Friday, May 24, 2013

সমুদ্রযাত্রা ও টাইটানিক

দিয়ালাতে প্রকাশিত
সমুদ্র মানেই এক অজানার হাতছানি। মানুষ এই অজানাকে জানার চেষ্টা করেছে বারবার, সেই প্রাচীন কাল থেকেই।


আমাদের প্রাচীন ভারতেও সমুদ্র যাত্রা ছিল। এই যাত্রা মূলত হত ব্যবসার কারণে। পরে, আরও নানা কারণে এই যাত্রা হত।

ছবি সৌজন্যেঃ ইন্টারনেট



ভারত থেকে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হয়েছে, বহু শতাব্দী ধরে। চিন, আরব, পারস্য আর ইউরোপের অনেক পরিব্রাজকের লেখাতেও এর উল্লেখ আছে। বেশ কিছুদিন আগে, গুজরাতের লোথাল অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের বানানো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ড্রাই ডকের (dry dock) আবিষ্কার হয়েছে।


পূর্ব এবং পশ্চিমে, তিনটি মহাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের বহু হাজার বছর ধরে কৃষ্টি আর বাণিজ্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রমাণ ঐ মহাদেশগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ হাজার আগে তৈরি উর ( UR) এবং সম্রাট নেবুকাডনেজারের (Nebuchadnezzar) প্রাসাদে যে কাঠের তক্তা এবং থাম পাওয়া গেছে, তা হলো ভারতীয় টিক আর দেবদারু গাছের গুঁড়ি থেকে তৈরি।
ঋগ্বেদে দেখি:- সমুদ্র দেবতা বরুণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা। বরুণদেবতার আশীর্বাদ ছাড়া, সেকালে এবং এখনও সমুদ্রযাত্রা যে নিরাপদ নয় , সেটা বারবার বলা আছে।
মন্ত্রটি হল:-শম্ ন বরুণঃ! অর্থাৎ:- হে সমুদ্র দেবতা বরুণ, তোমার আশীর্বাদ যেন নিরন্তর পাই! এইটাই এখন ভারতীয় নৌবাহিনীর CREST বা ব্যাজ! ১৯৪৮ এ চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এটা বেছে দেন।


বৃক্ষ আয়ুর্বেদে আছে জাহাজ তৈরির বিশদ বিবরণ!!!! শ্রী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় তাঁর- HISTORY OF INDIAN SHIPPING বইতে লিখেছেন:- ধারা রাজ্যের ভোজ, যাকে আমরা ভোজরাজা বা ভোজ নরপতি নামে জানি আর যিনি প্রাচীন ভারতে ম্যাজিকের স্রষ্টা( ভোজবাজী হচ্ছে- MAGIC এর কমন বাংলা), কৌটিল্য বা চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের মতই একটা বই লিখেছিলেন। নাম:- “যুক্তি কল্পতরু”। এতে রাজ্য শাসনের বিস্তৃত তথ্য আছে। এরই মধ্যে, একটা অংশ হলো বৃক্ষ আয়ুর্বেদ। এই খানে জাহাজ তৈরির জন্য কাঠের জাতি বিভাগ বা WOOD CLASSIFICATION আছে।


আমাদের সামুদ্রিক ইতিহাসের আরও অনেক কথা, অনেক ঘটনা নানা জায়গায় আছে, যা হারিয়ে যাওয়া পুঁথি এবং তথ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পরিব্রাজক মার্কো পোলো তাঁর ডায়রিতে লিখে গেছেন, তখন ভারতে তৈরি জাহাজে থাকতো চারটি মাস্তুল, চোদ্দটি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট, ষাটটি কেবিন আর দশটি লাইফবোট আর ক্রেন।


এবার ভাব, এইসব তো একদিনে তৈরি হয় নি! এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, সমুদ্রযাত্রার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং তার পর আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা। 


যখন মানুষের নানা বিষয়ে শ্রীবৃদ্ধি হয়, যখন বৈভব এবং ঐশ্বর্য তাদের কাছে সুখ বাড়াতে সাহায্য করে, তখন নিজের দেশ ছেড়ে দুর্গম স্থানে পাড়ি দিয়ে, ব্যবসা করে উত্তরোত্তর বৈভব এবং ঐশ্বর্য বাড়ানোর জন্য নিজের জান কবুল করতেও দ্বিধা করে না। তখনকার সময়ে রাস্তাঘাটে, হিংস্র জন্তু, ডাকাতকে মোকাবিলা করে, অপার সমুদ্র পাড়ি দিতেও দোনোমোনো করত না।
মনে রাখতে হবে, তখন কিন্তু কম্পাস ছিল না! তাহলে এরা দিকভ্রষ্ট হত না কেন? এখানেই খুব সহজ উত্তর আছে। ব্যবসার জন্যই জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা আর জ্যোর্তিবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছিল। লিখতে যতখানি সময় লাগছে, তার চেয়েও ঢের বেশী সময় লেগেছে এই ব্যাপারে গবেষণা করতে।


এই সমুদ্র যাত্রার বিপদও ছিল অনেক। জাহাজ ডুবিতে প্রচুর মানুষের প্রাণ গিয়েছে। তাও মানুষ এই নেশাটা ছাড়তে পারে নি।


ফলে, আমাদের দেশে সমুদ্র যাত্রা নিষেধ করে দেওয়া হয়। জাত- ধর্ম যাবে, এই দোহাই দিয়ে কালাপানি বা সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ তো গেল, প্রাচীন ভারত বা পৃথিবীর কথা।


ফিরে আসি মাত্র একশ বছর আগের কথায়। ইংল্যাণ্ড থেকে আমেরিকায় যাতায়াতের জন্য দরকার পড়ত আটলান্টিক মহাসাগর পেরনোর। 


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিমান বা প্লেন ছিল না। জাহাজই ছিলো সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার একমাত্র ভরসা। ইউরোপ থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা যাওয়ার জাহাজ ব্যবসা ছিল খুব লাভজনক। কম সময়ে, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পার হবার জন্য, যাত্রীদের আকৃস্ট করতে জাহাজ কোম্পানী গুলোর মধ্যে চলত প্রতিযোগীতা। ঐ সময়ের ইংল্যান্ডের প্রধান দুই জাহাজ কোম্পানী হল হোয়াইট স্টার(White Star) এবং কুনার্ড( Cunard )। ১৯০৭ সালে কুনার্ড কোম্পানী যখন খুব কম সময়ে আমেরিকা পৌছানোর দ্রুতগতি সম্পন্ন জাহাজ লুইজিতানিয়া (Lusitania )এবং মৌরিতানিয়া ( Mauretania) তাদের বহরে যোগ করল , চিন্তায় পড়ে গেলেন হোয়াইট স্টার লাইন (White Star) কোম্পানীর চেয়ারম্যান ইসমে ( J. Bruce Ismay )। বেলফাস্টের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হারল্যান্ড এন্ড উলফ (Harland and Wolff) এর মালিক উইলিয়াম পিরি ( William Pirrie,) এর সাথে পরামর্শ করে তিনটা বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ অলিম্পিক( Olympic ) টাইটানিক (Titanic)এবং ব্রিটানিক(Britannic, এটাও ডুবে গেছিল। ) তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন তারা।


এই কোম্পানীর সব জাহাজেরই নাম শেষ হতো “ইক” দিয়ে।


এই নামকরণের আর একটু ইতিহাস বলে নিলে, সুবিধে হবে।


গ্রিক পুরাণে জাইগান্টোস (Gigantos) হচ্ছে, ধরিত্রী দেবী গেয়া (Gaea) এবং আকাশ দেবতা ইউরেনাসের (Uranus) একশ সন্তান, দৈত্যাকার বন্য এক প্রজাতি। এরা দেখতে মানুষের মত, কিন্তু সুবিশাল আকার ও শক্তির জন্য খ্যাত। জাইগান্টোমেকি (gigantomachy) নামে এক যুদ্ধে অলিম্পিয়ানদের (Olympian) হাতে এরা ধ্বংস হয়ে যায়।


জাইগান্টোসদের মতো টাইটানরাও গেয়া ও ইউরেনাসের সন্তান আরেকটি প্রজাতি। অলিম্পিয়ানদের সর্দার জিউস টাইটানোমেকি (titanomachy) যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার আগে এরা পৃথিবী শাসন করত। এদের নাম থেকে টাইটানিক শব্দটি পাওয়া যায়, যার মানে অত্যন্ত বৃহদাকার।




ছবি :- ইনটারনেটের সৌজন্যে

১৯০৯ সালে হারল্যান্ড এন্ড উলফ (Harland and Wolff) কোম্পানির এনজিনিয়ার, টমাস এন্ড্রু (Thomas Andrews ) র নকশায় শুরু হল টাইটানিক জাহাজের নির্মাণ কাজ। সেই সময়ের সবচেয়ে বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ হিসেবে টাইটানিককে গড়ে তোলা হল। জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাহাজকে ভাগ করা হয় ১৬টা আলাদা প্রকোষ্ঠে বা চেম্বারে। এক প্রকোষ্ঠ হতে অন্য প্রকোষ্ঠে জল ঢোকা ছিল অসম্ভব । ১৬ টার মধ্যে ৪ প্রকোষ্ঠে জল ঢুকলেও জাহাজ ভেসে থাকতে অসুবিধা হত না। ফলে অনেকে বিশ্বাস করতেন টাইটানিক জাহাজ কোনদিন ও ডুববে না। ৩১শে মে ১৯১১ সালে ২২ টন সাবান দিয়ে মসৃণ করে তোলা রাস্তা বেয়ে জলে নামান হল টাইটানিককে।


জলে নামানোর সময় কাঠের তক্তা পড়ে মারা যায় এক কর্মী। জানা নেই. তারই অভিশাপ লেগেছিল কিনা টাইটানিকের ওপর।


তারপর শুরু হল যন্ত্রপাতি লাগানো, সাজশয্যা। ১৯১২ সালের এপ্রিলের গোড়ার দিকে পরীক্ষামূলক সমুদ্র যাত্রা শেষ হওয়ার পর তাকে নিরাপদ এবং আরামদায়ক সমুদ্র ভ্রমন উপযোগী জাহাজ হিসেবে হস্তান্তর করা হল জাহাজ কোম্পানীর কাছে । জাহাজের পুরো নাম হল RMS Titanic (Royal Mail Ship = RMS)। 


ওজন-৪৬,৩২৮ টন। লম্বায়- ৮৮২ ফুট ৬ ইঞ্চি। গতিবেগ :-ঘন্টায় ২৩ নট বা ৪৪ কিলোমিটার। ধোঁয়া বোরোনোর জন্য ফানেল ছিল, ৪ টে। প্রত্যেকটার উচ্চতা ছিল- ৬২ ফুট। ২৯ টা বয়লার ছিল, বাষ্প তৈরি করার জন্য। যাত্রী বহন ক্ষমতা ছিল-৩৫০০। যদিও প্রথম ও শেষ যাত্রায় যাত্রী ছিলেন-২২২৪ জন। এদের মধ্যে বেঁচে ফিরেছিলেন মাত্র ৭১০ জন। জাহাজে, কুকুর ছিল ১০ টা। সব কটাই মারা গেছিল।


এই জাহাজ কোনোদিন ডুববে না, এই ঘোষণা হয়, সেই সময়। তাই জাহাজে ৬৫ টি লাইফবোট নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ঐ দিন ছিল মাত্র ২০ টি । লাইফবোটের মোট ক্ষমতা ছিল ১১৭৮ জন। কিভাবে লাইফবোট ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে মহড়া অনুষ্ঠানের কথা ছিল ১৪ই এপ্রিল,১৯১২ র সকালে। অজ্ঞাতকারনে টাইটানিকের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ ঐ দিন মহড়া অনুষ্ঠান বাতিল করেন। মহড়া হলে আরো কিছু জীবন রক্ষা পেত এমন ধারনা করেন অনেকে। 


আটলান্টিক পেরুনোর ,২৬ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথের।


এইখানে একটা কথা বলা দরকার। সেইসময়, পাল তোলা জাহাজের আর বাস্পচালিত জাহাজের ছিল যুগসন্ধিক্ষণ। 


দুরকম ভাবে জাহাজের মুখ ঘোরানো হত। পাল তোলা জাহাজের মুখ ঘোরাতে হলে, যে দিক ঘোরাতে হবে, ঠিক তার উল্টো দিকে হুইল/ টিলার ঘোরাতে হত। একে বলা হত, “টিলার অর্ডার”।


বাস্পচালিত জাহাজের মুখ ঘোরাতে হলে, যে দিক ঘোরাতে হবে সেইদিকেই হুইল/টিলার ঘোরালেই হত। একে বলা হত “ রাডার অর্ডার”। জাহাজের চালক, রবার্ট হিচিনস, এই দুটোই জানতেন। কারণ, তখন আটলান্টিক পেরুনোর জন্য এই দুটো পদ্ধতিই জানা আবশ্যিক ছিল।


টাইটানিক ডুবে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, এই ষ্টিয়ারিং ভ্রান্তি। জাহাজ কম সময়ে পাড়ি দেবে, আর ডুবে যাবে না, এই ধারণাতেই ক্যাপ্টেন স্মিথ সমুদ্রে বড় বড় হিমশৈল থাকার প্রায় গোটা সাতেক সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছিলেন।


পরে জানা গিয়েছিল, হোয়াইট স্টার লাইন (White Star) কোম্পানীর অন্যতম মালিক ব্রুসের নির্দ্দেশ ছিল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথের ওপর, তিনি যেন কোনো অবস্থাতেই জাহাজের গতিবেগ না কমান।


পরে, হিমশৈল থাকার বিপদ বুঝে, ফার্ষ্ট অফিসার উইলিয়াম মার্ডক যখন চালক হিচিনসকে পরামর্শ দেন, জাহাজের মুখ ঘোরানোর জন্য, তখন হিচিনস ভয়ে, “টিলার অর্ডার” আর “ রাডার অর্ডারের” মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন।


“টিলার অর্ডার” দিয়ে তিনি জাহাজের মুখ ঘোরানোর চেষ্টা করলেও জাহাজ কিন্তু আসলে, হিমশৈলের দিকে গিয়ে ধাক্কা মারে।


তারপরেই ঘটে যায়, ঠিক শতাব্দী প্রাচীন সেই মারাত্মক দুর্ঘটনা।


আমরা সবাই সেই আত্মাদের শান্তি কামনা করি, যারা মারা গিয়েছিল, সেই অভিশপ্ত রাতে। ১৫/০৪/১৯১২ র রাত ১.৩০ থেকে রাত ৩.৩০ এর মধ্যে।

No comments: