Friday, May 24, 2013

ফুটলিশ


আদরের নৌকা - ওয়েবজিনে প্রকাশিত

তারক মোত্তিরের শোওয়ার ঘরে ঢুকে, কাউকেই দেখা গেল না প্রথমে ! পরিস্কার বিছানাতে চাদর পাতা !   মনে হল-ওপরে আরও একটা মোটা বেডকভার ।
ক্ষেতু বাগচী ভালো করে দেখে ঠাহর করলেন- বেডকভারটা একটা মানুষের অবয়ব  ।  ঠিক যেন- টম আ্যণ্ড জেরীর সিরিয়াল টমের দেওয়ালে ধাক্কা খাবার পর যে একটা দেওয়ালে  খোদাই করা ছবি দেখা যায়, সেরকম
পরে বোঝা গেল, ওই চাদরটা আসলে তারক মোত্তির ! জ্বরে কাহিল হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন ।
সামান্য একটু  হয়েছিল ঠিকই, তবে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেতেই জ্বরটা “ নীলম্” ঝড়ের মত আছড়ে পড়তে পারে নি, তারক মোত্তিরের শরীরে ।
চন্দন ডাক্তার সব পরীক্ষা করার পর রায় দিয়েছে, এটা ডেঙ্গি নয়, তবুও তারক বাবুর খুঁতখুঁতি যায় নাখাবার খেতে গিয়ে জিভে কোনো স্বাদই পাচ্ছেন না ।
তারক মোত্তির খাদ্যরসিক লোক  । সারাজীবন ইস্কুল মাষ্টারি, আর দেশ- দশের সেবা করতে গিয়ে আর বিয়ে করার সময় পাননি বলে দাবী করেন । বিয়েটা “ নীলা” র মত স্যুট করে নি । হোম-ডেলিভারিতে খাবার আনান আর পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগে পেয়েছেন একটা হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট ।  ভাইপো – ভাইঝিরা একই বিল্ডিংএ থাকে । তারা কাকাকে দেখাশোনা করে আর  বারবার আর্জি জানায় তাদের সঙ্গে খাওয়া- দাওয়াটা অন্তত করতে, তবে তারক মোত্তির সেটা করবেন না ।
বাসে- ট্রামে- ট্যাক্সিতে বেশী চড়া নেইরিক্সাতেই ঘুরে বেড়ান কোলকাতা লাগোয়া এই শহরতলীতে ।  বাইরে বেরুলে, টুকটাক এদিক- সেদিক যা খাবার পান, সেটা খান বটে, তবে তাতে সোয়াদ পান না ।
ক্ষেতু বাগচী আবার এই ব্যাপারে খলিফা লোক । অবসর জীবনে ঘুরে ঘুরে খাস কোলকাতার খাবার গুলো চেখে বেড়ান ।
তারক মোত্তির কুঁই কুঁই করে বললেন – ক্ষেতুদা ! আপনার অভিজ্ঞতাগুলো একটু বলুন না । শুনেই তৃপ্তি পাই ।
হোম – ডেলিভারির ছেলেটা খাবার দিয়ে গেল । ক্ষেতুদা বাটীগুলো খুলে দেখলেন । ট্যালটেলে ডাল,  আলু- মটরের তরকারি, একটা ভাজা টাইপের কিছু আর এক পিস ব্লেড দিয়ে কাটা পোনা, লাল রং করা জলের মধ্যে ভাসছে ।
ক্ষেতুদা বললেন – হ্যাঁ হে তারক ! এটা আলু মটরের তরকারি ?
-       দাদা,  তাই তো বলে এটাকে ওরাতবে মাঝে মধ্যে –কশ্চিৎ কদাচিৎ, কৌন বনেগা ক্রোড়পতির অডিশন কলের মত মটরের দানা একটা দুটো পাই বটে । বাকি সবই আলু !
-       আলুর দম দ্যায় না ?
-       মাঝে মধ্যে, তবে মুখতব্য নয় ।
-       ভাজা- টাজা দ্যায় ?
-       দ্যায় , তবে সেগুলো  ভাতের সঙ্গে জড়িয়ে কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয় ! ওগুলো কাঁকড় না ভাজা সেটা বুঝতে পারি না !
-       বলি, কোনোদিন দরবারি বেগুনি খেয়েছো ?
-       দরবারি বেগুনি !!! কি বলছেন দাদা !
-       তোমার বাড়ী থেকে খুব কাছেই, সিঁথির মোড়ে আটাকলের কাছে ।  এক- একটা লম্বায় প্রায় এক হাতের মত । চেহারায় পুরো সিনেমার টুনটুন ।
-       তালে একদিন নিয়ে যাবেন খাওয়াতে  ?
-       সে দোকান কব্বে উঠে গিয়েছে !!!
-       সে কি ! আপনার দেখছি, খাওয়ানোর কথা বললেই দোকানের গণেশ উল্টে যায় ।
-       এসব বলো না হে । দরবারি ধোঁকা থেকে আরম্ভ করে ফুলুরি, সবই বানাতো ওই দোকানে । তারই বনসাই এডিশান আজও  পাবে হাতি বাগানে । ঠিক আছে, ওঠো তো ! তোমাকে আজ খাওয়াবো । একটা গাড়ী ভাড়া করছি এত খোঁটা আর সহ্য হয় না !!
-       সে না হয় বুঝলাম । কিন্তু কি  খাওয়াবেন ? আর কোথায় !!!!
-       ওফ্ ! আগে ওঠো । আগে বিবেকানন্দ পার্কে গিয়ে আলুর দম খাবো । লা- জওয়াব বানায় ।
-       শোনো হে ! গাড়ীটা আগে ভাড়া করে নেই পার্থকে ফোন করে । তারপর গাড়ী আসতে আসতে তোমাকে বলছি কি  খাবো বা খেতে পারা যায় !
পার্থকে ফোন করলেন ক্ষেতু বাগচী । জবাব এলো- ঘন্টা খানেক সময় লাগবে, কারণ সব গাড়ী বেরিয়ে গেছে । যেটা আছে, তার ড্রাইভার স্নান, খাওয়া দাওয়া সারতে গেছে । তাই এই দেরী ।
তারক মোত্তিরের ভাইঝি পিঙ্কি, ক্ষেতুদার জন্য ফিলটার্ড কফি নিয়ে এলো ।  ইনষ্টান্ট কফি পছন্দ করেন না ক্ষেতুদা । খাস মালাবারের সুগন্ধ এই কফিতে । তারিয়ে তারিয়ে খান ! পিঙ্কিরাও আজকাল এই কফি খায় । বিগ- বাজার কাছেই, তাই আর কষ্ট করে নিউ মার্কেট যেতে হয় না । এটা বানানোর প্রচুর কায়দা আছে । যথার্থ ছাকনী দরকার কফি বানাতে গেলে । কফিতে আবার বেশী জল ঢাললে হবে না । ঘন করে নিয়ে তারপর ছাকনীতে ছেঁকে মেকদারে দুধ চিনি মেশাতে হবে । যথার্থ শিল্পের কাজ ।
কফিতে চুমুক দিয়ে খানিক চোখ বুঁজে রইলেন ক্ষেতুদা । তারপর খেপে খেপে চুমুক দিয়ে কফিটা শেষ করলেন । একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন:-
-       বুঝলে হে , তারক ! চা কিন্তু আমি খাই !
-       সেতো বল হরির চা ! চায়ের রং করা একগাদা জল মেশানো দুধে ।
-       আরে না হে ! ওটা তো সময় কাটানোর জন্য । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে ময়দানে চকচকে পেতলের বড়  নল লাগানো জার থেকে ভাঁড়ের চা । ছাতা মাথায় দিয়ে তোমার বৌদির সাথে পাশে বসে কত্ত খেয়েচি !!!
-       ওটা পাওয়া যায় আজকাল, নাকি ওটারও গণেশ উল্টেছে ?
-       না হে, পাওয়া যায় । তাচাড়া বৌ বা প্রেমিকা পাশে না থাকলে, ওটা গণেশ ওল্টানোর মতই ব্যাপার ।
-       আজ পাওয়া যাবে ?
-       যাবে, তবে তোমার বৌও নেই আর আজ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিরও দিন নয়  ! সেই সোয়াদ কি আর পাবে ? পরিবেশটা দরকার এই চা খেতে গেলে ।
-       হুম ! আরও কিছু ঝুলি থেকে বের করুন ।
-       রাইটার্স যাকে আজকাল মহাকরণ বলা হয়, তার পাশে প্রচুর দোকান ছিল খাবারের। নিরাপত্তার খাতিরে ওগুলো সরে গেছে । কাঁচকলা দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোল আর ভাত ! কি তার সোয়াদ ! পটলডাঙ্গার প্যালারামও চেয়ে চেয়ে খেত মনে হয় ।
-       এটারও গণেশ উল্টে দিলেন ?
-       আরে না, বললাম তো এরা আছে, তবে সরে গেছে । মিহিদানা থেকে শুরু করে কেষনগরের সরপুরিয়া সব পাওয়া যায় । মালপোয়া তো অনবদ্য । রসমালাই, ফুলকপির সিঙারা, জিলিপি, জলভরা সন্দেশ- কি নেই সেখানে !
-       আলু- পোস্ত পাওয়া যায় ? বলে সুরুৎ করে জিভের জল টানলেন তারক মোত্তির ।
-       আহা, আহা ! তা আর বলতে ? ঝিঙ্গে পোস্ত, পোস্ত বাটা, পেঁয়াজ পোস্ত – সব ! বাড়ীর থেকেও ভালো । যখন চাকরী কোত্তুম, বাড়ীতে খাবার না খেয়ে, পাত পেড়ে বসে ওখানে যজ্ঞি বাড়ির মত খাওয়া দাওয়া সাত্তুম ,সে দিনের সোনা ঝরা দুপুরে । বলে গুণগুণ করে গান ধরলেন ক্ষেতু বাগচী । 
-       আপনার তো পার্ক স্ট্রীটে আপিস ছিল ।
-       তা ছিল । তবে, লাঞ্চ টাইমে ঘুরে ঘুরে এই সব চাখতাম । মিডলটন রো তো বসে খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে ।  যেখানে পিটার ক্যাট আর সৌরভস্, সেখান থেকে এগিয়ে গেলেই এই সব দোকান । ইঁটের চেয়ার আর সামনে উঁচু করা ক্যাটারের টেবিল । খাসীর মাংসের তুলনা নেই এখানে । দেলখোস আর গোলবাড়ী হার মানবে ।
-       ক্ষেতুদা, আর  কোথায় খেয়েছেন ?
-       কেন , ডেকার্স লেন । মেট্রো সিনেমার সোজা যে রাস্তাটা কেসি দাশকে ডানে রেখে চলে গেছে !  ওই যে যেখানে আগে সব ধর্ণায় বসতো গো !  একটু এগিয়েই ডান দিকে গলিটা । অনেক দূর থেকে ভুর ভুর করে ভেসে আসবে খাবারের ফিউশন সুবাস । দিল এক্কেরে বাগ বাগ হয়ে যাবে । তবে, এখানকার স্পেসিয়ালিটি, কড়কড়ে ঝাল আর মিষ্টি টোষ্ট, সাথে সাদা কাপ- প্লেটে চা ! কি নেই এখানে ! চাইনিজ, মোঘলাই ।
-       মশলা মুড়ি ?
-       হে হে, কি যে বলো হে ! এই তেলেভাজা, মশলা মুড়ির জবাব নেই ! বিকেলে তো এটা দিয়েই জলখাবার খেতাম হে । রাত নয়টা পর্যন্ত আপিস করতে হত ।  কখনও চানাচুর মুড়ি, খবরের কাগজ পেতে আপিসের টেবিলে । এই চানাচুরের ফরমূলা কত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী বাগানোর চেষ্টা করেছে । পারে নি আর পারবেও না । এটমিক বোম্ব বানানোর ফরমূলার থেকেও কঠিন । আজকাল অবশ্য চকচকে আইসক্রিম কোণের মত প্যাকে মোবাইল মুড়ি পাওয়া যাচ্ছে, একটা বাঙালি কোম্পানীর, তবে তাতে, হাতে মেখে কৌটো ঝাঁকিয়ে মুড়ি মাখার সেই টেষ্ট নেই ।
-       দাদা, আজকাল শুনছি ম্যাকডোলাণ্ড আর কে এফ সির রমরমা বাজার !
-       ছোঃ ! বলি , চিকেন বা ফিস কবিরাজি খেয়েছো ?
-       একটা কথা মনে পড়ল আচ্ছা দাদা, এই কবিরাজি কথাটা কোত্থেকে এলো ? কোনো কোবরেজি মশলা থাকে নাকি, এটাতে ?
-       আরে নাঃ ! ওটা কভারেজের অপভ্রংশ । চিকেন বা ফিস টা তৈরি করে ওর ওপর যে আস্তরণ দেওয়া হয়, সেটাই কভারেজ । আগে তো ফাউল কবিরাজি বলত, এদানীর চিকেন বলে ।
-       কে এফ সির ক্রিস্পি চিকেন ?
-       রামোচন্দর ! ওটা একটা খাবার হলো ?  মিত্র কেবিন বা বসন্ত কেবিনের চিকেন কবিরাজি খাও । দেখবে, ওর চেয়ে শতগুণে ভালো । ওই রং চং এ লাইটে সকলের চোখ ধাঁধিয়ে যায় । কে এফ সির জয়গান !
-       বলছেন ?
-       হাজারবার !
-       দাদা ডিমের ডেভিল , মাটন টিকিয়া এসব ?
-       প্রতিষ্ঠিত দোকান প্রচুর আছে, কিন্তু হাতীবাগান বাজারের পাশে, ফুটপাথে বঙ্কার দোকান সক্কলকে হার মানাবে । পাশাপাশি আরও দোকান আছে, তবে বঙ্কা একেবারে পামঅলিভ ।
-       পামঅলিভ ?
-       আরে কপিল দেব একটা আ্যড করেছিল না ? পামঅলিভদা জওয়াব নেহি ! বঙ্কার জবাব নেই !
ক্ষেতুদার মোবাইল বাজল । কিছু কথা বলে করুণ মুখে বললেন :-
-   বুঝলে তারক, পার্থর ড্রাইভারের জ্বর এসে গেছে হঠাৎ । আজ আর আসতে পারছে না ।
-   গণেশ সত্যিই দেখি আপনার ফেভারে ক্ষেতুদা !  জয় গণেশ !
ক্ষেতুদা, কটমট করে তারক মোত্তিরের দিকে তাকিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ।








No comments: