আদরের নৌকা - ওয়েবজিনে প্রকাশিত
তারক মোত্তিরের শোওয়ার ঘরে
ঢুকে, কাউকেই দেখা গেল না প্রথমে ! পরিস্কার বিছানাতে চাদর পাতা ! মনে
হল-ওপরে আরও একটা মোটা বেডকভার ।
ক্ষেতু বাগচী ভালো করে দেখে
ঠাহর করলেন- বেডকভারটা একটা মানুষের অবয়ব । ঠিক
যেন- টম আ্যণ্ড জেরীর সিরিয়াল ।
টমের দেওয়ালে ধাক্কা খাবার পর যে একটা দেওয়ালে খোদাই করা ছবি দেখা যায়, সেরকম ।
পরে বোঝা গেল, ওই চাদরটা আসলে
তারক মোত্তির ! জ্বরে কাহিল হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন ।
সামান্য একটু হয়েছিল ঠিকই, তবে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট
খেতেই জ্বরটা “ নীলম্” ঝড়ের মত আছড়ে পড়তে পারে নি, তারক মোত্তিরের শরীরে ।
চন্দন ডাক্তার সব পরীক্ষা করার
পর রায় দিয়েছে, এটা ডেঙ্গি নয়, তবুও তারক বাবুর খুঁতখুঁতি যায় না । খাবার খেতে গিয়ে জিভে কোনো স্বাদই
পাচ্ছেন না ।
তারক মোত্তির খাদ্যরসিক
লোক । সারাজীবন ইস্কুল মাষ্টারি, আর দেশ-
দশের সেবা করতে গিয়ে আর বিয়ে করার সময় পাননি বলে দাবী করেন । বিয়েটা “ নীলা” র মত
স্যুট করে নি । হোম-ডেলিভারিতে খাবার আনান আর পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগে পেয়েছেন একটা
হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট । ভাইপো –
ভাইঝিরা একই বিল্ডিংএ থাকে । তারা কাকাকে দেখাশোনা করে আর বারবার আর্জি জানায় তাদের সঙ্গে খাওয়া- দাওয়াটা
অন্তত করতে, তবে তারক মোত্তির সেটা করবেন না ।
বাসে- ট্রামে- ট্যাক্সিতে বেশী
চড়া নেই । রিক্সাতেই
ঘুরে বেড়ান কোলকাতা লাগোয়া এই শহরতলীতে । বাইরে বেরুলে, টুকটাক এদিক- সেদিক যা খাবার পান,
সেটা খান বটে, তবে তাতে সোয়াদ পান না ।
ক্ষেতু বাগচী আবার এই ব্যাপারে
খলিফা লোক । অবসর জীবনে ঘুরে ঘুরে খাস কোলকাতার খাবার গুলো চেখে বেড়ান ।
তারক মোত্তির কুঁই কুঁই করে
বললেন – ক্ষেতুদা ! আপনার অভিজ্ঞতাগুলো একটু বলুন না । শুনেই তৃপ্তি পাই ।
হোম – ডেলিভারির ছেলেটা খাবার
দিয়ে গেল । ক্ষেতুদা বাটীগুলো খুলে দেখলেন । ট্যালটেলে ডাল, আলু- মটরের তরকারি, একটা ভাজা টাইপের কিছু আর
এক পিস ব্লেড দিয়ে কাটা পোনা, লাল রং করা জলের মধ্যে ভাসছে ।
ক্ষেতুদা বললেন – হ্যাঁ হে তারক
! এটা আলু মটরের তরকারি ?
- দাদা,
তাই তো বলে এটাকে ওরা । তবে মাঝে মধ্যে –কশ্চিৎ কদাচিৎ, কৌন
বনেগা ক্রোড়পতির অডিশন কলের মত মটরের দানা একটা দুটো পাই বটে । বাকি সবই আলু !
- আলুর
দম দ্যায় না ?
- মাঝে
মধ্যে, তবে মুখতব্য নয় ।
- ভাজা-
টাজা দ্যায় ?
- দ্যায়
, তবে সেগুলো ভাতের সঙ্গে জড়িয়ে কোথায় যে
নিরুদ্দেশ হয় ! ওগুলো কাঁকড় না ভাজা সেটা বুঝতে পারি না !
- বলি,
কোনোদিন দরবারি বেগুনি খেয়েছো ?
- দরবারি
বেগুনি !!! কি বলছেন দাদা !
- তোমার
বাড়ী থেকে খুব কাছেই, সিঁথির মোড়ে আটাকলের কাছে ।
এক- একটা লম্বায় প্রায় এক হাতের মত । চেহারায় পুরো সিনেমার টুনটুন ।
- তালে
একদিন নিয়ে যাবেন খাওয়াতে ?
- সে
দোকান কব্বে উঠে গিয়েছে !!!
- সে
কি ! আপনার দেখছি, খাওয়ানোর কথা বললেই দোকানের গণেশ উল্টে যায় ।
- এসব
বলো না হে । দরবারি ধোঁকা থেকে আরম্ভ করে ফুলুরি, সবই বানাতো ওই দোকানে । তারই
বনসাই এডিশান আজও পাবে হাতি বাগানে । ঠিক
আছে, ওঠো তো ! তোমাকে আজ খাওয়াবো । একটা গাড়ী ভাড়া করছি । এত খোঁটা আর সহ্য হয় না !!
- সে
না হয় বুঝলাম । কিন্তু কি খাওয়াবেন ? আর
কোথায় !!!!
- ওফ্
! আগে ওঠো । আগে বিবেকানন্দ পার্কে গিয়ে আলুর দম খাবো । লা- জওয়াব বানায় ।
- শোনো
হে ! গাড়ীটা আগে ভাড়া করে নেই পার্থকে ফোন করে । তারপর গাড়ী আসতে আসতে তোমাকে বলছি
কি খাবো বা খেতে পারা যায় !
পার্থকে ফোন করলেন ক্ষেতু বাগচী । জবাব এলো- ঘন্টা
খানেক সময় লাগবে, কারণ সব গাড়ী বেরিয়ে গেছে । যেটা আছে, তার ড্রাইভার স্নান, খাওয়া
দাওয়া সারতে গেছে । তাই এই দেরী ।
তারক মোত্তিরের ভাইঝি পিঙ্কি, ক্ষেতুদার জন্য
ফিলটার্ড কফি নিয়ে এলো । ইনষ্টান্ট কফি
পছন্দ করেন না ক্ষেতুদা । খাস মালাবারের সুগন্ধ এই কফিতে । তারিয়ে তারিয়ে খান !
পিঙ্কিরাও আজকাল এই কফি খায় । বিগ- বাজার কাছেই, তাই আর কষ্ট করে নিউ মার্কেট যেতে
হয় না । এটা বানানোর প্রচুর কায়দা আছে । যথার্থ ছাকনী দরকার কফি বানাতে গেলে ।
কফিতে আবার বেশী জল ঢাললে হবে না । ঘন করে নিয়ে তারপর ছাকনীতে ছেঁকে মেকদারে দুধ
চিনি মেশাতে হবে । যথার্থ শিল্পের কাজ ।
কফিতে চুমুক দিয়ে খানিক চোখ বুঁজে রইলেন ক্ষেতুদা ।
তারপর খেপে খেপে চুমুক দিয়ে কফিটা শেষ করলেন । একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন:-
- বুঝলে
হে , তারক ! চা কিন্তু আমি খাই !
- সেতো
বল হরির চা ! চায়ের রং করা একগাদা জল মেশানো দুধে ।
- আরে
না হে ! ওটা তো সময় কাটানোর জন্য । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে ময়দানে চকচকে পেতলের
বড় নল লাগানো জার থেকে ভাঁড়ের চা । ছাতা
মাথায় দিয়ে তোমার বৌদির সাথে পাশে বসে কত্ত খেয়েচি !!!
- ওটা
পাওয়া যায় আজকাল, নাকি ওটারও গণেশ উল্টেছে ?
- না
হে, পাওয়া যায় । তাচাড়া বৌ বা প্রেমিকা পাশে না থাকলে, ওটা গণেশ ওল্টানোর মতই
ব্যাপার ।
- আজ
পাওয়া যাবে ?
- যাবে,
তবে তোমার বৌও নেই আর আজ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিরও দিন নয় ! সেই সোয়াদ কি আর পাবে ? পরিবেশটা দরকার এই চা
খেতে গেলে ।
- হুম
! আরও কিছু ঝুলি থেকে বের করুন ।
- রাইটার্স
যাকে আজকাল মহাকরণ বলা হয়, তার পাশে প্রচুর দোকান ছিল খাবারের। নিরাপত্তার খাতিরে
ওগুলো সরে গেছে । কাঁচকলা দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোল আর ভাত ! কি তার সোয়াদ !
পটলডাঙ্গার প্যালারামও চেয়ে চেয়ে খেত মনে হয় ।
- এটারও
গণেশ উল্টে দিলেন ?
- আরে
না, বললাম তো এরা আছে, তবে সরে গেছে । মিহিদানা থেকে শুরু করে কেষনগরের সরপুরিয়া
সব পাওয়া যায় । মালপোয়া তো অনবদ্য । রসমালাই, ফুলকপির সিঙারা, জিলিপি, জলভরা
সন্দেশ- কি নেই সেখানে !
- আলু-
পোস্ত পাওয়া যায় ? বলে সুরুৎ করে জিভের জল টানলেন তারক মোত্তির ।
- আহা,
আহা ! তা আর বলতে ? ঝিঙ্গে পোস্ত, পোস্ত বাটা, পেঁয়াজ পোস্ত – সব ! বাড়ীর থেকেও
ভালো । যখন চাকরী কোত্তুম, বাড়ীতে খাবার না খেয়ে, পাত পেড়ে বসে ওখানে যজ্ঞি বাড়ির
মত খাওয়া দাওয়া সাত্তুম ,সে দিনের সোনা ঝরা দুপুরে । বলে গুণগুণ করে গান ধরলেন
ক্ষেতু বাগচী ।
- আপনার
তো পার্ক স্ট্রীটে আপিস ছিল ।
- তা
ছিল । তবে, লাঞ্চ টাইমে ঘুরে ঘুরে এই সব চাখতাম । মিডলটন রো তো বসে খাওয়ার
বন্দোবস্ত আছে । যেখানে পিটার ক্যাট আর
সৌরভস্, সেখান থেকে এগিয়ে গেলেই এই সব দোকান । ইঁটের চেয়ার আর সামনে উঁচু করা
ক্যাটারের টেবিল । খাসীর মাংসের তুলনা নেই এখানে । দেলখোস আর গোলবাড়ী হার মানবে ।
- ক্ষেতুদা,
আর কোথায় খেয়েছেন ?
- কেন
, ডেকার্স লেন । মেট্রো সিনেমার সোজা যে রাস্তাটা কেসি দাশকে ডানে রেখে চলে গেছে
! ওই যে যেখানে আগে সব ধর্ণায় বসতো গো
! একটু এগিয়েই ডান দিকে গলিটা । অনেক দূর
থেকে ভুর ভুর করে ভেসে আসবে খাবারের ফিউশন সুবাস । দিল এক্কেরে বাগ বাগ হয়ে যাবে ।
তবে, এখানকার স্পেসিয়ালিটি, কড়কড়ে ঝাল আর মিষ্টি টোষ্ট, সাথে সাদা কাপ- প্লেটে চা
! কি নেই এখানে ! চাইনিজ, মোঘলাই ।
- মশলা
মুড়ি ?
- হে
হে, কি যে বলো হে ! এই তেলেভাজা, মশলা মুড়ির জবাব নেই ! বিকেলে তো এটা দিয়েই
জলখাবার খেতাম হে । রাত নয়টা পর্যন্ত আপিস করতে হত । কখনও চানাচুর মুড়ি, খবরের কাগজ পেতে আপিসের
টেবিলে । এই চানাচুরের ফরমূলা কত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী বাগানোর চেষ্টা করেছে ।
পারে নি আর পারবেও না । এটমিক বোম্ব বানানোর ফরমূলার থেকেও কঠিন । আজকাল অবশ্য চকচকে
আইসক্রিম কোণের মত প্যাকে মোবাইল মুড়ি পাওয়া যাচ্ছে, একটা বাঙালি কোম্পানীর, তবে
তাতে, হাতে মেখে কৌটো ঝাঁকিয়ে মুড়ি মাখার সেই টেষ্ট নেই ।
- দাদা,
আজকাল শুনছি ম্যাকডোলাণ্ড আর কে এফ সির রমরমা বাজার !
- ছোঃ
! বলি , চিকেন বা ফিস কবিরাজি খেয়েছো ?
- একটা
কথা মনে পড়ল । আচ্ছা
দাদা, এই কবিরাজি কথাটা কোত্থেকে এলো ? কোনো কোবরেজি মশলা থাকে নাকি, এটাতে ?
- আরে
নাঃ ! ওটা কভারেজের অপভ্রংশ । চিকেন বা ফিস টা তৈরি করে ওর ওপর যে আস্তরণ দেওয়া
হয়, সেটাই কভারেজ । আগে তো ফাউল কবিরাজি বলত, এদানীর চিকেন বলে ।
- কে
এফ সির ক্রিস্পি চিকেন ?
- রামোচন্দর
! ওটা একটা খাবার হলো ? মিত্র কেবিন বা
বসন্ত কেবিনের চিকেন কবিরাজি খাও । দেখবে, ওর চেয়ে শতগুণে ভালো । ওই রং চং এ লাইটে
সকলের চোখ ধাঁধিয়ে যায় । কে এফ সির জয়গান !
- বলছেন
?
- হাজারবার
!
- দাদা
ডিমের ডেভিল , মাটন টিকিয়া এসব ?
- প্রতিষ্ঠিত
দোকান প্রচুর আছে, কিন্তু হাতীবাগান বাজারের পাশে, ফুটপাথে বঙ্কার দোকান সক্কলকে
হার মানাবে । পাশাপাশি আরও দোকান আছে, তবে বঙ্কা একেবারে পামঅলিভ ।
- পামঅলিভ
?
- আরে
কপিল দেব একটা আ্যড করেছিল না ? পামঅলিভদা জওয়াব নেহি ! বঙ্কার জবাব নেই !
ক্ষেতুদার মোবাইল বাজল । কিছু কথা বলে করুণ মুখে
বললেন :-
-
বুঝলে তারক, পার্থর ড্রাইভারের জ্বর
এসে গেছে হঠাৎ । আজ আর আসতে পারছে না ।
-
গণেশ সত্যিই দেখি আপনার ফেভারে
ক্ষেতুদা ! জয় গণেশ !
ক্ষেতুদা, কটমট করে তারক
মোত্তিরের দিকে তাকিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ।
No comments:
Post a Comment