!
-
আচ্ছা, আচ্ছা, চালু বাংলাই বলছি, কিন্তু ওই ও! ও! ও! টা কি?
-
বকা দিলাম আপনাকে!
-
বুঝেছি! কিন্তু কোমোরে যে ঢলঢল করছে!
-
কুছ পরোয়া নেহী! আমি আপনাকে বেল্ট পরিয়ে দিচ্ছি!
-
বেল্ট?
-
আরে বাবা, চর্ম কোমোর বন্ধনী!
-
আচ্ছা!
-
এই নিন লাল টি শার্ট
-
পরলাম!
-
এই নিন গগলস্!
-
এটা আবার কি?
-
রোদচশমা! যাতে রোদ চোখে না লাগে! তাছাড়া! আপনাকে বেশ স্মার্ট লাগবে!
-
বেশ!
-
বাঃ! আপনাকে তো এ্যাকেবারে যৌবনের উত্তমকুমার লাগছে!
-
উত্তমকুমার?
-
সে অনেক কথা! তবে উনি কিন্তু এখনও বাঙালী এবং বাংলার নয়নের মণি! উনি একজন মহাগুরু অভিনেতা! এখন অবশ্য একজন আছেন!
-
কে!
-
পোসেনজিৎ
-
সেটা আবার কে?
-
ওই অভিনেতা! তবে ইদানীং লালন ফকির করে বেশ নাম করেছে।
-
আচ্ছা, আচ্ছা!
-
কিন্তু, রামদাস বাবু, আপনাকে কিন্তু ঝক্কাস লাগছে! মেয়েরা আপনাকে দেখলে এ্যাকেবারে চটকে চৌষট্টি হয়ে যাবে!
-
ঝক্কাস!!!!!!!! চটকে চৌষট্টি!!!!!!!
-
এসব, এখন বাংলা এবং বাঙালীর নতুন লব্জ!
-
আরও কিছু বল তো সোম, শিখে নি!
-
হুম! বিন্দাস লাইফ,লাইফ ঘেঁটে গেছে, কেস জণ্ডিস, ইলু ইলু, খাল খিঁচে নেওয়া। এরকম আরও অনেক আছে! কত আর বলব?
-
আচ্ছা, আচ্ছা!
-
আপনি ট্রাউজারসের জিপটা লাগিয়ে নিন!
-
সেটা আবার কি?
-
ঠিক আছে, আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। বলে জিপটা টেনে দিল সোমদত্ত!
রামদাস বেশ অবাক হলেও দুঃখ পেলেন না! দেশাচার, সময়াচার- সবই মানতে হবে! যুগের নিয়মও তাই! না হলে যে মডার্ণ হওয়া হবে না!
বেশ আনন্দেই সোমের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন, রামদাস!!!! পায়ে নাইকির স্নিকার! হাঁটতে কোনো কষ্টই হচ্ছে না! বেশ আরাম। আগের মত আর পায়ে কাটার ভয়ও নেই।
হোটেলের ঠাণ্ডা থেকে বেরুতেই, একঝলক গরম হাওয়া এসে তাঁর মুখে ধাক্কা মারল! সোম বলল- এসি থেকে বেরিয়েছেন তো! একটু কষ্ট তো হবেই!
চারপাশে অজস্র চিৎকার আর বিভিন্ন রকমের গাড়ীর আওয়াজে এক অসহ্য শব্দ! কর্ণপটহ বিদারিত হইতেছে! থুড়ি কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে! চারিদিকে রঙ্গীন কাগজ লাগান!
সোমের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলেন, এগুলো ভোটের পোষ্টার! ভোট কি, আর পোষ্টারও কি জেনে নিলেন!
আচ্ছা, সোম এই যে ভোট টা হচ্ছে; এটা তো একটা লড়াই! তাই তো?
হুম! ঠিকই ধরেছেন!‍
তা কার, কার মধ্যে লড়াই?
সোম জবাব দেওয়ার আগেই, বিকট আওয়াজে একটা গান ভেসে এলো!
খোকা বাবু যায়! লাল জুতো পায়!
-এটা কিসের গান? সোমদত্ত?
-
বাংলা আধুনিক গান!
-
আমাদের সময়ের টপ্পা, কবির লড়াই- এসব কি উঠে গেছে!
-
টপ্পাটা রামকুমার বাবু বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু তিনি গত হবার পর আর চল নেই!
-
এখনকার কিছু গান বলবে?
-
বলাই যায়! তোমার দেখা নাই রে!
-
কার দেখা নেই?
-
সেটা তো কারও জানা নেই, তবে দুধওয়ালার গোঁফে মাছি, এটা জানি!
-
এই সব কি কলের গানে বাজানো হয়?
-
হ্যাঁ! তবে আজকাল বলে CD Player! তাই এগুলো গানের বদলে GUN!
-
তা এনাদের কি, গায়ক বলা হয়!
-
আরে না না! এরাও ইউনিসেক্স! এরা GUNNER নামে পরিচিত!
-
হুম! তোমার এই GUN এবং GUNNER এর গুঁতোয় আমি ভোটের লড়াইটা কাদের মধ্যে, সেটা জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেছিলাম। একটু বলবে?
-
ওটাই তো! আমরা তো বুঝতেই পারছি না! আর সেই জন্যই তো আপনাকে ডাকা! যদি কিছু বুঝতে পারেন! তাই, আমার BOSS শিবুদা আপনাকে যোগনিদ্রা থেকে উঠিয়েছেন!
-
শিবুদা?
-
ওই দেবাদিদেব মহেশ্বর!
-
তাই বলে, শিবুদা!!!!
-
দেখুন, আজকাল সব দাদা, দিদিদের যুগ! তাই, শিবুদা!
রামদাস, আর অবাক হচ্ছেন না! হাঁটতে, হাঁটতে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন!
ঘরের ওপরে লেখা আছে নির্বাচনী কার্যালয়। সোমদত্তের সঙ্গে ঢুকে পড়লেন, রামদাস!
কয়েকজন ছেলে- ছোকরা, এদিক- ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল! ওঁদের দেখে একজন বলে উঠল:-
-
আবে! তোরা কে বে?
-
আমরা, আপনাদের এই নির্বাচনী কার্যালয় দেখতে এসেছি!
-
এটা দেখার কি আছে বে? দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অফিস! বুয়েছিস?
-
স্বাধীনতা সংগ্রাম?
-
এলোমেলো করে দে মা লুটে পুটে খাই! এবার আমাদের লুটের পালা! তাই, স্বাধীনতা সংগ্রাম!!!!!!
-
বৎসগণ! স্বাধীনতা সংগ্রাম মানেই কি লুট?
-
আব্বে! বেশী জ্ঞান মারাস না তো!!! এটা পরিবর্তনের যুগ!
-
তাহা তো বুঝিলাম! কিন্তু, পরিবর্তন তো প্রচুর হইয়াছে, বৎস!
-
ক্কি! কোত্থেকে এয়েছিস বে, লালটু সেজে! কি ভাষায় কথা বলছিস! সব শ্লা, মাথার ওপর পিলেন হয়ে উড়ে যাচ্চে! ঠিক করে কথা বল্তো!
সোমদত্ত, রামদাসকে বের করে নিয়ে এলেন! বললেন- নাঃ! আপনার দেখছি কাণ্ডজ্ঞান নেই! এবারই ক্যালানি খেতেন!
-
ক্যালানি?
-
হ্যাঁ! ক্যালানি!!!!
-
সেটা কি?
-
মার! আজকাল আর একটা লব্জ হয়েছে, খিস্তি আর ক্যালানির বিকল্প নেই!
- রামদাস প্রতিজ্ঞাই করেছেন, আর অবাক হবেন না!
হাঁটতে থাকলেন! কিছু দূরে আর একটি নির্বাচনী কার্যালয়। ওঁদের দেখে, এখানকার লোকেরা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন!
-
আপনারা কারা? নির্বাচন কমিশনের লোক?
-
না না! আপনারা বিচলিত হইবেন না! আমরা দেখতে বেরিয়েছি, এই ভোটের বাজার!
-
ও! ও! আপনারা বাজারী কাগজের লোক?
-
মানে?
-
ও সব ভ্যানতাড়া করবেন না! আমরা বুঝি, কে কিভাবে এখানে আসে! গত ৩৫ বছর আমরা জনগণের সঙ্গে আছি। আমরা জনগণ দেখলেই বুঝি! আমরা না ওরা!
-
আমরা না ওরা!
-
হ্যাঁ! আমরা না ওরা! যে জনগণ আমাদের সাথে আছে, তারাই আমরা! আর যারা নেই, তারাই ওরা! এই ওরা দের ওপর আমাদের মাতব্বরী জন্মগত অধিকার! অধিকারের জন্য আমাদের লড়াই! এই লড়াইয়ের জন্য আমরা এবারও জিতব! সব মানুষকে অধিকার পাইয়ে দেওয়াই আমাদের বিপ্লব!
-
আপনারা কি শাক্ত?
-
এটা আবার কি! খায় না মাথায় দেয়?
-
মানে, আপনারা কি শক্তির পূজারী?
-
আরে না! শক্তি তো ওনাদের একচেটিয়া!
-
না! আমি ঠিক ওটা বোঝাতে চাই নি! আমি, বলছি- আপনারা কি দেবীর পূজা করেন?
-
বুঝেছি! আপনি ম্যাও!
-
না মহাশয়! আমি মার্জার নই!
-
আমরা মার্জারিত নই! জর্জরিত! ওই ম্যাওরা! না থাক! আপনারা সব দালাল! বুর্জোয়াদের! আমরা নিপীড়িত জনগণের প্রতিনিধি!
এত কথা বলে, লোকটি একটি ক্লাসিক সিগারেট ধরালেন!
রামদাসের মনে পড়িল-চতুর্ণামপি বর্ণণামেষ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ। কলিকালে, চারিবর্ণেরই এই সকল সনাতন ধর্ম্ম! ব্যাখ্যাও, মনে পড়িল। ইহারা নিরন্তর পাপকর্মকেই ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করিবে।
তাঁহার আরও কিছু মনে পড়িল।
কৃষিবদ্বাণিজ্যশিল্পয়োরপি কলৌ বর্ণচতুস্টয় সাধারণ ধর্ম্মত্বং দর্শয়িতুং বাণিজ্য শিল্পকমিত্যুক্তম্।
সংক্ষেপে, কলিযুগে কৃষির ন্যায় বাণিজ্য ও শিল্পকর্ম চারিবর্ণের সাধারণ ধর্ম।
ইহাতে দোষের কি হইল? উভয় পক্ষ কি পরাশর সংহিতা আদ্যোপান্ত দৃষ্টি করিয়াছেন? না, অনিষ্ট বিষয়েই যথেষ্ট চেষ্টা?
উভয় পক্ষের-ই কি শিষ্টসমাজে বিশিষ্ট গণ্য হইতে কি অনিষ্টে নিবিষ্টই উৎকৃষ্ট লক্ষণ?
রামদাসকে অন্যমনস্ক দেখে, সোমদত্ত সবই বুঝতে পারল!
-
চলুন! সিগারেট খাবেন?
-
সিগারেট কি?
-
শ্বেত ধূম্রশলাকা! তাম্বাকু সহ গোলাকার বস্তু!
-
হুম! চলুন। আজকাল তো আর হুঁকো পাওয়া যায় না! একটু মগজে ধোঁয়া দিলে যদি মাথাটা চাঙ্গা হয়!
-
চলুন দোকানে! ও ভাই! দুট্টো ভালো সিগারেট দেখি!
-
এই নিন! কিন্তু, ৫ টাকার বদলে ৭ টাকা দেবেন!
-
কেন ভাই? বাজেটে তো সিগারেটের দাম বাড়ে নি!
-
আরে, বাড়বে বলে তো কিনে রেখেছিলাম! বাড়ে নি তো আমার কি করার আছে? নেবেন তো নিন! না হলে বেশী বিলা করবেন না!
আপণালয়ের সত্বাধিকারীর এইরূপ বাক্যপ্রয়োগে, রামদাস, পুনরায় ব্যথিত হইলেন। মহামতি মনুর শ্লোক মনে পড়িল।
প্রিয় বাক্য প্রদানেন সর্বে তুষ্যন্তি জন্তবঃ।
তস্মাত্তদেব বক্তব্যং বচনে কা দরিদ্রতা।।
প্রিয় বাক্য বললে, মানুষ তো কোন ছার! পশুপাখিও তুষ্ট হয়! তাই প্রিয় বাক্য প্রয়োগই উচিত, ইহাতে কৃপণতা বা দারিদ্র্য কিসের?
আগেই জেনেছিলেন- লাউডস্পীকারের সাহায্যে বক্তব্য আরও পরিস্কার এবং জোরে শোনা যায়!
কিন্তু, এ কি? এরা তো, একে অপরকে নিন্দা এবং গালিগালাজেই ব্যস্ত!
সত্যং মৃদু প্রিয়ং ধীরো বাক্যে হীতকরং বদ্যেৎ।
আত্মোৎকর্ষন্তয়া নিন্দাং পরেষাং পরিবর্জয়েৎ।।
সজ্জন ব্যক্তি, সর্বদা বিনম্রভাবে , সত্য, প্রিয় এবং কেবল লোকের হিতকারী হয়, এমন বাক্যেই কথা বলবেন। তিনি, নিজের যেমন প্রশংসা করবেন না,তেমনি অপরের সমালোচনা বর্জন করবেন।
কিন্তু, নিন্দা সমালোচনা করিতেই হয় তাহা হইলে?
এক্ষেত্রে, ব্যক্তির গুণের প্রশংসা অগ্রভাগে করে,অতি স্নেহের সঙ্গে কাজের গঠনমূলক ভাবনা সহ নিন্দা করা উচিত!
রামদাস বুঝলেন- এখন, একে অপরের নিন্দাই করবে। মরে গেলেও অপরের প্রশংসা করবে না! এই ভাবে কি রাষ্ট্র চলে? সমস্ত প্রজা এই সংস্কৃতিতেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে, আর হয়েছে-ও!
তারই প্রতিফলন- রাজ্য পরিচালনা, শিক্ষা এবং সব ক্ষেত্রেই!
হা হতোস্মি!!!!!!
যুগ- যুগান্তর ধরে ক্ষমতার লড়াই চলে এসেছে! মহাভারত বা রামায়ণেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়! ছলে, বলে, কৌশলে ক্ষমতায় থাকতে ,আত্মপ্রচার করা দরকার! এর জন্য ,ষড়যন্ত্র, চরিত্রহনন, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, দরকার হলে গুপ্তহত্যা পর্যন্ত করতে হবে! ভারতের এটাই দস্তুর!
রামদাস, তাই বিচলিত হলেন না! মহামতি মনু, যতই স্মৃতিশাস্ত্র লিখে যান- সেটা মানার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না!
যোগনিদ্রার যাবার আগেও, তিনি ভারতের এই অবস্থা দেখে গেছিলেন।
ক্ষমতা মানেই- অর্থ, ভোগ! কিছু ব্যতিক্রমও আছে, কিন্তু কে না জানে- বিধিই, ব্যতিক্রমের নিয়ামক!
সোমদত্ত বুঝতে পারছেন, রামদাসের মনের অবস্থা!
রামদাস, বললেন- এক্ষণে,নগর কলিকাতা দর্শন এবং শাস্ত্র পাঠান্তে আমি যা বুঝিয়াছি, তাহা কথন করিতেছি। আপনি শ্রবণ করুন!
ইহলোকে, যে চারিপ্রকার যুগ বর্ণিত হইয়াছে, তাহা শুধু মাত্র সভ্যতার মাত্রা নির্ণয়ের নিমিত্ত!
আমাদের সৌভাগ্য- এই চারিযুগেই, কিছু মণীষী, যথার্থ বিদ্বান ও অপরাপর অশেষগুণালঙ্কৃত ব্যক্তিরা আবির্ভূত হইয়াছেন।
কার্যকাল সমাপ্ত হইলে- তাঁহারা লীন হইয়া যান। কিন্তু, জনসাধারণ তাঁহাদের উপদেশ স্মরণে রাখেন না!
পার্থিব সুখই তাদের কাম্য। শাস্ত্র- সাহিত্য-সঙ্গীত- বিজ্ঞান ধর্ম্ম-অর্থ- কাম ও তৎপ্রতিপাদক বিবিধ শাস্ত্র,পণ্ডিত ব্যক্তিগণ রচনা করিয়া গিয়াছেন এবং অদ্যাবধি তাহার নিরঙ্কুশ চর্চ্চা চলিতেছে। ইঁহারা ক্ষমতার জন্য লালায়িত কদাপি ছিলেন না, এখনও নহেন। আমোদের সহিত লক্ষণীয়, ইঁহারা ক্ষমতাবান দ্বারা চিরকাল ব্যবহৃত। কিছু পণ্ডিত, জ্ঞানত এবং কিছু অজ্ঞানত এই ব্যাবহার মানিয়া লন!
এই সকল ভাস্করতুল্য ব্যক্তিগণ, জ্ঞানাঞ্জন শলাকা দ্বারা বাংরবার মোহাবরণ নিরাকরণ করিয়া আমাদিগের নেত্রোল্মীলনের নিমিত্ত নিরন্তর চেষ্টিত।
মনুষ্যহিতকর কার্য্যসমূহ পাপজনক নহে, এই সমস্ত অসদভিপ্রায় দূষিত হইলেই পাপজনক হয়!
বর্তমানে সারা জম্বুদ্বীপ সহ এই খণ্ডিত বঙ্গদেশে যাঁহারা শাসন করিতেছেন/ করিবেন, তাঁহারা এই সমস্ত অসদভিপ্রায় দূর করিবার জন্য চেষ্টিত না হইলে;সমস্ত জনগণ- কালসর্পদিগের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইবে!
অতএব, সোমদত্ত! আপনি দেবাদিদেব মহাদেব কে এই বার্তাই দিবেন।
বুঝিলাম আমার দ্বারা এই দূরূহ কার্য্য সমাপন করিবার নিমিত্ত, দেবাদিদেব মহাদেব আমার যোগনিদ্রা ভঙ্গ করাইয়াছেন। আমি, আজি হইতে এই কার্য্যে ব্রতী হইলাম। আর যোগনিদ্রায় কালাতিপাত করিবো না। উহা স্বার্থপরের ন্যায় কার্য হইবে। বুঝিলাম, মদীয় এবং জাতির মোক্ষ মানবতাকে প্রচার করা!

মানবতার জয় হউক!