Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts

Tuesday, May 28, 2013

রোমন্থন

ভদ্রলোক সম্পর্কে যে খুব সবাই ভালো জানেন তা কিন্তু নয়তিনি সমরেশ,  সুনীল বা  হুমায়ুনের, মত জনপ্রিয় কোন লেখকও নন
হাতে গোনা যে কজন চেনেন, এই ভদ্রলোককে, তাঁরা খ্যাত নামা ঐতিহাসিক নামেই চেনেন । যখন, কলম ধরেন আমাদের মত পাঠকদের জন্য তখন, সেই লেখা পড়তে পড়তে একটা স্মৃতিমেদাতুর  হাসি মনে বুদবুদিয়ে ওঠে ।
আলী সাহেবের পর, এরকম মুজতবী কলম আমি অন্তত আর পাই নি । একজন রাশভারী ব্যক্তিত্ব যখন নিজের কথা লেখেন আত্মজীবনী হিসেবে, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় , ইনিই সেই ঐতিহাসিক ।
এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হবে তাদের মন আর মানসিকতা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারনার জন্ম হতে পারে।

লেখক এক জায়গায় বলছেন :-
আমার কাকা গেলেন কলকাতায়। সেখানে তিনি কাপড় কিনবেন। কলকাতার নিউমার্কেটে একটা দোকানে দোকানীর সাথে তিনি কথা বলছেন। দেখা গেল কাপড়ের দোকানদার তিনি নিজেও একজন বরিশালের মানুষ। আর যায় কোথায়? ঐ কাপড়ের দোকানদারও বুঝে ফেললেন যে আমার কাকা বরিশালের মানুষ। তাদের মাঝে দর কষাকষি শুরু হয়ে গেল।
কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ”দাম কত?” দোকানীর উত্তর এতকাকা বললেন, “দাম এত ক্যান? এই দামে তো নেওয়া যাবে না।দোকানীর উত্তর না নিলে না নিবেন, ঠেকলাম কিসে?”
এই হল বরিশালের মানুষের মন। একটা ইগো কাজ করে। আমরা যারা বরিশালের বিষয়টা আমাদের জন্য সহজ কিন্তু বাইরের অনেকেই হয়তো বিষয়টা ভুল বুঝতে পারে। যেমন ধরা যাক বরিশালের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম সবসময় খুব উঁচু। মনে হবে বুঝি রোম সভ্যতার পরই বরিশালের স্থান। জোয়ান বুড়া সবাই বরিশালের নামি ব্যক্তিত্বদের নাম মুখস্থ করে বসে আছে। একটু জিজ্ঞেস করলেই সব মুখস্থের মত বলে দেবে। আমাদের সময়ে ছাত্র মহলে প্রেমে ব্যর্থ যুবকদের বেশ কদর ছিল। তাদের কে কেমন জানি, একটু হিরো হিরো মনে হত। আর সে কারণেই বরিশালের সব যুবকরাই নিজেদেরকে রোমিও ভাবত। বুকের মধ্যে ভালোবাসা বেঁধে চিঠির সাথে ইটের টুকরা বেধে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে ঢিল দিত। আর সেই কখনো কখনো প্রেমিকার সামনে না পড়ে প্রেমিকার বাবার সামনে পড়লে তো বুঝতেই পার কি দুরবস্থা!! তবে আমরা সেই সব বীর যুবকদের নিয়ে গর্ব করতাম। বলতে গেলে প্রেম বিষয়টা বরিশালের একটা ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়েএকজন সফল প্রেমিকের ভাষায়, ” হ্যারে দেইখ্যা তপেরথমেই লাভে পড়িয়া গেলাম। হ্যার পর, নদীর ধারে দুই দিন ফলোকরলাম। তিনদিনের দিন একটু আন্ধার হইতেই ফোকাস মারলাম।
তিনি বরিশালের চাষি সম্বন্ধে লিখছেন :-
ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষি ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, “ক দেহি, মহারাণী ভিক্টোরিয়া এহন কি করতে আছে?
উত্তর, “হে কি আর আমাগো মত? পানি নাবতেই পান্তাভাত খাইয়া কাঁথা মুড়ি দিয়া উব্বুত।
বা, কোলকাতার হোস্টেলে প্লেন বিশেষজ্ঞকে আকাশে বিরাট একটা প্লেন দেখে , এটা কি ধরণের প্লেন যখন জিজ্ঞেস করা হয়, উত্তর আসে:- এয়ার ক্র্যাফট কেরিয়ার  !
অন্য জায়গায় লিখছেন :-  জেঠামশায়ের কথা- "একটু ইনডাইরেক্টলি কইয়া দিলাম আর কি !!!
জ্যাঠামশায় বরিশাল-কৃষ্টি সম্পর্কে অনেক কাহিনী শোনাতেন। ওঁদের ছোটবেলায় নাকি স্থানীয় ব্রাহ্মরকুসংস্কার-নিবারণী সভাস্থাপন করেন। জনহিতৈষী ব্রাহ্ম যুবকবৃন্দ প্রভাতফেরিতে বের হতেন, খোল-করতাল সহযোগে কুসংস্কার-নিবারণী কীর্তন করতে করতে,-(রাগ ভৈরবী, ঝাঁপতাল)
প্রভাতে উঠিয়া দেখ মাকুন্দ চো-ও-পা-আ।
বদন ভরিয়া বল ধোওপাআ, ধোওপাআ।

আবার লিখছেন :- হঃ, এরপর কইবেন "অগো বেঙ্গী, মগো বেঙ্গী আর জগদীশ্যা" আমার ছুডবেলার খেলার সাথী আছিল
“বরিশালী সংস্কৃতির সব চেয়ে লক্ষনীয় প্রকাশ প্রচণ্ড পৌরুষে ।
Machismo কাকে বলে ল্যাটিন আমেরিকার বাঘা বাঘা পুরুষ তথা মার্কিন গুণ্ডাবীর Rambo তা বরিশালবাসীর কাছে সাত জন্মে শিখতে পারে। এই machismo শুধু পুরুষ জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দামু কাকার দুই বৌ যখন সম্মিলিত শক্তি নিয়ে তাঁকে ঝাঁটাপেটা করতেন তখন সে দৃশ্য দেখলে অনেক পুরুষসিংহেরই পিতৃনাম বিস্মরন হত। আদর্শগত শুচিতা ভুলে নারী আন্দোলনকারিনীরা দামুরক্ষা সমিতিখুলতেন ।”
 



হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যায় ।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন । তাঁর বাঙাল নামায় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতি শ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙাল নামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)

“বাঙাল নামাঅথবা  “রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিতচর্চাগ্রন্থগুলোতো এখনো বাঙালির মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে যায় নি, নাকি?
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ বাঙাল নামার জন্য দুই বাংলার মানুষের অন্তরে যেন তিনি একটু বেশি পরিমাণেই আদৃত হয়ে আছেন।
নিউ ইয়র্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন :-
“দ্যাখো, আমি বরিশালের একজন মানুষ হিসেবে গর্বিতবরিশালের সেই সব স্মৃতি গুলো আমার জন্য শুধুই কোন নস্টালজিক বিষয় না। এই স্মৃতিগুলো আমার প্রতিদিনের জীবনের নিত্য খোরাক। আমি এই স্মৃতির মাঝেই প্রতিদিন বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি। একটা কথা বুঝতে হবে বরিশালের আলো-হাওয়ায় আমার শিরের শিরা-উপশিরায়। তাদের প্রতিদিনের জীবনের খুনসুটি, ইগো, যাই বল না কেন সব কিছুই কিন্তু আমি ধারণ করেই আমার এই যাপিত জীবন। আমার ছেলেবেলা কাটিয়েছি বরিশালে। আমার শৈশব স্মৃতি আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ নিয়ে কথা বললে এর শেষ করা যাবে না। শেরে বাংলা এক বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন। তবে আমার মনে হয় অনেক বরিশালিরাই হয়তো এই বিশাল মাপের মানুষকে সঠিক ভাবে চিনতে পেরেছিলেন। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি যে শেরেবাংলা কত দূরদর্শী ছিলেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বর্তমানে যে কোন রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে বিরল। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হবে তাদের মন আর মানসিকতা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারনার জন্ম হতে পারে।আমরা বলি বৃটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটা বিবাধের দেয়াল তুলে দিয়ে গেছে। আমি কিন্তু এটা বিশ্বাস করি না। বৃটিশ আসার আগেও হিন্দু-মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক খারাপ ছিল। আসল বিষয়টা হল ধর্ম মানেই এমন। আমরাটাই শ্রেষ্ঠ। তবে হ্যা, এই ধর্মকে কেন্দ্র কে আমাদের সাম্য কতটুকু ব্যাহত হয়েছে সেটা হল কথা। আমি বলব অনেকটুকুই। এই দেশ ভাগের কোন ফসল আমরা পাই নি। দেশ ভাগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উত্তর ভারতের মুসলমানদের। এখনো পর্যন্ত মারামারি কাটাকাটি লেগেই আছে। আমি কিছুদিন আগে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। ভাবতেই পারবেন না আমি সেখান থেকে কি যে ভালোবাসাটা পেয়েছি। একটা পাঞ্জাবীর দোকানে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার পর  বিল দিতে যাব। এই দেখে পাঞ্জাবী চায়ের স্টলের মালিক আমাকে কিছুক্ষণ তিরস্কার করলেন। তারপর চায়ের বিল দিতে আমাকে নিভৃত করলেন। আমরা তখন কেউ ভাবিনি যে আমি হিন্দু আর উনি মুসলমান। কথা হল সাধারন মানুষের ভালোবাসায় কে হিন্দু আর কে মুসলমান এই সব নেই। ধর্মকে মানুষ ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমরা এই সাধরণ মানুষরা কিন্তু এর করুণ শিকার ছাড়া আর কিছুই না। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য এই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সত্যটাতো একদম জলের মতই পরিস্কার
"বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের শরীয়ত-সুন্নাহ, পুজো-অর্চনা জীবনপ্রবাহ আর ইতিহাস মিলে গড়ে ওঠা ভাব-সংস্কৃতিই এখানে জীবন দর্শন। হিন্দু ব্রাহ্মণ কিংবা মুসলমান মৌলভী আর ব্রিটিশ সাহেবদের ভদ্র পোশাকি রাজনীতি অর্থনীতি অথবা প্রথাগত সমাজ সংস্কৃতির নগ্নরূপ এখানে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করেছে। মানবিক সম্পর্ক ফেলেছে সঙ্কটে। জনগণের ধর্মবোধ মানুষকে পৌঁছে দেয় মনুষত্ববোধের কাছে। সেখানে মানিয়ে চলার নামই উদারতা। মরুভূমির কঠোর ধর্মাচরণ নয়, দ্বীপের এই বাংলাদেশ পলিমাটির মননে জীবন্ত। এখানে ধর্ম তলোয়ারের জোরে নয়, পারস্য সভ্যতার নরম মেজাজে এসেছে। লালন ফকির আর আজমীরের মতো পীর ফকির দরবেশ আউলিয়াদের দরগায় হিন্দু-মুসলিম সব বাঙালীর ভ্রমণ আজও দৃশ্যমান। বাঙালী হিন্দু-মুসলিমের ধর্ম দর্শনে উন্মাদনার জায়গা ক্ষীণ, তবে সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে প্রথাগতদের বিরোধ ছিল। বাংলা সাহিত্যের ভিন্ন সুরে বাঙালী কেবলই আবেগের। সেখানে মনুষত্বের সংস্কৃতিরই আধিপত্য।"

অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী একজন ভারতীয় ইতিহাসবেত্তা যিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি দীর্ঘকাল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা বিষয়ে শিক্ষকতা করার পর বর্তমানে অক্সফোর্ডের সেইন্ট এন্টনী কলেজে এমিরিটাস ফেলো হিসেবে সংযুক্ত আছেন। তাঁর জন্ম ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, বাংলাদেশের বরিশালে, কীর্তিপাশায়, এবং সেখানেই তাঁর স্কুল জীবন অতিবাহিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে ছেড়ে তারা ভারতে চলে আসেনঅতঃপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন এবং উভয বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. ফিল. ডিগ্রী লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকেঁ সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান করে। জীবনের শুরু থেকেই তপন রায় চৌধুরী শিক্ষকতাকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় তাঁর বহু গ্রন্থ এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
=
আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার রইলো অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী
র প্রতি । পাঠকদের অনুরোধ- তাঁর বইটা পড়ে দেখুন ।
=
তথ্য :- ইন্টারনেটে প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকার এবং “বাঙাল নামা,  “রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিতচর্চা








Monday, May 27, 2013

পঞ্জিকা

পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার হলো দিন সমূহকে হিসাব করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি।
পঞ্জিকা অপভ্রংশে পাঁজি, নামটি এসেছে পঞ্চাঙ্গ থেকে। পঞ্চাঙ্গের অর্থ পঞ্জিকার ৫টি অঙ্গ।
1. বার বা বাসর: – সোমবার থেকে রবিবার বা সোমবাসর থেকে রবিবাসর।এই প্রত্যেকটি নাম গ্রহ থেকে এসেছে। রবি- সূর্য্য, সোম- চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি বা গুরু, শুক্র বা ভার্গব, শনি। 2. তিথি: – সূর্য্যের সঙ্গে সংযোগের হিসাবে চান্দ্রমাসের গড় মান-২৯.৫৩ দিন। চান্দ্রমাস কাকে বলা হয়? এক অমাবস্যা থেকে ঠিক পরের অমাবস্যা পর্য্যন্ত সময়কে সাধারণত ১ চান্দ্রমাস বলা হয়। চান্দ্রমাসের নামকরণ কিভাবে হয়? আমরা জানি ১২ টি সৌরমাস। যথা:- ১. বৈশাখ( বিশাখা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ২. জ্যৈষ্ঠ(জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৩.আষাঢ়(পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৪. শ্রাবণ (শ্রবণা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৫.ভাদ্র (পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৬. আশ্বিন (অশ্বিনী নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৭.কার্ত্তিক ( কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৮. অগ্রহায়ণ ( অপর নাম- মার্গশীর্ষ, মৃগশিরা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ৯. পৌষ (পুষ্যা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ১০. মাঘ (মঘা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ১১.ফাল্গুন (পূর্বফল্গুনি নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) ১২.চৈত্র (চিত্রা নক্ষত্র থেকে নাম এসেছে) । আমরা বৈশাখ থেকে আরম্ভ করি। এই মাসের কোন না কোন দিনে অমাবস্যা পড়বে। এই অমাবস্যা থেকে পরের অমাবস্যা পর্যন্ত ১ চান্দ্র বৈশাখ বলা হয়। এইভাবে ১২টি চান্দ্রমাস হবে। যদি একই মাসে ২ টি অমাবস্যা পড়ে, তবে সেই চান্দ্রমাস মলমাস হিসাবে গণ্য হবে। আগেই বলা হয়েছে যে, এক চান্দ্রমাসের মান ২৯.৫৩ দিন। ২৯.৫৩ কে পূর্ণসংখ্যাতে রুপান্তরিত করলে হয় ৩০। এই ৩০ দিনকে ৩০ টি সমান ভাগে ভাগ করে, এক একটি অংশকে বলা হয় তিথি। তিথি হলো ১ চান্দ্রদিন। এবার প্রশ্ন কেন? অমাবস্যা কে আদি তিথি বা ১ম দিন ধরা হয়। যখন চন্দ্র ও সূর্য্যের একই সরলরেখায় মিলন হয় তখন অমাবস্যা হয় । সুতরাং তিথি= ১ চান্দ্রদিন। অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ বা প্রথমা এবং শুরু শুক্লপক্ষ। সুতরাং অমাবস্যার পরের দিন শুক্লপক্ষের প্রতিপদ বা প্রথমা। চন্দ্র, সূর্য্যের সাপেক্ষে ১২ ডিগ্রী কৌণিক দূরত্ব (angular distance) অতিক্রম করলেই প্রতিপদ বা প্রথমার শেষ এবং শুক্লা দ্বিতীয়ার আরম্ভ। পক্ষ ২টি। শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ। পক্ষ সাধারণত ১৫ দিনের। অমাবস্যা থেকে পরের ১৫ দিন পর পূর্ণিমা। এই ১৫ দিন শুক্লপক্ষ । আবার পূর্ণিমা থেকে পরের ১৫ দিন পর অমাবস্যা। এই ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষ। সুতরাং ১ চান্দ্রমাসের ১ম ১৫ দিন শুক্লপক্ষীয় এবং ২য় ১৫ দিন কৃষ্ণপক্ষীয়। তিথি, যে কোন দিনাঙ্কের যে কোন সময়ে শুরু হতে পারে; দিনে অথবা রাত্রিতে। সাধারণত পঞ্জিকার যে কোন দিনাঙ্কের সূর্য্যোদয়ের সময় যে তিথি চলছে সেটাই সেই সৌরদিনের তিথি হিসাবে গণ্য হবে। তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্য্যন্ত হতে পারে। এর কারণ চন্দ্রের জটিল গতি। চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এক কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, এটা আমরা সবাই জানি। কক্ষপথটি কিন্তু উপবৃত্তাকার (Elliptical)| যার ফলে চন্দ্রের গতি সেই কক্ষপথে সব জায়গায় সমান নয়। কখনো ধীরে, কখনো জোরে।–আর সেই জন্যেই তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘণ্টা পর্য্যন্ত হয়। সুতরাং, পাঁজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হোল তিথি ।
এবার নক্ষত্র: – নক্ষত্র ২৭ টি। ক্রমানুসারে ২৭ টি নামগুলি হোল: – ১। অশ্বিনী ২। ভরণী ৩। কৃত্তিকা ৪। রোহিণী ৫। মৃগশিরা ৬।আর্দ্রা ৭। পুনর্বসু ৮। পুষ্যা ৯। অশ্লেষা ১০। মঘা ১১। পূর্বফাল্গুনি ১২। উত্তরফাল্গুনি ১৩। হস্তা ১৪। চিত্রা ১৫। ¯^vZx ১৬। বিশাখা ১৭। অনুরাধা ১৮। জ্যেষ্ঠা ১৯। মূলা ২০। পূর্বাষাঢ়া ২১। উত্তরাষাঢ়া ২২। শ্রবণা ২৩। ধনিষ্ঠা ২৪। শতভিষা ২৫। পূর্বভাদ্রপদ ২৬। উত্তরভাদ্রপদ ২৭। রেবতী । এছাড়াও অভিজিৎ নামেও আরও একটি নক্ষত্র আছে। উত্তরাষাঢ়ার শেষ পাদ এবং শ্রবণার প্রথম পঞ্চদশাংশ ব্যাপীয়া অভিজিৎ নক্ষত্র গণণা করা হয়। অর্থাৎ: – ৯ রাশি ৬ অংশ ৪০ কলা থেকে ৯ রাশি ১০ অংশ ৫৩ কলা ২০ বিকলা পর্য্যন্ত। এখন নক্ষত্র বলতে কি বুঝব? মূলত চন্দ্র রাশিচক্রের (প্রকৃতপক্ষে চান্দ্রমার্গের) ৩৬০ডিগ্রী ঘুরে আসে। এই চন্দ্র রাশিচক্রের ভাগ ২৭ টি। প্রত্যেকের ব্যবধান হোল ১৩ ডিগ্রী ২০ মিনিট । এই এক একটি ভাগকে নক্ষত্র বলা হয়। এই ভাগের প্রধান উজ্জ্বল তারাকে যোগতারা বলা হয়। কোন দিন কোন নক্ষত্র বললে বুঝতে হবে চন্দ্রের অবস্থান নক্ষত্রের ১৩ ডিগ্রী ২০ মিনিট সীমানার মধ্যে। করণ: – করণ হোল তিথির ১/২ বা অর্ধাংশ। যে কোন তিথির প্রথম অর্ধাংশ একটি করণ, দ্বিতীয় অর্ধাংশ অন্য একটি করণ। সুতরাং ৩০টি তিথিতে ৬০ টি করণ। করণের নামসমূহ: – ১। বব ২। বালব ৩। কৌলব ৪। তৈতিল ৫। গর ৬। বণিজ ৭।বিস্টি ৮।শকুনি ৯।চতুষ্পাদ ১০। নাগ ১১।কিন্তুঘ্ন প্রথম ৭টি করণ চরকরণ বা সাধারণকরণ। পরের ৪টি স্থিরিকরণ। ৪টি স্থিরিকরণ বিশেষ বিশেষ তিথির বিশেষ বিশেষ অর্ধাংশে প্রযোজ্য। কৃষ্ণচতুর্দশীতে-১টি, অমাবস্যায় -২টি, শুক্ল প্রতিপদে- ১টি । এই ৪টি স্থিরিকরণ । এই ৪টি বাদ দিলে থাকে ৫৬ টি করণ। এই ৫৬ টি করণের প্রথম ৭টি চরণাকরণের পৌনঃপুনিক (জবপঁৎৎরহম) মাত্র। যোগ: – পঞ্জিকার শেষের অঙ্গটি হলো যোগ। সূর্য্য ও চন্দ্রের দুইয়ের নিরয়ণস্ফুট (Longitude) যা দেওয়া থাকে তাদের যোগফলকে ১৩.৩৩ দিয়ে ভাগ করলে যা থাকবে – তাই যোগ। তিথি ও নক্ষত্রের মত যোগেরও অন্তকাল থাকে। যোগ ২৭ টি: – (ক্রমানুসারে) ১। বিষ্কুম্ভ ২। প্রীতি ৩। আয়ুষ্মান ৪। সৌভাগ্য ৫। শোভন ৬। অতিগন্ড ৭। সুকর্মা ৮। ধৃতি ৯। শূল ১০। গন্ড ১১। বৃদ্ধি ১২। ধ্রুব ১৩। ব্যাঘাত ১৪। হর্ষণ ১৫। বজ্র ১৬। অসৃক ১৭। ব্যাতিপাত ১৮। বরীয়ান ১৯। পরিঘ ২০। শিব ২১। সিদ্ধ ২২। সাধ্য ২৩। শুভ ২৪। শুক্র (শুক্ল) ২৫। ব্রহ্ম ২৬।ইন্দ্র ২৭। বৈধৃতি এগুলো গেল পঞ্জিকার সময় গণণা। এবার আসি পূজার সময় নিরূপণ। ১ অনুপল= ০.০০৪ সেকেন্ড। ৬০ অনুপল= ১ বিপল=০.২৫ সেকেন্ড। ৬০ বিপল= ১ পল=১৫ সেকেন্ড। ৯৬ পল= ১ দন্ড = ২৪ মিঃ। ২.৫ দন্ড =১হোরা =১ আওয়ার বা ঘন্টা। ৭.৫ দন্ড = ১ প্রহর = ৩ আওয়ার বা ঘন্টা। ৮ প্রহর = ১ দিবস (দিন+রাত্রি) বা অহোরাত্র। হোরা থেকে অহোরাত্র এসেছে। এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয় যে ইং hour এবং হোরা শব্দটির সাদৃশ্য।
৩ দিন ও রাত্রির ভাগ এরকম: – ২৫ দন্ড = দিন = ১০ ঘণ্টা । ৩৫ দন্ডে রাত্রি =১৪ ঘণ্টা । এটা কিন্তু general । ঋতু এবং সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে দিন ও রাত্রির ভাগ পাল্টাবে। সূর্য্যোদয়ের সময়ের একটা বড় ভূমিকা কি পঞ্জিকা, কি পূজা সময়ের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঘটিকা: -১ দন্ড বা ২৪ মিঃ কে ঘটিকা বলা হয়। মুহূর্ত্ত = ২ দন্ড বা ৪৮ মিঃ । ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত= সূর্যোদয়ের ২ মুহূর্ত্ত আগে অর্থাৎ ৯৬ মিঃ আগে বা ১ ঘণ্টা ৩৬ মিঃ পূর্বে। প্রদোষ= সূর্য্যাস্ত হতে ৫ দন্ড বা ২ ঘন্টা। রাত্রির প্রথম অর্ধপ্রহর বা ১ ঘণ্টা ৩০ মিঃ এবং শেষ অর্ধপ্রহরকে “দিবা” বলে। প্রথম অর্ধপ্রহরের পর অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ৩০ মিঃ পর ৬ দন্ড বা ২ ঘণ্টা ২৪মিঃ কে বলে “রাত্রি”। তাহার পর ১০ দন্ড কাল বা ৪ ঘণ্টা কাল নিশা ও মহানিশা। 
তথ্যসূত্র: – শ্রী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়- জোর্তিবিজ্ঞানী, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ও জগন্মোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত নিত্য পূজা পদ্ধতি)
এই প্রবন্ধটি অলঙ্করণ সহ বাংলা উইকি আমার আসল নামে-( রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য)
নথীভুক্ত করেছে।

Friday, May 24, 2013

তুলসী চক্রবর্তী


প্যাপিরাসে প্রকাশিত
*****************
চিত্র সৌজন্য :- গুগুল

বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ যে- সোনা হয়ে উঠতে পেরেছিলো তার অন্যতম কারণ তুলসী চক্রবর্তীর মত অভিনেতারা ছিলেন বলে।

"সাড়ে ৭৪"-এ তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীকে ছেড়ে যেন উত্তম-সুচিত্রার দিকে চোখই যায়না |

প্রথম সিনেমায় অভিনয় : -১৯৩২ এ। ছবির নাম ছিল- পুর্নজন্ম।
হ্যাঁ! আমার যতদূর জানা আছে, তুলসী চক্রবর্তী মেঘে ঢাকা তারা হয়েই ছিলেন। কিন্তু, তাতে তাঁর কোনো খেদ ছিল না। তিনি, এই রকম উপেক্ষাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। বাংলা সিচুয়েশন কমেডির ভাণ্ডার একেবারে শূন্য নয়, কিছু কিছু রত্ন সেখানে রয়েছে, যেখানে তুলসী চক্রবর্তী একটি উজ্জ্বল রত্ন। অনেকদিন আগে একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম( নামটা মনে নেই) : - শীতে কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে, অনুপকুমার তুলসী চক্রবর্তীকে একটা কোট কিনে দিয়েছিলেন। সেটা পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সন্তানহীন তুলসী চক্রবর্তী। অনুপকুমারকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ছেলে হিসেবে। পরশপাথর ছবিতে সত্যজিৎ রায় তুলসী চক্রবর্তীকে মুখ্য চরিত্রে নির্বাচিত করায়, আর এক দফা হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন। এই ছবিতে অভিনয় করার জন্য কত পেয়েছিলেন, জানলে আপনাদের চোখে জল আসবে। মাত্র, ১৫০০ টাকা। ৩১৬ টার মত বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। কোথাও নামমাত্র পয়সা বা কোথাও সবিনয় অনুরোধে, বিনে পয়সায় অভিনয় করতেন, এই অসাধারণ অভিনেতা। হাওড়ার শিবপুরে, নিজের বাড়ীতে ট্রাম ধরে ফিরে যেতেন স্যুটিং এর পর। টাক মাথা, ধুতি হাফ ফতুয়া পরা এই ভদ্রলোক পৌরহিত্য করতেন টাকার জন্য।

পরশপাথরে অভিনয়ের সময়, সত্যজিৎ রায় তুলসী বাবুকে ট্যাক্সি করে যাতায়াতের জন্য পরামর্শ দিয়ে হাতে টাকা দিয়েছিলেন। দুদিন যাতায়াতের পর তিনি সত্যজিৎ রায় কে বলেন : -এই ট্যাক্সি করে যাতায়াত কোরতে তিনি পারছেন না। এতে তিনি তাঁর অভিনয়ের স্বত: স্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলছেন। তারপর থেকে তিনি আবার ট্রামেই যাতায়াত শুরু করেন।




আজকালকার দিনে, কেউ ভাবতে পারবেন- এই কথা? অভিনয় করতেন কোনো মেক আপ ছাড়াই। খালি গায়ে স্যুটিং থাকলে তাঁর পৈতে দেখা যেত।
৩ রা মার্চ, ১৮৯৯ সালে হাওড়া জেলার গোয়ারী গ্রামে জন্ম। বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী রেলে কাজ করতেন বলে, পড়াশোনার জন্য কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে থাকতেন, তুলসী চক্রবর্তী। প্রসাদবাবু, ষ্টার থিযেটারে হারমোনিয়াম আর তবলা বাজাতেন। সেই সূত্র ধরেই অভিনয় জগতে প্রবেশ। ত্‌ৎকালীন ষ্টার থিযেটারের মালিক ছিলেন- অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর। সালটা ছিল ১৯১৬। এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো সব শিখেছিলেন। ১৯২০ তে প্রথম ষ্টেজে অভিনয় করেন। নাটকের নাম ছিল : - দুর্গেশনন্দিনী। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি ষ্টার থিযেটারেই ছিলেন। পরে যোগ দেন, মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২টা নাটকে অভিনয় করেন। শেষ নাটক ছিল- শ্রেয়সী ( ১৯৬০)। তার পর তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য ( হৃদযন্ত্র) আর নাটকে অভিনয় করেন নি।


১১ ই ডিসেম্বর ১৯৬১ তে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই অভিনেতা। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। প্রচণ্ড দারিদ্র তো ছিলই, তার ওপরে নিজের বাড়ীটা দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। স্ত্রী উষারাণী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য।
মারা যাবার পর সরকারের তরফ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনও বন্দোবস্ত ছিল না তখন। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না . তিনি আছেন . বাঙালির অন্তরে আছেন . থাকবেনও।

তুলসী চক্রবর্তী অমর রহে।

রূপোলী রূপকথার রাজপুত্তুর


ম্যাট্রিক পাশ করে, কলকাতা বন্দরে কেরানির কাজ  আর একই সময় বেশী রোজগারের আশায় স্কুলের ছেলেমেয়েদের গান শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে,কেজো জীবন শুরু হয়েছিল এই রাজপুত্তুরের ।
মেট্রো সিনেমাতে টর্চ লাইট নিয়ে “ আশারের” কাজ করতেন বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়
উত্তর কোলকাতার আহিরী টোলায় মামার বাড়িতে, ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬ এ জন্ম । বাবা নাম রেখেছিলেন অরুণ কুমার ।
জীবনের উত্থান পতন ছিলো তাঁর নিত্য সঙ্গীপাড়ার নাটকে অভিনয় করার সুবাদে পা রেখেছিলেন সিনেমার আঙিনায় । আজও মুক্তি পায় নি তাঁর প্রথম অভিনীত হিন্দী ছবি- মায়াডোর ।
১৯৩৯ সাল। দেশজুড়ে তখন এক অশান্ত অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা। সেই উত্তপ্ত সময়ের মধ্যে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন উত্তমের। একচল্লিশের ২২ শ্রাবণ। ১৫ বছরের অরুণ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায়, লক্ষ মানুষের মিছিল। পরের বছরই ভারত ছাড়োআন্দোলনের উন্মাদনায় ভবানীপুরের অলিগলিতে বের হতো অরুণের নেতৃত্বে স্বদেশি প্রভাতফেরি। অরুণেরই লেখা গান তারই সুরে গাওয়া হতো। সে বছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং পাস। ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন কলকাতার সাউথ সুবাবরণ মেইন স্কুল থেকে। ভর্তি হন গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। এখানে পড়েন কমার্স নিয়ে। ১৯৪২ সালেই নিদান ব্যানার্জির কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। ১৯৪৪ সালে পৌর কমিশনারস অফিসে খিদিরপুর ডকে ক্যাশিয়ারের চাকরি পান,  ২ হাজার টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে জমা দিয়ে।
১৯৪৭ সালে প্রথম ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওর ফ্লোরে আসেন উত্তম কুমার। প্রথম অভিনীত ছবি মায়াডোর’ (হিন্দি)
এ ছবিতে কাজ করে দৈনিক পাঁচ সিকি পেতেন। নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় কামনাছবিতে (১৯৪৯)নায়িকা ছিলেন ছবি রায়।কামনামুক্তি পাওয়ার পর এটি ফ্লপ করল।  সেই লড়াইটা ছিল ভয়ঙ্কর। ফ্লপ এবং ফ্লপ। হাত থেকে কনট্রাক্টের কাগজ ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রযোজক। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার চেহারাটা নায়কোচিত নয় তুলনাটা চলে আসত প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়ার সঙ্গে। দ্বিতীয় প্রতিপক্ষও তখন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সেই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।তাঁর মাচো-হিম্যানইমেজে গত শতাব্দীর পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিরা তখনও আত্মহারা। হৃদয়ের কুঠুরিতে লেখা হয়ে গেছেদুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কিংবা প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়াএই দুই নাম। তাদের পাশে নবাগত অরুণ কুমার।  নাম পালটে হলেন উত্তমকুমার । ভাগ্যিস বসু পরিবার (১৯৫২) বক্স অফিসের মুখ দেখেছিল।
উত্তম কুমার বিয়ে করেন ১৯৫০ সালের ১ জুন পদ্ম পুকুরের বাসিন্দা গৌরী দেবীকে। একমাত্র ছেলে গৌতমের জন্ম ১৯৫১ সালে। এই সংগ্রামের সময় গৌরী দেবী, উত্তমকুমারকে সব সময় সাহস যোগাতেন ।
কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় থাকতেন উত্তম কুমার। কাছাকাছি পাড়ায় সেকালের রূপবান নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য, পুরনো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, চরিত্রাভিনেতা ইন্দু মুখার্জি বসবাস করতেন। তাদের কাজ দেখে শিখেছেন উত্তম কুমার। আর তার সঙ্গে অবচেতন মনে ছিল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস, জ্যোতি প্রকাশ, অসিত বরণ ও রবীন মজুমদারের মতো রোমান্টিক সব নায়কের রূপালি পর্দায় দেখার অদৃশ্য শিহরণ।
অবশেষে  ১৯৫৩ তে এলো- ৭৪৷৷০ ( সাড়ে চুয়াত্তর) ১৯৫৪ তে অগ্নিপরীক্ষা । দুটোতেই নায়িকা সুচিত্রা সেন ।
ব্যাস্ ! পেছনে পড়ে রইলো দৃষ্টিদান (১৯৪৮), কামনা (১৯৪৯), মর্যাদা (১৯৫০), ওরে যাত্রী (১৯৫১), নষ্ট নীড় (১৯৫১), সঞ্জীবনী (১৯৫২)- এদের মত সব ফ্লপ ছবি ।
তখন প্রত্যেক মেয়েই চাইতো উত্তমকুমারের মত প্রেমিককে । উডু উডু অ্যালবাট চুল, বঙ্কিম গ্রীবা, হৃদয় তোলপাড় করা হাসি আর অভিনয়ের চূড়ান্ত আধুনিকতা এগুলোই  ছিল উত্তমের তুরুপের তাসসব মেয়ে ফিদা ।
মাত্র ৫৪ বছরেই নিভে গেল (২৪ জুলাই ১৯৮০, বৃহস্পতিবার রাত ৯-৩০ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে) এই মহানায়কের জীবন সলতে । একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে ।
বৃদ্ধ উত্তমকে ভাবাই যায় না । ভাবতেই পারি না ।

শিলচরের ভাষা আন্দোলন


“কমলা ভট্টাচার্য, কুমুদ দাস, শচীন পাল, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, সুকমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরুণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস এবং সত্যেন্দ্র দেব।”
-
এই নামগুলো কি আপনাদের চেনা  বা মনে পড়ে ?
আরও একটু ধরতাই দেই !
১৯৬১ সালের ১৯ মেবেলা ২.৩৫ মিনিট । জায়গাটা:- শিলচর স্টেশন
কেউ কেউ মনে করতে পারবেন- বোধহয়, অনেকেই মনে করতে পারবেন না ।
খুলেই বলি :-
উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা রাজ্য আসাম। আসামকে ভাগ করা হয়েছে দুটি উপত্যকায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বরাক উপত্যকা। বরাক উপত্যকায় রয়েছে তিনটি জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি। কাছাড় জেলার জেলা সদর শিলচর। এখানের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই বাঙালি বা বাংলায় কথা বলেন।
-

১৯৫১ সালে আদমশুমারিতে দেখা গেছে, বরাকে বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসাম রাজ্যের একটি অংশে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এটাই মেনে নিতে পারছিল না সেদিন অসমিয়া নেতারা। ফলে ভারত বিভাগের পর বাঙালিদের সঙ্গে অসমিয়াদের একটা ঠান্ডাযুদ্ধ লেগেই ছিল। আর এর জেরে সংখ্যালঘু অসমিয়ারা বাঙালিদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসত সরকারি মদদে। কারণ রাজ্য সরকারকে তখন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে অসমিয়ারাই। শুধু তা-ই নয়, যেসব খাস জমি বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে আবাদ করে উর্বর করে তুলেছে, সেই সব জমিও সরকার বাঙালিদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে দিয়ে দেয় অসমিয়া, খাসি ও গারোদের। ফলে এই নিয়ে বাঙালি-অসমিয়া বিরোধ শুরু হয়। বাঙালিদের মধ্যে বাড়তে থাকে ক্ষোভ ।
-
১৯৬০ সালের ২৮ অক্টোবর। আসাম বিধানসভায় পাস হওয়া আইনে বলা হয়, আসামের সরকারি ভাষা হবে অসমিয়া। বাঙালিসহ সবাইকে পড়তে হবে অসমিয়া ভাষায়। এই ঘোষণাকে সেদিন মেনে নিতে পারেননি বরাকের বাঙালিরা। তারা গর্জে ওঠে এর প্রতিবাদে। বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। সভাপতি হন আবদুর রহমান চৌধুরী আর সাধারণ সম্পাদক হন পরিতোষ পাল চৌধুরী। এই সংগ্রাম পরিষদকে ঘিরে বরাক উপত্যকার হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে যায় ভাষার প্রশ্নে। শুরু করে আন্দোলন। দাবি ওঠে, ‘জান দেব তবু ভাষা দেব না। চাই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, রাজ্যস্তরে সরকারি ভাষা হিসেবে।
শুরু হয় বরাকজুড়ে বাংলা ভাষার আন্দোলন। তখন আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের বিমলা প্রসাদ চালিহা। ইনিই আবার নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রে পরাজিত হয়ে শিলচরে এসে সেই বাঙালিদের আশার বাণী শুনিয়ে তাদের ভোটে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী চালিহাই ঘোষণা দেন, স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম হবে অসমিয়া। এই ঘোষণার পর তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বাঙালিদের মাঝে। শুরু হয় বরাক উপত্যকাজুড়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন। এই আন্দোলন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও কাছাড়ে। এরই মধ্যে শাসক দল কংগ্রেস থেকে ফতোয়া দেওয়া হয়, কোনো কংগ্রেস কর্মী ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না। স্কুল-কলেজে সরকারি নির্দেশ পৌঁছে গেল, কেউ যদি ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তাদের পেতে হবে শাস্তি।
এরপর ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা।
 

-
১৯৬১ সালের ১৯ মে। সব বাধা ভেঙে আসামে শুরু হলো বাংলা ভাষার দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সেদিন আন্দোলনে শরিক হতে শিলচর স্টেশনে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। চলছে অবস্থান ধর্মঘট। মানুষের মুখে মুখে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে নানা স্লোগান। বিকেল চারটার মধ্যে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিকেল দুইটা ৩৫ মিনিটে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো শিলচর স্টেশনে। ভারতের আধাসামরিক বাহিনী অতর্কিতে গুলি শুরু করে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর। এতে এখানে শহীদ হন আন্দোলনে যোগ দেওয়া ১১ তরুণ-তরুণী। 
শহীদ হলেন কমলা ভট্টাচার্য, কুমুদ দাস, শচীন পাল, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, সুকমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরুণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস এবং সত্যেন্দ্র দেব। সবারই বয়স ছিল ২৫-এর মধ্যে। কমলা ভট্টাচার্য এবং শচীন পালের বয়স ১৮ পার হয়নি। শহীদ হওয়ার আগের দিন এ দুজন স্কুলে দিয়েছিলেন জীবনের শেষ পরীক্ষা।
এই ঘটনার খবর ২০ মে ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে দেশজুড়ে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। দাবি ওঠে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। ৪০ হাজার মানুষের শোকমিছিল অনুষ্ঠিত হয় শিলচরে। তার পরই ১১ শহীদের শেষকৃত্য হয় শিলচর শ্মশানে। আজও সেই শ্মশানে এই ১১ শহীদের ১১টি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভের সামনে নামফলক রয়েছে শহীদদের। শুধু তা-ই নয়, শিলচর স্টেশনের সামনে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল এই ১১ তরুণ-তরুণীকে, সেখানেও তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। ১১ শহীদের নামে ১১টি স্তম্ভ।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ হয়েছিলেন -
“কমলা ভট্টাচার্য
=

=
তথ্য ও ঋণ :-
অমর সাহা | তারিখ: ১৯-০৫-২০১০প্রথম আলো

ভাষাচার্য্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্



চলচ্চিত্রের ফ্রেমে একটার পর একটা দৃশ্য যেমন বদলায়, ঠিক তেমনি আমাদের সমাজ জীবনেও নানা ধরণের ঘটনার ঘনঘটা ফ্রেমের পর ফ্রেমে ঘটে। গল্প কিন্তু একই থাকে ।  ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি নানা ধরণের বৈচিত্র্য ।  গল্প একই, তবে ফ্রেম পাল্টায় ।  ভাষা নিয়ে গবেষণা যুগে যুগে হয়েছে।  ভাষা নিয়ে চর্চা হয়েছে ,হচ্ছে , হবে । কিন্তু, একটা বাধা সবসময়েই থেকে যায় ।
আর্য্যরা, পঠন- পাঠন, লেখাতে সংস্কৃত ব্যবহার করত সাধারণ লোক, বাপ রে -মা রে করতে করতে প্রাকৃত ভাষাই সব কাজে ব্যবহার করত। সেই জন্য সাধারণ লোকেদের সাথে, সংস্কৃতর একটা দূরত্বও তৈরি হল। কারণটা হল প্রাকৃত ভাষা সব জায়গায় ছিল আলাদা, আলাদা । সব প্রাকৃত ভাষা এক ছিল না। আর সংস্কৃত শেখার জন্য যে সময় এবং অনুশীলন দরকার ছিল, সেটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল । আর, নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের জন্য যে ভাষার দরকার, সেটা তারা ভালভাবেই জানত, তাই সংস্কৃত ভাষার দরকার, সে ভাবে দরকার হয় নি, এবং এখনও সাধারণ মানুষ এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না ।
সংস্কৃত ভাষার চর্চা হত, কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের মধ্যে ।  মূলত, তারা ছিল ব্রাহ্মণ।  সংস্কৃত ভাষার চর্চা সীমাবদ্ধ রেখেছিল নিজেদের মধ্যেই । কিছু অব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণের লোকেদের তারা অনুমতি দিত এই ভাষার চর্চার জন্য । কিন্তু, কখনই অহিন্দুদের দিত না ।
সংস্কৃত “দেবভাষা”, তাই অহিন্দু বা যবনদের এই অধিকার দিতে কুণ্ঠা বোধ করত ব্রাহ্মণ্য বাদীরা তবে, আল বারুণী, দারা শিকহ- এই ভাষার চর্চা যে করতে পেরেছিলেন, তার প্রধান কারণ ছিল তাঁরা শাসক বর্গের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । আরও কিছু ব্যতিক্রম ছিল, কিন্তু সেটা উল্লেখ করতে গেলে এই প্রবন্ধের আয়তন বেড়ে যাবে
আমরা যদি এই আধুনিক কালে ফিরে আসি, তাহলে দেখবো সেই একই চরিত্র, এই সব সংস্কৃত চর্চার কারবারিদের ।  এই ভাষার শিক্ষা এবং তার চর্চার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছিলেন একজন তথাকথিত “অহিন্দু”সেই সংগ্রাম এখন ভুলে যাওয়া এক ইতিহাস । বাঙালি কবে তাদের নিজেদের ইতিহাস মনে রেখেছে? খোঁজ নেয় না, কিভাবে এই সব মানুষ সংগ্রাম করেছিলেন ।
সেই ইতিহাস, ভাষাচার্য্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ র । বেঁড়াচাপার একটা কলেজ তাঁর নামে, এপার বাংলায় আছে । এবারে ফিরে দেখা যাক তাঁর জীবন এবং সংগ্রাম প্রতিটি ঘটনাই যেন সিনেমার ফ্রেম।
 বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে, ১৮৮৫ সালের ১০ ই জুলাই  তাঁর জন্ম । পূর্বপুরুষদের সাথে হাড়োয়ার পীর গোরাচাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। শহীদুল্লাহর মাতা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিলো প্রচণ্ড আগ্রহতিনি বাড়িতে তাঁর পরিবার ও পেয়ারা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের শিক্ষা দিতেন। প্রথম দিকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ র নাম রাখা হয় মুহম্মদ ইব্রাহীম‌্কিন্তু, পরবর্তী সময়ে বাবার পছন্দে আকিকা করে তাঁর নাম আবার রাখা হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্পরিবারে তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদুল্লাহ‌্ ছোটোবেলায় ছিলেন দারুণ আমুদে ও আত্মভোলা। বাড়ির সবাই আদর করে তাঁকে ডাকতেন সদানন্দবলে। গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিত মশাইরা তাঁকে ডাকতেন সিরাজ দৌলাহ্নামে। কিন্তু তিনি নিজের নাম রেখেছিলেন জ্ঞানানন্দ সংগ্রামী
ছোটোবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে শহীদুল্লাহ্ উর্দূ, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। পাঠশালার পড়া শেষ করে ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলের ছাত্র থাকতেই বই পড়ার এবং নানা বিষয়ে জানার প্রতি ছিলো তাঁর দারুণ নেশা। হাওড়া স্কুলের স্বনামখ্যাত ভাষাবিদ আচার্য হরিনাথ দে সংস্পর্শে এসে শহীদুল্লাহ ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দূর পাশাপাশি হিন্দি ও ওড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে সংস্কৃতসহ এনট্রান্স্ পাশ করেন। এরপর কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে ১৯০৬ সালে এফ.এ পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে ১৯১০ সালে, সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেছিলেন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে  শহীদুল্লাহ্ র-ই  এই কৃতিত্ব প্রথম
এরপর স্বাভাবিক ভাবেই তিনি এম.এ তে ভর্তি হলেন সংস্কৃত নিয়ে পড়বার জন্য । তখন, এম. এ পাঠক্রমে অন্যতম বিষয় ছিল “বেদ”দু- মাস ঠিক ভাবে কাটলেও, গোলমালটা বাধালেন, বৈদিক পণ্ডিত “সত্যব্রত সামশ্রমী”তিনি, কোনো অহিন্দুকে বেদ পড়াবেন না বলে জেদ ধরে বসলেন । সেই, ব্রাহ্মণ্য বাদের অহেতুক গোঁড়ামি
শহীদুল্লাহ্ কে ভীষণ স্নেহ করতেন, উপাচার্য  স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় । তিনি অনেক অনুরোধ করেন সত্যব্রত বাবুকে । কিন্তু, সব অনুরোধ বিফলে গেল । অনাবশ্যক অটল জেদ ধরে বসে রইলেন  “সত্যব্রত সামশ্রমী”
এই ব্যাপারে সেই সময়ে, শিক্ষাজগতে একটা সাংঘাতিক আলোড়ন পড়ে যায় । অগ্রগণ্য মুসলিম নেতা, মুহম্মদ আলি তাঁর ইংরেজি পত্রিকা  “Comrade”   “ The Sahidullah Affair”  নামে একটা প্রবন্ধ,  কড়া ভাষায় লেখেন । ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি দিল্লি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহ্ কে সংস্কৃত পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি বিষয় চালু করে তাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  আদালতের দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী স্যার আশুতোষ, ভাষাতত্ত্ব বিভাগনামে নতুন একটি বিভাগ চালু করেন। ফলে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
শহীদুল্লাহ্ খুব বিব্রত বোধ করতে থাকেন। জনগণের সামনে তাঁর এই ব্যাপারটা চলে আসায় খুবই কুণ্ঠিত হয়েছিলেন।
সংস্কৃত ভাষা চর্চার জন্য শহীদুল্লাহ্ র এই ভাবে বাধা আসার জন্য স্যার আশুতোষ আরও একটা বিকল্প চেষ্টা করলেনতিনি, শহীদুল্লাহ্ যাতে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে সংস্কৃত পড়তে পারেন, তারও ব্যবস্থা করেন । এবারও শহীদুল্লাহ্ ব্যর্থ । বিদেশে যাবার জন্য তখন স্বাস্থ্য পরীক্ষা হত । আগের অসুস্থতা শরীরে ছাপ রেখে যাওয়ায়, শহীদুল্লাহ্ সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না । শহীদুল্লাহ্ এবং স্যার আশুতোষের স্বপ্ন ব্যর্থ হল।
উপায়ন্তর না দেখে, তিনি আইন বিভাগে ভর্ত্তি হয়ে, দু বছর বাদে আইনের স্নাতক হন । এরপর, তিনি চলে যান চট্টগ্রামের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতে । সেখানেও, এক বছরের বেশী মন টেঁকে নি ফিরে এলেন বসিরহাটেশুরু করলেন ওকালতি ।
বিচারপতি হিসেবে আশুতোষ এলেন একদিন বসিরহাট আদালতে পরিদর্শন করতে । কথা বার্তা শুরু হল শহীদুল্লাহ্ র সাথে । তীব্র মনঃকষ্টের কথা খুলে বললেন শহীদুল্লাহ্, স্যার আশুতোষকে। স্নেহ ভাজনের এই অবস্থা দেখে, স্যার আশুতোষ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ব বিভাগে গবেষণার সুযোগ করে দিলেন শহীদুল্লাহ্ কে । সেটা ১৯১৯ সাল ।
ছাত্রাবস্থা থেকেই শহীদুল্লাহ্ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সুবাদে । পরিষৎ - পত্রিকায়  তাঁর গবেষণা মূলক প্রবন্ধ ছাপা হত । সেখান থেকেই পরিচিত হন- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে ।
১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী । তাঁরই চেষ্টায়, শহীদুল্লাহ্ ওই বিভাগে লেকচারারের পদ পান ।
কিন্তু সংস্কৃত ভাষার নেশা শহীদুল্লাহ্ কে পেয়ে বসেছিল । সেই নেশায় পড়ে, তিনি তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় পৌঁছলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯২৬ সালে । 
বৈদিক ( সংস্কৃত ) ভাষার সঙ্গে তিনি পড়তে লাগলেন- প্রাচীন পারসিক( আবেস্তা), তিব্বতী এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ব। বৌদ্ধ তান্ত্রিক ভাষার ওপরে গবেষণা করে তিনি ১৯২৮ সালে ডি-লিট উপাধি পেলেন । ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম Tris Honorableপ্যারিসেরই Archive de la Parole থেকে ধ্বনিতত্বের ( ফোনেটিক্স)  ওপর ডিপ্লোমাও পান ।
এর পরে, তিনি আরও পড়ার জন্য জার্মানীর ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে বৈদিক সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাকৃত ও আরবী ভাষাও পড়েন। তবে, পড়া শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয় ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে ভার গ্রহণ করেন । ১৯৪৪ সালে অবসর নেবার পরও তাঁর দম ফেলবার ফুরসত ছিল না । গবেষণা,  ভাষা আর নানা রকম বিদ্যাচর্চায় তাঁর ভাঁটা পড়ে নি ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, তাঁকে সেখানকার বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে ভার নেন । ১৯৬৭ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমিরেটাস প্রফেসরের মর্যাদা দেয় ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্য্যাপদ আবিস্কার করলে, যে কয়জন এর চর্চায় মন দিয়েছিলেন, শহীদুল্লাহ্ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য পথিকৃৎ । তিনিই প্রথম চর্য্যাপদর ধর্মতত্ব বিষয়ক আলোচনা করেন ।
এই ব্যাপারে গবেষণার জন্য তাঁকে, একই সঙ্গে অসমিয়া, ওড়িয়া, মৈথিলি, হিন্দি,গুজরাতি, মারাঠি, সিন্ধি, লাহিন্দা, কাশ্মীরি,নেপালি, মালদ্বীপী প্রভৃতি ভাষার চর্চা করতে হয় ।
বৌদ্ধগান ও দোহা সম্বন্ধে তাঁর একটি গবেষণা মূলক বই প্রকাশ করে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় । এই বইটার ইংরেজী সংস্করণ বের করে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় । ফরাসী ভাষায় সুপণ্ডিত শহীদুল্লাহ্ ফরাসী ভাষাতেও বই লিখেছিলেন ।
“শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” এর ভাষাতত্ব বিষয়ে তাঁর কাজ বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখ যোগ্য অবদান । অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দূ উন্নয়ন সংস্থার উর্দূ অভিধান প্রকল্প, ঢাকায় বাঙলা একাডেমীর পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পএবংইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পেসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বহি কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাঙলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia -তে তিনি UNESCO - প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্র বিদ্বেষ নীতি, শহীদুল্লাহ্ সমর্থন করতে পারেন নি । তিনি বলেছিলেন :-“রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে বিশ্ববাসী। তাঁর বাণী সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্য। আমরা, পাকিস্তানীরা রবীন্দ্রনাথের উচ্চ ভাবধারাকেও আমাদের জিনিস বলে দাবী করতে পারি।”
এজন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত । এই একই হাল হয়েছিল তাঁর উত্তর সূরী সৈয়দ মুজতবা আলির ।
১৯৬২ সালে, ভারত সরকার ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরলন্ড টয়েনবি আর ইতালির ভারত তত্ত্ববিদ প্রফেসর তুচ্চির সাথে শহীদুল্লাহ্ কে Indian Council for Cultural relations  Fellow হিসেবে নির্বাচিত করলেও পাকিস্তান সরকার সেই সন্মান তাঁকে নিতে দেয় নি ।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে প্রথম লেখনি ধারণ করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যাপ্রবন্ধে বলেন,
পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন পশতু, বেলুচি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা; কিন্তু উর্দূ পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়,তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দূ ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য। বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দূ বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দূ ভাষার স্বপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।
এই প্রতিবাদ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে, জন্ম দিয়েছিল রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের। ডক্টর শহীদুল্লাহ্ রয়ে গেলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন,
আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালল-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার কোন জো-টি নেই।
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের আহ্বানে তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মাঝে সশরীরে উপস্থিত থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পুলিশি হামলায় টিয়ার গ্যাসে নিগৃহীত হয়েছেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন বাঙলা ভাষার প্রথম সহজবোধ্য বাংলা ব্যাকরণলিখলেন তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি হয়ে তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, আপনার বাংলা ব্যাকরণখানি পড়ে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। ব্যাকরণখানি সকল দিকেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে ছাত্রদের উপকার হবে। বইখানি আমার শান্তি নিকেতনের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের দেব। তাঁরা তা শ্রদ্ধাপূর্বক ব্যবহার করবেন।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিশু-কিশোরদের জন্য
আঙুরপত্রিকা বের করার পর একে স্বাগত জানিয়ে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত লোকসাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, আপনার মত এত বড় পণ্ডিত, যাহার বিদ্যার পরিধি আয়ত্ত করিবার সাধ্য আমাদের নাই, যিনি বেদ-বেদান্তের অধ্যাপক, ফার্সি ও আরবী যার নখদর্পণে, যিনি জার্মান ব্যাকরণের জটিল বুহ্য ভেদ করিয়ে অবসর রঞ্জন করে-তিনি একটি আঙুরহাতে নিয়া উপস্থিত!
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাইড অফ পারফরম্যানএবং ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্সপদকে ভূষিত করেন। আজীবন উদ্যমী এই মানুষটি সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘ভালো হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
তথ্যঋণ এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার :-
“শব্দনীড়” ওয়েবজিনে প্রকাশিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙলা ভাষা, ভাষা আন্দোলন
হারাধন চৌধুরী ( বর্তমান দৈনিক পত্রিকা )
সংসদ বাঙালা চরিতাবিধান; সাহিত্য সংসদ
আচার্য সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায়; বাংলা সাহিত্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ.বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি


নালন্দা


নালণ্দা
উপ মহাদেশের ইতিহাস বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুরএখানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ধর্মের নানা মুখী সংঘাত ও সংমিশ্রণের ইতিহাস, একই সাথে আছে শিক্ষা সভ্যতার প্রগতি ও বিলয়ে ভরা ইতিহাসমধ্য যুগে এই ইতিহাস রচনায় কাণ্ডারি ছিলেন বৌদ্ধ রাজারাসংসার ত্যাগী বুদ্ধ মতবাদের প্রচার প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তারা রাজ্য জুড়ে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বৌদ্ধ বিহারএই সব বিহার থেকে কিছু কিছু বিহার পরে অবাধ জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খোলস ছাড়িয়ে হাজার বছর আগে খ্যাতি পেয়েছিল বিশ্ব বিদ্যালয়ে রূপেতার মধ্যে-
বিক্রম শীলাঃ- ভারতের ভাগলপুর জেলার আন্টিচক, মাধোরামপুর, উরিয়াপ এই তিনটি গ্রাম নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল
সোমপুরঃ- বাংলাদেশের নওগাঁতে
ওদন্তপুরীঃ-মগধে অবস্থিত ছিলপাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত ছিল

জগদ্দলঃ- বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত ছিল
বাংলাদেশের রাজশাহী, পঞ্চগড়, ঠাকুর গাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ এবং ভারতের মালদা নিয়ে গঠিত ছিলকোন কোন ঐতিহাসিক জগদ্দল নওগাঁয় আবার কেউ জগদ্দল কে দিনাজপুরে স্থাপিত হয়েছিল বলে মত প্রকাশ করেন, তবে যেখানেই হোক না কেন সেটা যে বর্তমান বাংলাদেশের ভূখন্ডেই ছিল সেটা নিশ্চিত
তক্ষশীলাঃ-পাকিস্তানে অবস্থিত ছিলবর্তমান ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ও রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তরপশ্চিমেপ্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের জনক বলে খ্যাত চাণক্য এখানেই লেখা পড়া করেনশিক্ষা শেষে তিনি এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের আচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন
 নালন্দার মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাঠামোর ভিত্তি ভূমি স্থাপন করে দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ শাসকরা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার যে রাস্তা তৈরি করে গিয়েছিলেন সেখানে থেকে আমরা কেন আলোর পথ পরিহার করে অন্ধকারের পথে হাটা শুরু করলাম? এই কেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু করলে সর্ব প্রথম যে সহজ সরল উত্তরটি আমাদের সামনে ভেসে আসে তা হল ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসাবৌদ্ধ শাসন আমলে হিন্দু ব্রাহ্মণ দের আয় রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ায় ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়ায় তাদের মনের ভিতর যে আগুন বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে গোপনে অতি কষ্টে সংরক্ষিত ছিল তার বিস্ফোরণ ঘটায় হিন্দু রাজাদের শাসনামলে এসেসুযোগ হাতে পেয়েই তারা নিরীহ প্রগতি শীল বৌদ্ধদের নির্মম অত্যাচার, উৎপীড়ন, দমন ও হত্যা করে ভারত বর্ষ থেকে বিতাড়িত করেরাজ আনুকূল্য বন্ধ করে ধ্বস নামায় এই সব সার্বজনীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, উপরন্তু ব্রাহ্মণ্য বাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠায় জোরালো করেছিল দেবদাসী, সহমরণ ও তীব্র জাতি ভেদ প্রথার মত ঘৃণ্য সব প্রথার
ব্রাহ্মণ্য বাদের আলোচনা -সমালোচনা করা আমার মুখ্য বিষয় নয়প্রারম্ভিক কথাগুলো কান টানলে মাথা আসার মতইআমার আলোচনা নালন্দার সফল অগ্রগতি ও শেষে করুণ পরিণতি নিয়ে
পাল রাজাদের শাসন আমলে সোমপুর, বিক্রমশীলা ও নালন্দা একই প্রশাসনের অধীনে কাজ করতপ্রয়োজনে শিক্ষকরা এই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করে উন্নত শিক্ষার মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রজ্ঞাবর্মণ গুপ্ত রাজা কুমারগুপ্তকে নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করে গেছেনখনন কার্যে প্রাপ্ত একটি সীলমোহর থেকেও এই দাবীর পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নালন্দাশব্দটি এসেছে নালমএবং দাথেকেনালমশব্দের অর্থ পদ্ম ফুল যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে আর দাদিয়ে বুঝানো হয়েছে দান করাতার মানে নালন্দাশব্দের অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞান দানকারী”, প্রতিষ্ঠান টি প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরনের মত দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলস ভাবে

নালন্দা ঠিক কবে স্থাপিত হয়েছিল তা আজ সঠিক ভাবে বলা হয়তো সম্ভব নয়
কোথাও পেলাম ৪২৭ খ্রীষ্টাব্দ আবার এক জায়গায় পেলাম ৪৫০ তা যা হোক ধরে নিলাম ৪২৭ থেকে ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ের মধ্যে এটি স্থাপিত হয়ে থাকবে
এই বিশ্ব বিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত বড়গাঁওগ্রামের পাশেইপাটনার আদি নাম পাটালিপুত্রদুই হাজার তিনশ বছর আগে মৌর্যদের রাজধানী ছিল এই পাটালিপুত্রসম্রাট অশোক এখান থেকেই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছেবিহারশব্দের অর্থ বিচরণ”, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেখানে অবস্থান করেন বা বিচরণ করেন তাকে বলে বৌদ্ধ বিহার”, প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার স্বর্ণ যুগে এই অঞ্চলে প্রচুর বৌদ্ধ বিহারের উপস্থিতি থাকায় পরবর্তীতে ভারতের এই রা্জ্যের নাম করন হয়েছে বিহার”, মৌর্যদের পর বিহার চলে আসে গুপ্ত রাজাদের শাসনেপরে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৪ সালে বিহার দখল করেনমোগলদের পর বিহার হাত বদল হয়ে আসে নবাব দের দখলেনবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা এর বিহার দখল নেয়১৯১১ সালে বাংলা থেকে বিহার ও ওডিশা পৃথক হয়
নালন্দা প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি মহা বিহারযেখানে মূলত বৌদ্ধ দর্শনের খুঁটি নাটি, বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের অনুশাসন বিষয়ে পাঠ দান চলতস্থিতিশীল রাজ্য পরিচালনা, দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিকল্প নেই একটি সভ্য, উন্নত ও প্রগতিশীল মনন সম্পন্ন জাতিরযা তৈরী করতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট নয় এসত্য সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তৎকালীন নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বৌদ্ধ শাসকরাতাদের যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে বৌদ্ধ ধর্মের পাশা পাশি তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার উপযোগী, সাহিত্য, সংষ্কৃতি ও আন্তর্জাতিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আরো অনেক শাখা যুক্ত করে তারা নালন্দাকে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেনসম্রাট অশোক এখানে একটি বিহার তৈরী করেনগুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেনমূলত গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করেপরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাট গণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ব বিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান
নালন্দাকে তাঁরা গড়ে তুলে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ব বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা হিসাবেযে কেউ ইচ্ছে করলেই নালন্দায় লেখা পড়ার সুযোগ পেত নাএর জন্য প্রয়োজন হত শিক্ষার্থীর যোগ্যতারশিক্ষার্থী সত্যিই নালন্দায় লেখাপড়া করার যোগ্য কিনা তা প্রমাণের জন্য প্রবেশ দ্বারে দিতে হত মৌখিক পরীক্ষাসাফল্যের সাথে এই ভর্তি পরীক্ষায় উৎরে গেলেই মিলত এখানে বিদ্যা লাভের নিশ্চয়তাপরীক্ষা মোটেই সহজ ছিল নাএতটাই কঠিন ছিল প্রতি দশ জনে মাত্র তিন জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারতভাবতে অবাক লাগে তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ তাদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরো ২,০০০ শিক্ষকগড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক কত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের বিদ্যা দান সম্ভব তাও আবার থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ, ভেবে সত্যি অবাক না হয়ে উপায় নেইএই বিশ্ব বিদ্যালয়টির বিশাল খরচ চালানোও যেন তেন বিষয় ছিল নাঅর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় যাতে নালন্দার প্রশাসনকে কারো উপর নির্ভরশীল হতে না হয় সেদিক বিবেচনা করে ২০০ গ্রামকে শুধু মাত্র নালন্দার ব্যয় মিটানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যা উৎসাহী বৌদ্ধ শাসকরাএই সব গ্রাম গুলোর অবস্থান শুধু নালন্দার আশে পাশে ছিল না, ছিল সমগ্র বিহার রাজ্যের ৩০টি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়েচিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করে গ্রাম গুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অনান্য গ্রাম থেকেএই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের যোগান আসত
বাইরের কোন প্রকার উটকো ঝামেলা যাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্য উঁচু লাল ইটের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা ছিল সমগ্র বিশ্ব বিদ্যালয় চত্বরভিতরে ঢুকার জন্য ছিল বিশাল প্রবেশ দ্বারবিদ্যালয় টিতে ছিল ৮ টি ভিন্ন ভিন্ন চত্বর, শ্রেণী কক্ষ, ধ্যান কক্ষ এবং দশটি মন্দিরবিদ্যালয়টির শিক্ষার প্রাকৃতিক পরিবেশ যথাসাধ্য স্নিগ্ধ ও কোমল রাখতে সমগ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু সুরম্য উদ্যান যেগুলো ভরা ছিল বিচিত্র ফুল ফলের গাছ দিয়েস্নান ও প্রয়োজনীয় জলের সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল কয়েকটি দীঘিছাত্রদের জন্য ছিল ছাত্রাবাসজলের সমস্যার জন্য ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেদিকটা মাথায় রেখে প্রতিটি ছাত্রাবাসে পানীয় জলের অসুবিধা দূর করতে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু কুয়োমোট কথা সমগ্র নালন্দা ছিল নিখুঁত পরিকল্পনায় গড়া একটি শিক্ষা স্বর্গ


বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি বেদ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষা ব্যাবস্থার উপযোগী আরো বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত এখানে
শিক্ষকদের পাঠ দান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠনালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত প্রতিকুল এবরো থেবরো যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি সুদূর তিব্বত, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রীস তুরষ্ক থেকে ছুটে আসা বিদ্যা অনুরাগীদের


ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব দূরীকরণ এবং একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানের সমাবেশ ঘটাতে তৈরী করা হয়েছিল তিনটি সুবিশাল লাইব্রেরীলাইব্রেরী ভবন গুলো পরিচিত ছিল যথাক্রমে “রত্ন সাগর, রত্ন দধি ও রত্ন রঞ্জক” নামেলাইব্রেরীর নাম করণ থেকে অনুমান করা যায় নালন্দার শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতাচীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর মতে এখানে যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাদের জ্ঞানের খ্যাতি প্রসারিত ছিল বহুদূর ব্যাপি, চারিত্রিক দিক দিয়েও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ চরিত্রের অধিকারীর্নিলোভী এই শিক্ষকরা ভাল করেই অবগত ছিলেন বহুদূর দূরান্তের ছাত্ররা বন্ধুর পথের কষ্ট মাথায় নিয়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসতেন বিদ্যা পিপাসায়তাই তাঁরাও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেনলাইব্রেরীর প্রতিটি ভবনের উচ্চতা ছিল সুবিশাল প্রায় ৯ তলা বিশিষ্ট দালানের সমানএত বিশাল ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরী বর্তমান শিক্ষা সংষ্কৃতি ও ছাপাখানা প্রযুক্তির সহজ লভ্য যুগেও সচরাচর দেখা যায় নাপ্রায় ৮০০ বছর ধরে লাইব্রেরী গুলো ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছিল হাজার হাজার পুঁথি, ধর্মীয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের বই, চিকিৎসা শাস্ত্র, ও নানান গবেষণা লব্ধ মূল্যবান বই দিয়েপৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বই গুলো এখানে অনূদিত হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথেবিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান গরিমায় আর পাণ্ডিত্যে যাঁরা সে সময়ে উচ্চ পর্যায়ের ছিলেন তাঁরাই ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নালন্দায় সন্মিলিত হয়েছিলেন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের জন্য, ছাত্ররাও ছিল প্রাণবন্ত, শ্রদ্ধাবান, সুযোগ্য ও বিদ্যা উৎসাহীপৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই এখানে সমবেত হওয়ার কারণে, ভিন্নতা ছিল তাদের ভাষায়, ভিন্নতা ছিল তাদের ধর্মে, ভিন্নতা ছিল তাদের সংষ্কৃতিতেকিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎএই উদ্দেশ্যই তাদের করেছিল বিনয়ী ও একতা বদ্ধ
প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় এক সময় এত সুবিশাল একটি বিশ্ব বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান শীল ভদ্রযিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙ এর গুরুপ্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেনতিনি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেনআরো একজন বঙ্গীয় স্বনাম ধন্য পন্ডিত ব্যক্তির কথা উল্লেখ না করে উপায় নেই তিনি হলেন ঢাকার বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করা অতীশ দীপঙ্করবর্তমানে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান নাস্তিক পন্ডিতের ভিটানামে পরিচিততিনি ১৫ বছর ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারের শিক্ষকতা ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন বেশ সফলতার সাথে

শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটি সভ্য, উন্নত জাতি তৈরী ও জ্ঞান উৎপাদনকারী নিরীহ এই প্রতিষ্ঠানটি ১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী আক্রমন করে ধ্বংস করে ফেলেন
তার আক্রমনের বর্বরতা এত ভয়াবহ আকারে ছিল এ সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাঁর তাবাকাতে নাসিরিগ্রন্থে লিখেছেন হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন খিলজীএরপর আগুন লাগিয়ে দেন লাইব্রেরীর ভবন গুলোতে কোরাণ না থাকাতে এই পরিণতি বলে, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন । লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমাণ এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে(জনশ্রুতি আছে ছয় মাস) খলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করেন নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছেন একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা জানতে পারতাম সে যুগের ভারত বর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কেজাতি হিসাবেও হয়তো আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে সহস্র বছরসেদিন তার ধারালো তরবারির নিষ্ঠুর আঘাতে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া নিরস্ত্র মানুষের আর্ত চিৎকারে ও জীবন্ত মানুষ পোড়া গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে আসা বাচঁতে চাওয়া ঝলসানো সাধারণ মানুষ গুলোর করুণ আর্তনাদে স্তব্ধ হয়েছিল একটি সভ্য জাতির অগ্রযাত্রা

খলজীর এই পাশবিক নিষ্ঠুর বর্বরতাও পরিচিতি পায় এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের চোখে ধর্মীয় বিজয় হিসাবে!
এই পোড়া ভগ্ন স্তুপ থেকে নালন্দাকে আবারো মাথা তুলে দাঁড় করানোর শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন মুদিত ভদ্র নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু কিন্তু এইবার পুনরায় তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে থাকা দুই ক্ষু্ব্ধ ধর্মান্ধ ব্রাহ্মণ কারণ, তখন বেদ ছিল না সেখানে । ( থাকবে কি করে? পুড়ে গেছিল) এখানে আবারো ঘটে আরেক সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় বিজয়!
নালন্দায় বার বার ধর্মীয় বিজয় সফল হলেও লজ্জিত হয় মানবতা, পরাজিত হয় সভ্যতা, শৃঙ্খলিত হয় শিক্ষা
এভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা, আক্রোশ, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল ধর্মান্ধরা কয়েকশ বছর ধরে মানব সভ্যতাকে আলোর পথ দেখানো মানুষ গড়ার এই কারখানাটিকে এর ফলেই আমরা খুঁজে পাই না, আমাদের বহু ইতিহাস বা তথাকথিত সিস্টেমেটিক স্টাডির ব্যাখ্যান ।

তথ্য সংগ্রহঃ ইন্টারনেট ও বিভিন্ন বই ।