আদরের নৌকা তে প্রকাশিত
রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ খেলেও,ভোরবেলা
আজকাল চটপট ঘুম থেকে উঠে পড়ে, অতনু । কোনরকমে হাত মুখ ধুয়েই পাড়ার মোড়ের দিকে
হাঁটা লাগায় । আগে বাজার যেতে, যত রাজ্যের আলসেমি আসত
অতনুর । নতুন
বানানো ফ্লাইওভারের নীচে ফাঁকা পরিস্কার টাইলস বাঁধানো জায়গাগুলোতে বাজার বসাতে
সেই বাজার যাওয়ার আলেসেমীটা উধাও । ফুটপাথের পাশে যখন বাজার বসত, তখন একটা ঘিঞ্জি
নোংরা ভাব ছিল । বাস, রিক্সা, ঠেলাগাড়ী, প্রাইভেট কারের গুঁতোগুঁতিতে প্রাণ
নাজেহাল হয়ে যাবার উপক্রম । ভালো
করে যে জিনিস বাছাই করবে তার উপায় ছিল না ! এখন সেই অসুবিধেটা আর নেই ।
পাড়ার
মোড়, একটু খানি রাস্তা ! হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয়, দুপাশের
ফুলের গাছগুলো নীরবে সুপ্রভাত বলছে । একটা নাম না জানা ফুলের
গাছের দিকে তাকাতেই
ছোট্ট একটা ফুল হাতের কাছে এসে পড়ল । প্রথম শীতের শিশু রোদ, মুচকি হাসছে । বড় ফ্ল্যাট বাড়ীর গায়ে ধাক্কা লাগছে
রোদের ! অতনুর কেন যেন মনে হয়, রোদের
ব্যাথা লাগছে ।
রাস্তার
দুপাশে নানা রকম পাতাবাহার আর ফুলের গাছ । কেউ ফুল দ্যায়, কেউ বা পাতা । বারো ফ্ল্যাট
আর তেরো বাড়ীর ফাঁক দিয়ে, বালার্কর নরম প্রভা টুকি দ্যায় ।
গাছের ফুল আর নতুন পাতাগুলোও খুব আনন্দে মাতে । সকালে, বেরিয়ে টুক টুক করে হাঁটে অতনু । নীল আকাশের পেঁজা মেঘেরা টুকি-টুকি খেলে । মাঝে, মাঝে যন্ত্র-পাখী গর্জন করে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে- দেশ বিদেশ পানে । আওয়াজে ওপরের দিকে মাথা তুললে, চোখ চলে যায় ওই পাখীর দিকে । ঝক ঝকে গা দিয়ে ঠিকরে পড়ে- কাচ্চি ঘানি সোনা । গোমেদ আর পান্নার রং চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়, হীরেয় মোড়া যন্ত্র পাখী ।
গাছের ফুল আর নতুন পাতাগুলোও খুব আনন্দে মাতে । সকালে, বেরিয়ে টুক টুক করে হাঁটে অতনু । নীল আকাশের পেঁজা মেঘেরা টুকি-টুকি খেলে । মাঝে, মাঝে যন্ত্র-পাখী গর্জন করে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে- দেশ বিদেশ পানে । আওয়াজে ওপরের দিকে মাথা তুললে, চোখ চলে যায় ওই পাখীর দিকে । ঝক ঝকে গা দিয়ে ঠিকরে পড়ে- কাচ্চি ঘানি সোনা । গোমেদ আর পান্নার রং চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়, হীরেয় মোড়া যন্ত্র পাখী ।
বাড়ীতে তিনশো টাকা কেজি, দামের
চা থাকা সত্বেও মোড়ের মাথায় হরির দোকানে গিয়ে আজকাল দিনের প্রথম চায়ে আচমন করে
অতনু । মধুর দোকানে পলি প্যাকের দুধ, পাঁউরুটি নেয়, সাথে সিগারেটের একটা নতুন
প্যাকেট । গোবিন্দর কাছ থেকে এক প্যাকেট ফুলও নেয় । ফুরফরে সকালটা অবসরের পর এই
ভাবেই কাটায় ।
পাশের রিক্সাষ্টাণ্ডে তখন মাত্র
জনা দুয়েক রিক্সাওয়ালা থাকে । রবি, তাদের মধ্যে একজন । সিগারেট ছাড়া, বাকী সব
পাঠিয়ে দেয় রবিকে দিয়ে । রবি বাড়ীতে ওগুলো
দিয়ে ,ফিরে এলে ওর রিক্সায় বেরিয়ে পড়ে, বাজারের অভিসারে । রিক্সা করে যেতে যেতে
দেখে, ঘুম ভেঙে শহরতলীর এই জায়গাটা আস্তে আস্তে আড়মোড়া দিচ্ছে । এই অল্প ঠাণ্ডায়
আবহওয়াটা বেশ ন্যাচারাল এসি বলে মনে হয় ।
থলিটা রবির হাতে দিয়ে, বাজারে
ঢোকে অতনু ! সার সার মৃতদেহ । লোকে টিপেটুপে দেখছে, সেই মৃতদেহগুলো । একটু পরেই এদের শ্রাদ্ধ হবার কথা !
একটা মৃতদেহতে হাত দিল অতনু । ঠাণ্ডা গায়ে হাত দিতেই সারা গায়ে একটা শিনশিনে ভাব ।
অনেকদিন এই সব দেহে হাত দেয় নি । দামটা জিজ্ঞেস করতেই দোকানদারের সেলিম –জাভেদের
সংলাপ ।
- ইলিশটা
দেখতে হবে না দাদা ! শীতের মাল হলেও দারুণ “টেস” পাবেন ।
- দাম
?
- বেশী
নয়, মাত্র বারোশো টাকা কেজি !
শুনেই অতনুর হাতের মৃতদেহটা যেন
ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকে গেল । মিউ মিউ করে বলল:-
- লস
করে দিচ্ছো না তো হে ! আরও একশো টাকা বেশী নাও !
- না
না, দাদা ! অধর্ম করি না ! কেনা দামেই বেচি
আমি- আপনার কাছে !
- কষ্ট
করে, পাতিপুকুরে গিয়ে মাছ কিনে, সেটা কেনা দামেই বিক্রি করবি আমায় ! এটা কোনো কথা
হলো?
হতভম্ব মাছওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তি পায়
অতনু । পরে অন্য কোনো মাছ কিনবে ভেবে সব্জীর দিকে এগোয় ।
মানকচুটাকে দেখে বেশ হিরো হিরো লাগছে । নিচের দিকটা
নীলাভ আভা । ওপরে একটা মাটির রঙ । পুরো শাম্মী কাপুর। পাশে, নারকোলও আছে ।
দাম জিজ্ঞেস করাতে, দোকানদার
বলল:- জোড়া চল্লিশ টাকা !
অতনু বলল :- একটু কম হবে না ?
- হবে
বাবু, তবে আমার এখানে নয় ।
- কোথায়
?
- একটু
এগিয়ে যান, জোড়া ৩৫ টাকা । আর একটু এগুলে জোড়া ৩০ টাকা । করে করে, এগিয়ে গেলে দেখবেন, বিনে
পয়সায় প্রচুর নারকোল পাবেন !
দোকানদারের মজাটা বুঝে, মানকচুর লোভেই একটা নারকোল
কিনে নিলো । সান্তনা একটাই, রসিকতাটা ফাউ । কবিতাকে বলে, নারকোল দিয়ে মানবাটা খাবে
আজ ।
অতনু তেমন গদ্য
বা সাহিত্য বোঝে না ! পাঠ্যপুস্তকে যেটুকু
ছিল, সেটা পড়তে হয়েছিল পরীক্ষা পাশের দায়ে । রবীন্দ্রনাথের কবিতাও
পড়েছে । বি সরকারের নোটস পড়ে বুঝতে হয়েছে কবিতা গুলো ।
প্রেম কি
সেটা আর বোঝা হয় নি ! বিয়ের আগে, মেয়েদের দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না । লজ্জা লজ্জা
করত। বিয়ের পর, কবিতার সাথে সিনেমা বা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে বটে, তবে ওর বকর
বকর ছিল শুধু সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে । সেটা আর যাই হোক, সিনেমায় দেখা উত্তম-
সুচিত্রার প্রেমের মত ছিল না ।
ইদানীং প্রেম যে কি বুঝতে পারছে, বাজারে গেলে । তন্বী যুবতীরা শিশিরে স্নান করে সুন্দর ভাবে সেজে বসে থাকে ! সাদা টপ, সবুজ জিন্সের প্যান্ট পরে থাকে বসে থাকে যে সুন্দরী, এই প্রথম শীতের আমেজে তার প্রেমে অতনু বিভোর ! তুলে নিয়ে চুমো খায় তার বুকের মধ্যে খানে । সুন্দর এক মাটির গন্ধ । ভিজে ওঠে মন । ফুলকপি গুলো অনাঘ্রাতা যুবতীর বুকের মত উঁচু আর মাংসল ।
সবুজ জিন্স পরে যে পাশেই বসে থাকে, সেই সুন্দরী আরও মনোহর । এক্কেবারে বুনো বিড়ালের মত । ক্যাপসিক্যামটা ফুলকপির সাথে জমে ভাল । কমলা রঙের শাড়ী পরে গুটি শুঁটি মেরে পড়ে আছে টম্যাটোর সারি । বিরহে কাতর হয়ে পড়ে আছে পেঁয়াজ কলি আর রসুন পাতা । সবুজ বাঁধাকপির গুরুভার নিতম্ব আর হলুদ গাজরের পৌরুষ নিঃশব্দ ভাবে সোচ্চার ।
এত সুন্দরী
আর পৌরুষ এক জায়গায় পেয়ে মন ভরে যায় । থলি ভর্তি করে সেই সুন্দরী
আর পৌরুষ দিয়ে । নিজের হাতেই ওদের সব বসন খুলে ফেলতে
ইচ্ছে করে অতনুর । হবার
নয়, জানে সেটা ! কবিতা, বঁটি নিয়ে নির্মম ভাবে কাটবে ওদের । টুকরো টুকরো করে অতনুর
পরকীয়া প্রেমকে খতম করবে ।
এক জায়গায়
কুচো চিংড়ি দেখল অতনু । দামটাও আয়ত্বের মধ্যে । চিংড়িকে সম্রাট মনে হয় তার । এই
সম্রাটের হাজারটা বেগম । তবু, ইলিশকে ভোলে না সে । ইলিশ হলো ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী
। ধীরে ধীরে সব জয় করে নিয়েছে । ওদের রাজত্ব শেষ হলেও, সেই রাজত্বের কথা সবাই বলে
এখন । ইলিশেরও তাই !
কি যে খরচের বহর ! অবসরের জীবনে, এত টাকা কোত্থেকে আসবে, ভাবতে
ভাবতেই অতনুর শিরোদেশ ইন্দ্রলুপ্ত । ভাগ্যিস,
ছেলে – আই. সি. ইউয়ের সাপোর্ট সিস্টেমের কাজ করে । না হলে, ভেন্টিলেশনে গেলে আর
উইন করা সম্ভব হতো না !
তিল- যব- হরিতকী কিনতে
হবে, বাড়ীর গৃহদেবতার পূজার জন্য । ছেলে,
গত রাতেই হাতে একটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল – বাসমতী চাল, সোনামুগের
ডাল এনো । সাথে
ভালো ঘি । কবিতা বলেছিল- গোরোক্ষবাসী
রোডে, “বাপী সুইটসের” মিষ্টি আর “ অভিনন্দনের” দই মাস্ট !
মাথার হার্ড ডিস্কে ( ২ জিবি ) একটা ফাইল তৈরি ! ডিফ্র্যাগমেন্ট
করে সাজিয়ে নিল তালিকা গুলো । ধীরে
ধীরে আপলোড করে দেখল, ফ্যাট ( মাথাতেও
ফ্যাট ) সিস্টেমে ডিস্ক ফুল । পুরোনো বলে অতনুর হার্ড ডিস্কে আবার নিউ টাইপ ফাইল
সিস্টেম কাজ করে না । এক্কেবারে ফুলিস ব্যাপার । যাই হোক, বাজার হয়ে যাবার পর অভিনন্দনে
এলো অতনু দই কিনতে । কবিতার হুকুম ছিল :- খুচরো দই আনবে হাঁড়ি থেকে কেটে ।
- ভাই
মিষ্টি দই কত করে ? অতনুর ব্যাকুল জিজ্ঞাসা ।
- একশ
কুড়ি টাকা কিলো ।
- এ:,
কিলিয়ে দিলেন ভাই ! একশ বিশ করে হবে না ? একটু সস্তা হতো তালে !
- নামী
দোকানে একদাম ! নেবার হলে নিন, না হলে আসুন !
- ঠিক
আছে ভাই ! আড়াইশো দিন ! আর মাথাটা দেবেন !
- দইয়ের
মাথা তো ?
- আপনার
অমন অমূল্য মাথা নিয়ে, শেষে খুনের দায়ে ধরা পড়বো নাকি ? হ্যাঁ! দইয়ের মাথা ।
কেনা হলো দই । এবার মিষ্টি !
সুন্দর করে ট্রেতে সাজিয়ে রাখা ! শুধু মিষ্টিগুলো প্রায় অদৃশ্য । বায়স্কোপ থুক্কু টেলিস্কোপ থুক্কু
মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয় । আসলে আজকাল সব বিষয়েই এত “ স্কোপ” যে বাকী স্কোপেরা গুলিয়ে
যায় । সেগুলোও
মিনিমাম পাঁচ টাকা করে দাম । ১০ টা নিয়ে, রক্তকরবীর পালোয়ানের মত ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ীর দিকে রওনা দিল অতনু ।
আলাদা করে সব
থলিতে ভরে নিয়ে আঁশের থলিটা ঝুলিয়ে দিল রবির রিক্সার হ্যাণ্ডেলে । সব্জীর ব্যাগ,
দই- মিষ্টি নিজের হাতে নিয়ে রওনা দিল । বাড়ী ফিরে গর্বের
সাথে থলিদুটো ধরিয়ে দিল কবিতার হাতে ।
কবিতা, থলি খুঁটিয়ে সব দেখে বলল- অপদার্থ ! কোন খেয়ালে থাকে, কে জানে ! কাঁচালঙ্কাটাই নেই আর
চিংড়ি মাছটাও তো ছাড়িয়ে আনো নি ! অতনুর অসম্পূর্ণ অসমাপ্ত অবসরের মতই বাজারের
ব্যাগটা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
....সমাপ্ত
...
#################আদরের নৌকা ওয়েবজিনে প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment