“আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ
মাখিয়া দিয়া তাতে।
হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক
নিস্তব্ধ, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।।’
এইটা যখন প্রথম পড়ি, তখন মনে
হয়েছিল, মনের
কথা- পেটের কথা। পেটের কথা মানে- পেটের প্রেম।
অমৃত কাকে বলি জানি না! তবে মালদার
গোপালভোগের আমসত্ত্ব দুধে ফেলে ১ ঘন্টা পর দেখেছি, সেই দুধ পুরো
আমের ঘন সরবত হয়ে গেছে। তারপর সেটা ফ্রীজে রেখে ঠাণ্ডা করে, আস্তে আস্তে
চুমুক মেরে মনে হয়েছেঃ- ওরে দুধ গোলা রে! তুঁহু মম শ্যাম সমান!
শ্যামের কথাই যখন এলো, তখন পুরোনো
একটা গানের কথা বলি।
লুচির কোলে পড়ল চিনি
যেন শ্যামের কোলে সৌদামিনী!
প্রেম, ভালোবাসা- সব
লুচি আর চিনির লালাসিক্ত রসায়ন।
তারপর-
লুচির কোলে পড়ল ডাল
বামুন নাচে তালে তাল
“ভজ গৌরাঙ্গ’ বলে বামুনদের সে কি প্রেমের নাচ!!
সবার পাতে দই পড়ছে দেখে- বামুন আর
থাকতে পারল না!
রেগে বলল-
হাতে দই, পাতে দই, তবু বলে কই
কই
ওরে ব্যাটা হাঁড়ি হাতে, দে দই দে দই!
দই পেয়ে বামুন, সে কি
খুশী!!!!!!
নাচতে নাচতে গাইলো-
পান্তুয়া লম্বা, রসগোল্লা গোল
হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল!
লেখাটা পড়ে Horrible মনে হতে পারে, কিন্তু
খাওয়ার প্রতি বামুনদের যে ভালোবাসা, সেটা যে
নিখাদ- তার প্রমাণ, তার উন্মত্ত নাচ! আর সেই নাচ, প্রেমে মাতোয়ারা
হয়ে!
সেকালের খাদ্যপ্রেমী বামুনরা পেট
ভরেছে কিনা- সেটা জানার জন্য, পৈতেতে একটা চাবি বেঁধে রাখতেন।
এক নৈয়ায়িক, বামুনদের এক
প্রতিভূকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ- আপনার ঈদৃশ কার্যের
কারণ কি? উপবীতের সহিত কুঞ্চিকাঠির যোগ কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন?
বামুনঃ- মান্যবর! খাদ্যগ্রহণ কালে
মদীয় উদর পূর্ত্তি হইয়াছে কিনা তাহা বোধ করিতে পারি না। এই
কারণে, সংকেতের নিমিত্ত এই উপবীতের সহিত কুঞ্চিকাঠির
যোগ করিয়াছি।
নৈয়ায়িকঃ -সংকেতটি কী প্রকার?
বামুনঃ-উদরের সহিত কুঞ্চিকাঠি সমকোণে
উত্থিত হইলে, বোধগম্য হইবে যে- মদীয় উদর পূর্ত্তি হইয়াছে।
(কুঞ্চিকাঠি= চাবি)
বুঝুন! কী রকম খাদ্যপ্রেম!
সেই বামুনের আবার এরকমই খাদ্যরসিক যে
কহতব্য নয়!
নিয়মমত গায়ত্রী জপ করতে বসেছে!
প্রথমেই বললঃ-
“ওঁ প্রজাপতি ঋষি, পাতা পেড়ে বসি।
চিপিটক সহিত রম্ভা চর্বণে বিনিয়োগঃ।।’
(চিপিটক= চিড়া, রম্ভা = কলা)
খাদ্যরসিক সৈয়দ মুজতবা আলি আবার
এককাঠি ওপর দিয়ে গিয়েছেন!
অমৃতের সন্ধান, বলতে গিয়ে, সংস্কৃত
সাহিত্যের উপমা সহ বলছেনঃ-
“কেচিদ বদন্তি অমৃতস্তোসি সুরালয়ে
কেচিদ বদন্তি অমৃতস্তোসি প্রিয়াস্য
অধরে।
ময়া পঠিতানি নানা শাস্ত্রাণি
অমৃতস্তোসি জম্বুর নীর পুটিত
ভর্জিত মৎস খণ্ডে।’
অস্যার্থঃ- কেউ কেউ বলেন- অমৃত আছে
সুরালয়ে। ( এখানে, সুরালয়ে- শব্দটার দুটো মানে আছে।সন্ধির খেলা আর কি!
প্রথমটা পড়তে হবে- সুর+ আলয়= দেবতার মন্দির। দ্বিতীয়টা- সুরা+ আলয়=
ভাঁটিখানা) আবার কেউ কেউ বলেন- অমৃত আছে, প্রিয়ার অধরে মানে চুম্বনে। অনেক
শাস্ত্র পড়েছি- কিন্তু অমৃত আছে লেবুর রস দেওয়া ভাজা মাছের মধ্যে।
অহো! চুম্বনের সাথে- ভাজা মাছ! কী
অপূর্ব মেলবন্ধন! এটা নিশ্চয়ই কোনো বাঙালী পণ্ডিতের লেখা! না হলে মাছের
এই তুলনা আর কোন পণ্ডিত করতে পারতো না।
এক বাউন গিয়েছে বিয়ে বাড়ীতে। খেতে
খেতে শুয়ে পড়ে হাঁসফাঁস করছে।
বোঝাই গেল- আর খেতে পারছে না! একজন
বললেন- ঠাকুরমশাই! একটা হজমের বড়ি দি! কী বলেন?
অতিকষ্টে উত্তর এলো- হজমের বড়ি যদি
খাওয়ার জায়গা থাকতো হে, তা হলে তার বদলে আমি আরও ১০ টা পান্তুয়া খেতাম।
আগেই বলেছি, মুজতবা সাহেব
খাদ্যরসিক ছিলেন! একবার তিনি, চাঁদনী রাতে তাজমহল না দেখতে গিয়ে রামপাখীর মাংস খাচ্ছিলেন-
রেস্তোঁরায় বসে।
জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন- বাপু হে! ওই
তাজমহল, কড়কড়ায়তে-মড়মড়ায়তে
করে খাওয়া যায় না। তাই যাই নি!
বৈষ্ণব বাউনরা মাছ যাতে খেতে পারেন-
তার জন্য নীচের বিধান এলোঃ-
ইল্লিশ, খল্লিস, ভেটকী, মদগুর এব চ।
রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎস্যা
নিরামিষাঃ।।
অস্যার্থঃ- ইলিশ, খলসে, ভেটকী, মাগুর এবং
রুই- এই পাঁচরকম মাছ নিরামিষ। খেলে দোষ নেই!
সাথে, আরও জুড়ে
দিলেন:- কাঁচকলা দিয়ে রান্না করলে, সব রকম মাছই খাওয়া যায়!
বুঝুন! কি জাত বদমাশ বিধানদার
ঠাকুরমশাই! সব ভালো ভালো মাছগুলোকেই নিরামিষ বলে চালিয়ে দিলেন!!
তন্ত্রশাস্ত্র আরও সরেস! তাঁরা কী
বলেছেন বিধান দিতে গিয়ে!!!!!!
মৎস্য তিন প্রকার। উত্তম, মধ্যম ও অধম।
উত্তম মৎস্য= প্রায় কন্টক বিহীন।
মধ্যম মৎস্য= কিছু পরিমাণ কন্টক।
অধম মৎস্য= প্রচুর কন্টক হইলেও উত্তম
রূপে ভর্জিত হইলে অতীব উপাদেয়। মানেটা হলো, কাঁটা মাছ কড়কড়ে করে ভেজে খেতে পারো!
কী মৎস্যপ্রেম! কাউকে ছাড়া নেই! বাউন
বলে কথা!
বাউনদের খাওয়ার প্রতি লোভ এবং তাদের
বিধানদের ওপর একটু যদি নজর দেওয়া যায়, তবে দেখবেন- কী সুন্দর রাজনীতি এর
মধ্যে মিশে আছে।
এবার বিধানটা কী?
যে কোনো পূজোতে অব্রাহ্মণরা পক্কান্ন
দিতে পারবে না!
বেশ! তা না হয় হোলো!
এবার নৈয়ায়িকরা প্রশ্ন তুললেন- অন্নের
অর্থ সংকোচন পূর্বক তাহাকে পক্ক চাউলে (ভাত) পরিণত করা
হইয়াছে। কিন্তু, অন্নের অর্থ হইলো- যাহা কিছু, উদর পূর্ত্তি
করে, তাহাই অন্ন। উদর পরিতোষ বিনা কিভাবে পূজা সম্ভব?
বামুনরা নৈয়ায়িকদের বেশী ঘাঁটাল না।
তারা বললঃ-
কৃষরান্ন( খিচুড়ি) ও পক্ক চাউলে পূজা
নিবেদন করিতে পারিবে না। অপিচ( ইংরেজী- However এর
সমতুল্য) গোধূমপিষ্টক ( লুচি) সহ পরমান্ন (পায়েস) প্রদান করিতে
পারিবে।
নৈয়ায়িকদের মধ্যে বেশীর ভাগই বাউন।
তাঁরাও আর যুক্তি-তর্কের জাল বাড়ালেন না। এরই মধ্যে কিছু
নৈয়ায়িক মিউ মিউ করে বললেন- পরমান্ন, পক্কান্নের নামভেদ! সমস্যার সমাধান কী
রূপে হইবে?
উত্তরও এলো- চাউল যেহতু দুগ্ধে পক্ক, সে হেতু
প্রত্যব্যয় ( দোষ) নাই। কারন, দুগ্ধ গোমাতা হইতে প্রাপ্ত।
রাজনীতি এর মধ্যে কী? কিছুই না!
নিজের পয়সায় খিচুড়ি খাও আর পরের পয়সায় লুচি, পায়েস সাঁটাও! ব্যস্। খরচ হলে তোর হবে, আমার কী?
চালাকিটা ধরে ফেলে, কিছু নৈয়ায়িক
সংস্কৃত শ্লোক রচনা করলেনঃ-
পরান্নং প্রাপ্যে মূঢ়, মা প্রাণেষু
দয়াং কুরু।
পরান্নং দুর্ল্লভং লোকে, প্রাণাঃ
জন্মণি জন্মণি।।
অস্যার্থঃ- পরের অন্ন ( কেউ কাউকে
সহজে ডেকে খাওয়ায় না) এই পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। অতএব, হে মূর্খ! যত
পারো খাও! আর প্রাণ? সে তো জন্মজন্মান্তরেও পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে শুরু
করেছিলাম, তাই-রবীন্দ্রনাথের “জীবনস্মৃতি’ থেকে উদ্ধৃতি
দিচ্ছিঃ-
“আমাদের জলখাবার সম্বন্ধেও তাহার অত্যন্ত সংকোচ ছিল। আমরা খাইতে
বসিতাম। লুচি আমাদের সামনে একটা মোটা কাঠের বারকোশে রাশকরা থাকিত।
প্রথমে দুই-একখানি মাত্র লুচি যথেষ্ট উঁচু হইতে শুচিতা বাঁচাইয়া সে আমদের
পাতে বর্ষণ করিত। দেবলোকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতান্ত তপস্যার জোরে
যে-বর মানুষ আদায় করিয়া লয় সেই বরের মতো, লুচি কয় খানা
আমাদের পাতে আসিয়া পড়িত তাহাতে পরিবেশনকর্তার কুণ্ঠিত দক্ষিণহস্তের
দাক্ষিণ্য প্রকাশ পাইত না। তাহার পর ঈশ্বর প্রশ্ন করিত,আরো দিতে হইবে কিনা। আমি
জানিতাম, কোন্
উত্তরটি সর্বাপেক্ষা সদুত্তর বলিয়া তাহার কাছে গণ্য হইবে। তাহাকে
বঞ্চিত করিয়া দ্বিতীয়বার লুচি চাহিতে আমার ইচ্ছা করিত না। বাজার হইতে আমাদের
জন্য বরাদ্দমত জলখাবার কিনিবার পয়সা ঈশ্বর পাইত। আমরা কী খাইতে চাই
প্রতিদিন সে তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইত। জানিতাম, সস্তা জিনিস
ফরমাশ করিলে সে খুশি হইবে। কখনো মুড়ি প্রভৃতি লঘুপথ্য, কখনো-বা
ছোলাসিদ্ধ চিনাবাদাম-ভাজা প্রভৃতি অপথ্য আদেশ করিতাম। দেখিতাম, শাস্ত্রবিধি
আচারতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে ঠিক সূক্ষ্মবিচারে তাহার উৎসাহ যেমন প্রবল
ছিল, আমাদের
পথ্যাপথ্য সম্বন্ধে ঠিক তেমনটি ছিল না।’
তাহলেই বুঝুন! কী কেলোর কীর্ত্তি!!!!!!!!!
আরে বাপু খাবি তো খা না! কে বারণ
করেছে? পয়সাও
মারবি, বিনে
পয়সায় খাবি, আবার বড় বড় বাতেলাও মারবি, এটা কি ঠিক?
এবার দেখা যাক, সংস্কৃত
সাহিত্যে খাবারের কী রকম বর্ণণা আছে! সাহিত্য তো আর খাবার ছাড়া হয় না।
প্রেমও খাবার ছাড়া হয় না! আজকাল প্রেম করতে গেলেও একটা রেস্তোঁরায় বসতে হয়!
প্রেম- সাহিত্য- খাবার, এটা ত্রিকোণ!
যাবে কোথায় বাছা? আড্ডা মারতে গেলেও খাবার! এই যে পলার বাড়ীতে আড্ডা
মেরে এলাম, সেদিন! সেখানেও তো এক কিলো চাউমিনে, এক কিলো চিলি
চিকেন আর গোটা দশেক সন্দেশ সাঁটিয়ে এলাম! সবাই আড্ডা মারবে কি! ওরা আমার
খাওয়া দেখতেই ব্যস্ত! জল টল খেয়ে মনে হলো- নাঃ! এবার বোধহয় পেটে কিছু
দানাপানি পড়েছে!!!!!!!
নাম বলবো না! বললেই ক্ষেপে যাবে! এই
তো সেদিন-সল্ট লেকের ভজহরি মান্নাতে, একজন আমায়
হেব্বী খাওয়ালো! আমার খাওয়ার সময় রেস্তোঁরার লোকগুলো কেমন যেন সন্দেহের চোখে
তাকাচ্ছিল!
একজন ওয়েটার তো আর এক ওয়েটারকে ফিসফিস
করে বলেই ফেল্লো- শুনেছিলাম- ভীম নাকি বক রাক্ষসকে মেরে ফেলেছে!!!!!!
কোথায়? এই তো
সে!!!!!! এই লোকটা চলে গেলে মালিক কে বলে দোকান বন্ধ করে দে! আর তো খাবার নেই!
যাক! আসল কথায় আসি! আজকাল মাঝে মাঝে
একটু বেলাইন হয়ে যাই আর কি!!!!!!
খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে- দুজন বড়
মাপের বাঙালী কবি বিরাট বিরাট সংস্কৃত কাব্য লিখেছিলেন।
এঁদের মধ্যে একজন- কবিকর্ণপূর
পরমানন্দ সেন। বাড়ী – কাঞ্চনপল্লীতে মানে আজকাল যাকে কাঁচরাপাড়া
বলে। বিরাট বড়লোকের ছেলে আর খুব গুণী( বদ্যিরা এরকমই হয়)।
“শ্রীশ্রীকৃষ্ণাহ্নিক- কৌমুদী’ নামে একটা
কাব্য লিখেছিলেন। এই কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে ৮৫ থেকে ১১৮ শ্লোকে
বসন্ততিলক আর পুষ্পিতাগ্রা ছন্দে শ্রী রাধার – রান্নার
মনোরম বর্ণণা আছে।
আর একজন লেখক হলেন- শ্রী কৃষ্ণদাস
কবিরাজ। এনার লেখা বইটির নাম হলো- “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ এবং “গোবিন্দলীলামৃত’।
এই “গোবিন্দলীলামৃত’ তেই
নানাধরণের খাবারের বর্ণণা আর রান্নার প্রণালী দেওয়া আছে।
তবে, শ্রী
কৃষ্ণদাস কবিরাজ বেশ কিছুদিন বৃন্দাবনে থাকার ফলে একটু কম বর্ণণা দেওয়া আছে।
কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন বাংলাতে বসে লিখেছিলেন বলে বর্ণণাটা বেশ বিস্তৃত।
কবিকর্ণপুর বাথুয়া ( বাস্তুক), নটে ( মারিষ), নতির পত্র(
পটলশাক) কলায়লতার শাক( কলায়বল্লী শিখা), ছোলার শাকের
কচি ডগা ( চনকাগ্র শিখা), মটরশিখা, কোমল লাউডগা ( তুম্বিশিখা) আর পদিনার শাকের কথা উল্লেখ করেছেন-
৮৭ নং শ্লোকে। এই শাকগুলো নাকি শ্রীরাধা, শ্রীকৃষ্ণের
জন্য ভালো সরষের তেলে ভেজেছিলেন ( ওই সরষের তেলটা আর পাওয়া যায় না বলে- আজকাল
চারিদিকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা, ব্রততীঞ্চ সব
কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন)।
আমি নিজে পদিনার চাটনী খেয়েছি, কিন্তু পদিনা
শাকভাজা আমার নিজের রাধা কোনোদিন ভেজে খাওয়ান নি! পড়ে বলেছিলাম, রান্না করতে!
তা! যা প্রতিক্রিয়া হলো! যাক! অন্য দশ কথা এসে পড়বে!
ছোলার শাক আর মটর শাকের যে ঘন্ট হতে
পারে, সে
কথা কিন্তু কবিকর্ণপুর বলেন নি! শ্রীকৃষ্ণ কি ঘন্ট খেতেন না? কে
জানে!!!!!! ঘন্ট খেলে যদি শ্রীরাধার প্রেম উবে যায়! তা হলেই তো
ঘন্ট ঘেঁটে যাবে।
আমার শ্রীরাধা কিন্তু যে কোনো শাকই
বড়ই ভালো রাঁধেন। এক থাল ভাত উড়ে যায় খালি ওই শাক দিয়ে।
কবিরাজ গোস্বামী আবার পাকা তেঁতুলের
রস দিয়ে কলমি শাক, আর কাঁচা আম দিয়ে কালো নালতে পাতা রাঁধার কথাও বলেছেন।
এ ভাবে আমি খেয়েছি- উল্লুস!!!!!! জিভে
জল এসে, কী
বোর্ড পুরো ভিজে গেল।
কিন্তু, এই দুই কবির
লেখাতে- পুঁই, পালং, মূলোর শাকের কথা পাই নি! কে জানে কেন!!!!! কবিরা কি
এই শাকগুলো খেতে ভালোবাসতেন না! নাকি শ্রীকৃষ্ণের দৈববাণী হয়েছিল- বুঝলে
হে- আমি ওই সব শাক খাই না! তাই লিখো না।
এবার আসি ভাজার কথায়!
ভাজার কথা বলতে গিয়ে কবি কর্ণপুর
লিখেছেন ( শ্রীরাধা প্রেমে ভাজা ভাজা হয়েছিলেন কিনা!) – ( গোবিন্দলীলামৃত-৩.৯২-৯৩)
“বার্তাকু সূরণক মানক কর্করোথৈ
রম্ভামুঘোত্থ কণিশৈঃ কচুভিঃ পটোলৈঃ।
কুষ্মাণ্ডকৈর্লবলবৈঃ শিতসূচিরাজী
বেধেন নীরসতমৈর্বিবিধাহ্স ভাজী।।’
—————-
বার্তাকু= বেগুন। সূরণক= ওল। মানক=
মান। কর্করোথ= কাঁকরোল।
রম্ভামুঘোত্থ = গর্ভমোচার ছোট ছোট
কাঁচা কলা। পটোলৈঃ= পটল। কুষ্মাণ্ড= চালকুমড়ো।
এই আনাজগুলো ছোট ছোট করে কেটে ( কী
ধৈর্য্য!!!!!! প্রেমে অধৈর্য্য হলে হয় না, এটাই বোধহয়
কবি কর্ণপুর বোঝাতে চেয়েছেন!) সরু সূঁচ দিয়ে বিঁধিয়ে ভেতরের রস গুলো বের করে
নিতে হবে। এরপর ডালের বেসনে চুবিয়ে সেগুলো সরষের তেলে ভাজতে হবে। এটা
অবশ্য কবিরাজ গোস্বামীর বিধান।
সেই সময়ে আলু পাওয়া যেত না। গোল আলু-
যেটা এখন আমরা খাই, সেটা টমাস রো জাহাঙ্গীরের সময় ভারতে এনেছিলেন। তাই
বিভিন্ন শ্লোকে যে “আলুক’ কথাটা আছে সেটা রাঙ্গা আলু বলে ধরতে হবে বলে
গবেষকরা একমত।
কবিরাজ গোস্বামী, “ডিঙ্গিশ’( ঢ্যঁ¡ড়শ) চাকা চাকা করে কেটে ডালের বেসনে চুবিয়ে ঘিয়ে ভাজার কথা
বারবার বলেছেন।
প্রেমের যে কত লাফড়া! উফস্।
রান্নাঘরেই যদি সময়টা গেল, তবে প্রেমটা করবে কখন? যাক! ওনাদের
ব্যাপার, ওনারা
বুঝবেন! আমরা বরং সেই রান্নার রেসিপি গুলো দেখে নি!
একাল হলে, টিভিতে একটা
প্রোগ্রাম করিয়ে নেওয়া হত, শ্রীরাধাকে নিয়ে! টি. আর.পি-র জন্য ভাবতে হতো
না!!!!!! বকফুলভাজা নাকি- শ্রীকৃষ্ণের খুব প্রিয় ছিল! শ্রীরাধাকে তো
শেষমেষ “বক’- ই তো
দেখিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। মানে, আজকের ভাষায় যাকে বলে- হাফসোল।
বকফুলকে সংস্কৃতে, কাঞ্চনকলিকা
বলে। শ্রী রাধা, বকফুলকে ঘিয়ে ভেজে টক দইতে ভিজিয়ে, নুন-লংকা
মিশিয়ে একরকম “ডিস’ তৈরী করেছিলেন। আমি টেষ্ট করেছি! দারুণ খেতে!
আপনারাও ” টেরাই’ করতে পারেন।
কাসুন্দি, আদা- বাটা, নারকেল-বাটা দিয়ে কাঁঠালের বিচিও ” টেরাই’ করতে পারেন। “নতি পত্র’ মানে নলতে
পাতার শুক্তুনির রেসিপি চাই!!!!! কুছ পরোয়া নেহি!
“যস্মিন্ প্রতপ্ত-কটু তৈল্যা-তিক্তপত্রীঃ।
সৎকাসমর্দদলিতার্দ্রক-সাধুমৈত্রীঃ।।’
কাসুন্দি, মিহি করে আদা
বাটা দিয়ে , নলতে পাতাকে ম্যারিনেট করতে হবে। তারপর সরষের তেল গরম করে
ছেড়ে দিয়ে, নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন। অহো!!!! কী “সাধুমৈত্রীঃ’- অর্থাৎ, কাসুন্দি, মিহি করে আদা
বাটা, সরষের
তেল আর নলতে পাতার কী অসাধারণ বন্ধুত্ত্ব!!!!!
এবার দেখি, শ্রী রাধা, আর কী কী
বানিয়েছিলেন! শ্রীকৃষ্ণ আসছেন- প্রেমটা একটু মাখো মাখো করতে হবে
না? মাখো
মাখো করতে গেলে তো দুধের দরকার! শ্রীরাধা, দুগ্ধালাবু
বা দুধলাউ তৈরী করতে বসলেন।
সৌস্মেণ জীরকং- নিভং পরিকৃত্য তুম্বীং
সিদ্ধাঞ্জকেন পয়সা চ নিধায় কম্বীম্।
আলোড্য দত্তঘনসারমপাচি দুগ্ধাহ-
লাবুঃ সিতামরিচ জীরক হিঙ্গুমুগ্ধাঃ।।
———–
লাউকে জিরের দানার মত ঝিরিঝিরি করে
কেটে, জল
এবং দুধ মিশিয়ে সেদ্ধ করবে, আর সেদ্ধ করার সময় বারবার হাতা দিয়ে নাড়তে হবে। তারপর, কর্পূর, চিনি, মরিচ, জিরা, হিং দিয়ে ঘন
হয়ে গেলে নামিয়ে নেবে।
তবে কবিরাজ গোস্বামী হিং দিতে কিন্তু
বলেন নি। এটার নাম তিনি দিয়েছিলেন- দুগ্ধতুম্বী ( তুম্বী= লাউ)। এরপর, শ্রীরাধার
মনে হলো- নাঃ! কম পড়ে যাচ্ছে!!!! আবার তিনি কচি মোচা কেটে ,” মরিচাঘ্য’ রাঁধতে
বসলেন। মোচার ছোটো ছোটো শস্য গুলো ঝিরি ঝিরি কেটে জলে ডুবিয়ে খানিকক্ষণ রেখে
দিলেন। তারপর, দুধ, মরিচ আর হিং দিয়ে ঘন ঘন নেড়ে ফুটে গেলে নামিয়ে রেখে
ঠাণ্ডা হতে দিলেন।
কবিরাজ গোস্বামী হিং দিতে এখানেও বলেন
নি! শ্রীকৃষ্ণ হিং ভালোবাসতেন কিনা জানা যায় না, তবে কবিরাজ
গোস্বামী হিং ভালোবাসতেন না- এটা পরিস্কার! এত কিছু করে, শ্রীরাধার
মনে হলো, এবার
কিছু “অম্ল’ বা টক তৈরী
করতে হবে। আজকাল হলে শ্রীকৃষ্ণ এত কিছু খাবার পর জেলুসিল খেতেন! কিন্তু, তখন তো ওসব পাওয়া
যেত না! দেখি! শ্রীরাধা কী কী রাঁধলেন!!
পাকা কুমড়ো খণ্ড খণ্ড করে কেটে, সরষের তেলে
ভেজে নিয়ে – ঘোল ( তক্র), আদা (আর্দ্রক), মৌরী ( মৌরিকা) ও হিং (হিঙ্গু) দিয়ে
মিশিয়ে রাখলেন। তারপর ছানা আর মুগের বড়া দিয়ে পরিবেশন।
মূলা, পাকা চালতা
চাকা চাকা করে কেটে, তক্র, গুড় এবং ভব্যখণ্ড ( পাকা তেঁতুল) দিয়ে আর রকম “অম্ল’।
মিষ্টি পাকা আম, জলে ভালো করে
মেখে- তারপর আদাবাটা, চিনি আর দুধ!
এরকম আরও বারো রকম “অম্ল’ র বর্ণণা
পাওয়া যায়! এদের আবার মোট তিন রকমের ভাগও রয়েছে!
ঈষদম্ল( অল্প টক)
মধুরাম্ল ( মিষ্টি টক)
মধ্যাম্ল ( মাঝামাঝি টক)
“চিধ্যাম্রাতকচুক্রাম্রৈস্তত্তদ্ ব্যাদিযোগতঃ।
ঈষন্মধুরগাঢ়াম্লভেদাম্ল দ্বিষড়বিধঃ।।’
অর্থঃ- তেঁতুল,আমড়া,আমরুল ও আম এই চার রকমের
টক, মুগের
বড়ার সাথে মিলিয়ে বারো রকমের টক হত!
কিছু বুঝতে পারছেন? কোথায় লাগে
আজকালকার বোতোলবন্দী সব সফ্ট ড্রিংকস?!!!!!!!!!!!!!
শেষে আসি মিষ্টির কথায়! যাকে বলে, মধুরেণ
সমাপয়েৎ।
এই দুই কাব্যে- শাক, ভাজা, তরকারি, ডাল, টক ছাড়াও, নানা রকমের
পিঠে আর পায়েসের বর্ণণাও আছে। পিঠেগুলোর নাম ভারী সুন্দর, কিন্তু সব
সময় এর রেসিপি আমরা পাই না! ( কী দুঃক্কু!) কয়েকটা পিঠের নাম বলছি!
হংসকেলি
শোভারিকা
বেণী
চন্দ্রকান্তি
ললিতা! ( মাননীয় মান্না দে, আমার মনে হয়, এই পিঠেটা
খেয়েছিলেন, না হলে ওই বিখ্যাত গানটা হতো না)
চিত্রা
কর্পূরকেলি
অমৃতকেলি
এখন আমরা যে মিষ্টিগুলো খাই, চারশ বছর
আগেও সেই মিষ্টিগুলো ছিল!
“জীলাবিকা মউহরি পুরু পূপগূজা
নাড়ীচয়াঃ কৃত সরস্বতি* কাদি পূজাঃ।
খর্চুরদাড়িমক শর্করপালমুক্তা
লাড্ডুৎকরান্ বিধতি রেহত
কলাভিযুক্তাঃ।।’
(*সরস্বতি- এই বানানটা সম্বোধনে বলে- ই কার হয়েছে)
জীলাবিকা=জিলিপি
পুরু= পুরী ( আটার তৈরী)
গূজা= গজা/ গুজিয়া
খর্চুর= খইচুর
দাড়িমক= কদমা ( মনে হয়)
যাই হোক, এবার বুইলেন
তো!!!!!!!!! প্রেমের কী ল্যাঠা!!!!!!! খাও আর খেয়ে যাও! তারপর প্রেম করো!
শেষে ওই বিখ্যাত কবিতাটার দুই লাইন
বলি!
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ভরে মনটা
খাও তবে কচুপোড়া, খাও তবে
ঘণ্টা!
সমাপ্ত
ঋণঃ- উদ্বোধন শতাব্দী জয়ন্তী সঙ্কলনে, বিমান বিহারী
মুখোপাধ্যায়ের রচনাঃ- সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলার খাবার।
No comments:
Post a Comment