Showing posts with label কিশোর প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label কিশোর প্রবন্ধ. Show all posts

Friday, July 12, 2013

তারিণী খুড়ো



ঘনাদা আর টেনিদার পর তারিণী খুড়ো । পুরো নাম-তারিণীচরণ বাঁডুজ্জেবাঁড়ুজ্জে-  “বন্দ্যোপাধায়পদবীর চলতি নাম ।
গল্পের স্টক খুড়োর অঢেল নানা ধরণের চাকরী করতে গিয়ে ভদ্রলোক সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছেন অভিজ্ঞতার ঝুড়ি একেবারে ভর্তি হয়ে টইটুম্বুরবিচিত্র সেই সব অভিজ্ঞতা, আর   তাই গল্পগুলোও নানা স্বাদের ।
তারিণী খুড়োর মতে, আর্টের খাতিরে যেটুকু কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় সেটুকু ছাড়া আর নাকি সবই সত্যি!! অবশ্য এই আর্টের খাতিরে কল্পনার আশ্রয় নেবার কথাই বা কে স্বীকার করে? আমাদের নমস্য ঘনাদা করেননি, টেনিদাও করেননি।
তারিণী খুড়ো প্রায়ই বলেন, “আমার মনের সব কপাট খোলা। আমি হাঁচি, টিকটিকি, ভূত-প্রেত, দত্যি-দানা, বেদ-বেদান্ত, আইন্সটাইন-ফাইন্সটাইন সব মানি। বোঝো ঠ্যালা !!!
অবিবাহিত এই মানুষটি থাকেন কলকাতার শোভাবাজারের বেনেটোলায়, পুরোপুরি ঠিকানাটা কাউকে বলেছেন বলে তো মনে পড়ে না । বিকেলের চা-জলখাবার খাওয়ার জন্যই বেনেটোলা থেকে বালিগঞ্জে আসেন তিনি গল্প শোনাতে। বাস না পেলে পুরো রাস্তা হেঁটেই পাড়ি দেন। বাস ভাড়া বাঁচাতে, তিনি রোজই হেঁটে আসেনএটা আমার আন্দাজ । কোত্থাও  অবশ্য লেখা নেই এই বাস ভাড়া বাঁচানোর কথাটা ।
ঘনাদার মতোই লম্বা-চওড়া গল্প বলতে ভালবাসেন তারিণী খুড়ো। ভুতের গল্প থেকে হাসির গল্প কি নেই তার ঝোলায়অধিকাংশ গল্পেই দেখা যায় আসন্ন ঝামেলা বা সমস্যা থেকে তারিণী খুড়ো বেঁচে গেছেন স্রেফ উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। অনেক সময় আবার  ভাগ্যের জোরেও কেটেছে ফাঁড়া। খুড়োর জন্ম বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারে হলেও কাজকর্মের সূত্রে নিজেকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পুরো ভারতে।  তাই বেশ একটা সর্বভারতীয় ফ্লেভার তাঁর সব গল্পেই ।
স্কুল পড়ুয়া ন্যাপলা, ভুলু, চটপটি, সুনন্দরা হচ্ছে এই সব গল্পের শ্রোতা ।
কেমন মানুষ তারিণী খুড়ো? জীবনে প্রচুর রোজগার করেছেন। কিন্তু সারাক্ষণ টাকার পেছনে আদৌ দৌড়ননিমাঝে মাঝে রোজগারের ওপর বিতৃষ্ণা এসে গেলে সব ছেড়েছুড়ে স্রেফ ভ্রমণের নেশায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যকে কখনো খুব একটা গুরুত্ব দেননি। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই তারিণী বাঁডুজ্জের অভ্যেস। তাঁর নেশা দুটিও খুবই সামান্য। তাঁর নেশা দুটিও খুবই সামান্য। দুধ-চিনি ছাড়া চা আর এক্সপোর্ট কোয়ালিটির বিড়ি।
তারিণী খুড়োর সাথে  রক্তের কোন সম্পর্ক নেই এই সব খুদে শ্রোতাদেরতিনি ওদের বাবা-কাকাদের দেশের পড়শি সূত্রে খুড়ো, ওদেরও খুড়ো। আসলে খুড়ো নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে আদৌ রাজি নন। ওর শ্রোতাদের মধ্যে ন্যাপলা একবার খুড়োকে দাদু বলে ডেকেছিল। খুড়ো তাতে বেজায় চটেছিলেন। আর চটবেন নাই বা কেন? ওঁর সঙ্গে যখন আমাদের প্রথম পরিচয় হয় তখন তাঁর বয়স চৌষট্টি। কিন্তু আদৌ অথর্ব নন তিনি। ছফিট শরীরটা এই বয়সেও মজবুততারিণী খুড়োর মতে ৩৩টি শহরে তিনি ৫৫ রকম কাজ করেছেন। তার সবকটির হদিশ আমরা পাইনি। তবে যা পেয়েছি তাই বা কম কি ! করদ রাজ্যগুলির জনাকয়েক রাজার সেক্রেটারি কিম্বা ম্যানেজার, ব্যবসায়ী বা প্রাক্তন অভিনেতার সেক্রেটারি, ম্যাজিশিয়ানের ম্যানেজার, ফিল্ম কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার। আবার স্বাধীন ব্যবসাতেও তিনি আছেন। কখনো শিল্পীর মডেল, কখনো খবরের কাগজের ফ্রি-ল্যান্স জার্নালিস্ট এমন কি কখনো বা জ্যোতিষীওস্টেজে এবং স্টেজের বাইরে অভিনয়ও করেছেন তারিণীচরণ বাঁডুজ্জে। ৩৩টা শহরের পুরো হিসেবও নেই আমাদের কাছে। কোলকাতা লক্ষ্ণৌ, পুনে, আজমীর, হায়দ্রাবাদ, নাগপুর, ডুমনিগড়, ধুমলগড়, মার্তন্ডপুর, মন্দোর, তারাপুর, ছোট নাগপুরে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর সেইসব অভিযান কাহিনী। সব জায়গাগুলির হাল-হদিশ হয়তো ম্যাপে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাতে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। ভগবানের সৃষ্টিতে ডিফেক্ট থাকে, আর মানুষের তৈরি ম্যাপে ভুল থাকতে পারে না?
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট এই তারিণী খুড়ো চরিত্রটির পুরো জীবনটাই রোমঞ্চকর ঘটনায় ভরপুর।  যারা  এই সব গল্প পড়তে চাও- তারা পড়তে পারো :- “তারিণী খুড়োর অভিযান বই আর সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায়ের যেখানে ভূতের ভয় চলচিত্রটি দেখতে পারোচলচিত্রে মোট তিনটে গল্পের মধ্যে প্রথম দুটো সত্যজিৎ রায়ের লেখা , শেষেরটা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের  ।
   
কৃতজ্ঞতা :- তারিণী খুড়োর অভিযান
                বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকম/তামিম আবদুল্লাহ
                ইন্টারনেট

দিয়ালা কিশোর পত্রিকায় প্রকাশিত



Friday, May 24, 2013

ঘনাদা ও ঘনার বচন ( ঘনশ্যাম দাস)


শারদীয় " কৈশোরকে" প্রকাশিত

এদের গল্প শোনবার জিনিস, বিশ্বাস করবার নয় তবে বিশ্বাস করাই ভাল, নইলে ঠকতে হয়’–মন্তব্যটি করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী তাঁর সৃষ্ট নীললোহিত চরিত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে।
শিশু-কিশোর সাহিত্যের যাঁরা মুগ্ধ পাঠক, তাঁরা জানেন প্রমথ চৌধুরী কি অপূর্ব নৈপুণ্যে তাঁর নীললোহিত চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন। তবে এ-কথাও ঠিক যে, এখনকার পাঠক অনেকেই কিন্তু নীললোহিতের কথা জানে না যাই হোক, তিনি কি তাঁর আগে এ-রকম কোনও চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন? ঘনাদার জন্ম অনেক পরে হয়েছে তা অবশ্যই ঠিক, কিন্তু ব্যারন মাঞ্চোসেনের কথা চৌধুরী মশাইয়ের মাথায় ছিল না, এমন নয়৷ চৌধুরী মশাই জানিয়েছিলেন, “কাইজার নাকি তাঁকে বলেছিলেন যে নীললোহিত যদি তাঁর সঙ্গে জার্মানিতে যান, তাহলে তিনি তাঁকে সাবমেরিনের সর্বপ্রধান কাপ্তেন করে দেবেন যে মাইনে কাইজার তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন তাতে তাঁর পোষায় না বলে তিনি সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন৷ওদিকে প্রেমেনবাবু ঘনাদাকে দিয়ে বলান, “সেই যে সাংকুর নদীর ধারে এম বুজি মাঈ থেকে হিরে পাচার করার জন্য আমায় ম্যাজিকের ধোঁকা দিয়ে এপুলু-তে নিয়ে গিয়ে মিথ্যে খবরে ইতুরি-র গহন বনে পাঠিয়ে জংলিদের ঝোলানো ফাঁসিতে লটকে মারার চেষ্টা করেছিল, আর যার মতলব হাসিল হলে পৃথিবী আরও বিরাট হয়ে দুনিয়ার কি দশা হত জানি না, সেই মালাঞ্জা এমপালে ভেবেই আপনাকে একটু তাচ্ছিল্য করেছিলাম গোড়ায়৷গল্প পরিবেশনে এই দুরন্ত অননুকরণীয় ভঙ্গি বাংলা সাহিত্যে বিরল
বাংলা সাহিত্যে যাকে টলস স্টোরি বা টল টেলস-এর মর্যাদা দেওয়া হয়, তাকে আর্টের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীই, মাঞ্চোসেন বা নীললোহিত যে-কৌলীন্য অর্জন করেছিল, তার উত্তরসূরি হল ঘনাদা।
১৯৪৫ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী “আলপনা” য় ঘনাদা সিরিজের প্রথম গল্প "মশা" প্রকাশিত হয়। এই সিরিজের প্রথম বই ঘনাদার গল্প  ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ঘনাদার গল্পগুলি দুটি বর্গে বিভক্ত - কল্পবিজ্ঞান আর ঐতিহাসিক গল্প।
লম্বা, হাড়-জিরজিরে দেহের গড়ন। আর ইয়া লম্বা তার নাক। বয়স? সে কথা আর  না বলাই ভালো, আন্দাজ করাই ভার! ৩৫ থেকে ৫৫- এর মধ্যে একটা কিছু হবে। জিজ্ঞাসা করবে কে? অমনি বলবেন, এত দেশ ঘুরেছি, বয়সের হিসেব রাখবো কি করে? এমন লোককে কি, ঠিক গুলবাজ বলা যায়!
ঘনাদা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্ট চরিত্র। পুরো নাম ঘনশ্যাম দাস। থাকেন, বেহালার-৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের একটি মেসের তেতলার এক চোরা কুঠুরিতে। খালি সকলকে গল্প শোনান, আর শিশিরের কাছ থেকে ধার করে সিগারেট খান, কোনো কাজই করেন না।  তবে, তিনি কিন্তু অকৃতজ্ঞ নন, প্রতিবার ধার করেন আর শিশিরকে বলেন কত তম সিগারেট ধার করলেন। আর তিনি যে অনেক সিগারেট ধার করেছেন তাও কিন্তু নয়, এক গল্পে দেখা গেলো সংখ্যাটা ২৮৫৭, কয়েক গল্প পরেই সেটা ৩৮৯৯, এ আর কতো-ই বা! এখানেই তার কীর্তির শেষ নয়।দু:খের বিষয় প্রায় প্রতিটা গল্পের শেষেই শিশিরের সিগারেটের টিনটা ঘনাদার হস্তগত হয়ে যায়, সেটা আর ফেরত পাওয়ার কোনো আশা থাকে না| ওনার মেস ভাড়া বলতে গেলে বাকিই পড়ে থাকে। তবু মেসের বাকি সদস্যরা, মানে শিবু, শিশির, গৌর আর সুধীর তাকে বেশ পছন্দই করে। তাকে আরাম কেদারা ছেড়ে দেয়, তার জন্যে দুইদিন পরপর নবাবী খানার ব্যবস্থা করে দেয়, কেবল তার গল্প অর্থাৎ গুল-গল্প শোনার জন্যে। এই মেসের অন্যান্য চরিত্রদের মধ্যে আছে রামভুজ নামের রাঁধুনি ঠাকুর আর সর্ব ঘটের কাঁটালি কলা ফরমাইস খাটা- বানোয়ারী মেসের বাবুদের ফাই-ফরমাস খাটিয়ে মাঝে মাঝেই বনোয়ারীর ওপর দায়িত্ব পড়ে  চ্যাঙ্গারী চ্যাঙ্গারী সুখাদ্য সরবরাহ করার
এই অদ্ভুত মজার আর গুলবাজ (?) ঘনাদা কিন্তু বেশ জ্ঞানী। তিনি বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন সব বিষয়ে এতো বেশি জানেন, তাকে টেক্কা দেবে কে? আর তাই তো তার গুল্প শুনে এত মজা। গল্পে গল্পে কখন যে  বিজ্ঞানের মজার মজার সব ব্যাপার শিখিয়ে দেবেন, কেউ টেরও পাবে না। আর সে যে কি ভয়ানক সাহসী আর বীর, তার আর কি বলবো! কত পালোয়ান দেখা যায় তার কাছে মার খেয়ে চিৎপটাংকত বিপদে কত ভয়াবহ কাজ করার কথা আছে তার গল্পে। অথচ একবার যখন মেসের সবাই মিলে ঘুরতে বের হলো, প্লেনে চড়তেই তার সে কই ভয়! অবশ্য গল্প শুনিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিলেন, তিনি মোটেই ভয় পাচ্ছেন না। তিনি আসলে অতো বাজে প্লেনে চড়েনই না!
বনমালী নস্কর লেনের এই মেসবাড়ি ছাড়াও কয়েকটি গল্পে বা উপন্যাসে লেকের ধারের সান্ধ্য-আড্ডায় ঘনাদাকে আসার জমাতে দেখা যায় এখানে ঘনাদা আর সাধারণ ঘনাদা নয় ইনি এখন ঘনশ্যাম বাবু এই সব গল্পগুলিতে মেসবাড়ির মজলিশি আড্ডার পরিবর্তে গুরুগম্ভীর আলোচনার মেজাজ লক্ষ্য করা যায় কথা-সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখনীর মুনশিয়ানা দাপটে এখানে এসে হাজির হন ঘনাদার পূর্বপুরুষরা ঘনাদা এই সব গল্পগুলির নায়ক নন, পরিবর্তে পৃথিবী রক্ষার দায়িত্বে আসেন তস্য তস্যব্যক্তিরা ইনকা সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে শিবানীর আগ্রা থেকে পলায়ন এইসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনায় ঘনাদার পূর্বপুরুষ গানাদো বা ঘনরাম দাসের অবদান - লেকের ধারের এই আড্ডা ছাড়া জানা কখনই সম্ভব ছিল না
স্মরণ করা যাক, ঘনাদার প্রবীণ বন্ধুদের পরিচয়৷ যাঁরা একটি জলাশয়ের ধারে একটি নাতি বৃহৎ পর্কটী বৃক্ষকে কেন্দ্র করে সমবেত হন৷ তাঁরা কে? নামেদভারে হস্তীর মত বিপুল সেই সদা প্রসন্ন ভবতারণ বাবু, উদরদেশ যার কুম্ভের মত স্ফীত সেই রামশরণবাবু, মস্তক যাঁর মর্মরের মত মসৃণ সেই শিবপদবাবু, মাথার কেশ যাঁর কাশের মত শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু এবং উষ্ট্রের মত শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীনআলোচনার প্রাণ ও প্রাণান্ত ঘনশ্যাম দাস ওরফে কোনও মহলে যিনি ঘনাদা৷ লেকের ধারের এই আড্ডার গল্পগুলিতে নায়িকার আবির্ভাব ঘটেছে ও কিছু পরিণত দৃশ্যেরও সূচনা হয়েছে, সেকারণে বলা যেতে পারে যে এই গল্পগুলি পরিণত বয়স্ক পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন
এই সব গল্পের যিনি লেখক, সেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের ডাক নাম ছিল সুধীর । শিবু, গৌর ও শিশির চরিত্রগুলি যথাক্রমে লেখক শিবরাম চক্রবর্তী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও সম্পাদক গৌরাঙ্গ প্রসাদ বসু এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অভিনেতা শিশির মিত্র ।
এই চারজন সত্যিই বেহালার একটা মেসে থাকতেন, একসঙ্গে । এই সূত্রেই অনেকের জানতে ইচ্ছে করে ঘনাদা, চরিত্র কল্পনাকালে লেখক কোনও বাস্তব চরিত্র অবলম্বন করেছিলেন কি না এ নিয়ে বেশ মজার ইতিহাস আছেপ্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর ঘনাদা চরিত্র কল্পনা করেছিলেন দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতার বারফট্টাইকে মনে রেখে কারও মতে ঘনাদা আসলে বিমল ঘোষ নামে মেসের এক বাসিন্দা, যাঁকে প্রেমেনবাবু ডাকতেন টেনদা বলে
সেই ঘনাদা, আমাদের আজও আনন্দ দিয়ে চলেছেন, অনবরত ভাবে । আর কি কেউ লিখতে পারবেন এই ভাবে? কে জানে !!!!!!!!!!!!!
কৃতজ্ঞতা : -
অরুণাংশু ভট্টাচার্য ( দি সানডে ইণ্ডিয়ান)
ঘনাদা সমগ্রের মুখবন্ধ।
ইন্টারনেট ।

মহামানবের ছেলেমানুষি।


দিয়ালাতে প্রকাশিত


ছেলেবেলায় দুষ্টুমি করাটা সকলেরই মজ্জাগত। দুষ্টুমী না করলে ছেলেবেলা সার্থক হয় না। এবার এমন একজন বিখ্যাত মানুষের নাম শোনাব, যাঁর দুষ্টুমিতে সারা নবদ্বীপ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
ঠাকুরদা, মধুকর মিশ্র ওড়িশার যাজপুর থেকে রাজা ভ্রমরের অত্যাচারের ভয়ে ,অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টে এসে বসবাস শুরু করেন। এই শ্রীহট্টই হলো এখনকার সিলেট। পরে, মধুকর মিশ্রের ছেলে জগন্নাথ মিশ্র সংস্কৃত শেখার জন্য নদীয়া জেলার নবদ্বীপে এসে সেখানেই থেকে যান।
পড়াশুনো শেষ হলে, জগন্নাথ মিশ্র, নীলাম্বর চক্রবর্তীর মেয়ে শচীদেবীকে বিয়ে করেন। এঁদের পরপর সাত মেয়ে হলেও সব কটা অকালে মারা যায়। পরে,দুই ছেলে- বিশ্বরূপ আর বিশ্বম্ভর কিন্তু অকালে মারা যান নি। সেকালে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেত সবার। ষোলো বছরে বিশ্বরূপের বিয়ের কথা হলে, তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে চলে যান।
জগন্নাথ মিশ্র ভাবলেন- অল্প বয়সে বেশী পড়াশোনার করার ফলেই বড় ছেলের এই হাল! একে তো সাত মেয়ে মারা গেছে, তার ওপর বড় ছেলে বিবাগী হয়ে চলে গেল, ফলে বিশ্বম্ভর কে আর পড়াশোনা করতেই পাঠালেন না!!!!!! বিশ্বম্ভরের ডাক নাম ছিল নিমাই!
কিন্তু, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক!!!!!! দুষ্টু নিমাই পরে কি হয়েছিল, সেটা বলছি!!!! তার আগে ওর ছেলেবেলার কথা বলে নিই! খুব মজা পাবে।
ওহো! নিমাইয়ের জন্ম তারিখটা তো বলতেই ভুলে গেছি। ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার সন্ধে ৬ টা থেকে ৭টার মধ্যে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে নিমাইয়ের জন্ম।
পাঁচ বছর থেকেই মহা দুষ্টুমি শুরু করেছিল এই নিমাই। তখনকার সব লোক গঙ্গাতে স্নান করতে যেতেন। একটা বিশ্বাস তখনও ছিল, এখনও আছে! গঙ্গাতে স্নান করলে নাকি সব পাপ দূর হয়। তাছাড়া, তখন তো আর ঘরে ঘরে স্নানঘরে শাওয়ার, বাথটাব ছিল না! ফলে লোকে গঙ্গাতেই স্নান করত। আর সেখানেই শুরু হত নিমাইয়ের দুষ্টুমি! ব্রাহ্মণরা স্নান করে উঠলেই গায়ে গোবোর মেশান কাদা ছুঁড়ে দিতেন। কারও শিবঠাকুর নিয়ে পালিয়ে যেতেন। বাচ্চা মেয়েদের চুলে ওকরা নামের একটা কাঁটা ওয়ালা ফলের বীচি ছুঁড়ে দিতেন। চুল জট পাকিয়ে যেত। সে এক কেলেঙ্কারী!!!!!!
জগন্নাথ মিশ্র সাধে কি, দুঃখ করে লিখেছিলেন!!!!!!!:-
“এহি যদি সর্বশাস্ত্রে হবে গুণবান্।
ছাড়িয়া সংসার সুখ করিবে পয়ান।।
অতএব ইহার পড়িয়া কার্য্য নাই।
মূর্খ হৈয়া ঘরে মোর থাকুক নিমাঞি।।”
তোমরা ভাবছ, আমি বানান ভুল করেছি? আরে না! এটা ১৪৭৩ সালে লেখা!!!!! তখনকার বানান গুলো এরকমই ছিল। আমি ওটা অবিকল তুলে দিয়েছি।
ওই বাচ্চা মেয়েরা নিজেদের বাবা মার কাছে গিয়ে বলত:-
“বলে মোরে চাহে বিভা* করিবারে”
*বিভা= বিবাহ বা বিয়ে।
পরে আর এক মেয়ে বলছে:-
“পূর্বে শুনিলাম যেন নন্দের কুমার।
সেইমত কি তোমার পুত্রের ব্যাবহার।।”

আর একজন ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্রকে বলছেন:-
“সন্ধ্যা করি জলেতে নামিয়া।
ডুব দিয়া লৈয়া যায় চরণ ধরিয়া।।”
বোঝো কাণ্ড নিমাইয়ের!! ওই পাঁচ বছর বয়সেই ডুব সাঁতার শিখে গেছিল। ব্রাহ্মণ, স্নান সেরে জপ করছেন জলে নেমে আর নিমাই ডুব সাঁতার দিয়ে ব্রাহ্মণের পা টেনে আবার জলে ফেলে নাকানী চোবানী খাওয়াচ্ছেন!

“কেহ বলে মোর শিবলিঙ্গ করে চুরী।
কেহ বলে মোর লয়ে পলায়ে উত্তরী*।।”
*উত্তরী= উত্তরীয় বা গায়ে দেওয়ার চাদর!
এবার দিনে দিনে বেড়েই চলল, নিমাইয়ের দুষ্টুমী! একদিন এঁটো রান্নার হাঁড়ির ওপর বসে খালি দুলতে লাগল! আর সঙ্গে ঠন্ ঠনা ঠন্ আওয়াজ !!
মা, শচী দেবী বকলেন! বললেন:- ভদ্রতা জানিস না? নিমাই নাকি এর উত্তরে বলেছিল:- ( এটা পরে অন্য লোকে লিখেছেন)
“প্রভু বলে মোরে, না দিস পড়িতে।
ভদ্রাভদ্র মূর্খ বিপ্র* জানিবে কি মতে।।
মূর্খ আমি না জানি যে ভাল মন্দ স্থান।
সর্বত্র আমার এক অদ্বিতীয় স্থান।।”
*বিপ্র= ব্রাহ্মণ
এখন আর জগন্নাথ বাবুর কোনো উপায় থাকল না! গ্রামের সকলের পরামর্শে, নিমাইকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পাঠিয়ে দিলেন পড়তে!
শচী দেবীর হলো বিপদ! ছেলে আর বই ছেড়ে ওঠে না! শচী দেবী ভাবলেন- ছেলে পাগল হয়ে গেছে!!!!
এ ব্যাপারে লেখা আছে:-
“কিবা স্নানে কি ভোজনে কিবা পর্যটনে।
নাহিক প্রভুর আর চেষ্টা শাস্ত্র বিনে।।
আপনি করেন প্রভু সুত্রের টিপ্পনী।
ভুলিয়া পুস্তক রসে সর্বে দেবমণি।।
না ছাড়েন শ্রীহস্তে পুস্তক একক্ষণে।.....
পুঁথি ছাড়িয়া নিমাঞি না জানে কোনো কর্ম ।
বিদ্যারস ইহার হয়েছে সর্বধর্ম।।
একবার যে সুত্র পড়িয়া প্রভু যায়।
আরবার উল্টিয়া প্রভু সবারে ঠেকায়।।”
এই দুষ্টু নিমাই কালে কালে হয়ে উঠলো মস্ত পণ্ডিত! নাম হলো চৈতন্যদেব!
কি!!! এবার নামটা মনে পড়েছে? আর তো লিখবো না! তোমরা এবার খুঁজে পড়ো তাঁর জীবনী! আমি এবার বরং আসি! কি বলো? শুধু শেষে একটা কথা বলি:- দুষ্টমি কর! কিন্তু সাথে পড়াশোনাটাও কর! কে জানে, তোমাদেরই মধ্যে লুকিয়ে আছেন, একালের আর এক চৈতন্যদেব! !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
....................................................................................
তথ্যসূত্র: দীনেশচন্দ্র সেনের “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ( ১৯০৮)
পদ্য: চৈতন্য ভাগবত ( আদি) থেকে উদ্ধৃত! 

সমুদ্রযাত্রা ও টাইটানিক

দিয়ালাতে প্রকাশিত
সমুদ্র মানেই এক অজানার হাতছানি। মানুষ এই অজানাকে জানার চেষ্টা করেছে বারবার, সেই প্রাচীন কাল থেকেই।


আমাদের প্রাচীন ভারতেও সমুদ্র যাত্রা ছিল। এই যাত্রা মূলত হত ব্যবসার কারণে। পরে, আরও নানা কারণে এই যাত্রা হত।

ছবি সৌজন্যেঃ ইন্টারনেট



ভারত থেকে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হয়েছে, বহু শতাব্দী ধরে। চিন, আরব, পারস্য আর ইউরোপের অনেক পরিব্রাজকের লেখাতেও এর উল্লেখ আছে। বেশ কিছুদিন আগে, গুজরাতের লোথাল অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের বানানো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ড্রাই ডকের (dry dock) আবিষ্কার হয়েছে।


পূর্ব এবং পশ্চিমে, তিনটি মহাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের বহু হাজার বছর ধরে কৃষ্টি আর বাণিজ্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রমাণ ঐ মহাদেশগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ হাজার আগে তৈরি উর ( UR) এবং সম্রাট নেবুকাডনেজারের (Nebuchadnezzar) প্রাসাদে যে কাঠের তক্তা এবং থাম পাওয়া গেছে, তা হলো ভারতীয় টিক আর দেবদারু গাছের গুঁড়ি থেকে তৈরি।
ঋগ্বেদে দেখি:- সমুদ্র দেবতা বরুণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা। বরুণদেবতার আশীর্বাদ ছাড়া, সেকালে এবং এখনও সমুদ্রযাত্রা যে নিরাপদ নয় , সেটা বারবার বলা আছে।
মন্ত্রটি হল:-শম্ ন বরুণঃ! অর্থাৎ:- হে সমুদ্র দেবতা বরুণ, তোমার আশীর্বাদ যেন নিরন্তর পাই! এইটাই এখন ভারতীয় নৌবাহিনীর CREST বা ব্যাজ! ১৯৪৮ এ চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এটা বেছে দেন।


বৃক্ষ আয়ুর্বেদে আছে জাহাজ তৈরির বিশদ বিবরণ!!!! শ্রী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় তাঁর- HISTORY OF INDIAN SHIPPING বইতে লিখেছেন:- ধারা রাজ্যের ভোজ, যাকে আমরা ভোজরাজা বা ভোজ নরপতি নামে জানি আর যিনি প্রাচীন ভারতে ম্যাজিকের স্রষ্টা( ভোজবাজী হচ্ছে- MAGIC এর কমন বাংলা), কৌটিল্য বা চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের মতই একটা বই লিখেছিলেন। নাম:- “যুক্তি কল্পতরু”। এতে রাজ্য শাসনের বিস্তৃত তথ্য আছে। এরই মধ্যে, একটা অংশ হলো বৃক্ষ আয়ুর্বেদ। এই খানে জাহাজ তৈরির জন্য কাঠের জাতি বিভাগ বা WOOD CLASSIFICATION আছে।


আমাদের সামুদ্রিক ইতিহাসের আরও অনেক কথা, অনেক ঘটনা নানা জায়গায় আছে, যা হারিয়ে যাওয়া পুঁথি এবং তথ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পরিব্রাজক মার্কো পোলো তাঁর ডায়রিতে লিখে গেছেন, তখন ভারতে তৈরি জাহাজে থাকতো চারটি মাস্তুল, চোদ্দটি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট, ষাটটি কেবিন আর দশটি লাইফবোট আর ক্রেন।


এবার ভাব, এইসব তো একদিনে তৈরি হয় নি! এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, সমুদ্রযাত্রার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং তার পর আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা। 


যখন মানুষের নানা বিষয়ে শ্রীবৃদ্ধি হয়, যখন বৈভব এবং ঐশ্বর্য তাদের কাছে সুখ বাড়াতে সাহায্য করে, তখন নিজের দেশ ছেড়ে দুর্গম স্থানে পাড়ি দিয়ে, ব্যবসা করে উত্তরোত্তর বৈভব এবং ঐশ্বর্য বাড়ানোর জন্য নিজের জান কবুল করতেও দ্বিধা করে না। তখনকার সময়ে রাস্তাঘাটে, হিংস্র জন্তু, ডাকাতকে মোকাবিলা করে, অপার সমুদ্র পাড়ি দিতেও দোনোমোনো করত না।
মনে রাখতে হবে, তখন কিন্তু কম্পাস ছিল না! তাহলে এরা দিকভ্রষ্ট হত না কেন? এখানেই খুব সহজ উত্তর আছে। ব্যবসার জন্যই জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা আর জ্যোর্তিবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছিল। লিখতে যতখানি সময় লাগছে, তার চেয়েও ঢের বেশী সময় লেগেছে এই ব্যাপারে গবেষণা করতে।


এই সমুদ্র যাত্রার বিপদও ছিল অনেক। জাহাজ ডুবিতে প্রচুর মানুষের প্রাণ গিয়েছে। তাও মানুষ এই নেশাটা ছাড়তে পারে নি।


ফলে, আমাদের দেশে সমুদ্র যাত্রা নিষেধ করে দেওয়া হয়। জাত- ধর্ম যাবে, এই দোহাই দিয়ে কালাপানি বা সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ তো গেল, প্রাচীন ভারত বা পৃথিবীর কথা।


ফিরে আসি মাত্র একশ বছর আগের কথায়। ইংল্যাণ্ড থেকে আমেরিকায় যাতায়াতের জন্য দরকার পড়ত আটলান্টিক মহাসাগর পেরনোর। 


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিমান বা প্লেন ছিল না। জাহাজই ছিলো সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার একমাত্র ভরসা। ইউরোপ থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা যাওয়ার জাহাজ ব্যবসা ছিল খুব লাভজনক। কম সময়ে, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পার হবার জন্য, যাত্রীদের আকৃস্ট করতে জাহাজ কোম্পানী গুলোর মধ্যে চলত প্রতিযোগীতা। ঐ সময়ের ইংল্যান্ডের প্রধান দুই জাহাজ কোম্পানী হল হোয়াইট স্টার(White Star) এবং কুনার্ড( Cunard )। ১৯০৭ সালে কুনার্ড কোম্পানী যখন খুব কম সময়ে আমেরিকা পৌছানোর দ্রুতগতি সম্পন্ন জাহাজ লুইজিতানিয়া (Lusitania )এবং মৌরিতানিয়া ( Mauretania) তাদের বহরে যোগ করল , চিন্তায় পড়ে গেলেন হোয়াইট স্টার লাইন (White Star) কোম্পানীর চেয়ারম্যান ইসমে ( J. Bruce Ismay )। বেলফাস্টের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হারল্যান্ড এন্ড উলফ (Harland and Wolff) এর মালিক উইলিয়াম পিরি ( William Pirrie,) এর সাথে পরামর্শ করে তিনটা বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ অলিম্পিক( Olympic ) টাইটানিক (Titanic)এবং ব্রিটানিক(Britannic, এটাও ডুবে গেছিল। ) তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন তারা।


এই কোম্পানীর সব জাহাজেরই নাম শেষ হতো “ইক” দিয়ে।


এই নামকরণের আর একটু ইতিহাস বলে নিলে, সুবিধে হবে।


গ্রিক পুরাণে জাইগান্টোস (Gigantos) হচ্ছে, ধরিত্রী দেবী গেয়া (Gaea) এবং আকাশ দেবতা ইউরেনাসের (Uranus) একশ সন্তান, দৈত্যাকার বন্য এক প্রজাতি। এরা দেখতে মানুষের মত, কিন্তু সুবিশাল আকার ও শক্তির জন্য খ্যাত। জাইগান্টোমেকি (gigantomachy) নামে এক যুদ্ধে অলিম্পিয়ানদের (Olympian) হাতে এরা ধ্বংস হয়ে যায়।


জাইগান্টোসদের মতো টাইটানরাও গেয়া ও ইউরেনাসের সন্তান আরেকটি প্রজাতি। অলিম্পিয়ানদের সর্দার জিউস টাইটানোমেকি (titanomachy) যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার আগে এরা পৃথিবী শাসন করত। এদের নাম থেকে টাইটানিক শব্দটি পাওয়া যায়, যার মানে অত্যন্ত বৃহদাকার।




ছবি :- ইনটারনেটের সৌজন্যে

১৯০৯ সালে হারল্যান্ড এন্ড উলফ (Harland and Wolff) কোম্পানির এনজিনিয়ার, টমাস এন্ড্রু (Thomas Andrews ) র নকশায় শুরু হল টাইটানিক জাহাজের নির্মাণ কাজ। সেই সময়ের সবচেয়ে বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ হিসেবে টাইটানিককে গড়ে তোলা হল। জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাহাজকে ভাগ করা হয় ১৬টা আলাদা প্রকোষ্ঠে বা চেম্বারে। এক প্রকোষ্ঠ হতে অন্য প্রকোষ্ঠে জল ঢোকা ছিল অসম্ভব । ১৬ টার মধ্যে ৪ প্রকোষ্ঠে জল ঢুকলেও জাহাজ ভেসে থাকতে অসুবিধা হত না। ফলে অনেকে বিশ্বাস করতেন টাইটানিক জাহাজ কোনদিন ও ডুববে না। ৩১শে মে ১৯১১ সালে ২২ টন সাবান দিয়ে মসৃণ করে তোলা রাস্তা বেয়ে জলে নামান হল টাইটানিককে।


জলে নামানোর সময় কাঠের তক্তা পড়ে মারা যায় এক কর্মী। জানা নেই. তারই অভিশাপ লেগেছিল কিনা টাইটানিকের ওপর।


তারপর শুরু হল যন্ত্রপাতি লাগানো, সাজশয্যা। ১৯১২ সালের এপ্রিলের গোড়ার দিকে পরীক্ষামূলক সমুদ্র যাত্রা শেষ হওয়ার পর তাকে নিরাপদ এবং আরামদায়ক সমুদ্র ভ্রমন উপযোগী জাহাজ হিসেবে হস্তান্তর করা হল জাহাজ কোম্পানীর কাছে । জাহাজের পুরো নাম হল RMS Titanic (Royal Mail Ship = RMS)। 


ওজন-৪৬,৩২৮ টন। লম্বায়- ৮৮২ ফুট ৬ ইঞ্চি। গতিবেগ :-ঘন্টায় ২৩ নট বা ৪৪ কিলোমিটার। ধোঁয়া বোরোনোর জন্য ফানেল ছিল, ৪ টে। প্রত্যেকটার উচ্চতা ছিল- ৬২ ফুট। ২৯ টা বয়লার ছিল, বাষ্প তৈরি করার জন্য। যাত্রী বহন ক্ষমতা ছিল-৩৫০০। যদিও প্রথম ও শেষ যাত্রায় যাত্রী ছিলেন-২২২৪ জন। এদের মধ্যে বেঁচে ফিরেছিলেন মাত্র ৭১০ জন। জাহাজে, কুকুর ছিল ১০ টা। সব কটাই মারা গেছিল।


এই জাহাজ কোনোদিন ডুববে না, এই ঘোষণা হয়, সেই সময়। তাই জাহাজে ৬৫ টি লাইফবোট নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ঐ দিন ছিল মাত্র ২০ টি । লাইফবোটের মোট ক্ষমতা ছিল ১১৭৮ জন। কিভাবে লাইফবোট ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে মহড়া অনুষ্ঠানের কথা ছিল ১৪ই এপ্রিল,১৯১২ র সকালে। অজ্ঞাতকারনে টাইটানিকের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ ঐ দিন মহড়া অনুষ্ঠান বাতিল করেন। মহড়া হলে আরো কিছু জীবন রক্ষা পেত এমন ধারনা করেন অনেকে। 


আটলান্টিক পেরুনোর ,২৬ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথের।


এইখানে একটা কথা বলা দরকার। সেইসময়, পাল তোলা জাহাজের আর বাস্পচালিত জাহাজের ছিল যুগসন্ধিক্ষণ। 


দুরকম ভাবে জাহাজের মুখ ঘোরানো হত। পাল তোলা জাহাজের মুখ ঘোরাতে হলে, যে দিক ঘোরাতে হবে, ঠিক তার উল্টো দিকে হুইল/ টিলার ঘোরাতে হত। একে বলা হত, “টিলার অর্ডার”।


বাস্পচালিত জাহাজের মুখ ঘোরাতে হলে, যে দিক ঘোরাতে হবে সেইদিকেই হুইল/টিলার ঘোরালেই হত। একে বলা হত “ রাডার অর্ডার”। জাহাজের চালক, রবার্ট হিচিনস, এই দুটোই জানতেন। কারণ, তখন আটলান্টিক পেরুনোর জন্য এই দুটো পদ্ধতিই জানা আবশ্যিক ছিল।


টাইটানিক ডুবে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, এই ষ্টিয়ারিং ভ্রান্তি। জাহাজ কম সময়ে পাড়ি দেবে, আর ডুবে যাবে না, এই ধারণাতেই ক্যাপ্টেন স্মিথ সমুদ্রে বড় বড় হিমশৈল থাকার প্রায় গোটা সাতেক সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছিলেন।


পরে জানা গিয়েছিল, হোয়াইট স্টার লাইন (White Star) কোম্পানীর অন্যতম মালিক ব্রুসের নির্দ্দেশ ছিল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথের ওপর, তিনি যেন কোনো অবস্থাতেই জাহাজের গতিবেগ না কমান।


পরে, হিমশৈল থাকার বিপদ বুঝে, ফার্ষ্ট অফিসার উইলিয়াম মার্ডক যখন চালক হিচিনসকে পরামর্শ দেন, জাহাজের মুখ ঘোরানোর জন্য, তখন হিচিনস ভয়ে, “টিলার অর্ডার” আর “ রাডার অর্ডারের” মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন।


“টিলার অর্ডার” দিয়ে তিনি জাহাজের মুখ ঘোরানোর চেষ্টা করলেও জাহাজ কিন্তু আসলে, হিমশৈলের দিকে গিয়ে ধাক্কা মারে।


তারপরেই ঘটে যায়, ঠিক শতাব্দী প্রাচীন সেই মারাত্মক দুর্ঘটনা।


আমরা সবাই সেই আত্মাদের শান্তি কামনা করি, যারা মারা গিয়েছিল, সেই অভিশপ্ত রাতে। ১৫/০৪/১৯১২ র রাত ১.৩০ থেকে রাত ৩.৩০ এর মধ্যে।