সৌকর্য- ওয়েবজিনে প্রকাশিত
ক্ষেতু
বাগচীর বেশ কয়েক দিন দর্শন নেই । চন্দন ডাক্তারের চেম্বারে, সন্ধে সাতটার পর
আড্ডাটা বেশ ঝিমিয়ে আছে । সত্য কম্পাউন্ডার ওরফে সত্য কম্পুর ইংরেজি বলার তোড়টাও
কম ।
তারক
মোত্তির একদিন খবর নিয়ে এলেন, ক্ষেতু বাগচী ফেসবুক প্রোফাইল খুলেছেন । সেখানেই দিনরাত আড্ডা দিচ্ছেন লিখিত ভাবে ।
প্রচুর যুবতী মেয়ে ফ্যান জুটে গেছে ওনার । একটা লজঝরে বিংশ শতাব্দীর স্কুটারও নাকি
কিনেছেন । সেটা চেপে মাঝে মাঝে বিভিন্ন গ্রুপের গেট টু গেদার থেকে লিটল ম্যাগাজিন
মেলাতেও যথেচ্ছ যাতায়াত ক্ষেতু বাগচীর ।
চায়ের
দোকানের হরি স্বচক্ষে দেখেছে, বৌদিকেও মাঝে মাঝে পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন । খালি,
চন্দনের চেম্বারেই আসছেন না ।
আজ,
ধড়পড় করে একটা স্কুটার ক্ষেতু বাগচীর
দেহটা নিয়ে এসে থামল চন্দনের চেম্বারের সামনে । বিশাল দেহটা বয়ে নিয়ে এসে মনে হল,
স্কুটারটা হাঁপাচ্ছে ।
ক্ষেতু
বাগচীর পদার্পণ হলো চন্দন ডাক্তারের চেম্বারে । সবাই প্রথমে একটু হতচকিত হল। নাটু
লাহিড়ী বলে উঠলেন :-
-
একি ,
ক্ষেতুদা ! আপনার চেহারা দেখছি পূর্ণিমার চাঁদের মত চেকনাই দিচ্ছে ।
-
শুক্লপক্ষের
শশিকলার ন্যায় বর্ধিত ?
-
মানে না ,
হ্যাঁ ।
-
ভাগ্যিস
জটায়ুর মত হাঁয়ে স বলনি ! ক্ষেতুদার দরাজ গলা ।
-
তা, ঐ
পুরোনো স্কুটারটা আপনার বপুর ভার সইতে পারছে ?
-
বল কি হে !
আমার কাছে তো ঐ কোম্পানি চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে আমার এই স্কুটারে চড়ার একটা ফোটো
নিয়ে ক্যাপশন দেবে :- ইভেন দিস ওল্ড ব্র্যান্ড অফ আওয়ার স্কুটার ক্যান বিয়ার দিস
ওয়েট ! থিংক আ্যবাউট দি নিউ মডেল উই আর গোয়িং টু লঞ্চ সুন ।
-
বলেন কি ?
-
হুঁ হুঁ
বাওয়া, যা বলি- ঠিকই বলি ! একি আর তারক ! কথায় কথায় মুখেন মারিতং জগৎ ?
-
কিন্তু,
ক্ষেতুদা আজকাল তো স্কুটারের প্রোডাকশন তো আর হয়ই না ! ওরা নতুন মডেল বের করবে বলেছে
? বিরাট ইনভেস্টমেন্ট করে, এই সব তো আর
খাবে না মার্কেটে , তালে লাভ কি ?– তারক মোত্তির উবাচ ।
-
তুমি একটা
শাখামৃগ, তারক । বলি, স্কুটারের উন্নত সংস্করণ এখন স্কুটি – বোয়েচ ? ইনভেস্টমেন্ট
দ্বিগুণ ফেরত আসবে !
-
ইনভেস্টমেন্ট
ছাড়া দেখছি কিছু হয় না !
-
হবে কি করে
? ভিক্ষা করতেও ইনভেস্টমেন্ট দরকার হয় ।
-
সে কি ? –
সবাই হতভম্ব ।
-
হুঁ ! হুঁ !
একটা বিড়ি আর এক কাপ চা ! এই দুটোর তো ইনভেস্টমেন্ট লাগেই ভিক্ষে করতে !
-
ইন্টারেস্ট
! হাউ ফ্লিজিং ! নোয়াখালীর পূর্বতন বাসিন্দা সত্য কম্পু বললেন ।
-
তা,
ক্ষেতুদা আপনার এই বিংশ শতাব্দীর স্কুটারের পেছনে ইনভেস্টমেন্টের রহস্য কি ?
-
দেড় হাজারে
কিনেছি । আর চার হাজার টাকা লেগেছে সারাই করতে । মোট সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ।
-
আপনার লাভ ?
-
বল কি হে !
রিকশা ভাড়া কত বাঁচছে জান ?
-
কি রকম ?
-
আর বলো না! রিকশাওয়ালাদের
প্রচুর বায়নাক্কা । বাজার করতে যেতে লাগে ছয় টাকা । আর এরা কিছুতেই সেই ভাড়া নেবে
না । শীতের সময় বলবে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, দুটাকা বেশী দিন । ঠিক আছে, সেটা না হয়
দিলাম। কিন্তু দশ টাকার নোট দিলেই বলবে, খুচরো নেই ফেরত দেবার । বাকী দুটাকা নাকি
গোবিন্দের ভোগে লাগাবে । কার ভোগে লাগে কে জানে ! সবই উড়ো খই । গরম, আর বৃষ্টির
দিনেও এক কথা । তাই কিনেই ফেললাম ।
-
কিন্তু
পেট্রোল যা দামী !
-
তা হলেও
আমার পুষিয়ে যায় । হিসেব করে দেখেছি- আমার মাসিক রিকশা ভাড়ার থেকেও কম লাগে এই
স্কুটারের খরচা ।
-
আপনার জীবনে
সব চেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট কি, ক্ষেতুদা ? চন্দন, হরির চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল
।
-
বিয়ে
-
কার বিয়ে?
-
তোমার বৌদির
বিয়েতে !
-
আমার বৌদির
বিয়েতে আপনার ইনভেস্টমেন্ট কেন হবে দাদা ?
-
আরে , আমার
বৌ, তো তোমাদের বৌদি !
-
সেটা বলুন !
তা প্রফিট অ্যান্ড লস রেশিও কি ?
-
মাইনাস
ব্যালেন্স ! মানে রেকারিং লস ! তাও মেনটেন করছি । ভাগ্যিস আমার ক্রেডিট কার্ড
হারিয়েছে ।
-
সর্বনাশ !
আপনি পুলিসকে আর ব্যাংকে জানান নি, এই ব্যাপারে !
-
নাঃ !
-
সে কি !
এটাও তো আপনার হেব্বী লস !
-
না হে না !
চোরটা আমার গিন্নির থেকেও অনেক কম খরচ করছে । তাই ওটা আমার রাইট ইনভেস্টমেন্ট !
বুইলে কিনা !
-
আপনি তো
ইদানীং কোলকাতা শহরেও যাচ্ছেন স্কুটার নিয়ে । পুলিশের খপ্পরে পড়েন নি ?
-
পড়েছি ! আর
ব্যাটারা আমার ফাইন করবে বলেছিল ।
-
তালে,
ফাইনটাও তো আপনার ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট !
-
মোটেই না !
-
সে আবার কি
! আপনাকে ফাইন দিতে হয় নি ?
-
না !
-
কি রকম ?
-
আমি বললাম ,
দেখুন আপনারা আমায় দাঁড় করিয়েছেন, আর আমি দাঁড়িয়েছি কিনা ? ওরা বলল- হ্যাঁ ! তারপর বললাম, আমি সিনিয়র
সিটিজেন । আপনারা তাড়া করলে এই স্কুটার জোরে চালিয়ে আমি পালাবো আর পালাতে গিয়ে
উল্টে পড়লে, আমি শেষ ! সরকার থেকে আমার পরিবারকে দু লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে । আর আপনার চাকরটি
যাবে ! ভেবে দেখুন- কি করবেন !
-
তারপর ?
-
রাস্তার শেষ
মোড়ে এক অফিসার বাবু বসেছিল । তার কাছে নিয়ে গেল আমায় । আমি ওর কাছে যেতেই বলল-
এটা ওয়ান ওয়ে । আপনি এখান দিয়ে এলেন কেন ? আমি বললাম –এখন সব ওয়ান উইন্ডো ! এসব
আবার বললে, আমি কিন্তু কমপ্লেন ঠুকবো আপনার নামে । মাথা টাথা
চুলকে আমায় ছেড়ে দিল । এটাও অবশ্য একরকমের
ইনভেস্টমেন্ট ।
-
মাথা চুলকে
মানে তো, চিন্তা ?
-
হ্যাঁ !
ওটাও একটা ইনভেস্টমেন্ট ! তবে, ওরা ঠিক ভাবে করতে পারে নি !
-
কি রকম ?
-
অত বকবক
শুকনো মুখে করতে পারব না বাপু ! আবার “বলো হরির” চা বল । গলাটা ভিজিয়ে নি ।
ক্ষেতু
বাগচী চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই ওনার সেল ফোনে একটা বিতিকিচ্ছিরি রিং টোন বেজে উঠল
। একবারও স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই ফোনটা
কেটে দিলেন । এবারে তিনি একটা ফোন করে
বললেন-
-
হ্যাঁ , বলো
! কি ? টমাটো সস্ আর কর্নফ্লাওয়ার আনতে হবে ? ঠিক আছে ফেরার সময় নিয়ে যাবো । বলে ফোনটা কেটে দিলেন ।
তারক
মোত্তির বললেন :-
-
কার ফোন
ছিল, সেটা না দেখেই কেটে দিলেন ?
-
ওটা তোমাদের
বৌদির কল ছিল ! তাই কেটেছি ।
-
কি করে
বুঝলেন, বৌদির ফোন ?
-
ওনার
নাম্বারটা আমি পার্সোনালাইজড্ করে রেখেছি একটা রিং টোন দিয়ে । আর ওটা শুনলেই কেটে
দি ফোন ।
-
এ বাবা !
এরকম কেন ?
-
ফোনটা আগে
ধরতাম । পরে দেখি , মহামহিম বলছেন – তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার ব্যাল্যান্স
নেই হয়ে যায় । মানে, ফোনের কথা বলার টাকা শেষ । আমাকে দুশো টাকার টক টাইম ভরে দাও
। এরকম দুচার বার হতেই আমি ফোন কেটে দিয়ে রিং ব্যাক করি । আর সেই টাকা ভরার বখেরা
থাকে না !এত ইনভেস্টমেন্ট আর পোষায় না !
-
বৌদি বেশ
ব্যালান্সিং ক্যারেক্টার ! চন্দন ডাক্তারের হাসিমুখে জবাব ।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল ।
ক্ষেতু বাগচী বললেন – ঐ জন্যই তো মাঝে সাজে এনাকে নিয়ে আমি পিকনিক আর জিটি তে যাই
। না হলেই সব ব্যাল্যান্স শেষ হয় । এই বয়সেও ফেসবুকে মেয়ে বন্ধুদের মধ্যে আমার
জনপ্রিয়তার জোয়ার দেখে তিনি আবার অন্য ইনভেস্টমেন্ট করে না বসেন ।
তারক মোত্তির জিজ্ঞাসা করলেন :
-
-
ক্ষেতুদা,
আর একটা চিন্তার ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে কোন
উদাহরণ দেবেন ?
-
এ আর বেশী
কথা কি ! ভাবছি এবার ধূপ কাঠি শিল্প গড়ে তুলবো । বাংলার বুকে শিল্পের জোয়ারে ধূপ
কাঠির একটা সদর্থক ভূমিকা বরাবরই আছে। আরও একটা আছে !
-
কি সেটা ?
-
চাকরীর
প্রয়োজনে আমাকে প্রায়ই প্লেনে চড়ে এদিক সেদিক যেতে হত । কয়েকবার আমার বসও গিয়েছেন
সাথে । প্লেনে চড়েই তিনি ভালো করে ভেতরের চারপাশটা দেখে নিতেন । কয়েকবার এরকম
হওয়াতে একবার জিজ্ঞেস করেই ফেললাম – কি এত দেখেন বলুন তো !
-
দেখি,
বাচ্চা বেশী আছে কিনা !
-
বাচ্চা বেশী
থাকলে আপনার লাভ ?
-
বুঝলে না,
বাচ্চা গুলো সব নিষ্পাপ । বুড়ো গুলো সবই এনারজেটিক তো ! তাজা জিনিস । তাই এদের
পাপের ভাগ বেশী । বুড়ো গুলো বেশী থাকলে প্লেন আবার এক্সিডেন্ট করে না বসে ।
-
দারুণ
দিয়েছেন তো উনি !
ক্ষেতু বাগচীর আর ফোনে সেই
বিতিকিচ্ছিরি রিং টোন ! ফোন কেটে দিয়ে, রিং ব্যাক করে বললেন – আসছি ।
স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে বাড়ীর
পথে রওনা হলেন “ ইনভেস্টার” ক্ষেতু বাগচী ।
...... সমাপ্ত .......
No comments:
Post a Comment