Friday, August 29, 2014

পঞ্চানন

কোলকাতার নন্দনে চলছে- ক্ষুদ্র পত্রিকা মেলা,২০১৪ । চারিদিকে আলো, হইহই, হরিপদর চা, সারি সারি ষ্টলে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকা । লোকজনের আনাগোনা ।

একটু খোলামেলা জায়গায় এসে বসলাম, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ।

হঠাৎ মনে হলো, চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এলো । সব আলো, হইহই নিমেষে উধাও।
শুধু সামনে, কয়েকটা চেয়ার পড়ে আছে । বুঝতে পারছি না, কি হচ্ছে ?

আমি কি অসুস্থ বোধ করছি, নাকি মরে যাচ্ছি !!!!!!!

এমন সময়ে একজন, মলিন ধূতি / কামিজ পরা এক আধা বয়েসী ভদ্রলোক সামনের চেয়ারে এসে বসলেন ।

বাঁ হাতে, যেভাবে ইলিশ মাছ দড়ি দিয়ে ঝোলায়, ঠিক সেই ভাবে দুটো লম্বা পাবদা মাছ আছে আর বড় বড় দুটো পেঁয়াজ কলি ।

চিনতে না পেরে, অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

মনের ভাবটা বুঝতে পারলেন বোধহয় ভদ্রলোক ।

- আমাকে তো দেখো নি হে তাই চিনতে পারছো না !!! দেখবেই বা কি করে !! সেই ইংরেজি ১৮০৪ সালে মারা গেছিলাম ।
- আপনার নামটা বলবেন কি দয়া করে ?
- নাম বললে, চিনবে কি !!!! আজকাল তো কেউ চেনেই না !!! অথচ এই যে মেলা হচ্ছে, তার জন্য আমার কিছু অবদান আছে বৈকি !!
- আহা, নামটা বলুন না, তারপর দেখা যাক, চিনতে পারি কিনা !
- আমার নাম, পঞ্চানন কর্মকার ।
- নামটা শোনা শোনা লাগছে !!! আপনার নিবাস ?
- হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে। আমার পূর্বপুরুষ পেশায় ছিলেন কর্মকার বা লৌহজীবি। কিন্তু বেশ কয়েক পুরুষ আগে আমরা ছিলাম লিপিকার। তামার পাতে, অস্ত্রশস্ত্রে অলঙ্করণ বা নামাঙ্কনের কাজে পূর্বপুরুষরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। আমিও পূর্বপুরুষদের এই শিল্পবৃত্তির গুনপনা পাই। পূর্বপুরুষেরা প্রথমে ছিলেন হুগলী জেলার জিরাট বলাগড়ের অধিবাসী, পরে ত্রিবেণীতে গিয়ে বসবাস শুরু।
- বাপরে !!! এতো লম্বা ইতিহাস ? তাও ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনার সঠিক পরিচয় ।
- ওই যে বললুম, আমাদের আর কে চেনে ? বলি, উইলিয়াম কেরীর নাম শুনেছো?
- শুনবো না !!! কি যে বলেন !
- সায়েবের নাম বলাতে চিনলে ? আমি সেই পঞ্চানন কর্মকার, যে...
- যে ?
- ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স যখন হুগলীতে নাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেডের লেখা এ গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ বইটি মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখন আমিই প্রথম আমার প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে বাংলা হরফ প্রস্তুতের কাজে উইলকিন্স কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। 

- আচ্ছা, আচ্ছা- মনে পড়েছে !!! দিন দিন, পায়ের ধুলো দিন !
- থাক! আর আদিখ্যেতা করতে হবে না !! ঢের হয়েছে ।
- আরে রাগ করেন কেন ? আপনি না থাকলে এই সব কখনও হতো ?

- ছাপার জন্য ছেনিকাটা, ঢালাই করা চলনশীল বা বিচল যে ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়, তা উইলকিন্স এবং আমার যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছিলো। 

১৭৭৯ সালে তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের উৎসাহে উইলকিন্সের পরিচালনাধীনে কলিকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছাপাখানায় আমি কাজ শুরু করি। 


১৭৮৫ সালে পুরোদমে এই সরকারি ছাপাখানা চালু ছিল,আমি সেখানে কাজ করতাম। হরফ নির্মাণের কলাকৌশল আমি না থাকলে সায়েবরা করতেই পারতো না। 

আমি মারা যাবার আগে, জামাই মনোহর কর্মকারকে সমস্ত জ্ঞান ও কলাকৌশল শিখিয়ে যাই । 


- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে । তা, এই খানে কেন আপনি ?

- একটা কথা বলতে এলাম । আমার শ্রীরামপুরের বাড়ীটা ভেঙ্গে একটা রাজার প্রাসাদ তৈরী করেছে । তোমরা যাকে এখন ফ্ল্যাট বাড়ী বলো । ওটা ঠিক নিউ গেট ষ্ট্রীটে পঞ্চানন সিঙ্গির বাড়ীর উল্টোদিকে ।

এই ব্যাপারে তোমরা একটু প্রচার করো বাপু । এই বসত বাড়ীটা অনেক কষ্টে তৈরি করেছিলাম ।

- নিশ্চয়ই বলবো !!! কাজ হবে কিনা জানি না !

- ঠিক আছে, ভাই আমি চলি এখন । মনোহর এয়েচে । ও আবার পেঁয়াজকলি দিয়ে পাবদা মাছ ভালো বাসে । বৌ রাঁধবে বলে বসে আছে ।

আঁধার চলে গেল । হরিপদ বলল লেবু না দুধ চা ?

No comments: