Friday, May 24, 2013

নালন্দা


নালণ্দা
উপ মহাদেশের ইতিহাস বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুরএখানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ধর্মের নানা মুখী সংঘাত ও সংমিশ্রণের ইতিহাস, একই সাথে আছে শিক্ষা সভ্যতার প্রগতি ও বিলয়ে ভরা ইতিহাসমধ্য যুগে এই ইতিহাস রচনায় কাণ্ডারি ছিলেন বৌদ্ধ রাজারাসংসার ত্যাগী বুদ্ধ মতবাদের প্রচার প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তারা রাজ্য জুড়ে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বৌদ্ধ বিহারএই সব বিহার থেকে কিছু কিছু বিহার পরে অবাধ জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খোলস ছাড়িয়ে হাজার বছর আগে খ্যাতি পেয়েছিল বিশ্ব বিদ্যালয়ে রূপেতার মধ্যে-
বিক্রম শীলাঃ- ভারতের ভাগলপুর জেলার আন্টিচক, মাধোরামপুর, উরিয়াপ এই তিনটি গ্রাম নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল
সোমপুরঃ- বাংলাদেশের নওগাঁতে
ওদন্তপুরীঃ-মগধে অবস্থিত ছিলপাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত ছিল

জগদ্দলঃ- বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত ছিল
বাংলাদেশের রাজশাহী, পঞ্চগড়, ঠাকুর গাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ এবং ভারতের মালদা নিয়ে গঠিত ছিলকোন কোন ঐতিহাসিক জগদ্দল নওগাঁয় আবার কেউ জগদ্দল কে দিনাজপুরে স্থাপিত হয়েছিল বলে মত প্রকাশ করেন, তবে যেখানেই হোক না কেন সেটা যে বর্তমান বাংলাদেশের ভূখন্ডেই ছিল সেটা নিশ্চিত
তক্ষশীলাঃ-পাকিস্তানে অবস্থিত ছিলবর্তমান ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ও রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তরপশ্চিমেপ্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের জনক বলে খ্যাত চাণক্য এখানেই লেখা পড়া করেনশিক্ষা শেষে তিনি এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের আচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন
 নালন্দার মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাঠামোর ভিত্তি ভূমি স্থাপন করে দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ শাসকরা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার যে রাস্তা তৈরি করে গিয়েছিলেন সেখানে থেকে আমরা কেন আলোর পথ পরিহার করে অন্ধকারের পথে হাটা শুরু করলাম? এই কেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু করলে সর্ব প্রথম যে সহজ সরল উত্তরটি আমাদের সামনে ভেসে আসে তা হল ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসাবৌদ্ধ শাসন আমলে হিন্দু ব্রাহ্মণ দের আয় রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ায় ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়ায় তাদের মনের ভিতর যে আগুন বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে গোপনে অতি কষ্টে সংরক্ষিত ছিল তার বিস্ফোরণ ঘটায় হিন্দু রাজাদের শাসনামলে এসেসুযোগ হাতে পেয়েই তারা নিরীহ প্রগতি শীল বৌদ্ধদের নির্মম অত্যাচার, উৎপীড়ন, দমন ও হত্যা করে ভারত বর্ষ থেকে বিতাড়িত করেরাজ আনুকূল্য বন্ধ করে ধ্বস নামায় এই সব সার্বজনীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, উপরন্তু ব্রাহ্মণ্য বাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠায় জোরালো করেছিল দেবদাসী, সহমরণ ও তীব্র জাতি ভেদ প্রথার মত ঘৃণ্য সব প্রথার
ব্রাহ্মণ্য বাদের আলোচনা -সমালোচনা করা আমার মুখ্য বিষয় নয়প্রারম্ভিক কথাগুলো কান টানলে মাথা আসার মতইআমার আলোচনা নালন্দার সফল অগ্রগতি ও শেষে করুণ পরিণতি নিয়ে
পাল রাজাদের শাসন আমলে সোমপুর, বিক্রমশীলা ও নালন্দা একই প্রশাসনের অধীনে কাজ করতপ্রয়োজনে শিক্ষকরা এই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করে উন্নত শিক্ষার মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রজ্ঞাবর্মণ গুপ্ত রাজা কুমারগুপ্তকে নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করে গেছেনখনন কার্যে প্রাপ্ত একটি সীলমোহর থেকেও এই দাবীর পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নালন্দাশব্দটি এসেছে নালমএবং দাথেকেনালমশব্দের অর্থ পদ্ম ফুল যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে আর দাদিয়ে বুঝানো হয়েছে দান করাতার মানে নালন্দাশব্দের অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞান দানকারী”, প্রতিষ্ঠান টি প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরনের মত দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলস ভাবে

নালন্দা ঠিক কবে স্থাপিত হয়েছিল তা আজ সঠিক ভাবে বলা হয়তো সম্ভব নয়
কোথাও পেলাম ৪২৭ খ্রীষ্টাব্দ আবার এক জায়গায় পেলাম ৪৫০ তা যা হোক ধরে নিলাম ৪২৭ থেকে ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ের মধ্যে এটি স্থাপিত হয়ে থাকবে
এই বিশ্ব বিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত বড়গাঁওগ্রামের পাশেইপাটনার আদি নাম পাটালিপুত্রদুই হাজার তিনশ বছর আগে মৌর্যদের রাজধানী ছিল এই পাটালিপুত্রসম্রাট অশোক এখান থেকেই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছেবিহারশব্দের অর্থ বিচরণ”, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেখানে অবস্থান করেন বা বিচরণ করেন তাকে বলে বৌদ্ধ বিহার”, প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার স্বর্ণ যুগে এই অঞ্চলে প্রচুর বৌদ্ধ বিহারের উপস্থিতি থাকায় পরবর্তীতে ভারতের এই রা্জ্যের নাম করন হয়েছে বিহার”, মৌর্যদের পর বিহার চলে আসে গুপ্ত রাজাদের শাসনেপরে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৪ সালে বিহার দখল করেনমোগলদের পর বিহার হাত বদল হয়ে আসে নবাব দের দখলেনবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা এর বিহার দখল নেয়১৯১১ সালে বাংলা থেকে বিহার ও ওডিশা পৃথক হয়
নালন্দা প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি মহা বিহারযেখানে মূলত বৌদ্ধ দর্শনের খুঁটি নাটি, বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের অনুশাসন বিষয়ে পাঠ দান চলতস্থিতিশীল রাজ্য পরিচালনা, দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিকল্প নেই একটি সভ্য, উন্নত ও প্রগতিশীল মনন সম্পন্ন জাতিরযা তৈরী করতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট নয় এসত্য সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তৎকালীন নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বৌদ্ধ শাসকরাতাদের যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে বৌদ্ধ ধর্মের পাশা পাশি তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার উপযোগী, সাহিত্য, সংষ্কৃতি ও আন্তর্জাতিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আরো অনেক শাখা যুক্ত করে তারা নালন্দাকে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেনসম্রাট অশোক এখানে একটি বিহার তৈরী করেনগুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেনমূলত গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করেপরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাট গণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ব বিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান
নালন্দাকে তাঁরা গড়ে তুলে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ব বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা হিসাবেযে কেউ ইচ্ছে করলেই নালন্দায় লেখা পড়ার সুযোগ পেত নাএর জন্য প্রয়োজন হত শিক্ষার্থীর যোগ্যতারশিক্ষার্থী সত্যিই নালন্দায় লেখাপড়া করার যোগ্য কিনা তা প্রমাণের জন্য প্রবেশ দ্বারে দিতে হত মৌখিক পরীক্ষাসাফল্যের সাথে এই ভর্তি পরীক্ষায় উৎরে গেলেই মিলত এখানে বিদ্যা লাভের নিশ্চয়তাপরীক্ষা মোটেই সহজ ছিল নাএতটাই কঠিন ছিল প্রতি দশ জনে মাত্র তিন জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারতভাবতে অবাক লাগে তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ তাদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরো ২,০০০ শিক্ষকগড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক কত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের বিদ্যা দান সম্ভব তাও আবার থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ, ভেবে সত্যি অবাক না হয়ে উপায় নেইএই বিশ্ব বিদ্যালয়টির বিশাল খরচ চালানোও যেন তেন বিষয় ছিল নাঅর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় যাতে নালন্দার প্রশাসনকে কারো উপর নির্ভরশীল হতে না হয় সেদিক বিবেচনা করে ২০০ গ্রামকে শুধু মাত্র নালন্দার ব্যয় মিটানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যা উৎসাহী বৌদ্ধ শাসকরাএই সব গ্রাম গুলোর অবস্থান শুধু নালন্দার আশে পাশে ছিল না, ছিল সমগ্র বিহার রাজ্যের ৩০টি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়েচিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করে গ্রাম গুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অনান্য গ্রাম থেকেএই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের যোগান আসত
বাইরের কোন প্রকার উটকো ঝামেলা যাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্য উঁচু লাল ইটের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা ছিল সমগ্র বিশ্ব বিদ্যালয় চত্বরভিতরে ঢুকার জন্য ছিল বিশাল প্রবেশ দ্বারবিদ্যালয় টিতে ছিল ৮ টি ভিন্ন ভিন্ন চত্বর, শ্রেণী কক্ষ, ধ্যান কক্ষ এবং দশটি মন্দিরবিদ্যালয়টির শিক্ষার প্রাকৃতিক পরিবেশ যথাসাধ্য স্নিগ্ধ ও কোমল রাখতে সমগ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু সুরম্য উদ্যান যেগুলো ভরা ছিল বিচিত্র ফুল ফলের গাছ দিয়েস্নান ও প্রয়োজনীয় জলের সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল কয়েকটি দীঘিছাত্রদের জন্য ছিল ছাত্রাবাসজলের সমস্যার জন্য ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেদিকটা মাথায় রেখে প্রতিটি ছাত্রাবাসে পানীয় জলের অসুবিধা দূর করতে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু কুয়োমোট কথা সমগ্র নালন্দা ছিল নিখুঁত পরিকল্পনায় গড়া একটি শিক্ষা স্বর্গ


বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি বেদ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষা ব্যাবস্থার উপযোগী আরো বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত এখানে
শিক্ষকদের পাঠ দান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠনালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত প্রতিকুল এবরো থেবরো যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি সুদূর তিব্বত, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রীস তুরষ্ক থেকে ছুটে আসা বিদ্যা অনুরাগীদের


ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব দূরীকরণ এবং একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানের সমাবেশ ঘটাতে তৈরী করা হয়েছিল তিনটি সুবিশাল লাইব্রেরীলাইব্রেরী ভবন গুলো পরিচিত ছিল যথাক্রমে “রত্ন সাগর, রত্ন দধি ও রত্ন রঞ্জক” নামেলাইব্রেরীর নাম করণ থেকে অনুমান করা যায় নালন্দার শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতাচীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর মতে এখানে যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাদের জ্ঞানের খ্যাতি প্রসারিত ছিল বহুদূর ব্যাপি, চারিত্রিক দিক দিয়েও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ চরিত্রের অধিকারীর্নিলোভী এই শিক্ষকরা ভাল করেই অবগত ছিলেন বহুদূর দূরান্তের ছাত্ররা বন্ধুর পথের কষ্ট মাথায় নিয়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসতেন বিদ্যা পিপাসায়তাই তাঁরাও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেনলাইব্রেরীর প্রতিটি ভবনের উচ্চতা ছিল সুবিশাল প্রায় ৯ তলা বিশিষ্ট দালানের সমানএত বিশাল ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরী বর্তমান শিক্ষা সংষ্কৃতি ও ছাপাখানা প্রযুক্তির সহজ লভ্য যুগেও সচরাচর দেখা যায় নাপ্রায় ৮০০ বছর ধরে লাইব্রেরী গুলো ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছিল হাজার হাজার পুঁথি, ধর্মীয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের বই, চিকিৎসা শাস্ত্র, ও নানান গবেষণা লব্ধ মূল্যবান বই দিয়েপৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বই গুলো এখানে অনূদিত হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথেবিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান গরিমায় আর পাণ্ডিত্যে যাঁরা সে সময়ে উচ্চ পর্যায়ের ছিলেন তাঁরাই ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নালন্দায় সন্মিলিত হয়েছিলেন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের জন্য, ছাত্ররাও ছিল প্রাণবন্ত, শ্রদ্ধাবান, সুযোগ্য ও বিদ্যা উৎসাহীপৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই এখানে সমবেত হওয়ার কারণে, ভিন্নতা ছিল তাদের ভাষায়, ভিন্নতা ছিল তাদের ধর্মে, ভিন্নতা ছিল তাদের সংষ্কৃতিতেকিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎএই উদ্দেশ্যই তাদের করেছিল বিনয়ী ও একতা বদ্ধ
প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় এক সময় এত সুবিশাল একটি বিশ্ব বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান শীল ভদ্রযিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙ এর গুরুপ্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেনতিনি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেনআরো একজন বঙ্গীয় স্বনাম ধন্য পন্ডিত ব্যক্তির কথা উল্লেখ না করে উপায় নেই তিনি হলেন ঢাকার বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করা অতীশ দীপঙ্করবর্তমানে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান নাস্তিক পন্ডিতের ভিটানামে পরিচিততিনি ১৫ বছর ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারের শিক্ষকতা ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন বেশ সফলতার সাথে

শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটি সভ্য, উন্নত জাতি তৈরী ও জ্ঞান উৎপাদনকারী নিরীহ এই প্রতিষ্ঠানটি ১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী আক্রমন করে ধ্বংস করে ফেলেন
তার আক্রমনের বর্বরতা এত ভয়াবহ আকারে ছিল এ সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাঁর তাবাকাতে নাসিরিগ্রন্থে লিখেছেন হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন খিলজীএরপর আগুন লাগিয়ে দেন লাইব্রেরীর ভবন গুলোতে কোরাণ না থাকাতে এই পরিণতি বলে, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন । লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমাণ এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে(জনশ্রুতি আছে ছয় মাস) খলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করেন নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছেন একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা জানতে পারতাম সে যুগের ভারত বর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কেজাতি হিসাবেও হয়তো আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে সহস্র বছরসেদিন তার ধারালো তরবারির নিষ্ঠুর আঘাতে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া নিরস্ত্র মানুষের আর্ত চিৎকারে ও জীবন্ত মানুষ পোড়া গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে আসা বাচঁতে চাওয়া ঝলসানো সাধারণ মানুষ গুলোর করুণ আর্তনাদে স্তব্ধ হয়েছিল একটি সভ্য জাতির অগ্রযাত্রা

খলজীর এই পাশবিক নিষ্ঠুর বর্বরতাও পরিচিতি পায় এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের চোখে ধর্মীয় বিজয় হিসাবে!
এই পোড়া ভগ্ন স্তুপ থেকে নালন্দাকে আবারো মাথা তুলে দাঁড় করানোর শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন মুদিত ভদ্র নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু কিন্তু এইবার পুনরায় তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে থাকা দুই ক্ষু্ব্ধ ধর্মান্ধ ব্রাহ্মণ কারণ, তখন বেদ ছিল না সেখানে । ( থাকবে কি করে? পুড়ে গেছিল) এখানে আবারো ঘটে আরেক সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় বিজয়!
নালন্দায় বার বার ধর্মীয় বিজয় সফল হলেও লজ্জিত হয় মানবতা, পরাজিত হয় সভ্যতা, শৃঙ্খলিত হয় শিক্ষা
এভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা, আক্রোশ, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল ধর্মান্ধরা কয়েকশ বছর ধরে মানব সভ্যতাকে আলোর পথ দেখানো মানুষ গড়ার এই কারখানাটিকে এর ফলেই আমরা খুঁজে পাই না, আমাদের বহু ইতিহাস বা তথাকথিত সিস্টেমেটিক স্টাডির ব্যাখ্যান ।

তথ্য সংগ্রহঃ ইন্টারনেট ও বিভিন্ন বই ।

No comments: