Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Friday, May 24, 2013

বাজার

আদরের নৌকা তে প্রকাশিত

রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ খেলেও,ভোরবেলা আজকাল চটপট ঘুম থেকে উঠে পড়ে, অতনু । কোনরকমে হাত মুখ ধুয়েই পাড়ার মোড়ের দিকে হাঁটা লাগায় । আগে বাজার যেতে, যত রাজ্যের আলসেমি আসত অতনুরনতুন বানানো ফ্লাইওভারের নীচে ফাঁকা পরিস্কার টাইলস বাঁধানো জায়গাগুলোতে বাজার বসাতে সেই বাজার যাওয়ার আলেসেমীটা উধাও । ফুটপাথের পাশে যখন বাজার বসত, তখন একটা ঘিঞ্জি নোংরা ভাব ছিল । বাস, রিক্সা, ঠেলাগাড়ী, প্রাইভেট কারের গুঁতোগুঁতিতে প্রাণ নাজেহাল হয়ে যাবার উপক্রমভালো করে যে জিনিস বাছাই করবে তার উপায় ছিল না ! এখন সেই অসুবিধেটা আর নেই ।
পাড়ার মোড়, একটু খানি রাস্তা ! হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয়, দুপাশের ফুলের গাছগুলো  নীরবে সুপ্রভাত বলছে । একটা নাম না জানা ফুলের গাছের দিকে তাকাতেই ছোট্ট একটা ফুল হাতের কাছে এসে পড়ল । প্রথম শীতের শিশু রোদ, মুচকি হাসছে । বড় ফ্ল্যাট বাড়ীর গায়ে ধাক্কা লাগছে রোদের !  অতনুর কেন যেন মনে হয়, রোদের ব্যাথা লাগছে ।
রাস্তার দুপাশে নানা রকম পাতাবাহার আর ফুলের গাছ । কেউ ফুল দ্যায়, কেউ বা পাতা বারো ফ্ল্যাট আর তেরো বাড়ীর ফাঁক দিয়ে, বালার্কর নরম প্রভা টুকি দ্যায়
গাছের ফুল আর নতুন পাতাগুলোও খুব আনন্দে মাতে ।  সকালে, বেরিয়ে টুক টুক করে হাঁটে অতনুনীল আকাশের পেঁজা মেঘেরা  টুকি-টুকি খেলে । মাঝে, মাঝে যন্ত্র-পাখী গর্জন করে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে- দেশ বিদেশ পানে । আওয়াজে ওপরের দিকে মাথা তুললে, চোখ চলে যায় ওই পাখীর দিকে । ঝক ঝকে গা দিয়ে ঠিকরে পড়ে- কাচ্চি ঘানি সোনা গোমেদ আর পান্নার রং চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়, হীরেয় মোড়া যন্ত্র পাখী ।
বাড়ীতে তিনশো টাকা কেজি, দামের চা থাকা সত্বেও মোড়ের মাথায় হরির দোকানে গিয়ে আজকাল দিনের প্রথম চায়ে আচমন করে অতনু । মধুর দোকানে পলি প্যাকের দুধ, পাঁউরুটি নেয়, সাথে সিগারেটের একটা নতুন প্যাকেট । গোবিন্দর কাছ থেকে এক প্যাকেট ফুলও নেয় । ফুরফরে সকালটা অবসরের পর এই ভাবেই কাটায়
পাশের রিক্সাষ্টাণ্ডে তখন মাত্র জনা দুয়েক রিক্সাওয়ালা থাকে । রবি, তাদের মধ্যে একজন । সিগারেট ছাড়া, বাকী সব পাঠিয়ে দেয় রবিকে দিয়ে  । রবি বাড়ীতে ওগুলো দিয়ে ,ফিরে এলে ওর রিক্সায় বেরিয়ে পড়ে, বাজারের অভিসারে । রিক্সা করে যেতে যেতে দেখে, ঘুম ভেঙে শহরতলীর এই জায়গাটা আস্তে আস্তে আড়মোড়া দিচ্ছে । এই অল্প ঠাণ্ডায় আবহওয়াটা বেশ ন্যাচারাল এসি বলে মনে হয় ।
থলিটা রবির হাতে দিয়ে, বাজারে ঢোকে অতনু ! সার সার মৃতদেহ । লোকে টিপেটুপে দেখছে, সেই মৃতদেহগুলো একটু পরেই এদের শ্রাদ্ধ হবার কথা ! একটা মৃতদেহতে হাত দিল অতনু । ঠাণ্ডা গায়ে হাত দিতেই সারা গায়ে একটা শিনশিনে ভাব । অনেকদিন এই সব দেহে হাত দেয় নি । দামটা জিজ্ঞেস করতেই দোকানদারের সেলিম –জাভেদের সংলাপ ।
-       ইলিশটা দেখতে হবে না দাদা ! শীতের মাল হলেও দারুণ “টেস” পাবেন ।
-       দাম ?
-       বেশী নয়, মাত্র বারোশো টাকা কেজি !
শুনেই অতনুর হাতের মৃতদেহটা যেন ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকে গেল । মিউ মিউ করে বলল:-
-       লস করে দিচ্ছো না তো হে ! আরও একশো টাকা বেশী নাও !
-       না না, দাদা ! অধর্ম করি না  ! কেনা দামেই বেচি আমি- আপনার কাছে !
-       কষ্ট করে, পাতিপুকুরে গিয়ে মাছ কিনে, সেটা কেনা দামেই বিক্রি করবি আমায় ! এটা কোনো কথা হলো?
হতভম্ব মাছওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তি পায় অতনু । পরে অন্য কোনো মাছ কিনবে ভেবে সব্জীর দিকে এগোয় ।
মানকচুটাকে দেখে বেশ হিরো হিরো লাগছে । নিচের দিকটা নীলাভ আভা । ওপরে একটা মাটির রঙ । পুরো শাম্মী কাপুর। পাশে, নারকোলও আছে ।
দাম জিজ্ঞেস করাতে, দোকানদার বলল:- জোড়া চল্লিশ টাকা !
অতনু বলল :- একটু কম হবে না ?
-       হবে বাবু, তবে আমার এখানে নয় ।
-       কোথায় ?
-       একটু এগিয়ে যান, জোড়া ৩৫ টাকা । আর একটু এগুলে জোড়া ৩০ টাকাকরে করে, এগিয়ে গেলে দেখবেন, বিনে পয়সায় প্রচুর নারকোল পাবেন !
দোকানদারের মজাটা বুঝে, মানকচুর লোভেই একটা নারকোল কিনে নিলো । সান্তনা একটাই, রসিকতাটা ফাউ । কবিতাকে বলে, নারকোল দিয়ে মানবাটা খাবে আজ ।
অতনু তেমন গদ্য বা সাহিত্য  বোঝে না ! পাঠ্যপুস্তকে যেটুকু ছিল, সেটা পড়তে হয়েছিল পরীক্ষা পাশের দায়ে । রবীন্দ্রনাথের কবিতাও পড়েছেবি সরকারের নোটস পড়ে বুঝতে হয়েছে কবিতা গুলো ।
প্রেম কি সেটা আর বোঝা হয় নি ! বিয়ের আগে, মেয়েদের দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না । লজ্জা লজ্জা করত। বিয়ের পর, কবিতার সাথে সিনেমা বা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসেছে বটে, তবে ওর বকর বকর ছিল শুধু সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে । সেটা আর যাই হোক, সিনেমায় দেখা উত্তম- সুচিত্রার প্রেমের মত ছিল না ।
 
ইদানীং প্রেম যে কি বুঝতে পারছে, বাজারে গেলে । তন্বী যুবতীরা শিশিরে স্নান করে সুন্দর ভাবে সেজে বসে থাকে ! সাদা টপ, সবুজ জিন্সের প্যান্ট পরে থাকে বসে থাকে যে সুন্দরী, এই প্রথম শীতের আমেজে তার প্রেমে অতনু বিভোর ! তুলে নিয়ে চুমো খায় তার বুকের মধ্যে খানে । সুন্দর এক মাটির গন্ধ ভিজে ওঠে  মন । ফুলকপি গুলো অনাঘ্রাতা যুবতীর বুকের মত উঁচু আর মাংসল ।
সবুজ জিন্স পরে যে পাশেই বসে থাকে, সেই সুন্দরী আরও মনোহর । এক্কেবারে বুনো বিড়ালের মত । ক্যাপসিক্যামটা ফুলকপির সাথে জমে ভাল । কমলা রঙের শাড়ী পরে গুটি শুঁটি মেরে পড়ে আছে টম্যাটোর সারি ।  বিরহে কাতর হয়ে পড়ে আছে পেঁয়াজ কলি আর রসুন পাতা । সবুজ বাঁধাকপির গুরুভার নিতম্ব আর হলুদ গাজরের পৌরুষ  নিঃশব্দ ভাবে সোচ্চার ।
এত সুন্দরী আর পৌরুষ এক জায়গায় পেয়ে মন ভরে যায় । থলি ভর্তি করে সেই সুন্দরী আর পৌরুষ দিয়েনিজের হাতেই ওদের সব বসন খুলে ফেলতে ইচ্ছে করে  অতনুর হবার নয়, জানে সেটা ! কবিতা, বঁটি নিয়ে নির্মম ভাবে কাটবে ওদের । টুকরো টুকরো করে অতনুর পরকীয়া প্রেমকে খতম করবে ।
এক জায়গায় কুচো চিংড়ি দেখল অতনু । দামটাও আয়ত্বের মধ্যে । চিংড়িকে সম্রাট মনে হয় তার । এই সম্রাটের হাজারটা বেগম । তবু, ইলিশকে ভোলে না সে । ইলিশ হলো ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী । ধীরে ধীরে সব জয় করে নিয়েছে । ওদের রাজত্ব শেষ হলেও, সেই রাজত্বের কথা সবাই বলে এখন । ইলিশেরও তাই !
কি যে খরচের বহর  ! অবসরের জীবনে, এত টাকা কোত্থেকে আসবে, ভাবতে ভাবতেই অতনুর শিরোদেশ ইন্দ্রলুপ্তভাগ্যিস, ছেলে – আই. সি. ইউয়ের সাপোর্ট সিস্টেমের কাজ করে । না হলে, ভেন্টিলেশনে গেলে আর উইন করা সম্ভব হতো না !
তিল- যব- হরিতকী কিনতে হবে,  বাড়ীর গৃহদেবতার পূজার জন্য  । ছেলে, গত রাতেই হাতে একটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল – বাসমতী চাল, সোনামুগের ডাল এনো সাথে ভালো ঘি ।   কবিতা বলেছিল- গোরোক্ষবাসী রোডে, “বাপী সুইটসের” মিষ্টি আর “ অভিনন্দনের” দই মাস্ট !
মাথার হার্ড ডিস্কে  ( ২ জিবি ) একটা ফাইল তৈরি ! ডিফ্র্যাগমেন্ট করে সাজিয়ে নিল তালিকা গুলো ধীরে ধীরে আপলোড করে দেখল,  ফ্যাট ( মাথাতেও ফ্যাট ) সিস্টেমে ডিস্ক ফুল । পুরোনো বলে অতনুর হার্ড ডিস্কে আবার নিউ টাইপ ফাইল সিস্টেম কাজ করে না । এক্কেবারে ফুলিস ব্যাপার যাই হোক, বাজার হয়ে যাবার পর অভিনন্দনে এলো অতনু দই কিনতে । কবিতার হুকুম ছিল :- খুচরো দই আনবে হাঁড়ি থেকে কেটে
-      ভাই মিষ্টি দই কত করে ? অতনুর ব্যাকুল জিজ্ঞাসা ।
-      একশ কুড়ি টাকা কিলো ।
-      এ:, কিলিয়ে দিলেন ভাই ! একশ বিশ করে হবে না ? একটু সস্তা হতো তালে !
-      নামী দোকানে একদাম ! নেবার হলে নিন, না হলে আসুন !
-      ঠিক আছে ভাই ! আড়াইশো দিন ! আর মাথাটা দেবেন !
-      দইয়ের মাথা তো ?
-      আপনার অমন অমূল্য মাথা নিয়ে, শেষে খুনের দায়ে ধরা পড়বো নাকি ? হ্যাঁ! দইয়ের মাথা ।
কেনা হলো দই । এবার মিষ্টি ! সুন্দর করে ট্রেতে সাজিয়ে রাখা ! শুধু মিষ্টিগুলো প্রায় অদৃশ্যবায়স্কোপ থুক্কু টেলিস্কোপ থুক্কু মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয় । আসলে আজকাল সব বিষয়েই এত “ স্কোপ” যে বাকী স্কোপেরা গুলিয়ে যায়সেগুলোও মিনিমাম পাঁচ টাকা করে দাম । ১০ টা নিয়ে, রক্তকরবীর পালোয়ানের মত  ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ীর দিকে রওনা দিল অতনু
আলাদা করে সব থলিতে ভরে নিয়ে আঁশের থলিটা ঝুলিয়ে দিল রবির রিক্সার হ্যাণ্ডেলে । সব্জীর ব্যাগ, দই- মিষ্টি নিজের হাতে নিয়ে রওনা দিল বাড়ী ফিরে গর্বের সাথে থলিদুটো ধরিয়ে দিল কবিতার হাতে ।

 কবিতা, থলি খুঁটিয়ে সব দেখে বলল- অপদার্থ ! কোন খেয়ালে থাকে, কে জানে ! কাঁচালঙ্কাটাই নেই আর চিংড়ি মাছটাও তো ছাড়িয়ে আনো নি ! অতনুর অসম্পূর্ণ অসমাপ্ত অবসরের মতই বাজারের ব্যাগটা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।


....সমাপ্ত ...


#################আদরের নৌকা ওয়েবজিনে প্রকাশিত


ট্যুশানি


আদরের নৌকা- ব্লগজিনে প্রকাশিত

বাবার ডেস্কটপে ফেসবুক লগ ইন করে সবে নোটিফিকেশন গুলো দেখছে তুহিনা, এই সময় ডোরবেল বেজে উঠল । সন্ধের সময়টা মা, চ্যানেল থেকে চ্যানেলান্তরে বাংলা সিরিয়াল আর রিয়েলিটি শো গুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে । ডিভানে তখন ফেভিকুইকের বন্যা সাথ দ্যায় কাজল মাসী । সংলাপ শুনে, এরপর কি হতে পারে সেটা মা আর কাজলমাসী , দুজনে মিলে জোর আলোচনা চালায় ।
 বাবা, বাড় এসে সকালের বাসী কাগজগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নিজের মতামত টুকে রাখে একটা ডায়েরীতে  । পরের দিন অফিসে গিয়ে সারগর্ভ ভাষণ দেওয়ার  নোটস ওগুলো ।
কাজল মাসী গিয়ে দরজাটা খুলতেই , ঝড়ের বেগে অমৃতা ঢুকে সোজা তুহিনার সামনে । হাঁফাতে হাঁফাতে অমৃতা কোন রকমে বলল – এক গ্লাস জল ।
টুং করে একটা পিঙ্গের শব্দ ।
-      কেমন আছেন ?
তুহিনা আড়চোখে দেখল, একটা অচেনা লোকের মেসেজ । আজকাল, ফেসবুকে আরও একটা নতুন আপদ হয়েছে । নোটিফিকেশন এলেও টুং করে আওয়াজ হয় । চ্যাটটা বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে বলে রোজ ঠিক করে, আর ভুলে যায় ! চ্যাট অফ করে রাখলেও এই আপদ গুলো জ্বালিয়ে মারে ।
অমৃতা একটু ধাতস্থ হয়েছে । তুহিনা বলল- কি হয়েছে রে ? এরকম হাঁফাচ্ছিস কেন !!
-      প্রেম করার সময়  গৌতম কিন্তু এইসব আগে ভাগে বলে দেয় নি ।
-      কি রে ?
-      আমাকে রোজ সন্ধের সময় শাঁখে ফুঁ  দিতে হবে
-      কে বলেছে, শাঁখে ফুঁ  দিতে ?
-      আমার শাশুড়ি
-      সেকি রে !
-      হুম ! সেটাই তো ! আজ সন্ধের সময় ঠাকুরাইন বললেন- বৌমা, ঠাকুরঘরে সন্ধে দাও । প্রদীপটা জ্বালিয়ে চলে এসেছি । সেই সময় উনি বললেন – শাঁখ বাজালে না ?
-      তুই কি বললি ?
-      বললাম, আমি পারি না মা ! ব্যাস্, উনি ভিসুভিয়াস হয়ে আমাকে বাংলা সংস্কৃতি আর কৃষ্টি সম্বন্ধে একটা দশ মিনিটের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিলেন ।
-      তুই কি বললি ?
-      কি আর বলব ? মাথা হেলিয়ে চুপচাপ শুনলাম । তারপর টুকটাক শপিং আছে বলে কেটে, তোর বাড়ীতে বডি গ্যারেজ ।
-  তুই যে আজ শাড়ী পরেছিস ?
-      কি করবো ? শ্বশুরবাড়ীতে ড্রেস কোড মানতে হয় । জিনস্ বা সালোয়ার কামিজ পরা চলবে না, এটা প্রকাশ্য বিধান । জানিস তো, বাড়ীতে নাইটি পরাও চলবে না ! গৌতম এটাও আগে বলেনি । কাঁদো কাঁদো মুখে বলল অমৃতা । ইতিমধ্যে কাজল মাসী চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে সব শুনছিল । ফুট কাটল :-
-      তা বাপু ! মেয়েরা যখন বৌ হয়, তখন এসব করলে ক্ষতি কি ?
-      তুমি থামো তো মাসী ! এবার কাজে যাও । তুহিনা ধমক দিলো ।
ইংরেজীতে এম. এ পাশ করার পর, এখন বাবার  হোটেলে বসে খাওয়া শুধু ।  বি. এড করার ইচ্ছে মনে মনে আছে, তবে গেঁতোমী করে আর আ্যপ্লাই করাই  হচ্ছে না তুহিনার মাঝে পাড়ার একটা প্রাইভেট মন্টেশরী স্কুলে চাকরী করেছিল । ভোরবেলায় উঠতে হয় । বেলা সাড়ে বারোটায় ছুটি । মাস গেলে মাত্র দু হাজার টাকা ।   ধ্যাৎত্তারি, বলে ছেড়ে দিয়ে এখন বাড়ীতে বসে ল্যাদ খায় ।
বাবার সুপ্ত ইচ্ছে  বিয়েটা হয়ে যাক , তবে তুহিনার এখনই বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই । এখনও বছর দুই অপেক্ষা করতে চায়  । সাবলম্বী হয়েই তবে বিয়ের কথা ভাববে । মা গজগজ করে বলে-  এম. এ পাশ করে মেয়ে আঁতেল হয়ে গেছে । ওর আর বিয়ে হবে না !
কয়েকজন বান্ধবীদের বিয়ে হয়েছে ।  এরই মধ্যে একজনের ডিভোর্সও শেষবাকীরা মোটামুটি আছে । সবারই একই সমস্যা । কারও শ্বশুর ভালো তো কারও শাশুড়ি সুবিধের নয় ।  রান্না করতে পারে না বলে কারও শ্বশুরের মৃদু অভিযোগ  । এইসব দেখে তুহিনা আপাতত বিয়ে করার কথা শিকেয় তুলে রেখেছে ।
অমৃতা বলল- মাইরি ! বিয়ে করে জীবনটা খণ্ড ত হয়ে গেল । ভাগ্গিস, প্রাইমারি টিচারের চাকরিটা ছাড়িনি ! নইলে নরকে যেতে হত ।  তুইও একটা চাকরি বাকরি খুঁজে নে । আপাতত ট্যুশানি কর । ইংরেজীর হেব্বী ডিমাণ্ড ।
তুই খুঁজে দে না ! তুহিনার জবাব !
-      সিরিয়াসলি করবি তো ?
-      আরে হ্যাঁ ! ফেসবুকে ছেলেদের বোকা বোকা প্রেম নিবেদনে হাঁফিয়ে উঠেছি ।
-      তালে, তোকে একটা ফোন নং দিচ্ছি । মাল্লু আছে ওদের ! একটা মেয়েকে ইংরেজী পড়াতে হবে । এবারে ক্লাস টুতে উঠল । নাম্বার দিচ্ছি,তুই ফোন করে ওটা ঠিক করে নে ।
-      আমি ? আমার ফোন করাটা উচিত হবে না বোধহয় !
-      আচ্ছা, দাঁড়া, আমি ফোন করছি ওদের তারপর তুই কথা বলে নে
সেল ফোনে নাম্বার ডায়াল করল অমৃতা । ও প্রান্তে ফোন তুলতেই  লাউডস্পীকার অন করে কথা চালু করল।
-      হ্যালো, মিসেস প্যাটেল বলছেন ?
-      আরে, অমৃতা বলো ! কেমন আছ ? তোমার বিয়ের রিসেপশানের পর আর তো দেখাই হল না আমাদের । আমার মেয়ের ইংরেজী মাষ্টারনী পেলে ?
-      ওইজন্যই তো ফোন করলাম । আর শুনুন আমার বন্ধু তুহিনা । গতবছর প্রেসিডেন্সী থেকে ইংরেজীতে এম এ পাশ করেছে । ওকে অনেক বলে কয়ে রাজী করালাম  আপনাদের বাড়ীর ট্যুশানিটা করতে
-      তা, ওনাকে আমার বাড়ী কাল পাঠাও না । কথা বলি ।
-      ঠিক আছে, ওর সাথে কথা বলুন ।
তুহিনাকে ফোনটা ধরিয়ে দিল অমৃতা ।
-      গুড ইভিনিং মিসেস প্যাটেল ! আমি তুহিনা !
-      ওয়াও !!! সারু ছে !
-      কি বললেন, সেরেছে ?
-      আরে না ! সারু ছে, মানে খুব ভালো, নামটা খুব ভালো, সেটাই বললাম । আনন্দ হলে, মাতৃভাষা গুজরাতি বেরিয়ে পড়ে আর কি ।
-      ও আচ্ছা !
-      বলছি কি, কাল সকাল ১২ টা নাগাদ আমার বাড়ী আসতে পারবেন ?
-      তা পারবো !
-      সারু ছে  ! মজামা !
-      কি বললেন মোজা পরে যেতে হবে ?
-      ওহো ! সরি সরি ! মজামা মানে আনন্দ !
-      ও ! তাই বলুন ।
-      বলছিলাম, সেই সময় বিজয় ভাই থাকবে, বেশী লেট করলে, উনি আবার বেরিয়ে যাবেন ।
-      আপনার ভাই, বিজয় এসব দেখেন ?
-      ভাই মানে আমার হ্যাজবেণ্ড ! ছেলেদের ভাই বলে । আর আমার হাবির নাম বিজয় !
-      ও ! ঠিক আছে । তাই যাবো । বাই !
বলে, তুহিনা সেল ফোন অফ করে অমৃতার হাতে ফেরত দিল ।
-      বাপরে, কি জিনিস গুরু ! এর বাড়ীতে পড়াতে হবে ?
-      তোর কি রে ? পড়াবি, মাইনে নিবি, চলে আসবি ব্যস ! কিন্তু, প্রেসিডেন্সীর মেয়ে হয়ে তুই গুজু ভাষাটা বুঝলি না ?
-      ওসব আমি বুঝি না ! প্রেসিডেন্সীতে পড়লে এক্সট্রা হাত – পা গজায় নাকি ?
অমৃতার সেলে এবার কলার টিউন বাজল । এক পলক দেখে নিয়ে বলল- গৌতম ফোন করেছে । দাঁড়া, কথা বলি ।
-      বল !
-      ...
-      আরে আমি, বাড়ী ছেড়ে চলে আসবো কেন ?
-      ...
-      আমি শাঁখ বাজাতে পারি না বলে, দু চারটে মেঠো বক্তৃতা শুনতে হল । তাই শপিংয়ের নাম করে তুহিনার বাড়ীতে এসেছি । এমনিতে, আসতেই হত । মিসেস প্যাটেল জ্বালিয়ে খাচ্ছেন একজন ইংলিশ টিউটরের জন্য ।
-      ...
-      সত্যি বলছ ? পিটার ক্যাটে ডিনার করবে ? মা কিছু বলবে না ?
-      ...
-      যাক বাবা ! ম্যানেজ করেছ তা হলে । আমি কিন্তু, জিন উইথ ফ্রেশ লাইম খাবো, বলে দিচ্ছি ।
-      ...
-      ঠিক আছে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসছি । তুমি, মিউজিক ওয়ার্ল্ডের সামনে দাঁড়াও ।
তুহিনাকে বলল- সরি রে ! আজ চলি । গৌতম ডিনার করাবে বাইরে আর থাকতে পারছি না তোর এখানেতুই কিন্তু কাল ঠিক চলে যাস, মিসেস প্যাটেলের বাড়ীতে ।
তুহিনা অবাক হয়ে দেখল, কত সহজে পোষ মানলো অমৃতা । কি জানি, তার বেলাতেও এই ব্যাপার হবে কিনা ! হুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফেসবুকে মন দিল তুহিনা ।
সেই অচেনা লোকটা একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছে ।
আপনি খুব সুন্দর দেখতে ।  বন্ধু হবেন ?
হাড় পিত্তি জ্বলে গেল তুহিনার । এইসব লোকেরা ভাবে কি নিজেদের ? ফেসবুকে এইসব নোংরামো !!
ও লিখলো :- প্রোফাইল পিকচারটা আমার নয় । অমিতাভ বচ্চনের বৌমার !
টুং শব্দে জবাব এলো:- আহা রাগ করছেন কেন ? আপনার আ্যবাউটটা দেখে খুব ভালো লাগলো ।
-      বেশ , তা হলে কি করতে হবে ?
-      না, তেমন কিছু নয় । একটা গ্রুপে আপনার লেখা কবিতা পড়ে খুব ভালো লাগলো । আপনি বেশ ভালো কবিতা লেখেন ।
-      বেশ !
-      জানেন ? আমি অবাঙালি ! কিন্তু কোলকাতায় জন্ম এবং কর্মআহমেদাবাদ আমাদের রুট । কবিতা আমার দারুণ লাগে ।
এবারে একটু  অবাক হলো তুহিনা । এই ক্যালেণ্ডারকে কাল্টিভেট করতে ইচ্ছে করছে । হাইলি সাসপিসিয়াস ! গতকালই আবার নতুন করে বোম্বাইয়ের বোম্বেটে দেখছিল টিভিতে, তাই কয়েনজটা মনে এলো
টাইপ করল –
-      বাঃ ! আপনি তো দারুণ লোক ! তা, কবিতা লেখেন ?
-       থ্যাংক ইউ ! লিখি, তবে সেটা পাতে দেবার মত নয় ! আর আপনার কাছে তো কিছুই নয় !
তুহিনা বুঝল, লোকটা ওকে ফুয়েলিং করার চেষ্টা করছে । আরও একটু দেখে না হয় ওকে ব্লক করে দেবে ।
-      আপনি তো বাংলিশে লিখছেন ।  বাংলা পড়তে- লিখতে পারেন ?
-      কি যে বলেন ! কম্পিউটারে বাংলা টাইপ ঠিক আসে না ! তবে, বাংলা পড়া আর লেখা জলের মত পারি ।
-  কি করেন আপনি?
-  ব্যবসা ! ইলেকট্রনিক গুডসের । চাঁদনীতে দোকান আছে আমার ।
-      কোথায় থাকেন ?
-      যাদবপুর । আপনি কোথায় থাকেন ?
-      জেনে লাভ কি ?
-      না, মানে এমনি অলস কৌতুহল ।
-      বাঘাযতীনে ।
-      বাঃ ! তাহলে তো কাছেই একেবারে ।
-      কোনো লাভ নেই !
-      আপনি খুব রাগী ? তাই না !
-      মোটেই নয়, তবে অচেনা লোকের সাথে ফালতু হ্যাজানো ভালো লাগে না আমার ।
-      তা, ম্যাডাম আপনার সাথে একটু কাজের কথা বলতে পারি ?
-      আবার কি !
-      আ্যবাউটসে দেখলাম আপনি  ইংরেজীতে এম. এ । একটা টিউশনি করবেন ? ক্লাস টুয়ের বাচ্চা  । আমার বোনের মেয়ে ।
-      কোথায় ?
-      যাদবপুরেই । রামঠাকুরের আশ্রমের কাছে ।
-      কাল সকালে, আর একটা টিউশনের ব্যাপারে যাবো ওদিকে । যদি সময় পাই তাহলে যেতে পারি , আপনার বোনের বাড়ীতে
-      তাহলে, আমার ফোন নং দিলাম । এলে আমাকে একটা কল করবেন । আমার নাম উমিচাঁদ প্যাটেল ।
-      ভেবে দেখবো ! উঠি এখন ।
ফেসবুক থেকে লগ অফ করে এবারে আদরের নৌকার এফ . এম শুনতে লাগল তুহিনা । এটা অনিয়মিত চালায় ওরা-   ভালো ভালো গান আর কবিতা আবৃত্তি করে  শোনায় অভিক । শুনছে, এটা নাকি ওরা বন্ধ করে দেবে । অভিক ওর ফ্রেণ্ড লিষ্টে আছে ।  ওকে মেসেজ করেছিল এই ব্যাপারে, অভিক অনেক সমস্যার কথা শোনাল । নিয়মিত এফ এম শোনানো কেন যাবে না , তার একটা লম্বা ফিরিস্তি । তা যাক, ওদের ব্যাপার, ওরা বুঝুক আপাতত গান শুনে ডিনার । তারপর শুয়ে পড়বে ।
কবিতা লেখার কথা মনে পড়তেই ফিক করে মনে মনে হাসল তুহিনা । সবাই আজকাল কবিতা লেখে । গদ্য লেখার হ্যাপা অনেক । তাছাড়া মনসামঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলী, চণ্ডীমঙ্গল বেশির ভাগ কবি পড়েই নি । অল্প কয়েকটা ইংরেজী বই আর সিনেমা দেখে কিছু কঠিন শব্দ দিয়ে কয়েকটা কবিতা নামিয়ে , একটা সংকলন বের করে ফেলে তার আ্যড দ্যায় ফেসবুকে । এত কবিতার বই যে কে পড়ে, কে জানে ! এদিকে ফেসবুকে কবিতা কেউ পড়ে কিনা বোঝা যায় না । কিছু পাঠক বাদে সকলেই মন্তব্যে লেখে- দারুণ, দুর্দান্ত, বা ফাটাফাটি । বোঝা যায় এরা পড়েই নি । উমিচাঁদও মনে হয় ওই ক্যাটাগরির । মেয়েদের ইম্প্রেস করার চেষ্টা ।
মিসেস প্যাটেলের ওখান থেকে  একবার ফোন করে দেখবে উমিচাঁদকে ।  সুবিধের না , মনে হলে ওর নাম্বারটা ফোনেই ব্লক করে দেবে । জন্মদিনে বাবা এই লেটেষ্ট মডেলের ফোনটা গিফ্ট করেছিল । দেখাই যাক, দুটো টিউশনি পেলে হাতখরচটা চলে যাবে । নেট রিচার্জের জন্য বাবার কাছে হাত পাততে হবে না ।
পরের দিন ফোন করে, মিসেস প্যাটেলের বাড়ীতে হাজির হলো তুহিনা ।   পুতুলের মত বাচ্চা মেয়েটা দারুণ মিষ্টি ।
প্রথমেই এক গ্লাস জল এনে টেবিলে রাখলেন মিসেস প্যাটেলতার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হলেও হতে পারেন । এই সকালেও চড়া মেক আপ । তবে, বয়স কম এটা বোঝাই যাচ্ছে । সালোয়ার কামিজে বেশ সুন্দরী ।
জলটা দিয়ে বললেন- এটা আমাদের গুজরাতিদের কালচার । আপনারা যেমন চা দেন, সেরকম আমরা আগে জল দেই অথিতিকে । তারপর চা । আমার পুরো নামটা বলা হয় নি আপনাকে । আমার নাম হলো, প্রমীলা বিজয় প্যাটেল ।
-      বিজয় নামটা মধ্যে কেন ?
-      এটা আমাদের আর একটা নিয়ম । নামের পরে স্বামী বা বাবার নাম মধ্যে রাখতে হয় । তবে, ওটা অফিসিয়াল । এমনিতে আমি প্রমীলা প্যাটেল । আপনাকে তো গতকাল বলেছি, আমার হাবির নাম বিজয় ভাই । মানে, বিজয় ।
ইচ্ছে করেই মাসে দেড় হাজার টাকা বলল তুহিনা । সপ্তাহে তিনদিন পড়াবে, বিকেলে ।  অবাক হয়ে দেখল প্রমীলা দরাদরি করল না ।
এর মধ্যে বিজয় বাবু এসে হাজির হলেন, লিভিং রুমে ।  হ্যাণ্ডসাম চেহারা । বর- বৌয়ের জুটিটাও  সুন্দর ।  আলাপ হয়ে ভালই লাগলো । ঠিক হলো, সামনের মাসের পয়লা তারিখ থেকে পড়াতে আসবে তুহিনা ।
একটা কথা মনে হতেই সেল ফোনটা বের করে গতকালের সেভ করে রাখা উমিচাঁদের নাম্বারে ডায়াল করল তুহিনা । তার আগে অবশ্য এক্সকিউস মি বলে নিয়েছে ওদের ।
এর মধ্যে বিজয়ের সেল ফোনে একটা কলার টিউন । বিজয় স্লাইডিং ফোনটা তুলে বলল – হ্যালো !
তুহিনার সেলেও হ্যালো । মনে হল আওয়াজটা কাছ থেকে আসছে ।
-      আমি তুহিনা বলছি । আপনি কি উমিচাঁদ ?
-      আরে হোয়াট এ প্লেজার । বলুন ম্যাম ।
তুহিনা অবাক হয়ে দেখল, বিজয়ই কথা বলছে ওর সাথে । বিজয় অত খেয়াল করে নি  ।  ফোনটা কেটে দিয়ে প্রমীলাকে জিজ্ঞেস করল- আপনার হাবির পুরো নামটা কি যেন ?
-      বিজয় উমিচাঁদ প্যাটেল । কেন বলুন তো ?
-       এবারে বুঝলাম । চাঁদনীতে ওনার দোকান আছে, ইলেকট্রনিক গুডসের ?
-      হ্যাঁ ! কিন্তু আপনি জানলেন কি করে ?
-      সে অনেক কথা ।  প্রমীলা ম্যাম, আপনার মেয়েকে আমার আর পড়ানো হলো না ।
-      কেন ?
-      সেটা আপনার হাবিকে জিজ্ঞেস করবেন । চলি ।
হতভম্ভ প্রমীলা আর বিজয়ের মুখের দিকে একটা মুচকি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো তুহিনা ।







দোতালা বাস এবং...................... (ডায়েরী)




মামাবাড়ি ছিল বাঘাযতীনে। তখন হাওড়া যাবার জন্য এই পথে মূলত 5 GARIA  চলত। আর যাদবপুর থেকে পাওয়া যেত 8B
দুটো রুটেই ছিল দোতালা বাস। মাঝে মাঝে, বেশ কয়েকটা এক চোখ কানা বাস পাওয়া যেত। ওগুলো, দোতালা বাসেরই একতলা সংস্করণ!
যখনকার কথা বলছি, তখন সবে ঢাকুরিয়ার ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হয়েছে। পথে পড়ত, লেভেল ক্রসিং! এখনও মনে আছে,  হাওড়া থেকে আসবার সময় ক্রসিংটা পেরিয়েই রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে আবার সোজা ছিল। আসবার সময় ডানদিকে ।
দোতালা বাসে চেপে এলে এই বাঁক নেবার সময়, বাসটা কেতরে চলত।
উড়ি ত্তারা! কি ভয় লাগত। অথচ, বাসের ফুট বোর্ডে ঝুলে থাকা লোকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকতো না।
তখন, কত আর বয়স হবে? এই ১৬ বা ১৭কিন্তু, মেয়েদের ব্যাপারে কৌতূহল তুঙ্গে। জয় ফার্মেসির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সম্মিলিত উদ্বাস্তু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের হাঁ করে দেখতাম, আমার স্কুলে যাওয়ার পথে।
উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়- তবে কোনো মেয়েই মাথায় লম্বা ছিল না! সবই আ্যভারেজ ! মাঝেই মাঝেই দোতালা বাস গুলো এসে মেয়েদের ঢেকে দিত! অজান্তেই দাঁত কিড়মিড় করতাম!
সরস্বতী পুজোর কয়েকদিন আগে, একটা মেয়ে হঠাৎ করে একটা ছোট্ট চিরকুট ছুঁড়ে দিল আমার দিকে! প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, তারপর তুললাম চিরকুটটা! সাত রাজার এক ধন আমার কাছে। প্রথমে, একটা চুমু খেলাম চিরকুটটাতে! তারপর, আস্তে আস্তে খুললাম।
লেখা আছে:- এই লম্বু বাঁদর! রোজ রোজ আমার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে কি দেখিস রে? জবাব দিবি কিন্তু!!!!!
উত্তেজনায়, সেদিন বিকেলে লণ্ঠনের চিমনী পরিষ্কার করা, ফিতে সাইজ করে কাটা, কেরোসিন তেল ভরা, ( তখন ইলেকটিরি স্বপ্ন) সসসব ভুলে গেলাম। দাদু আর ছোটমামার কি বেদম বকা! কিচ্ছুটি গায়ে লাগল নি কো! রাতে হাঁসের ডিমের ডালনা ছিল, ভাত কম খাওয়াতে দিদিমা  আমার কপালে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল জ্বর এসেছে কিনা আমার!!!!
পরের দিন খুব ভোরে উঠে লিখে ফেললাম চার শব্দের জবাব:- তোকে খুব ভালো লাগে!
স্কুলে যাবার সময় মেয়েটাকে দেখতে পেয়েই অন্য মনস্ক ভাবে আলতো করে ফেলে দিলাম ছোট কাগজটা!
খুলে তক্ষুনি পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল! দিল্ একদম তর্ র্ র্ র্! এই ভাবেই চলছিল চিরকুটের দেয়া - নেয়া । সঙ্গে, ঠোঁটের কোণে মুচকী হাসি । সাবান মাখার মাত্রাটা বেড়ে গেছিল আমার।
একদিন বিকেলে ফেরার পথে, আর একটা চিরকুট পেলাম! লেখা:-
পরশু সরস্বতী পুজোর পরে দোতালা বাসে চড়ে বেড়াতে যাবি? কোনোদিন চড়ি নি! সারাদিনের ছুটি সেদিন আমার! যদি হ্যাঁ হয়, তবে মাথা ডান দিকে হেলাবি আর এখান থেকে চড়া যাবে না, সোজা গড়িয়া বাস স্ট্যান্ডে চলে যাবি দুপুর বারটার সময়! ভোগ খেয়ে বেড়াতে যাবো! আমার কাছে জমান ১০ টাকা আছে। তোর কাছে কিছু আছে? না থাকলেও ক্ষতি নেই! চলে আসবি কিন্তু!
সম্মোহিতের মত ডেস্পারেট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ঘাড়টা ডান দিকে হেলিয়ে দিলাম।
দিন যেন আর কাটতে চায় না! তবে, সরস্বতী পুজোর ভার টার পেয়ে নিজেকে খুব লায়েক মনে হচ্ছিল। খিচুড়ি, বাঁধাকপির তরকারি আর আলু বখরার চাটনি! এই ছিল ভোগ!
তবে অঞ্জলি দেবার সময় কুচ যুগ শোভিত মুক্তাহারেবলতে বলতে মূর্ত্তির বুকের দিকে তাকাতে পারতাম না ভয়ে। পাছে, পাপ হয়!!!! তবে, অবাধ্য চোখ ওইদিকেই বারবার করে যেত আর কেমন যেন সিটকে যেতাম।
সেদিন যেন আরও বেশি করে চোখ যাচ্ছিল। গড়িয়া যেতেও তো টাইম লাগবে। বিজয়গড় থেকে হেঁটে বাঘাযতীনের মোড় তারপর বাস ধরে সোজা গড়িয়া বাসষ্টাণ্ড!
ভাড়া  দিতাম না! কনডাক্টর টিকিট চাইতে এলেই, একটা ১০ পয়সা দিয়ে  গম্ভীর মুখে বলতাম :- একটা হাওড়া!
মুখ ভেংচে  কনডাক্টর বলত:- এটা গড়িয়া যাবে, হাওড়া নয়! যাও! নেমে যাও!
দোতালা বাসের ফুট বোর্ডটা ছিল বেশ চওড়া! বাঁদিকে, ঘুরেই একতলার বসার জায়গা। বাঁ দিকেই ছিল লেডিস সিট! ( ওই জন্যই বোধহয় মহিলাদের বামা বলা হয়)
আর সোজা উঠে গেছে দোতালা ওঠবার বাঁ দিকে ঘোরান সিঁড়ি!
আমি ফুট বোর্ডেই দাঁড়িয়ে থাকতাম। পদ্মশ্রী সিনেমার সামনে ছিল আশাপূর্ণা দেবীর দোতালা বাড়ী! ওখানেই সাধারণত নামতে হত মানে নেমে যেতে হত। তারপর হাঁটতাম।
কিন্তু সেদিন আর নো রিস্ক! বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী আর সাদা ধূতি (দাদু পরিয়ে দিতেন)পকেটে একটা কড়কড়ে বড় নতুন পাঁচ টাকার নোট  ( দিদিমার দেওয়া)সঙ্গে কিছু খুচরো পয়সা।
ভোর বেলা অত ঠাণ্ডার মধ্যেও,মাথায় সাবান দিয়ে চুলটা ফুরফুরে করে নিয়েছি। তখন অত শ্যাম্পুর চল ছিল না! পুকুরে নাইতে হত। বড় নতুন লাক্স সাবানটা ঘষে ঘষে আদ্ধেক করে দিলেও মনে হচ্ছিল, আরও সাবান দিলে হত!

ভোগ খেয়েই কোঁচা সামলে, হাঁটা লাগালাম লায়েলকা মাঠের পাশ ধরে। বিজয়গড় শিক্ষা নিকেতনের পাশেই ছিল গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী! ফ্রিতে বিখ্যাত গায়কদের গান শোনার লোভ দমে গেছিল সাক্ষাতের উত্তেজনায়।
প্রায় দৌড়ে হাঁটার সময় মনে হল- মেয়েটা হাফ সোল মারল না তো? এবার কিন্তু উত্তেজনাটা ভয়ে পালটাল। মোড়ে আসতেই বাস। তবে, একতলা! উঠতেই  মুখ চেনা কনডাক্টর হেসে বলল:- এই বাস কিন্তু, হাওড়া নয় গড়িয়া যাবে। আজও পদ্মশ্রীতে সিনেমা দেখবে নাকি?
বুক চিতিয়ে বললাম:- না কাকু, আজ টিকিট কাটবোই! আর আজ গড়িয়াতে নামবো।
কনডাক্টর কাকু বলল, না থাক! ট্র্যাডিশন ভাঙ্গবে কেন? তোমার এই দুষ্টুমিটা আমাদের ভালো লাগে! কয়েকজন তো চিনে ফেলেছে তোমায়! নতুন আরও একটা ভয় ঢুকল মনে! যদি, চেনা কনডাক্টর কাকু বেরোয়? সাড়ে সব্বোনাশ! তার ওপর মেয়েটার আসার চান্স কতখানি কে জানে?
স্ট্যান্ডে নেমে, মনটা ফুলেল তেল হয়ে গেল! মেয়েটা, বাসন্তী শাড়ী পরে খোঁপায় একটা গোলাপ গুঁজে দাঁড়িয়ে এদিক- ওদিক তাকাচ্ছে কাঁদ কাঁদ মুখে। তখন একটু এগুলেই, বারবধূদের বাড়ীগুলো ছিল। তারপরেই সামনে একটা কাঠের পুল। জায়গাটা খারাপ!
ঘড়িতে সাড়ে বারটা দুপুর।
আমি এগিয়ে যেতেই একগাল হাসি! মুখ থেকে যেন দিনের বেলাতেই পূর্ণিমার আলো ঝরে পড়ছে, শুক্লা বসন্ত পঞ্চমীর দিনে। সেই এক আকাশ জ্যোৎস্নাতে আমার মনটা উথাল পাথাল! পুরুষ্টু বুক দুটো ফেটে বেরিয়ে আসছে। গলায় একটা ঝুটো মুক্তোর মালা, উপত্যকার ভেতর দিয়ে গোপনে চলে গেছে, কামনার দিকে।
------------------
চল, এবার বাস বাছি! বলল, মেয়েটি! সার দিয়ে চার খানা ৫ নং বাস দাঁড়িয়ে । সব নীল রঙের! ফুট বোর্ড গুলো কালচে লাল।
ও বলল:- কালো ধোঁয়া যে বাস দিয়ে বেরুবে, সেই বাসে উঠবো না কিন্তু!
টাইম জেনে, একটা প্রায় নতুন বাসের দোতালায় একেবারে সামনের সীটে বসলাম দুজনে। লম্বু হবার ফলে, মাথাটা নিচু করেই সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কাড়াকাড়ি করে জানলার পাশে বসে আমার বাঁ হাতটা নিয়ে ওর ডান হাতটা রাখল। তখনও বাসে কেউ নেই! আমার কি যে হলো! শরীরে একটা ৪৪০ ভোল্ট! এদিক ওদিক তাকিয়ে টকাস করে ওর গালে একটা চুমু খেলাম। লজ্জায় লাল হয়ে, প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বিড়বিড় :- যা:! তুই না ভারী অসভ্য! তবে কিন্তু বেশ লাগল। এবার আর দুষ্টুমি করিস না!
 আস্তে আস্তে দোতালাটা ভর্তি হয়ে গেল। আমাদের পাশের সীটে এক বৃদ্ধ তাঁর বছর ৭/৮ এর নাতিকে নিয়ে বসেছেন। তখন, বাসগুলো ধোওয়া হত। ঠাণ্ডা হাওয়ার ভয়ে সামনের কাঁচ দুটো পুরো বন্ধ। তবে পাশের জানলাটা হাফ খোলা!
নীচের তলায় টিং টিং করে বাস ছাড়ার ঘণ্টি । বাসের এঞ্জিন স্টার্ট হতেই বাসটা একটু কেঁপে উঠল। তারপর, ডিপো থেকে বেরিয়ে একটু কেতরে ডান দিকে বাঁক নিয়ে সোজা বড় রাস্তায়! সামনে ড্রাইভার নেই, অথচ বাস চলছে, এ এক অসাধারণ অনুভূতি! প্লেনে তখনো উঠি নি, তবে কেন যেন মনে হল, এটাই প্লেন। পাশে, সুন্দরী কিশোরী!!!!! স্বর্গীয় ব্যাপার সাপার!
কিশোরী বলল:- আমি যা ভাবছি, তুইও কি সেটা ভাবছিস!!!!!!
মুখ দিয়ে সাহিত্য বেরিয়ে এলো! বিয়ে বাড়ীতে শোনা একটা মন্ত্রর মানে  বুঝে নিয়েছিলাম। উত্তর দিলাম :-যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম।
বুঝলও না মনে হয়! একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আমাকে জিভ দেখাল।
পাশের বৃদ্ধটি কান পেতে শুনছিলেন আমাদের কথোপকথন মনে হল।
হেসে বললেন:- মা! ছেলেটি বলল- তোমার আর আমার হৃদয় একতা বাছারা! তোমরা দেখছি প্রেমিক যুগল! বেশ লাগছে দুটিতে! বেড়াতে বেরিয়েছো?
আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললাম- হ্যাঁ
-         কোন ক্লাসে পড়?
-         আমি ক্লাস ইলেভেন আর ও ক্লাস টেন।
-         কি নিয়ে পড়ছো?
-         দুজনেই সায়েন্স।
-         বেশ, বেশ! এক স্কুল নয় নিশ্চয়ই!
-         না! আমি, বিজয়গড় শিক্ষা নিকেতন আর ও সম্মিলিত উদ্বাস্তু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।
-         তোমার তো সামনেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা! মন দিয়ে পড়ছো তো?
-         হ্যাঁআআ!
-         ঠিক আছে, সরস্বতী পুজোর দিন পড়তে নেই আর হাতে খড়ি দিতে নেই! দেবী আনন্দ উপভোগ করেন। তাই এগুলো বারণ! এটা অনেকেই জানে না।
-         আপনিও কি বেরিয়েছেন?
-         হ্যাঁ! নাতিকে নিয়ে কোলকাতা দেখাবো, দোতালা বাসে চড়ে।

বলতে, বলতেই পদ্মশ্রী সিনেমার কাছে বাসটা বাঁক নিলো বাঁ দিকে। আর মেয়েটি এসে পড়লো আমার কাঁধে!
একটু হেসে সামলে নিল চন্দনা! বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটু কি উদাস?  হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন:- ওই দ্যাখো আশাপূর্ণা দেবী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ব্যালকনিতে। ঠিক সেই সময়েই বাসটা বেরিয়ে গেল, দেখা আর হলো না! কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কনডাক্টর এলেন। আমাকে দেখেই চমকে উঠলেন!
-         একি! তুমি? সঙ্গে এ কে?
যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়! কনডাক্টর কাকু আমাদের দুটো বাড়ী পরের সজল কাকু। বিয়ে থা করেন নি! সংসারে নিবেদিত প্রাণ! বাসটা হঠাৎ ব্রেক কষল! সজলকাকু, হাতটা বাসের ছাদে হাত দিয়ে টাল সামলালেন। এই কায়দাটা বাসের দোতালায় করতে হত। ওখানে কোনো রড থাকতো না।
রামগড়ের মোড়ে বাসটা দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ- দিকে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের বাড়ী! বেশ কিছু গায়ক- গায়িকা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওনাদের দেখতেই ভীড়!
আমতা আমতা করে বললাম- কাকু, আমরা বেড়াতে বেড়িয়েছি, দোতালা বাসে! আর ও হলো চন্দনা! বাঘাযতীন আই ব্লকে থাকে। 
-তোর সাথে কি করে পরিচয় হল?
- মানে! এই যাতায়াত করতে করতে!!!!!
- পারিসও তোরা! তা কোথায় যাবি?
- হাওড়া!
- তারপর?
-দেখি, কি করা যায়!
- হুম! আমার একটা কথা শোন!‍ তোরা হাওড়ায় নেমে, এক কামরার ট্রামে শিবপুর পর্যন্ত ঘুরে আয়! ভাল লাগবে।
চন্দনা একটা আধুলি বের করে বলল- টিকিট দেবেন কাকু!
সজলদা হেঁসে বললেন- আমি অতখানি পাষাণ নই! তোরা ওই পয়সায় হাওড়ায় কিছু খেয়ে নিস। আর হ্যাঁ! তোরা কিন্তু সন্ধে লাগার আগেই ফিরে আসবি। আমি তোদের কথা বাস গুমটিতে বলে আসব। আমার নাম বলবি! ফেরার টিকিটের পয়সা লাগবে না! বুঝলি?
বাস এগিয়ে চলেছে। বাঁদিকে, ঝক ঝকে হলুদ রঙের গাঙুলিবাগান টেনামেন্টস স্কিমের  লম্বা বাড়ি।
চন্দনা মাথা নীচু করল।
কারণটা জানি! ও তো ওখানেই থাকে! বাধ্য হয়ে কাকুকে মিথ্যে কথাটা বলতে হল।

বৃদ্ধ বললেন- একি? মাথা নীচু করছ কেন, এই মেয়ে
চোখ কচলাতে কচলাতে, চন্দনা বলল- চোখে কি একটা যেন পড়ল!
বৃদ্ধ কি বুঝলেন কে জানে! চুপ করলেন। সামনেই বিদ্যাসাগর ষ্টপেজ। এবারেও বাঁ দিকে ঝুঁকে চলল বাস। একটা বট গাছের ডাল ছিঁড়ে কয়েকটা পাতা ঝরে পড়ল চন্দনার গায়ে।
বিদ্যাসাগরে থামতেই, হই হই করে বেশ কয়েকটা মেয়ে উঠে পড়ল বাসে।  ওরা ওপরে উঠে,দাঁড়িয়ে রইল, সিঁড়ির ধাপের মুখটাতে। দোতালায় ষ্টাণ্ডিং নিষেধ । শুধু কনডাক্টর আসতে পারত।
একটা মেয়ে চেঁচিয়ে বলল- আ্যই চন্দনা! কোথায় যাচ্ছিস রে! সাথে ওটা কে?
ঘাড় ঘুরিয়ে চন্দনা বলল, আরে বৈশাখী!!!! তোরা আবার কোথায় চললি?
পঞ্চানন তলা! তা বললি না, তোর সাথে ছেলেটা কে?
চন্দনা মুচকি হেসে আবার জিভ বের করল।
প্যাণ্ডেল থেকে গান ভেসে আসছে- বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা!

আমাদের পেছনের সিটের দুজন বাঘাযতীনে নেমে গেলে, দুটো মেয়ে এসে বসল পেছনে! বসেই একটা টোকা মারল চন্দনাকে।
এটা সেই ছেলেটা?
-         হুম
-         এর বাবা মা তো উড়িষ্যায় থাকে!
-         জানলি কি করে?
-         বা! আমার দাদা তো এর ক্লাসমেট! জানবো না?
-        
-         তা , শেষে তুই এই হাড়গিলেটাকে পছন্দ করলি!!!!
-         হাড়গিলেটাই দেখলেন, আমার লাবণ্য দেখলেন না? – আমি বলে উঠলাম।
-         ও বাবা, এ দেখছি ভালো বাংলা বলে!!!
-         শিখেছি তো! অন্নদা শঙ্করও বাংলা শিখেছিলেন! তাতে কি?
-         আরে বাবা, সব বলেই গোল! নাঃ! আপনার হবে!
বাস শুদ্দু ছেলে- মেয়ে গুলো হেসে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দোতালাটা সব আমাদের বয়েসী! খালি, ওই বৃদ্ধ চুপচাপ, একটা ছোট্ট হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে।
সজল কাকু এসে সবার কাছে টিকিট চাইছে, আর মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে!
এর মধ্যেই ঢাকুড়িয়া লেভেল ক্রসিং এ বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। লেভেল ক্রসিংএ দাঁড়িয়ে থাকাটা বোরিং জিনিস। বাদাম বিক্রি করছিল একটা মধ্যবয়স্ক লোক। চন্দনা কয়েকটা প্যাকেট কিনে নিল। তবে, বেশী ভুগতে হলো না! টুকটাক করে খেতে খেতে আর চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম হাওড়া!
নেমে, দুজনে হাঁটা লাগালাম এক কামরার ট্রামের দিকে।
খুব তেষ্টা পেয়েছে, চল কোকাকোলা খাই! চন্দনা বলল।
আট আনা দিয়ে দু বোতল কিনে আস্তে আস্তে খেতে লাগলাম।
খুব বেশী ভীড় নেই ষ্টেশন চত্তরে। কয়েকটা সেকেলে ঘোড়ার গাড়ী দাঁড়িয়ে।
চন্দনা বলল- তুই আমাকে ভুলবি না তো?
-         হঠাৎ এই প্রশ্ন!!!
-         না ধর,আমি মরে গেলাম, তখন?
-         ধ্যাৎ! খুব সুচিত্রা উত্তমের ছবি দেখছিস বুঝি আজকাল?
-         না রে না! আমার আজকাল কেন জানি মনে হয় এরকম! তাছাড়া আমরা তো ব্রাহ্মণ নই! তোর বাড়িতে মেনে নেবে?
-         মা- বাবা মানবে না, তবে দাদু- দিদা আছে! নো চিন্তা!
-         শোন, আমি একটা বক্স ক্যামেরা এনেছি! ফোটো তুলব।
-         সে কি রে? দারুণ তো!
 *************************
 নে, পোজ দে! ছবি তুলি!
সেটা না হয় হলো! আমাদের দুজনের একটা ফোটো হবে না?
দাঁড়া, দাঁড়া! কাউকে খুঁজতে হবে।
বলতে বলতে দেখি, সজল কাকু দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে চা খাচ্ছেন। ওনার বাস ছাড়ার টাইমের দেরী আছে।
আমরা গিয়ে আব্দার করাতে, ফোটো তুলে দিলেন। এবারে বললেন- শোন! পেছনে এক ভদ্র লোক বসে তোদের দেখছিলেন। আমি যখন তোদের কাছ থেকে পয়সা না নিয়ে চলে এলাম ,তখন ডেকে বললেন
আপনি ওদের চেনেন?
ছেলেটাকে চিনি, মেয়েটাকে নয়!
হুম! মেয়েটা আমার বন্ধুর মেয়ে। বলে গম্ভীর হয়ে গড়িয়াহাট নেমে গেছিলেন। আমি বলি কি তোরা এই বাসে ফিরে চল! সন্ধে হওয়ার আগেই ফিরে যেতে পারবি!
চন্দনা দেখলাম খুব একটা ঘাবড়ালো না! বলল- আমি মাকে বলে এসেছি! ও যে আমার সঙ্গে আছে, সেটা মা জানে!‍ বাবা জানে না! ঠিক আছে!সজলকাকু তুমি যখন বলছ তখন ফিরেই যাই! বেকার অশান্তি বাড়িয়ে কি লাভ?
আবার সেই দোতালার সামনের সিট! কিন্তু এবার চন্দনার মুখে প্রতিপদের চাঁদও নেই!
গাঙ্গুলী বাগানে নেমে গেল, আমাকে নামতে নিষেধ করে।
পরের বেশ কয়েক দিন আর দেখা নেই! মনে অসহ্য যন্ত্রণা‍! দশদিন পর বৈশাখী এসে একটা চিঠি দিল আমার হাতে।
খুলে পড়তে শুরু করলাম।
শোন
সেদিন, বাবার কাছে বকা খেলেও মা সব সামলে নিয়েছিল। এমনিতে আর কিছু হয় নি! ছবিগুলো প্রিন্ট হয়ে এসেছে। মা নিজেই সব করে দিল।
আমার, কেন জানি না খুব জ্বর হয়েছে। শরীর দুর্বল। তাই বেরুচ্ছি না। তোর তো সামনেই পরীক্ষা। ভালো করে পড়বি! কিছু একটা তোকে হতেই হবে। সেটা রাজনীতি হোক( যেটা তুই খুব ভালবাসিস) বা অন্য কিছু। তোকে ৭ বছর সময় দিলাম। তারপরে, একসঙ্গে থাকবো! বাবা রাজী।
এবার তোর পালা, অবশ্য পরে করলেও চলবে।
বাবা- মার সাথে পুরী যাচ্ছি। স্কুলে পরীক্ষার সিট পড়েছে। তাই আমাদের ছুটি। শরীরটা চাঙ্গা করে এসে, তোর সাথে ঘুরতে যাবো আবার!
ভালো থাকিস!
পু:- তোর চুমু খাবার কথা কাউকে বলিনি! ওটা আমার!
------------
পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এবার জেদ ধরে গেছিল। ভাল রেজাল্ট করতেই হবে।
পরীক্ষার শেষের দিন বৈশাখী দেখা করতে এলো আমার সঙ্গে, সেন্ট লরেন্স স্কুলে। ওখানেই আমার সিট পড়েছিল।
বাবার গাড়ী নিয়ে এসেছি। সোজা চল চন্দনার বাড়ী। ওর মা তোকে ডেকেছে। বৈশাখী বলল।
সারারাস্তা বৈশাখী চুপ। কিছু বলতে গেলেই ইশারা করে ড্রাইভার দেখিয়ে নিঃস্তব্ধ ।
নামিয়ে দিয়ে বৈশাখী চলে গেল। বাড়ী টা খুঁজে বেল বাজালাম।
এক মহিলা দরজা খুলেই আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে বললেন: ছবি দেখেই তোমাকে চিনলাম বাবা!
কেন যে ওকে সমুদ্রে ছাড়লাম। সমুদ্রেই চলে গেল মেয়েটা

চন্দনাআআআআআ!!!!!!! ৫০ বছর হয়ে গেল। তুই কোথায় আমি জানি না! শুনেছি, সমুদ্র সব ফিরিয়ে দেয়!!!
আজও মনে মনে ভাবি, তুই আমার ফেসবুকে, অরকুটে, মনে, পত্রিকায় সব জায়গায় আছিস। জানি, তুই এই চিঠিটা পড়ছিস।
মনে ঝড়ের সমুদ্র!
কবে ফিরবি রে?
....................................

****শারদীয়া সংখ্যা- দমকা হাওয়া পত্রিকায় – রাণাঘাট, প্রকাশিত