Friday, May 24, 2013

মহামানবের ছেলেমানুষি।


দিয়ালাতে প্রকাশিত


ছেলেবেলায় দুষ্টুমি করাটা সকলেরই মজ্জাগত। দুষ্টুমী না করলে ছেলেবেলা সার্থক হয় না। এবার এমন একজন বিখ্যাত মানুষের নাম শোনাব, যাঁর দুষ্টুমিতে সারা নবদ্বীপ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
ঠাকুরদা, মধুকর মিশ্র ওড়িশার যাজপুর থেকে রাজা ভ্রমরের অত্যাচারের ভয়ে ,অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টে এসে বসবাস শুরু করেন। এই শ্রীহট্টই হলো এখনকার সিলেট। পরে, মধুকর মিশ্রের ছেলে জগন্নাথ মিশ্র সংস্কৃত শেখার জন্য নদীয়া জেলার নবদ্বীপে এসে সেখানেই থেকে যান।
পড়াশুনো শেষ হলে, জগন্নাথ মিশ্র, নীলাম্বর চক্রবর্তীর মেয়ে শচীদেবীকে বিয়ে করেন। এঁদের পরপর সাত মেয়ে হলেও সব কটা অকালে মারা যায়। পরে,দুই ছেলে- বিশ্বরূপ আর বিশ্বম্ভর কিন্তু অকালে মারা যান নি। সেকালে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেত সবার। ষোলো বছরে বিশ্বরূপের বিয়ের কথা হলে, তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে চলে যান।
জগন্নাথ মিশ্র ভাবলেন- অল্প বয়সে বেশী পড়াশোনার করার ফলেই বড় ছেলের এই হাল! একে তো সাত মেয়ে মারা গেছে, তার ওপর বড় ছেলে বিবাগী হয়ে চলে গেল, ফলে বিশ্বম্ভর কে আর পড়াশোনা করতেই পাঠালেন না!!!!!! বিশ্বম্ভরের ডাক নাম ছিল নিমাই!
কিন্তু, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক!!!!!! দুষ্টু নিমাই পরে কি হয়েছিল, সেটা বলছি!!!! তার আগে ওর ছেলেবেলার কথা বলে নিই! খুব মজা পাবে।
ওহো! নিমাইয়ের জন্ম তারিখটা তো বলতেই ভুলে গেছি। ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার সন্ধে ৬ টা থেকে ৭টার মধ্যে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে নিমাইয়ের জন্ম।
পাঁচ বছর থেকেই মহা দুষ্টুমি শুরু করেছিল এই নিমাই। তখনকার সব লোক গঙ্গাতে স্নান করতে যেতেন। একটা বিশ্বাস তখনও ছিল, এখনও আছে! গঙ্গাতে স্নান করলে নাকি সব পাপ দূর হয়। তাছাড়া, তখন তো আর ঘরে ঘরে স্নানঘরে শাওয়ার, বাথটাব ছিল না! ফলে লোকে গঙ্গাতেই স্নান করত। আর সেখানেই শুরু হত নিমাইয়ের দুষ্টুমি! ব্রাহ্মণরা স্নান করে উঠলেই গায়ে গোবোর মেশান কাদা ছুঁড়ে দিতেন। কারও শিবঠাকুর নিয়ে পালিয়ে যেতেন। বাচ্চা মেয়েদের চুলে ওকরা নামের একটা কাঁটা ওয়ালা ফলের বীচি ছুঁড়ে দিতেন। চুল জট পাকিয়ে যেত। সে এক কেলেঙ্কারী!!!!!!
জগন্নাথ মিশ্র সাধে কি, দুঃখ করে লিখেছিলেন!!!!!!!:-
“এহি যদি সর্বশাস্ত্রে হবে গুণবান্।
ছাড়িয়া সংসার সুখ করিবে পয়ান।।
অতএব ইহার পড়িয়া কার্য্য নাই।
মূর্খ হৈয়া ঘরে মোর থাকুক নিমাঞি।।”
তোমরা ভাবছ, আমি বানান ভুল করেছি? আরে না! এটা ১৪৭৩ সালে লেখা!!!!! তখনকার বানান গুলো এরকমই ছিল। আমি ওটা অবিকল তুলে দিয়েছি।
ওই বাচ্চা মেয়েরা নিজেদের বাবা মার কাছে গিয়ে বলত:-
“বলে মোরে চাহে বিভা* করিবারে”
*বিভা= বিবাহ বা বিয়ে।
পরে আর এক মেয়ে বলছে:-
“পূর্বে শুনিলাম যেন নন্দের কুমার।
সেইমত কি তোমার পুত্রের ব্যাবহার।।”

আর একজন ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্রকে বলছেন:-
“সন্ধ্যা করি জলেতে নামিয়া।
ডুব দিয়া লৈয়া যায় চরণ ধরিয়া।।”
বোঝো কাণ্ড নিমাইয়ের!! ওই পাঁচ বছর বয়সেই ডুব সাঁতার শিখে গেছিল। ব্রাহ্মণ, স্নান সেরে জপ করছেন জলে নেমে আর নিমাই ডুব সাঁতার দিয়ে ব্রাহ্মণের পা টেনে আবার জলে ফেলে নাকানী চোবানী খাওয়াচ্ছেন!

“কেহ বলে মোর শিবলিঙ্গ করে চুরী।
কেহ বলে মোর লয়ে পলায়ে উত্তরী*।।”
*উত্তরী= উত্তরীয় বা গায়ে দেওয়ার চাদর!
এবার দিনে দিনে বেড়েই চলল, নিমাইয়ের দুষ্টুমী! একদিন এঁটো রান্নার হাঁড়ির ওপর বসে খালি দুলতে লাগল! আর সঙ্গে ঠন্ ঠনা ঠন্ আওয়াজ !!
মা, শচী দেবী বকলেন! বললেন:- ভদ্রতা জানিস না? নিমাই নাকি এর উত্তরে বলেছিল:- ( এটা পরে অন্য লোকে লিখেছেন)
“প্রভু বলে মোরে, না দিস পড়িতে।
ভদ্রাভদ্র মূর্খ বিপ্র* জানিবে কি মতে।।
মূর্খ আমি না জানি যে ভাল মন্দ স্থান।
সর্বত্র আমার এক অদ্বিতীয় স্থান।।”
*বিপ্র= ব্রাহ্মণ
এখন আর জগন্নাথ বাবুর কোনো উপায় থাকল না! গ্রামের সকলের পরামর্শে, নিমাইকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পাঠিয়ে দিলেন পড়তে!
শচী দেবীর হলো বিপদ! ছেলে আর বই ছেড়ে ওঠে না! শচী দেবী ভাবলেন- ছেলে পাগল হয়ে গেছে!!!!
এ ব্যাপারে লেখা আছে:-
“কিবা স্নানে কি ভোজনে কিবা পর্যটনে।
নাহিক প্রভুর আর চেষ্টা শাস্ত্র বিনে।।
আপনি করেন প্রভু সুত্রের টিপ্পনী।
ভুলিয়া পুস্তক রসে সর্বে দেবমণি।।
না ছাড়েন শ্রীহস্তে পুস্তক একক্ষণে।.....
পুঁথি ছাড়িয়া নিমাঞি না জানে কোনো কর্ম ।
বিদ্যারস ইহার হয়েছে সর্বধর্ম।।
একবার যে সুত্র পড়িয়া প্রভু যায়।
আরবার উল্টিয়া প্রভু সবারে ঠেকায়।।”
এই দুষ্টু নিমাই কালে কালে হয়ে উঠলো মস্ত পণ্ডিত! নাম হলো চৈতন্যদেব!
কি!!! এবার নামটা মনে পড়েছে? আর তো লিখবো না! তোমরা এবার খুঁজে পড়ো তাঁর জীবনী! আমি এবার বরং আসি! কি বলো? শুধু শেষে একটা কথা বলি:- দুষ্টমি কর! কিন্তু সাথে পড়াশোনাটাও কর! কে জানে, তোমাদেরই মধ্যে লুকিয়ে আছেন, একালের আর এক চৈতন্যদেব! !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
....................................................................................
তথ্যসূত্র: দীনেশচন্দ্র সেনের “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ( ১৯০৮)
পদ্য: চৈতন্য ভাগবত ( আদি) থেকে উদ্ধৃত! 

No comments: