Friday, May 24, 2013

বাজার

আদরের নৌকা তে প্রকাশিত

রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ খেলেও,ভোরবেলা আজকাল চটপট ঘুম থেকে উঠে পড়ে, অতনু । কোনরকমে হাত মুখ ধুয়েই পাড়ার মোড়ের দিকে হাঁটা লাগায় । আগে বাজার যেতে, যত রাজ্যের আলসেমি আসত অতনুরনতুন বানানো ফ্লাইওভারের নীচে ফাঁকা পরিস্কার টাইলস বাঁধানো জায়গাগুলোতে বাজার বসাতে সেই বাজার যাওয়ার আলেসেমীটা উধাও । ফুটপাথের পাশে যখন বাজার বসত, তখন একটা ঘিঞ্জি নোংরা ভাব ছিল । বাস, রিক্সা, ঠেলাগাড়ী, প্রাইভেট কারের গুঁতোগুঁতিতে প্রাণ নাজেহাল হয়ে যাবার উপক্রমভালো করে যে জিনিস বাছাই করবে তার উপায় ছিল না ! এখন সেই অসুবিধেটা আর নেই ।
পাড়ার মোড়, একটু খানি রাস্তা ! হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয়, দুপাশের ফুলের গাছগুলো  নীরবে সুপ্রভাত বলছে । একটা নাম না জানা ফুলের গাছের দিকে তাকাতেই ছোট্ট একটা ফুল হাতের কাছে এসে পড়ল । প্রথম শীতের শিশু রোদ, মুচকি হাসছে । বড় ফ্ল্যাট বাড়ীর গায়ে ধাক্কা লাগছে রোদের !  অতনুর কেন যেন মনে হয়, রোদের ব্যাথা লাগছে ।
রাস্তার দুপাশে নানা রকম পাতাবাহার আর ফুলের গাছ । কেউ ফুল দ্যায়, কেউ বা পাতা বারো ফ্ল্যাট আর তেরো বাড়ীর ফাঁক দিয়ে, বালার্কর নরম প্রভা টুকি দ্যায়
গাছের ফুল আর নতুন পাতাগুলোও খুব আনন্দে মাতে ।  সকালে, বেরিয়ে টুক টুক করে হাঁটে অতনুনীল আকাশের পেঁজা মেঘেরা  টুকি-টুকি খেলে । মাঝে, মাঝে যন্ত্র-পাখী গর্জন করে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে- দেশ বিদেশ পানে । আওয়াজে ওপরের দিকে মাথা তুললে, চোখ চলে যায় ওই পাখীর দিকে । ঝক ঝকে গা দিয়ে ঠিকরে পড়ে- কাচ্চি ঘানি সোনা গোমেদ আর পান্নার রং চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়, হীরেয় মোড়া যন্ত্র পাখী ।
বাড়ীতে তিনশো টাকা কেজি, দামের চা থাকা সত্বেও মোড়ের মাথায় হরির দোকানে গিয়ে আজকাল দিনের প্রথম চায়ে আচমন করে অতনু । মধুর দোকানে পলি প্যাকের দুধ, পাঁউরুটি নেয়, সাথে সিগারেটের একটা নতুন প্যাকেট । গোবিন্দর কাছ থেকে এক প্যাকেট ফুলও নেয় । ফুরফরে সকালটা অবসরের পর এই ভাবেই কাটায়
পাশের রিক্সাষ্টাণ্ডে তখন মাত্র জনা দুয়েক রিক্সাওয়ালা থাকে । রবি, তাদের মধ্যে একজন । সিগারেট ছাড়া, বাকী সব পাঠিয়ে দেয় রবিকে দিয়ে  । রবি বাড়ীতে ওগুলো দিয়ে ,ফিরে এলে ওর রিক্সায় বেরিয়ে পড়ে, বাজারের অভিসারে । রিক্সা করে যেতে যেতে দেখে, ঘুম ভেঙে শহরতলীর এই জায়গাটা আস্তে আস্তে আড়মোড়া দিচ্ছে । এই অল্প ঠাণ্ডায় আবহওয়াটা বেশ ন্যাচারাল এসি বলে মনে হয় ।
থলিটা রবির হাতে দিয়ে, বাজারে ঢোকে অতনু ! সার সার মৃতদেহ । লোকে টিপেটুপে দেখছে, সেই মৃতদেহগুলো একটু পরেই এদের শ্রাদ্ধ হবার কথা ! একটা মৃতদেহতে হাত দিল অতনু । ঠাণ্ডা গায়ে হাত দিতেই সারা গায়ে একটা শিনশিনে ভাব । অনেকদিন এই সব দেহে হাত দেয় নি । দামটা জিজ্ঞেস করতেই দোকানদারের সেলিম –জাভেদের সংলাপ ।
-       ইলিশটা দেখতে হবে না দাদা ! শীতের মাল হলেও দারুণ “টেস” পাবেন ।
-       দাম ?
-       বেশী নয়, মাত্র বারোশো টাকা কেজি !
শুনেই অতনুর হাতের মৃতদেহটা যেন ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকে গেল । মিউ মিউ করে বলল:-
-       লস করে দিচ্ছো না তো হে ! আরও একশো টাকা বেশী নাও !
-       না না, দাদা ! অধর্ম করি না  ! কেনা দামেই বেচি আমি- আপনার কাছে !
-       কষ্ট করে, পাতিপুকুরে গিয়ে মাছ কিনে, সেটা কেনা দামেই বিক্রি করবি আমায় ! এটা কোনো কথা হলো?
হতভম্ব মাছওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তি পায় অতনু । পরে অন্য কোনো মাছ কিনবে ভেবে সব্জীর দিকে এগোয় ।
মানকচুটাকে দেখে বেশ হিরো হিরো লাগছে । নিচের দিকটা নীলাভ আভা । ওপরে একটা মাটির রঙ । পুরো শাম্মী কাপুর। পাশে, নারকোলও আছে ।
দাম জিজ্ঞেস করাতে, দোকানদার বলল:- জোড়া চল্লিশ টাকা !
অতনু বলল :- একটু কম হবে না ?
-       হবে বাবু, তবে আমার এখানে নয় ।
-       কোথায় ?
-       একটু এগিয়ে যান, জোড়া ৩৫ টাকা । আর একটু এগুলে জোড়া ৩০ টাকাকরে করে, এগিয়ে গেলে দেখবেন, বিনে পয়সায় প্রচুর নারকোল পাবেন !
দোকানদারের মজাটা বুঝে, মানকচুর লোভেই একটা নারকোল কিনে নিলো । সান্তনা একটাই, রসিকতাটা ফাউ । কবিতাকে বলে, নারকোল দিয়ে মানবাটা খাবে আজ ।
অতনু তেমন গদ্য বা সাহিত্য  বোঝে না ! পাঠ্যপুস্তকে যেটুকু ছিল, সেটা পড়তে হয়েছিল পরীক্ষা পাশের দায়ে । রবীন্দ্রনাথের কবিতাও পড়েছেবি সরকারের নোটস পড়ে বুঝতে হয়েছে কবিতা গুলো ।
প্রেম কি সেটা আর বোঝা হয় নি ! বিয়ের আগে, মেয়েদের দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না । লজ্জা লজ্জা করত। বিয়ের পর, কবিতার সাথে সিনেমা বা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে বটে, তবে ওর বকর বকর ছিল শুধু সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে । সেটা আর যাই হোক, সিনেমায় দেখা উত্তম- সুচিত্রার প্রেমের মত ছিল না ।
 
ইদানীং প্রেম যে কি বুঝতে পারছে, বাজারে গেলে । তন্বী যুবতীরা শিশিরে স্নান করে সুন্দর ভাবে সেজে বসে থাকে ! সাদা টপ, সবুজ জিন্সের প্যান্ট পরে থাকে বসে থাকে যে সুন্দরী, এই প্রথম শীতের আমেজে তার প্রেমে অতনু বিভোর ! তুলে নিয়ে চুমো খায় তার বুকের মধ্যে খানে । সুন্দর এক মাটির গন্ধ ভিজে ওঠে  মন । ফুলকপি গুলো অনাঘ্রাতা যুবতীর বুকের মত উঁচু আর মাংসল ।
সবুজ জিন্স পরে যে পাশেই বসে থাকে, সেই সুন্দরী আরও মনোহর । এক্কেবারে বুনো বিড়ালের মত । ক্যাপসিক্যামটা ফুলকপির সাথে জমে ভাল । কমলা রঙের শাড়ী পরে গুটি শুঁটি মেরে পড়ে আছে টম্যাটোর সারি ।  বিরহে কাতর হয়ে পড়ে আছে পেঁয়াজ কলি আর রসুন পাতা । সবুজ বাঁধাকপির গুরুভার নিতম্ব আর হলুদ গাজরের পৌরুষ  নিঃশব্দ ভাবে সোচ্চার ।
এত সুন্দরী আর পৌরুষ এক জায়গায় পেয়ে মন ভরে যায় । থলি ভর্তি করে সেই সুন্দরী আর পৌরুষ দিয়েনিজের হাতেই ওদের সব বসন খুলে ফেলতে ইচ্ছে করে  অতনুর হবার নয়, জানে সেটা ! কবিতা, বঁটি নিয়ে নির্মম ভাবে কাটবে ওদের । টুকরো টুকরো করে অতনুর পরকীয়া প্রেমকে খতম করবে ।
এক জায়গায় কুচো চিংড়ি দেখল অতনু । দামটাও আয়ত্বের মধ্যে । চিংড়িকে সম্রাট মনে হয় তার । এই সম্রাটের হাজারটা বেগম । তবু, ইলিশকে ভোলে না সে । ইলিশ হলো ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী । ধীরে ধীরে সব জয় করে নিয়েছে । ওদের রাজত্ব শেষ হলেও, সেই রাজত্বের কথা সবাই বলে এখন । ইলিশেরও তাই !
কি যে খরচের বহর  ! অবসরের জীবনে, এত টাকা কোত্থেকে আসবে, ভাবতে ভাবতেই অতনুর শিরোদেশ ইন্দ্রলুপ্তভাগ্যিস, ছেলে – আই. সি. ইউয়ের সাপোর্ট সিস্টেমের কাজ করে । না হলে, ভেন্টিলেশনে গেলে আর উইন করা সম্ভব হতো না !
তিল- যব- হরিতকী কিনতে হবে,  বাড়ীর গৃহদেবতার পূজার জন্য  । ছেলে, গত রাতেই হাতে একটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল – বাসমতী চাল, সোনামুগের ডাল এনো সাথে ভালো ঘি ।   কবিতা বলেছিল- গোরোক্ষবাসী রোডে, “বাপী সুইটসের” মিষ্টি আর “ অভিনন্দনের” দই মাস্ট !
মাথার হার্ড ডিস্কে  ( ২ জিবি ) একটা ফাইল তৈরি ! ডিফ্র্যাগমেন্ট করে সাজিয়ে নিল তালিকা গুলো ধীরে ধীরে আপলোড করে দেখল,  ফ্যাট ( মাথাতেও ফ্যাট ) সিস্টেমে ডিস্ক ফুল । পুরোনো বলে অতনুর হার্ড ডিস্কে আবার নিউ টাইপ ফাইল সিস্টেম কাজ করে না । এক্কেবারে ফুলিস ব্যাপার যাই হোক, বাজার হয়ে যাবার পর অভিনন্দনে এলো অতনু দই কিনতে । কবিতার হুকুম ছিল :- খুচরো দই আনবে হাঁড়ি থেকে কেটে
-      ভাই মিষ্টি দই কত করে ? অতনুর ব্যাকুল জিজ্ঞাসা ।
-      একশ কুড়ি টাকা কিলো ।
-      এ:, কিলিয়ে দিলেন ভাই ! একশ বিশ করে হবে না ? একটু সস্তা হতো তালে !
-      নামী দোকানে একদাম ! নেবার হলে নিন, না হলে আসুন !
-      ঠিক আছে ভাই ! আড়াইশো দিন ! আর মাথাটা দেবেন !
-      দইয়ের মাথা তো ?
-      আপনার অমন অমূল্য মাথা নিয়ে, শেষে খুনের দায়ে ধরা পড়বো নাকি ? হ্যাঁ! দইয়ের মাথা ।
কেনা হলো দই । এবার মিষ্টি ! সুন্দর করে ট্রেতে সাজিয়ে রাখা ! শুধু মিষ্টিগুলো প্রায় অদৃশ্যবায়স্কোপ থুক্কু টেলিস্কোপ থুক্কু মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয় । আসলে আজকাল সব বিষয়েই এত “ স্কোপ” যে বাকী স্কোপেরা গুলিয়ে যায়সেগুলোও মিনিমাম পাঁচ টাকা করে দাম । ১০ টা নিয়ে, রক্তকরবীর পালোয়ানের মত  ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ীর দিকে রওনা দিল অতনু
আলাদা করে সব থলিতে ভরে নিয়ে আঁশের থলিটা ঝুলিয়ে দিল রবির রিক্সার হ্যাণ্ডেলে । সব্জীর ব্যাগ, দই- মিষ্টি নিজের হাতে নিয়ে রওনা দিল বাড়ী ফিরে গর্বের সাথে থলিদুটো ধরিয়ে দিল কবিতার হাতে ।

 কবিতা, থলি খুঁটিয়ে সব দেখে বলল- অপদার্থ ! কোন খেয়ালে থাকে, কে জানে ! কাঁচালঙ্কাটাই নেই আর চিংড়ি মাছটাও তো ছাড়িয়ে আনো নি ! অতনুর অসম্পূর্ণ অসমাপ্ত অবসরের মতই বাজারের ব্যাগটা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।


....সমাপ্ত ...


#################আদরের নৌকা ওয়েবজিনে প্রকাশিত


No comments: