Friday, May 24, 2013

ভাষাচার্য্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্



চলচ্চিত্রের ফ্রেমে একটার পর একটা দৃশ্য যেমন বদলায়, ঠিক তেমনি আমাদের সমাজ জীবনেও নানা ধরণের ঘটনার ঘনঘটা ফ্রেমের পর ফ্রেমে ঘটে। গল্প কিন্তু একই থাকে ।  ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি নানা ধরণের বৈচিত্র্য ।  গল্প একই, তবে ফ্রেম পাল্টায় ।  ভাষা নিয়ে গবেষণা যুগে যুগে হয়েছে।  ভাষা নিয়ে চর্চা হয়েছে ,হচ্ছে , হবে । কিন্তু, একটা বাধা সবসময়েই থেকে যায় ।
আর্য্যরা, পঠন- পাঠন, লেখাতে সংস্কৃত ব্যবহার করত সাধারণ লোক, বাপ রে -মা রে করতে করতে প্রাকৃত ভাষাই সব কাজে ব্যবহার করত। সেই জন্য সাধারণ লোকেদের সাথে, সংস্কৃতর একটা দূরত্বও তৈরি হল। কারণটা হল প্রাকৃত ভাষা সব জায়গায় ছিল আলাদা, আলাদা । সব প্রাকৃত ভাষা এক ছিল না। আর সংস্কৃত শেখার জন্য যে সময় এবং অনুশীলন দরকার ছিল, সেটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল । আর, নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের জন্য যে ভাষার দরকার, সেটা তারা ভালভাবেই জানত, তাই সংস্কৃত ভাষার দরকার, সে ভাবে দরকার হয় নি, এবং এখনও সাধারণ মানুষ এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না ।
সংস্কৃত ভাষার চর্চা হত, কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের মধ্যে ।  মূলত, তারা ছিল ব্রাহ্মণ।  সংস্কৃত ভাষার চর্চা সীমাবদ্ধ রেখেছিল নিজেদের মধ্যেই । কিছু অব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণের লোকেদের তারা অনুমতি দিত এই ভাষার চর্চার জন্য । কিন্তু, কখনই অহিন্দুদের দিত না ।
সংস্কৃত “দেবভাষা”, তাই অহিন্দু বা যবনদের এই অধিকার দিতে কুণ্ঠা বোধ করত ব্রাহ্মণ্য বাদীরা তবে, আল বারুণী, দারা শিকহ- এই ভাষার চর্চা যে করতে পেরেছিলেন, তার প্রধান কারণ ছিল তাঁরা শাসক বর্গের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । আরও কিছু ব্যতিক্রম ছিল, কিন্তু সেটা উল্লেখ করতে গেলে এই প্রবন্ধের আয়তন বেড়ে যাবে
আমরা যদি এই আধুনিক কালে ফিরে আসি, তাহলে দেখবো সেই একই চরিত্র, এই সব সংস্কৃত চর্চার কারবারিদের ।  এই ভাষার শিক্ষা এবং তার চর্চার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছিলেন একজন তথাকথিত “অহিন্দু”সেই সংগ্রাম এখন ভুলে যাওয়া এক ইতিহাস । বাঙালি কবে তাদের নিজেদের ইতিহাস মনে রেখেছে? খোঁজ নেয় না, কিভাবে এই সব মানুষ সংগ্রাম করেছিলেন ।
সেই ইতিহাস, ভাষাচার্য্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ র । বেঁড়াচাপার একটা কলেজ তাঁর নামে, এপার বাংলায় আছে । এবারে ফিরে দেখা যাক তাঁর জীবন এবং সংগ্রাম প্রতিটি ঘটনাই যেন সিনেমার ফ্রেম।
 বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে, ১৮৮৫ সালের ১০ ই জুলাই  তাঁর জন্ম । পূর্বপুরুষদের সাথে হাড়োয়ার পীর গোরাচাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তিনি ছিলেন বাবা-মার পঞ্চম সন্তান। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ইংরেজ আমলে সরকারি জরিপ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। শহীদুল্লাহর মাতা হরুন্নেছা খাতুনের শিক্ষার প্রতি ছিলো প্রচণ্ড আগ্রহতিনি বাড়িতে তাঁর পরিবার ও পেয়ারা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের শিক্ষা দিতেন। প্রথম দিকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ র নাম রাখা হয় মুহম্মদ ইব্রাহীম‌্কিন্তু, পরবর্তী সময়ে বাবার পছন্দে আকিকা করে তাঁর নাম আবার রাখা হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্পরিবারে তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদুল্লাহ‌্ ছোটোবেলায় ছিলেন দারুণ আমুদে ও আত্মভোলা। বাড়ির সবাই আদর করে তাঁকে ডাকতেন সদানন্দবলে। গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিত মশাইরা তাঁকে ডাকতেন সিরাজ দৌলাহ্নামে। কিন্তু তিনি নিজের নাম রেখেছিলেন জ্ঞানানন্দ সংগ্রামী
ছোটোবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে শহীদুল্লাহ্ উর্দূ, ফার্সী ও আরবি শেখেন এবং গ্রামের পাঠশালায় সংস্কৃত পড়েন। পাঠশালার পড়া শেষ করে ভর্তি হন হাওড়া জেলা স্কুলে। স্কুলের ছাত্র থাকতেই বই পড়ার এবং নানা বিষয়ে জানার প্রতি ছিলো তাঁর দারুণ নেশা। হাওড়া স্কুলের স্বনামখ্যাত ভাষাবিদ আচার্য হরিনাথ দে সংস্পর্শে এসে শহীদুল্লাহ ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি আরবী-ফার্সী-উর্দূর পাশাপাশি হিন্দি ও ওড়িয়া ভাষা পড়তে শিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে সংস্কৃতসহ এনট্রান্স্ পাশ করেন। এরপর কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে থেকে ১৯০৬ সালে এফ.এ পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে ১৯১০ সালে, সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেছিলেন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে  শহীদুল্লাহ্ র-ই  এই কৃতিত্ব প্রথম
এরপর স্বাভাবিক ভাবেই তিনি এম.এ তে ভর্তি হলেন সংস্কৃত নিয়ে পড়বার জন্য । তখন, এম. এ পাঠক্রমে অন্যতম বিষয় ছিল “বেদ”দু- মাস ঠিক ভাবে কাটলেও, গোলমালটা বাধালেন, বৈদিক পণ্ডিত “সত্যব্রত সামশ্রমী”তিনি, কোনো অহিন্দুকে বেদ পড়াবেন না বলে জেদ ধরে বসলেন । সেই, ব্রাহ্মণ্য বাদের অহেতুক গোঁড়ামি
শহীদুল্লাহ্ কে ভীষণ স্নেহ করতেন, উপাচার্য  স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় । তিনি অনেক অনুরোধ করেন সত্যব্রত বাবুকে । কিন্তু, সব অনুরোধ বিফলে গেল । অনাবশ্যক অটল জেদ ধরে বসে রইলেন  “সত্যব্রত সামশ্রমী”
এই ব্যাপারে সেই সময়ে, শিক্ষাজগতে একটা সাংঘাতিক আলোড়ন পড়ে যায় । অগ্রগণ্য মুসলিম নেতা, মুহম্মদ আলি তাঁর ইংরেজি পত্রিকা  “Comrade”   “ The Sahidullah Affair”  নামে একটা প্রবন্ধ,  কড়া ভাষায় লেখেন । ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি দিল্লি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহ্ কে সংস্কৃত পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি বিষয় চালু করে তাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  আদালতের দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী স্যার আশুতোষ, ভাষাতত্ত্ব বিভাগনামে নতুন একটি বিভাগ চালু করেন। ফলে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এ বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
শহীদুল্লাহ্ খুব বিব্রত বোধ করতে থাকেন। জনগণের সামনে তাঁর এই ব্যাপারটা চলে আসায় খুবই কুণ্ঠিত হয়েছিলেন।
সংস্কৃত ভাষা চর্চার জন্য শহীদুল্লাহ্ র এই ভাবে বাধা আসার জন্য স্যার আশুতোষ আরও একটা বিকল্প চেষ্টা করলেনতিনি, শহীদুল্লাহ্ যাতে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে সংস্কৃত পড়তে পারেন, তারও ব্যবস্থা করেন । এবারও শহীদুল্লাহ্ ব্যর্থ । বিদেশে যাবার জন্য তখন স্বাস্থ্য পরীক্ষা হত । আগের অসুস্থতা শরীরে ছাপ রেখে যাওয়ায়, শহীদুল্লাহ্ সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না । শহীদুল্লাহ্ এবং স্যার আশুতোষের স্বপ্ন ব্যর্থ হল।
উপায়ন্তর না দেখে, তিনি আইন বিভাগে ভর্ত্তি হয়ে, দু বছর বাদে আইনের স্নাতক হন । এরপর, তিনি চলে যান চট্টগ্রামের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতে । সেখানেও, এক বছরের বেশী মন টেঁকে নি ফিরে এলেন বসিরহাটেশুরু করলেন ওকালতি ।
বিচারপতি হিসেবে আশুতোষ এলেন একদিন বসিরহাট আদালতে পরিদর্শন করতে । কথা বার্তা শুরু হল শহীদুল্লাহ্ র সাথে । তীব্র মনঃকষ্টের কথা খুলে বললেন শহীদুল্লাহ্, স্যার আশুতোষকে। স্নেহ ভাজনের এই অবস্থা দেখে, স্যার আশুতোষ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ব বিভাগে গবেষণার সুযোগ করে দিলেন শহীদুল্লাহ্ কে । সেটা ১৯১৯ সাল ।
ছাত্রাবস্থা থেকেই শহীদুল্লাহ্ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সুবাদে । পরিষৎ - পত্রিকায়  তাঁর গবেষণা মূলক প্রবন্ধ ছাপা হত । সেখান থেকেই পরিচিত হন- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে ।
১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী । তাঁরই চেষ্টায়, শহীদুল্লাহ্ ওই বিভাগে লেকচারারের পদ পান ।
কিন্তু সংস্কৃত ভাষার নেশা শহীদুল্লাহ্ কে পেয়ে বসেছিল । সেই নেশায় পড়ে, তিনি তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় পৌঁছলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯২৬ সালে । 
বৈদিক ( সংস্কৃত ) ভাষার সঙ্গে তিনি পড়তে লাগলেন- প্রাচীন পারসিক( আবেস্তা), তিব্বতী এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ব। বৌদ্ধ তান্ত্রিক ভাষার ওপরে গবেষণা করে তিনি ১৯২৮ সালে ডি-লিট উপাধি পেলেন । ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম Tris Honorableপ্যারিসেরই Archive de la Parole থেকে ধ্বনিতত্বের ( ফোনেটিক্স)  ওপর ডিপ্লোমাও পান ।
এর পরে, তিনি আরও পড়ার জন্য জার্মানীর ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে বৈদিক সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাকৃত ও আরবী ভাষাও পড়েন। তবে, পড়া শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয় ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে ভার গ্রহণ করেন । ১৯৪৪ সালে অবসর নেবার পরও তাঁর দম ফেলবার ফুরসত ছিল না । গবেষণা,  ভাষা আর নানা রকম বিদ্যাচর্চায় তাঁর ভাঁটা পড়ে নি ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, তাঁকে সেখানকার বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে ভার নেন । ১৯৬৭ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমিরেটাস প্রফেসরের মর্যাদা দেয় ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্য্যাপদ আবিস্কার করলে, যে কয়জন এর চর্চায় মন দিয়েছিলেন, শহীদুল্লাহ্ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য পথিকৃৎ । তিনিই প্রথম চর্য্যাপদর ধর্মতত্ব বিষয়ক আলোচনা করেন ।
এই ব্যাপারে গবেষণার জন্য তাঁকে, একই সঙ্গে অসমিয়া, ওড়িয়া, মৈথিলি, হিন্দি,গুজরাতি, মারাঠি, সিন্ধি, লাহিন্দা, কাশ্মীরি,নেপালি, মালদ্বীপী প্রভৃতি ভাষার চর্চা করতে হয় ।
বৌদ্ধগান ও দোহা সম্বন্ধে তাঁর একটি গবেষণা মূলক বই প্রকাশ করে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় । এই বইটার ইংরেজী সংস্করণ বের করে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় । ফরাসী ভাষায় সুপণ্ডিত শহীদুল্লাহ্ ফরাসী ভাষাতেও বই লিখেছিলেন ।
“শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” এর ভাষাতত্ব বিষয়ে তাঁর কাজ বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখ যোগ্য অবদান । অধ্যাপনার বাইরে তিনি করাচির উর্দূ উন্নয়ন সংস্থার উর্দূ অভিধান প্রকল্প, ঢাকায় বাঙলা একাডেমীর পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পএবংইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পেসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের সদস্য, ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বহি কমিটির সদস্য, বাংলা একাডেমীর বাঙলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজি সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে Seminar on Traditional Culture in South-East Asia -তে তিনি UNESCO - প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এর চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্র বিদ্বেষ নীতি, শহীদুল্লাহ্ সমর্থন করতে পারেন নি । তিনি বলেছিলেন :-“রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে বিশ্ববাসী। তাঁর বাণী সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্য। আমরা, পাকিস্তানীরা রবীন্দ্রনাথের উচ্চ ভাবধারাকেও আমাদের জিনিস বলে দাবী করতে পারি।”
এজন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত । এই একই হাল হয়েছিল তাঁর উত্তর সূরী সৈয়দ মুজতবা আলির ।
১৯৬২ সালে, ভারত সরকার ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরলন্ড টয়েনবি আর ইতালির ভারত তত্ত্ববিদ প্রফেসর তুচ্চির সাথে শহীদুল্লাহ্ কে Indian Council for Cultural relations  Fellow হিসেবে নির্বাচিত করলেও পাকিস্তান সরকার সেই সন্মান তাঁকে নিতে দেয় নি ।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দূকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। এর প্রতিবাদে প্রথম লেখনি ধারণ করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যাপ্রবন্ধে বলেন,
পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন পশতু, বেলুচি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা; কিন্তু উর্দূ পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়,তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দূ ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য। বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দূ বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দূ ভাষার স্বপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।
এই প্রতিবাদ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে, জন্ম দিয়েছিল রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের। ডক্টর শহীদুল্লাহ্ রয়ে গেলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন,
আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালল-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার কোন জো-টি নেই।
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের আহ্বানে তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মাঝে সশরীরে উপস্থিত থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পুলিশি হামলায় টিয়ার গ্যাসে নিগৃহীত হয়েছেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন বাঙলা ভাষার প্রথম সহজবোধ্য বাংলা ব্যাকরণলিখলেন তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি হয়ে তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, আপনার বাংলা ব্যাকরণখানি পড়ে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। ব্যাকরণখানি সকল দিকেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে ছাত্রদের উপকার হবে। বইখানি আমার শান্তি নিকেতনের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের দেব। তাঁরা তা শ্রদ্ধাপূর্বক ব্যবহার করবেন।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিশু-কিশোরদের জন্য
আঙুরপত্রিকা বের করার পর একে স্বাগত জানিয়ে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত লোকসাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, আপনার মত এত বড় পণ্ডিত, যাহার বিদ্যার পরিধি আয়ত্ত করিবার সাধ্য আমাদের নাই, যিনি বেদ-বেদান্তের অধ্যাপক, ফার্সি ও আরবী যার নখদর্পণে, যিনি জার্মান ব্যাকরণের জটিল বুহ্য ভেদ করিয়ে অবসর রঞ্জন করে-তিনি একটি আঙুরহাতে নিয়া উপস্থিত!
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ এই জ্ঞানতাপস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাইড অফ পারফরম্যানএবং ১৯৬৭ সালে ফরাসী সরকার তাঁকে নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্সপদকে ভূষিত করেন। আজীবন উদ্যমী এই মানুষটি সর্বদা ছিলেন কর্মচঞ্চল। ১৯৬৭ সালে ২৭ ডিসেম্বর প্রথম সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হন এই জ্ঞানানন্দ প্রবাদপুরুষ। জীবন সায়াহ্নে যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন ডান হাতের লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘ভালো হয়ে নিই, আমার বাম হাতে লেখার অভ্যাস করবো১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর। ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মূসা খাঁন মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
তথ্যঋণ এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার :-
“শব্দনীড়” ওয়েবজিনে প্রকাশিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙলা ভাষা, ভাষা আন্দোলন
হারাধন চৌধুরী ( বর্তমান দৈনিক পত্রিকা )
সংসদ বাঙালা চরিতাবিধান; সাহিত্য সংসদ
আচার্য সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায়; বাংলা সাহিত্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ.বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি


No comments: