Sunday, November 9, 2014

সকাল

তখন সকাল পৌনে সাতটা হবে । উনি এসে বললেন:- একজন ডাকছেন তোমাকে ।

কে ?

চিনি না

লুঙ্গি সামলে গিয়ে দেখি একজন চেনা অথচ অচেনা মানুষ ।

এক গাল হেসে বলল ;- আজ যান নি হরির দোকানে?

না- ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল আজ । এই যাবো ! ভেতরে এসে বসুন

আমার নাম নীলিম গঙ্গোপাধ্যায় । আমি তো হরির দোকানে খানিক বসে আপনার বাড়ী এলাম, হরির দোকানে আড্ডা মারতে ।

কোনো রকমে হাত মুখ ধুয়ে, একটা হাফ হাতা পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে রওনা দিলাম, দোকানে ।

মাত্র বছর খানেক হলো অবসর নিয়েছে ব্যাংকের চাকরি থেকে । বাগুইআটি, কেষ্টপুরে থাকে ।
গান বাজনা, লেখালেখিও করে ।

ছুটির দিন বলে রিক্সা ষ্টাণ্ড ফাঁকা তখনও ।
 প্রথমেই এলো রতন ।
কি রে ! আজ দেরি কেন ?

আর কি করবো? আজ ছুটির দিনে প্রাণে লাইফ নাই ।
বেঁটে নীলু- পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান । গামছার ওপর একটা গেঞ্জি পরে এসেছে চা খেতে । অনেক দিন ধরে বলছি, আমার বেড সুইচটা পাল্টাতে ।
দেখেই রেগে বললাম – তোর বড় বাড় বেড়েছে, এত ডাকছি, তাও আসছিস না  ।

আমার বার আর কোথায় ?
মানে ?
সব বারই তো আপনার । রবি থেকে শুরু করে  শনি পর্যন্ত ।  সবার মাঝে গালি দিচ্ছেন- আমার পিষ্টিজ নেই ?

ইয়ার মাছওয়ালা এসে বসল, গামছায় মুখ মুছে । খড়িবাড়ী থেকে সাইকেল চালিয়ে আসে । এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট লাগে আসতে ।

আমরা বলি নিউ টাউন- ওরা বলে ঘুনের ভেড়ী ।  ওখানকার ভেড়ী থেকেই মাছ আনে।
কেষ্টপুর খালের মাছ নোংরা জলের মাছ, খেতে “টেস” নেই । জোয়ারের মাছ নয় ।
নীলিমের ওঠার সময় হয়ে গেল ।
মঞ্চে এক আখওয়ালার প্রবেশ তখন ।
 দাঁত পরি গেসে, এখন আর পয়সা দিয়ে  ঠোঁট ছিড়ি, আখ খাবো কেনে ? রস করি দেলে খাবো নে ।

------
এই ভাবেই শুরু হলো আজকের দিনটা ।


Friday, November 7, 2014

ওধুয়া

ওধুয়া- বলে একটা গ্রাম আছে ঝাড়খণ্ডে । জায়গাটা তখন বিহারে ছিল । পশ্চিমবঙের লাগোয়া বলতে গেলে ।
মালদার মাণিকচক বা বিহারের রাজমহল হয়ে যাওয়া যেত সেই গ্রামে ।
মায়ের বাবা তখন ওখানে ডাক্তারি করতেন, দেশ ভাগ হবার পর ।
হিন্দু, মুসলমান সবাই মিলে মিশে থাকতো । হিন্দি বাংলা দুটোই চলত কথ্য ভাষা হিসেবে।
যে বাড়ীতে থাকতাম, তার পাশ দিয়েই গঙ্গা নদীর চওড়া বুক । রাতের বেলা কান পাতলে জলের ছলাৎ ছলাৎ শোনা যেত ।
মাছ ধরার জেলে নৌকো থেকে আস্তে ভেসে আসতো সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত ছবি নাগিনের গান মন ডোলে রে ।
কলের গানে বাজতো আরও হিন্দি গান- ৭৮ আর পি এম রেকর্ডে । একটু দূরেই ছিল একটা ভাঙা ব্রিজ ।
বলা হতো ওটা মোঘল আমলে তৈরি, রাজমহলের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য ।
তা, ঐ ভাঙা ব্রীজের ওপর দিয়ে নাকি ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যেত গভীর রাতে । লোকের ভয় ছিল ।
মাঝে মাঝে চীৎকার হত উর্দু ভাষায় ।
ভয়ে সিঁটকে , চোখ খুলে চাইতে পারতাম না লণ্ঠনের আলোয় ভরা গঙ্গা মুখী বারান্দার দিকে । মায়ের পাশে চুপ করে শুয়ে থাকতাম । মা পাখা নেড়ে হাওয়া করতো আমায় ।
আমার মেজোমামা ছিলেন দাদুর কম্পাউণ্ডার । ওধুয়ার হাটখোলাতে সোনার দোকান ছিল ভগীরথ মামার ।
মেজোমামার হাত ধরে , ভগীরথ মামার দোকানে যেতাম ।
ভারি পয়সাওয়ালা লোক তারা । বাড়ীতে, ইয়া বড় একটা রেডিও আর চোং লাগানো কলের গান ছিল ।
বিশাল দুটো উঁচু বাঁশ দু দিকে পোঁতা । মধ্যে খানে ঝুলতো তামার পাক খাওয়া তার।
তারটা বাঁধা থাকতো দুটো শামুকের খোলের মত দেখতে সাদা পোরসিলিনের ছোট খোপ ওয়ালা জিনিসের সঙ্গে । ও দুটো আবার দড়ি দিয়ে বাঁধা, বাঁশ গুলোর সাথে ।
তামার তারের মাঝখানে জোড়া একটা কালো তার নেমে সেঁধিয়ে যেত রেডিওতে । এটার পোষাকী নাম ছিল এরিয়াল । আজকালকার অ্যান্টেনার ছোট ভাই।
বলা হতো- যত উঁচুতে থাকবে এরিয়েল- তত ভালো রিসেপশান হবে রেডিওতে ।
কত যে গান বাজনা শুনতাম ।
ছুটি ফুরিয়ে গেলে গরুর গাড়ী চেপে আসতাম মায়ের সঙ্গে রাজমহল ষ্টেশনে।
সেখান থেকে দু বার ট্রেন বদল করে ওডিশার পারলাখেমুণ্ডিতে বাবার কাছে।
মেজোমামা পৌঁছে দিয়ে একদিন বাদেই ফিরে যেতো ওধুয়ায় , না হলে একা দাদুর কষ্ট হবে ।
বাবা একবার জন্মদিনে আমায় একটা রুপোর টাকা দিয়েছিলেন- রাজার মুখ খোদাই করা ।

কোথায় যে হারিয়ে গেল সেটা ! এখন শুধু স্মৃতি সেই টাকা আর পায়েস খাওয়া

সংস্কৃত বলার বিপদ



আমি যে সময়ে মালদায় থাকতাম, সেই সময়ে গৌড় আদিনা দেখানোর গাইড ছিল না- এখনও নেই বোধহয় ।
মালদায় ট্যুরিষ্ট লজের ম্যানেজার বাবু, বিদেশী সাহেব এলেই এই অধমকে সেলাম দিতেন- গাইড হওয়ার জন্য ।
তা, খারাপ লাগতো না !!! আমার ফ্রেঞ্চ ইংরেজীতে যা পারতাম , আপ্রাণ ভাবে চেষ্টা চালাতাম, ওদের বোঝানোর ।
আর প্রশ্নের পর প্রশ্ন । যতটা পারতাম, উত্তর দিতাম ।
টাকা পয়সা তো মিলতই তার ওপর খ্যাঁটন আর বিলেইতি কারণ বারি ।
ম্যারিকান ইংরেজী বলা খুব সোজা ! নাকী সুরে বাংলা উচ্চারণে ইংরেজী বললেই হল। ওদের গুলো বোঝা যেত না সহজে ।
একবার এই রকমই ডাক পড়লো ।
গিয়ে দেখি দুই সাহেব । আমার কাছে, সব সাহেবই এক লাগতো দেখতে । তবে, এদের উচ্চারণটা বোঝা যাচ্ছিল । একজন বয়স্ক, আরেকজন তুলনায় কম বয়েসী ।
রওয়ানা দিলাম । দেখাতে দেখাতে চলেছি । মাঝে দু একটা সংস্কৃত শ্লোক ।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বয়স্ক সাহেবটা বলল :- ইট সিম্স্ ইউ নো সানস্ক্রিট‌ !!!
আম্মো ভাবলাম :- সায়েবরা আর সংস্কৃত কি বুঝবে ?
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আমার উত্তর :- ইয়া ইয়া ! সিওর !
তারপরই- বিনা মেঘে বজ্রপাত !
দেন লেট আস টক্ ইন‌ সানস্ক্রিট্ , হোয়াই ইন ইংলিশ ?
কিভাবে যে সামলেছিলাম------ ভগাই জানে !
=======
পরে জেনেছিলাম- বয়স্ক মুশকো সাহেবটি জার্মান এবং তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের ডিন্ আর ছোটটি অধ্যাপক সংস্কৃতের ।
তার পর থেকে আর সংস্কৃত নিয়ে কথা বলি না !

মাত্থা খারাপ ?

এখন ভোর

ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে যায় আমার । আর বিছানায় ভালো লাগে না । আগে যেমন ঘুমের রেশ কাটতোই না, এখন সেটা একেবারেই অনুপস্থিত ।

হাফহাতা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরণে, পায়ে চপ্পল সেঁধিয়ে বেরিয়ে পরি, হরির দোকানের উদ্দেশ্যে ।

গলির চারপাশের বাড়ী থেকে ভেসে আসে রান্নার সুবাস । পাঁচফোড়ন, হলুদ, সরষের তেল, পেঁয়াজ, রসুন- সব মিলিয়ে একটা ফিউশন ।

ভ্যানগাড়ীতে ভর্তি হয়ে চলেছে- শাক, সব্জী বিভিন্ন বাজারের দিকে ।
ভাঙড় থেকে সাইকেল চালিয়ে পাতিপুকুর গিয়ে মাছ নিয়ে আসে ইয়ার আর আসলাম।
গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে- হরিকে চা দিতে বলে ।
পরপর ছুটি গেছে বলে, আজ রিক্সা চালকদের ব্যস্ততা তুঙ্গে । ষ্টাণ্ডে বারোখানা রিক্সার প্রত্যেকটা খালি খেপ খেটে যাচ্ছে, বিবেকানন্দ পল্লী থেকে নাগের বাজার বা সাতগাছি।
বেশীর ভাগই স্কুলের ভাড়া ।  অনেকের আবার পুল কার বা স্কুলের বাস আসে গলির মুখে ।

সদ্য ঘুম ভাঙা বাচ্চা গুলো , পিঠে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ে রিক্সা বা গাড়ীতে ।  আব্দার করে , টফি- বিস্কুট- বা কেকের জন্য ।
কিনে দিয়ে হাতে দিলে ওদের মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির আভা ।
হাপ বয়েল ডিমের সাদা অংশের মত আকাশে টুকরো মেঘ । তার গায়ে আঁকিবুকি কেটে উড়ে যাচ্ছে যন্ত্রপাখি ।
কয়েকডজন শালিক আর চড়ুই ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ে খাবার খোঁজে ।
 খাবার আমরাও খুঁটে খাই ওই পাখীদের মত ।

মনের সব কালিমা দূর হয় হয় – এমন সময়ে হরির চায়ের ফার্ষ্ট ইন্সটলমেন্ট হাজির গেলাসে চড়ে ।

শুরু হয়- বিরাটের বিরাটত্বের বাড়াবাড়ি ।

এক ধাক্কায়ে বাস্তবের মাটিতে ।





পাল বনাম সাহা

আমি, এবার থেকে পণ করেই ফেলেছি- বেশী রাস্তাঘাটে বেরুবো না !!!
বিশেষ করে সন্ধের দিকে ।
বেরুলেই ঘটনার ছড়াছড়ি চোখে পড়বেই , আর এমনি কপাল যে তার মধ্যস্থতা; আমাকেই করতে হবে ?
নাগের বাজার মোড়েই দেখেছিলাম- রঘু পাল, ফটিক পাল, পঞ্চু সাহা আর পলু সাহা, গুরুদেবের আশ্রম থেকে বেরিয়ে; টলমল করতে করতে আসছে সাতগাছি মোড়ের দিকে ।
আমার অন্য একজনের সঙ্গে দেখা বাবুতলার কাছে । কুশল বিনিময় কালীনই দেখলাম, ওরা চারজন খুব জোরে জোরে কথা বলে হাঁটছে ।
সাতগাছি মোড়ে দুলালের দোকানে সিগারেট কেনার সময়, ওরা আমায় দেখে ফেলল।
পলু সাহা আমাকে মোড়ে, ঐ ভীড়ের মধ্যে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করছে :-

ক ক ক কয়েন দেহি, রা রা রামকিসনোদা !!!
কি ?
পাল বড়ো না সাহা বড় ?
মুশকিল !‍ !!! আমি জানবো কি করে ?
না না‍!‍ এ এ এর একটা বিহিত করণ লাগে- রঘু পাল মরীয়া !!
পঞ্চু সাহাও নাছোড় বান্দা !!! আরম্ভ করলো :-
কি কি কি বিহিত করণের আসে ক দেহি !!! আমাগো- ম্যাঘনাদ সাহা, বি বি বিজ্ঞানী !!! আরতী সাহা সাঁতরাইয়া স স সমুদ্র পাড়ি দেছিল !!!! কোলকাতার বি বি বি.কে সাহা পুলিশ কমিশনার আছিল । তোগো পালেরা কি আছিল ?
এবার আসরে, ফটিক পাল আমাগো পালেরা নাই ?
না নাই !
পালেরা নাই ?
ক ক কইলাম তো, নাই !!!
তোগো বি কে সাহা, কার আণ্ডারে কাম করতো, ক দেহি !!!
কার ?
হঃ !!! জানে না , আবার বড় বড় কথা কয় !!!
কি কইলাম ?
ওই যে সাহা- রা বড় !!
বড়ই তো !!
তইলে শোন !! বি কে সাহা কাম করতো কার আণ্ডারে !!!
কার !!

রাইজ্য পাল !!!! হুঃ !!

Wednesday, November 5, 2014

রঘুদাস পাল





পাড়ার রঘুকে নিয়ে লিখলে, মহাভারত হয়ে যাবে । আমাদের হরির দাদা- রঘু । না, ডাকাত নয়, তবে মাতাল ।

নাগেরবাজার – হাওড়া রুটে মিনি বাস চালাতে দেখছি, গত আঠেরো বছর ধরে । ষ্টিয়ারিং ধরলে- একটুও মদ খায় না । বলে- গুরুর বারণ ।

দুরন্ত গাড়ী চালায় রঘু । এই তল্লাটে এই রকম মিডিয়াম ভেহিকল চালানোর লোক খুব কমই আছে ।
এমনিতে, বিনয়ী- ভদ্র- কম কথা বলে ।
বাস গ্যারাজ করে – গুরু পাঁচুর আশ্রমে ঢোকে নাগের বাজার মোড়ে । দুটো বোতল সাফ করে ঢোকে পাড়ায় ।

যত তাফালিং শুরু হয়- পাড়ায়  ।

আমার সঙ্গে দেখা হলেই- একটা স্যালুট ঠুকে, বিড়ি দেবে । সঙ্গে পেটেন্ট সংলাপ :- মা কি তোর একার ? ( মদ না খেলে আমায় – আপনি বলে)
স্যালুট ঠোকারও কারণ আছে ।
বছর ১৪/১৫ আগে, ট্রেন লেট থাকার ফলে ;দেরি হয়েছে হাওড়া থেকে আসতে । ভাগ্য ভালো হওয়াতে একটা ২১৯ বাস পেয়েছিলাম ।

প্রায় রাত বারোটায় নামলাম নাগের বাজারে । কি আশ্চর্য- একটা চেনা রিক্সাও পেলাম, পাড়ার ।
একটু এগুতেই দেখি- রঘু হেব্বী কাকুতি মিনতি করছে জীপে বসা কামারডাঙা ফাঁড়ির বড়বাবু- সেন সাহেবের কাছে ।

আমারে ছাইড়া দ্যান ছ্যার ।  মিনি চালাই সারাদিন, তারপরে আর শরিলে দ্যায় না ছ্যার । ওই একটু মদ খাই ।

সেন বাবু মিচকি হাসছেন ।

আমাকে দেখতে পেলো রঘু ।
ও রামকিসনোদা, বড়বাবুরে কইয়া দ্যান না ।

সেন বাবু হেসে বললেন :- নিয়ে যেতে পারবেন আপনার রিক্সাতে ?

কেন পারবো না ? ও আর আমি তো একই পাড়াতে থাকি ।

সে জানি- ব্যাটা এত টলছিল, যে কোনো সময় লরী চাপা পড়তে পারতো, তাই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম ।

রঘু আস্তে করে এসে উঠলো রিক্সায় । একেবারে স্পিকটি নট ।

গলির মুখটাতে ঢুকতেই গর্জে উঠলো ।

আমারে ছাড়াইলেন ক্যান ?

আমি তো ছাড়াই নি, বড় বাবুই তো ছেড়ে দিয়েছেন ।

রাহেন !  বদনাম করসে আমার  ।

কি ?
আমি নাকি এত মদ খাইসি যে টলতাছিলাম । ঘোরান “রিস্কা” । আজ ইসপার উসপার ।

আমি কেনাকে বললাম – ঘোরা রিক্সা ! রঘুর অপমার সহ্য করা আমার পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না ।

ঘুরিয়ে একটু এগিয়েছি , ওমনি রঘু বলল:-

থাউক গিয়া । অত রাতে আর ক্যাচাল কইরা লাভ নাই, ফেরত চলেন ।

===========
পরের দিন হরির দোকানে আমাকে আর কেনাকে চা খাইয়ে একপাশে ডেকে বলেছিল :-

রাইতের কথা আর কাউরে কইয়েন না ।

এত বছর পর এই আপনাদের বললাম – অবশ্য আগেও বলেছি বোধহয় ।







Monday, November 3, 2014

ফক্কার





সালটা ১৯৭১ বা ৭২ হবে বোধহয় । কটকে আমার পোষ্টিং । ভুবনেশ্বরে এয়ারপোর্ট ।
কটক থেকে ভুবনেশ্বরের এয়ারপোর্ট দূরত্ব সড়ক পথে মোটামুটি ভাবে ৩০ কিমি ।
ঘন ঘন বাস ছিল ( এখনও আছে) ভুবনেশ্বর যাওয়ার । কোলকাতায় মিটিংয়ের ডাক পড়তো আর স্যাংশান ছিল ট্রেনে ফার্ষ্ট ক্লাসের ।
ট্রেনের ভাড়া, যতদূর মনে আছে- ছিল ২৮ টাকা মত ( কম বেশী, হতে পারে, ঠিক মনে নেই )।
তখন, ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্স বাসে করে নিয়ে যেত, এয়ার পোর্টে- সে কোলকাতা বা ভুবনেশ্বর, যেখানেই হোক ।
একবার ওদের সিটি অফিসে রিপোর্ট করলেই হল । কোলকাতায় চিত্তরঞ্জন এভিনিউ তে অফিসটা এখনও আছে বোধহয় ।
প্লেনের ভাড়া ছিল বোধহয় ৬০ / ৭০ টাকা । যে পয়সা পাবো, সেটার সঙ্গে নিজের গোটা ত্রিশেক টাকা জুড়লেই প্লেনের বাবুয়ানি ।
২৮ সিটের ফক্কার চলতো সেই সময় । প্রেসারাইজড্ প্লেন । টু বাই টু সিট ।
এখন যেমন মাইকে কি কি করতে হবে বমি পেলে বা মাথা ঘুরলে, বলে দেওয়া হয় আর কিছু বাদে বাদে দাঁড়িয়ে এয়ার হোষ্টেসরা মূকাভিনয় করে, তখন সেটা ছিল না ।
দরজা বন্ধ হলে, একজন উঁচু গলায় করণীয় গুলো বলে দিতো । সিটের মাথার ওপর ছিল এসির মুখ, ঘোরানো যেত । জানলা গুলো গোল নয়, আয়তাকার ।
নাইট ল্যাণ্ডিং ফেসেলিটি ছিল না ভুবনেশ্বরে । ফলে, দুপুর গড়িয়ে জাষ্ট বিকেল হচ্ছে ঠিক সেই লাষ্ট ফ্লাইটটা ধরতাম ভুবনেশ্বর থেকে ।
যাতায়াত করতে করতে, প্রায় অনেক ষ্টাফের সঙ্গেই পরিচিতি হয়ে গেছিল ।
তা, সেদিন কমাণ্ডে ছিল ক্যাপ্টেন সঞ্জীব মিশ্রা ( নামটা সঞ্জয়ও হতে পারে ) । বোম্বে ফিল্মের হিরো মার্কা চেহারা । প্রায় ৬ ফুটের মত উচ্চতা ।
তেমনই সুন্দর কথা বলতো- ইংরেজী, হিন্দিতে ।
ডিউটি শেষ হলে- অনেক সময় নিজের গাড়ীতে তুলে নিত আমায় । তবে, এই সুযোগ বেশী পেতাম না , ওর বিভিন্ন কাজের জন্য ।
স্মুদ টেক অফ । উড়ে চলেছি কোলকাতার দিকে ।
নীচের বাড়ী ঘর, রাস্তা , গাড়ী টাড়ি সব খেলনার মত লাগছে । আমার ডান দিকের উইণ্ডো সিট । জানলা দিয়ে মোটামুটি প্লেনের পাখা যে ঘূর্ণায়মান, সেটা একটু দেখতে পারা যাচ্ছে ।
মাঝে মাঝে একটু ঝাঁকানি , এয়ার পকেটের জন্য, কারণ এই প্লেন বেশী উঁচুতে উড়তে পারতো না, তবে সেটা আমার গা সওয়া হয়ে গেছিল ।
কানে ধাপা ধরতো, কিন্তু মুখটা হাঁ করে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নিলে, কিছুক্ষণ পরে ছাড় পেতাম ।
কফি খেতে খেতে , একটা ইলাষ্ট্রেটেড উইকলিতে চোখ রেখে ছবি আর লেখা গুলো পড়ছি ।
পাশের সিটে এক মাড়োয়ারি সহযাত্রী হনুমান চালিশা পড়ছে মন দিয়ে উঁচু গলায় ।
জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটাই তার প্রথম বায়ু মার্গে ভ্রমণ ।
হঠাৎ প্লেনটা একটু বাঁ দিকে হেলে পড়ল আর কাঁপা শুরু ।
হোষ্টেসদের মুখ গম্ভীর । একবার করে ফ্লাইট ডেকে ঢুকছে আর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসছে ।
জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলছে না ।
আমার এবারে ভয় ধরলো । মাত্র বছর তিনেক ( ১৯৬৮) আগেই দমদমে প্যান অ্যামের বোয়িং প্লেন ভেঙে পড়েছিল রানওয়ে ছোঁয়ার আগেই ।
নীচে নীল জল দেখা যাচ্ছে । অল্প একটু সময় বঙ্গপোসাগরের ওপর দিয়ে যেত বা যায় এখনও ।





মিনিট পাঁচ এরকম ছিল । তারপরই সব স্বাভাবিক ।
ভয়টা তখনও কাজ করছে মনে । ধীরে নজরে এলো সুতোর মত কোলকাতার রাস্তা ।
রানওয়েতে নেমে এলো মসৃণ ভাবে আমাদের প্লেন ।
সবার শেষে নামলাম আমি ।
ঘর্মাক্ত সঞ্জীব একটা ট্রলির গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে । তখন এত কড়াকড়ি ছিলই না ।
জিজ্ঞেস করলাম কেয়া হুয়া থা ইয়ার !
একটা সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেনের উত্তর :- এক সাইড কা এঞ্জিন বন্ধ্ হুয়া থা ফর এ সর্ট হোয়াইল ।
আমার পড়ে যাওয়াটকে কোনো রকমে আটকেছিল সঞ্জয় বা সঞ্জীব ।
========

তার পর আর পারতপক্ষে প্লেনে কোলকাতা যেতাম না, লাচার না হলে