শারদীয় " কৈশোরকে" প্রকাশিত
‘এদের গল্প শোনবার জিনিস, বিশ্বাস করবার নয়। তবে
বিশ্বাস করাই ভাল, নইলে ঠকতে হয়’–মন্তব্যটি করেছিলেন প্রমথ
চৌধুরী তাঁর সৃষ্ট নীললোহিত চরিত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে।
শিশু-কিশোর সাহিত্যের যাঁরা
মুগ্ধ পাঠক, তাঁরা জানেন প্রমথ চৌধুরী কি অপূর্ব নৈপুণ্যে তাঁর নীললোহিত চরিত্রটি সৃষ্টি
করেছিলেন। তবে এ-কথাও ঠিক যে, এখনকার পাঠক অনেকেই কিন্তু নীললোহিতের কথা জানে না। যাই হোক, তিনি কি তাঁর আগে
এ-রকম কোনও চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন? ঘনাদার জন্ম অনেক পরে হয়েছে তা অবশ্যই ঠিক, কিন্তু ব্যারন
মাঞ্চোসেনের কথা চৌধুরী মশাইয়ের মাথায় ছিল না, এমন নয়৷ চৌধুরী মশাই
জানিয়েছিলেন, “কাইজার নাকি তাঁকে বলেছিলেন যে নীললোহিত যদি তাঁর সঙ্গে জার্মানিতে যান, তাহলে তিনি তাঁকে
সাবমেরিনের সর্বপ্রধান কাপ্তেন করে দেবেন। যে মাইনে কাইজার তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন তাতে
তাঁর পোষায় না বলে তিনি সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন৷” ওদিকে প্রেমেনবাবু ঘনাদাকে
দিয়ে বলান, “সেই যে সাংকুর নদীর ধারে এম বুজি মাঈ থেকে হিরে পাচার করার জন্য আমায়
ম্যাজিকের ধোঁকা দিয়ে এপুলু-তে নিয়ে গিয়ে মিথ্যে খবরে ইতুরি-র গহন বনে পাঠিয়ে
জংলিদের ঝোলানো ফাঁসিতে লটকে মারার চেষ্টা করেছিল, আর যার মতলব হাসিল হলে
পৃথিবী আরও বিরাট হয়ে দুনিয়ার কি দশা হত জানি না, সেই মালাঞ্জা এমপালে ভেবেই
আপনাকে একটু তাচ্ছিল্য করেছিলাম গোড়ায়৷” গল্প পরিবেশনে এই দুরন্ত
অননুকরণীয় ভঙ্গি বাংলা সাহিত্যে বিরল।
বাংলা সাহিত্যে যাকে টলস
স্টোরি বা টল টেলস-এর মর্যাদা দেওয়া হয়, তাকে আর্টের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন প্রমথ
চৌধুরীই, মাঞ্চোসেন বা নীললোহিত যে-কৌলীন্য অর্জন করেছিল, তার উত্তরসূরি হল ঘনাদা।
১৯৪৫ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের
পূজাবার্ষিকী “আলপনা” য় ঘনাদা সিরিজের প্রথম গল্প "মশা" প্রকাশিত হয়।
এই সিরিজের প্রথম বই ঘনাদার গল্প ১৯৫৬
সালে প্রকাশিত । ঘনাদার
গল্পগুলি দুটি বর্গে বিভক্ত - কল্পবিজ্ঞান আর ঐতিহাসিক গল্প।
লম্বা, হাড়-জিরজিরে দেহের গড়ন। আর ইয়া লম্বা তার নাক। বয়স? সে
কথা আর না বলাই ভালো, আন্দাজ করাই ভার! ৩৫ থেকে ৫৫- এর মধ্যে একটা কিছু হবে। জিজ্ঞাসা করবে কে?
অমনি বলবেন, এত দেশ ঘুরেছি, বয়সের হিসেব রাখবো কি করে? এমন লোককে কি, ঠিক গুলবাজ
বলা যায়!
ঘনাদা প্রেমেন্দ্র মিত্রের
সৃষ্ট চরিত্র। পুরো নাম ঘনশ্যাম দাস। থাকেন, বেহালার-৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের
একটি মেসের তেতলার এক চোরা কুঠুরিতে। খালি সকলকে গল্প শোনান, আর শিশিরের কাছ থেকে ধার করে সিগারেট খান, কোনো কাজই
করেন না। তবে, তিনি কিন্তু অকৃতজ্ঞ নন,
প্রতিবার ধার করেন আর শিশিরকে বলেন কত তম সিগারেট ধার করলেন। আর তিনি
যে অনেক সিগারেট ধার করেছেন তাও কিন্তু নয়, এক গল্পে দেখা
গেলো সংখ্যাটা ২৮৫৭, কয়েক গল্প পরেই সেটা ৩৮৯৯, এ আর কতো-ই বা! এখানেই তার কীর্তির শেষ নয়।দু:খের বিষয় – প্রায় প্রতিটা গল্পের শেষেই শিশিরের সিগারেটের টিনটা ঘনাদার হস্তগত হয়ে
যায়, সেটা আর ফেরত পাওয়ার কোনো আশা থাকে না| ওনার মেস ভাড়া বলতে গেলে বাকিই পড়ে থাকে। তবু মেসের বাকি সদস্যরা,
মানে শিবু, শিশির, গৌর
আর সুধীর তাকে বেশ পছন্দই করে। তাকে আরাম কেদারা ছেড়ে দেয়, তার
জন্যে দুইদিন পরপর নবাবী খানার ব্যবস্থা করে দেয়, কেবল তার
গল্প অর্থাৎ গুল-গল্প শোনার জন্যে। এই মেসের অন্যান্য চরিত্রদের মধ্যে আছে রামভুজ
নামের রাঁধুনি ঠাকুর আর সর্ব ঘটের কাঁটালি কলা ফরমাইস খাটা- বানোয়ারী – মেসের বাবুদের ফাই-ফরমাস খাটিয়ে – মাঝে মাঝেই
বনোয়ারীর ওপর দায়িত্ব পড়ে চ্যাঙ্গারী চ্যাঙ্গারী
সুখাদ্য সরবরাহ করার।
এই অদ্ভুত মজার আর গুলবাজ (?)
ঘনাদা কিন্তু বেশ জ্ঞানী। তিনি বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন সব
বিষয়ে এতো বেশি জানেন, তাকে টেক্কা দেবে কে? আর তাই তো তার গুল্প শুনে এত মজা। গল্পে গল্পে কখন যে বিজ্ঞানের মজার মজার সব ব্যাপার শিখিয়ে দেবেন,
কেউ টেরও পাবে না। আর সে যে কি ভয়ানক সাহসী আর বীর, তার আর কি বলবো! কত পালোয়ান দেখা যায় তার কাছে মার খেয়ে চিৎপটাং। কত বিপদে কত ভয়াবহ কাজ করার কথা আছে
তার গল্পে। অথচ একবার যখন মেসের সবাই মিলে ঘুরতে বের হলো, প্লেনে চড়তেই তার সে কই ভয়! অবশ্য গল্প শুনিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিলেন,
তিনি মোটেই ভয় পাচ্ছেন না। তিনি আসলে অতো বাজে প্লেনে চড়েনই না!
বনমালী নস্কর লেনের এই মেসবাড়ি ছাড়াও কয়েকটি গল্পে বা
উপন্যাসে লেকের ধারের
সান্ধ্য-আড্ডায় ঘনাদাকে আসার জমাতে দেখা যায়। এখানে ঘনাদা আর সাধারণ ঘনাদা নয় – ইনি এখন ঘনশ্যাম
বাবু। এই সব গল্পগুলিতে মেসবাড়ির মজলিশি আড্ডার পরিবর্তে গুরুগম্ভীর আলোচনার
মেজাজ লক্ষ্য করা যায়। কথা-সাহিত্যিক
প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখনীর মুনশিয়ানা দাপটে এখানে এসে হাজির হন ঘনাদার পূর্বপুরুষরা – ঘনাদা এই সব গল্পগুলির নায়ক নন, পরিবর্তে
পৃথিবী
রক্ষার দায়িত্বে আসেন ‘তস্য তস্য’ ব্যক্তিরা। ইনকা সাম্রাজ্যের
পতন থেকে শুরু করে শিবানীর
আগ্রা থেকে পলায়ন – এইসব গুরুত্বপূর্ণ
ঐতিহাসিক ঘটনায় ঘনাদার
পূর্বপুরুষ গানাদো বা ঘনরাম দাসের অবদান - লেকের ধারের এই আড্ডা ছাড়া জানা কখনই সম্ভব ছিল না।
স্মরণ করা যাক, ঘনাদার প্রবীণ বন্ধুদের পরিচয়৷ যাঁরা একটি
জলাশয়ের ধারে একটি নাতি বৃহৎ পর্কটী বৃক্ষকে কেন্দ্র করে সমবেত হন৷ তাঁরা কে? না–মেদভারে হস্তীর মত বিপুল সেই সদা প্রসন্ন ভবতারণ বাবু, উদরদেশ যার কুম্ভের মত
স্ফীত সেই রামশরণবাবু, মস্তক যাঁর মর্মরের মত মসৃণ সেই শিবপদবাবু, মাথার কেশ যাঁর
কাশের মত শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু এবং উষ্ট্রের মত শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন–আলোচনার প্রাণ ও প্রাণান্ত ঘনশ্যাম দাস ওরফে কোনও মহলে যিনি ঘনাদা৷ লেকের
ধারের এই আড্ডার গল্পগুলিতে নায়িকার আবির্ভাব ঘটেছে ও কিছু পরিণত দৃশ্যেরও সূচনা হয়েছে, সেকারণে বলা যেতে পারে যে এই গল্পগুলি পরিণত বয়স্ক পাঠকদের কথা মাথায় রেখেই প্রেমেন্দ্র
মিত্র লিখেছেন।
এই সব গল্পের যিনি লেখক, সেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের ডাক নাম ছিল – সুধীর । শিবু, গৌর ও শিশির চরিত্রগুলি যথাক্রমে লেখক শিবরাম
চক্রবর্তী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও সম্পাদক গৌরাঙ্গ প্রসাদ বসু এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক ও
অভিনেতা শিশির মিত্র ।
এই চারজন সত্যিই বেহালার একটা
মেসে থাকতেন, একসঙ্গে । এই সূত্রেই অনেকের জানতে ইচ্ছে করে ঘনাদা, চরিত্র কল্পনাকালে
লেখক কোনও বাস্তব চরিত্র অবলম্বন করেছিলেন কি না। এ নিয়ে বেশ মজার ইতিহাস
আছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র
তাঁর ঘনাদা চরিত্র কল্পনা করেছিলেন দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত বাঙালি
মানসিকতার বারফট্টাইকে মনে রেখে। কারও মতে ঘনাদা আসলে বিমল ঘোষ নামে মেসের এক বাসিন্দা, যাঁকে প্রেমেনবাবু
ডাকতেন টেনদা বলে।
সেই ঘনাদা, আমাদের আজও
আনন্দ দিয়ে চলেছেন, অনবরত ভাবে । আর কি কেউ লিখতে পারবেন এই ভাবে? কে জানে
!!!!!!!!!!!!!
কৃতজ্ঞতা : -
১।অরুণাংশু ভট্টাচার্য ( দি সানডে ইণ্ডিয়ান) ।
২।ঘনাদা সমগ্রের মুখবন্ধ।
৩। ইন্টারনেট ।
No comments:
Post a Comment