Tuesday, January 12, 2010

খনা বা ক্ষণা

তাঁর আসল নাম লীলাবতী বলে অনুমান করা হয় কারণ, যে গণিত শাস্ত্রের বই পাওয়া যায়, তাতে খনার ছাপ স্পষ্ট। ছোট ছোট সূত্রে তিনি গণিতের মূল কথা গুলো বলেছিলেন।

“অঙ্কস্য বামা গতি” অর্থাৎ অঙ্ক দক্ষিণ থেকে বাম দিকে গণণা করিতে হইবে।

জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারীর যিনি বচন রচনার জন্যেই বেশি সমাদৃত, মূলত খনার ভবিষ্যতবাণীগুলোই খনার বচন নামে বহুল পরিচিত। মনে করা হয় ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার আবির্ভাব হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের অধুনা উত্তর চব্বি পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম ছিন অনাচার্য। খনার একটি বচনে এই পরিচয় পাওয়া যায়।

“ আমি অটনাচার্যের বেটি, গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি”

প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, খনা যদি সিংহলের কন্যা হয়েই থাকেন, এবং উজ্জয়নীতে শ্বশুরবাড়ী হয়, তবে বচন গুলো বাংলায় লিখলেন কি করে? সিংহলে বা উজ্জয়নীতে তো বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল না। যদিও কোনো প্রমান নেই, তবে মনে করা হয়, খনা গণিত শাস্ত্রের বইতে যে ভাবে ছোট ছোট সূত্র লিখেছিলেন, সেই ভাবেই সংস্কৃততে এই বচন গুলো লিখেছিলেন।পরে সে গুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়। বাংলায় অনুবাদ, চর্যাপদর আগেই হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।

অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে তিনি ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা। উজ্জয়নীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ সভার প্রখ্যাত জোতির্বিদ বরাহপুত্র মিহিরকে খনার স্বামীরূপে পাওয়া যায়। কথিত আছে বরাহ তার পুত্রের জন্ম কোষ্ঠি গনণা করে পুত্রের আয়ু এক বছর দেখতে পেয়ে শিশু পুত্র মিহিরকে একটি পাত্রে করে সমুদ্র জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌছলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালন পালন করেন এবং পরে কন্যা খনার সাথে বিয়ে দেন। খনা এবং মিহির দু'জনেই জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। অনুমান,বরাহের প্রয়াণের পর মিহির একসময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পরলে, খনা এ সমস্যার সমাধান দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাস রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতো বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। এর কিছুকাল পরে খনার মৃত্যু হয়। এছাড়া বররুচি এর পুত্র মিহির তার স্বামী ছিলেন বলেও কিংবদন্তী আছে।

খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। অজস্র খনার বচন যুগ যুগান্তর ধরে গ্রাম বাংলার জন জীবনের সাথে মিশে আছে। এই রচনা গুলো চার ভাগে বিভক্ত।

  • কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার।
  • কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান।
  • আবহাওয়া জ্ঞান।
  • শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।

কয়েকটি খনার বচন:-

১) মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছে তথায় যা

২) ডাকে পাখী, না ছাড়ে বাসা, খনা বলে, সেই তো ঊষা

৩) ভরা থেকে শূন্য ভালো যদি ভরতে যায় ।

আগে থেকে পিছে ভালো যদি ডাকে মায় ।।

৪) যদি বর্ষে কাতি, রাজা বাঁধে হাতি

যদি বর্ষে আগনে, রাজা নামে মালা হাতে মাগনে।

যদি বর্ষে পৌষে, কড়ি হয় তুষে।

যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুন্য দেশ।

৫) যদি অশ্বি কুয়া ধরে, তবে ধানগাছে পোকা ধরে

৬) কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত।

Saturday, January 9, 2010

অতীশ দীপঙ্কর




অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলেন একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত যিনি পাল সাম্রজ্যের আমলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্মপ্রচারক ছিলেন।

শৈশব

তিনি ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মুগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত। অতীশ দীপঙ্কর গৌড়ীয় রাজ পরিবারে রাজা কল্যাণশ্রী ও প্রভাবতীর মধ্যম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন।তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়।

পরবর্তী জীবন

আদিনাথ প্রথমে নিজের মায়ের কাছে এবং পরে সে সময়ের প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অবধূত জেতারির কাছে তিনি পাঁচটি অপ্রধান বিজ্ঞানে বিদ্যালাভ করেন। অতীশ জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং বহু গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তার গুরুদের মধ্যে ১২জনের নাম পাওয়া যায়- জ্ঞানশ্রী মিত্র, দ্বিতীয় কুশালি, জেতারি, কৃষ্ণপাদ/বাল্যাচার্য, দ্বিতীয় অবধূতিপা, ডোম্বিপা, বিদ্যাকোকিল, মহিজ্ঞানবোধি, নারোপা, পন্ডিত মহাজন, ভূত কোটিপা, মহাপন্ডিত দানশ্রী, প্রজ্ঞাভদ্র, বোধিভদ্র প্রমুখ। অবদূতীপাদ রাজগৃহের দক্ষিণে সাতটি পর্বত ঘেরা নির্জন পরিবেশে বসবাস করতেন। অতীশ সেখানে ১২-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বাস করেন এবং অবদূতীপাদের কাছ থেকে তন্ত্র শাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। তিনি ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত চুরাশী সিদ্ধাচার্যের অন্যতম ও বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বার পন্ডিত নারোপা/ নাঙপাদ এর কাছে তন্ত্র শাস্ত্র শিক্ষালাভের জন্য শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ত্রিপিটক ভৈবাষিক দর্শন ও তান্ত্রিক শাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। ওদন্তপুরী বিহারের জ্ঞানী ভীক্ষু রাহুল গুপ্ত তাকে "গুহ্যজ্ঞান ব্রজ" পদবীতে ভূষিত করেন। তিনি ওদন্তপুরী বিহারের মহাসঙ্ঘিকাচার্য শীল রক্ষিত তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। এ সময় মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি একজন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। তখন আচার্য শীলরক্ষিত তাকে 'শ্রীজ্ঞান' উপাধি প্রদান করেন এবং তাঁর নতুন হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। একত্রিশ বছর বয়সে ধ্যান শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মগধের জ্ঞানবৃদ্ধ আচার্য ধর্মরক্ষিতের কাছে যান। ধর্মরক্ষিত তার বোধিসত্বের ব্রতে সাফল্য দেখে তাকে ভিক্ষুধর্মের শ্রেষ্ঠ উপাধি দেন। এর পর ১০১১ সালে তিনি ১২৫জন অনুগামী ভিক্ষুসহ এক সওদাগরী জাহাজে মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে যান এবং সেখানে প্রখ্যাত আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি বহু পন্ডিতব্যক্তিকে যুক্তি-তর্কে পরাজিত করে ক্রমেই একজন অপ্রতিদ্বন্দী পন্ডিত হয়ে উঠেন। ফেরার পরে কিছু দিন শ্রীলংকায় অবস্থান করে ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ বছর বয়সে তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। এ সময় বজ্রাসন মহাবোধি বিহারে (বর্তমান বৌদ্ধগয়া) আয়োজিত সংবর্ধনায় তার অসামান্য পান্ডিত্যের জন্য 'ধর্মপাল' উপাধি দেওয়া হয়।

ভারতবর্ষে ফেরার পর ১৫ বছর ধরে তিনি ওদন্তপুরী ও সোমপুরী বিহারে অধ্যাপক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গদেশের রাজা প্রথম মহীপালের অনুরোধে বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। তিব্বতের রাজা হ্লা-লামা তাঁকে স্বর্ণ উপহার দিয়ে সেখানে ধর্ম প্রচারের আহ্বান জানান, কিন্তু দীপঙ্কর তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিব্বতের পরবর্তী রাজা চ্যান-চাব জ্ঞানপ্রভ তাঁকে পুনরায় আমন্ত্রণ করলে তিনি ১০৪১ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে যাত্রা শুরু করে দুর্গম হিমালয় পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে তিব্বতে যান। পথে নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। নেপালের রাজপুত্র পথপ্রভা তাঁর কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন।

তিব্বতে পৌঁছে দীপঙ্কর রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এখনও সেখানকার মঠের প্রাচীরে এই সংবর্ধনার দৃশ্য আঁকা আছে। তিনি সেখানে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা ও কারিগরিবিদ্যা সম্পর্কে তিব্বতি ভাষায় দুইশ'রও বেশি বই রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিব্বতবাসীদের মাঝে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিব্বতবাসীরা গৌতম বুদ্ধের পরেই তাঁকে স্থান দেয় এবং তাঁকে 'জোবো ছেনপো' বা মহাপ্রভুরূপে মান্য করে। তারা তাঁকে "অতীশ" উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি তিব্বতে বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং নিজ হাতে সেগুলির প্রতিলিপি করে বাংলায় পাঠান।

অতীতের তিব্বতের যেকোন আলোচনাতেই অতীশ দীপঙ্কর ঘুরে ফিরে আসেন। তিনি তিব্বতের ধর্ম, ইতিহাস, রাজকাহিনী, জীবনীগ্রন্থ, ও স্তোত্রনামা লেখেন। তাঁর মূল সংস্কৃত রচনাগুলি বর্তমানে বিলুপ্ত। তিনি তাঞ্জুর' নামের বিশাল তিব্বতি শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। এই মহাগ্রন্থে দীপঙ্করের ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ আছে।

১৩ বছর তিব্বতে বাস করার পর ১০৫৪ সালে বাহাত্তর বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরীর অদূরে ঞেথাং বিহারে অতীশ দীপঙ্কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮শে জুন তাঁর পবিত্র দেহভস্ম চীন থেকে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে অনীত হয় এবং সেখানে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

তথ্যসূত্র

Portrait of Atisha [Tibet (a Kadampa monastery) (1993.479)]'Timeline of Art History'New York: The Metropolitan Museum of Art, 2000– (October 2006)

Friday, January 8, 2010

নোবেল পুরস্কার

সালটা ১৮৯৫। রচিত হতে যাচ্ছে এক মহান দলিল,যাতে তৈরী হবে মনুষ্য সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত। স্বীকৃত হবে মানুষের আবিস্কারের ফসল। সেই সব আবিস্কারের গুণগ্রাহী,আর এক আবিস্কারকের প্রবর্তিত পুরস্কার নিয়ে এই তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন।
ডঃ অ্যালফ্রেড নোবেলঃ-(১৮৩৩-১৮৯৬)-নেপথ্য নায়ক ও কারিগরসুইডিশ এই মনিষী, ডঃ অ্যালফ্রেড নোবেল একাধারে ছিলেন দুঃসাহসীক বিজ্ঞানী,লেখক ও শান্তিপ্রয়াসী।ডিনামাইট আবিস্কারক, ডঃ নোবেল এই আবিস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ ও খ্যাতিলাভ করেন।মৃত্যুর প্রায় আগে আগে ১৮৯৫ সালে তিনি তাঁর বিপুল ধনসম্পত্তির সিংহভাগ অংশ দলিল করে এই পুরস্কারের ভিত্তি স্থাপন করে যান।নোবেল ফাউণ্ডেশন বা নোবেল তহবিলতৈরী হল একটি প্রাতিজনিক প্রতিষ্ঠান।১৯০০ সালে ডঃ নোবেলের দলিলের শর্ত্ত অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। ডঃ নোবেলের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের বিভিন্ন সম্মেলন আয়োজন করা, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর যে সব প্রতিষ্ঠান বা পরিষদ, পুরস্কার প্রাপকদের যে তালিকা তৈরী করেন; তাদের প্রতিনিধিত্ত্ব করা এবং সর্বোপরি নোবেল পুরস্কারের প্রদানের আয়োজন করা এই প্রাতিজনিক প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজ।১৯০১ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্যসাধারণ গবেষণা, উদ্ভাবন ও সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য এই পুরষ্কার(সুয়েডীয়: Nobelpriset নোবেল্‌প্রীসেৎ) দেওয়া হয়। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হল: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। নোবেল পুরস্কার এ সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদেরকে ইংরেজিতে নোবেল লরিয়েট বলা হয়।নোবেল মৃত্যুর পূর্বে উইলের মাধ্যমে এই পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে।আলফ্রেদ নোবেল তার উইলে অর্থনীতির ওপর পুরস্কার উল্লেখ করেননি। ১৯৬৯ সাল থেকে নোবেলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে অর্থনীতির ওপর “সভেরিজ্ রিকসব্যাংক” (Sveriges Riksbank)পুরস্কার প্রদান শুরু হয়।নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের একটি করে পদক, ব্যক্তিগত উপাধি এবং বর্তমানে নগদ ৯লক্ষ ৯০ হাজার ডলার(ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫ কোটি টাকা) দেওয়া হয়।প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, ২০০১ সালে এর শত বর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগে নগদ অর্থমূল্য ৯লক্ষ ৪০ হাজার ডলার ছিল। শত বর্ষ পূর্ত্তি উপলক্ষে ৫০ হাজার ডলার বাড়ান হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেয়া হয়না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে।
১৯০৪ সালে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি গঠিত হয়। এর আগে নরওয়ের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার দায়িত্ব পালন করতেন। গঠনের পর কমিটির ৫ জন সদস্য শান্তি পুরস্কার দেবার জন্য গবেষণামূলক কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করে। তাঁদেরকে নরওয়েজীয় আইনসভা মনোনয়ন দেয়, তথাপি তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। নরওয়ের আইনসভার সদস্যরা এই কমিটিতে অংশ নিতে পারেন না।


নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের নির্বাচন বা মনোনয়নস্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, কারা নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নির্বাচিত করেন? ডঃ অ্যালফ্রেড নোবেল তাঁর দলিলে, নির্দ্দিষ্ট ভাবে কতকগুলি প্রতিষ্ঠানকে বিষয় ভিত্তিক ভাবে এই গুরু দায়িত্ত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। এরা হলঃ-১. The Royal Swedish Academy of Sciences- (রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান পরিষদ) । পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্র।২.Karolinska Institute- শারীরতত্ত্ব ও ওষুধ।৩.Swedish Academy – সাহিত্য।৪.The Norwegian Parliament (Storting) - শান্তি। Storting – Stor= বড় ।Ting= পরিষদ।এই নরওয়ের ব্যবস্থা পরিষদ ৫জন স্বনামধন্য ব্যক্তির একটি সমিতি গঠনকরে এই শান্তির পুরস্কার প্রাপকদের নাম মনোনয়ন বা নির্বাচিত করেন।৫. ১৯৬৮ সাল থেকে অর্থনীতির নোবেল বিজয়ীদের নাম মনোনয়ন বা নির্বাচিত করেন The Royal Swedish Academy of Sciences- (রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান পরিষদ)।নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণাএবার প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠানের সদস্যবৃন্দ, বিজ্ঞানী, পূর্বতন নোবেল বিজয়ী, আইন সভার সদস্যবৃন্দ এবং অন্যান্যদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ভাবে আমন্ত্রন জানান হয় এবং নাম পাঠানর জন্যও সুপারিশ করতে বলা হয়।যতদূর সম্ভব, পৃথিবী ব্যাপী সবাইকে আমন্ত্রন জানান হয়।নাম আসার পর, একটা আহূত সভায় নির্বাচন করে,তার পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন সমিতি বৈঠক ও সভা ডেকে নির্বাচন পর্ব শেষ করেন।যার ফলে একই দিনে সব নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় না।নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণার দিন এবং ..................১০ ই ডিসেম্বর এক স্মরণীয় দিনাঙ্ক। এসে যায় সেই অমৃতযোগ। স্থান-ষ্টকহোম, মধ্যমঞ্চে সুইডেনের রাজা ১৬শ কার্ল গুস্তাফ। তাঁর চারিদিকে মণিমুক্তার মত নোবেল বিজয়ীরা । ওদিকে ওসলোতে নরওয়ের রাজা ৫ম রাজা হেরাল্ড।ষ্টকহোমে- দেওয়া হয়
১)পদার্থবিদ্যা
২)রসায়ন শাস্ত্র
৩)শারীরতত্ত্ব ও ওষুধ
৪)সাহিত্য
৫) অর্থনীতিতে পুরস্কার
ওসলোতে- শান্তির পুরস্কার।
নোবেল বিজয়ীরা তাঁদের সারগর্ভ ভাষণ উপস্থাপিত করেন।
১৯০২ সাল থেকে সুইডেনের রাজা স্টকহোমে পুরস্কার বিতরণ করে আসছেন। প্রথম বছর সুইডেনের রাজা ছিলেন রাজা ২য়অস্কার; তিনি এতো মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার বিরোধী ছিলেন। এজন্য তিনি পু্রষ্কার প্রদানে সম্মত হননি। পরবর্তীতে অবশ্য জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য এবং সুইডেনের সম্মান রক্ষার খাতিরেই তাঁকে মত পরিবর্তন করতে হয়েছে।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নবরত্ন সভার নবরত্নদের নাম

মহাকবি কালিদাসের “জ্যোতির্বিদ্যাভরণ” গ্রন্থে মহারাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (বিক্রমাদিত্য নামে খ্যাত) নবরত্ন সভার নবরত্নদের নাম পাওয়া যায়।
“ধন্বন্তরি-ক্ষপণকামরসিংহ-শঙ্কু-বেতালভট্ট-ঘটকর্পর-কালিদাসাঃখ্যাতোবরাহমিহিরোনৃপতেঃ সভায়াংরত্নানি বৈ বররুচির্নব বিক্রমস্য।
অর্থাৎ : নৃপতি বিক্রমের সভায় যে নয়জন রত্ন
১) ধন্বন্তরি
২) ক্ষপণক
৩) অমরসিংহ
৪) শঙ্কু
৫) বেতালভট্ট
৬) ঘটকর্পর
৭) কালিদাস
৮) বরাহমিহির
৯) বররুচি

“স্পুনারিজম”“

Ends well, that all well” এই উক্তিটি মনে পড়ছে? বা চেনা চেনা ঠেকছে কি? যাঁরা শ্রীসত্যজিৎ রায় রচিত “কৈলাসে কেলেঙ্কারী” পড়েছেন বা তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রীসন্দীপ রায় পরিচালিত চলচিত্রটি দেখেছেন, তাঁদের ঝট্ করে মনে পড়ে যাবে।বইটি বা চলচিত্রটির শেষে জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলি এই বাক্যবন্ধটি ব্যাবহার করেছিলেন।এখন প্রশ্ন হচ্ছে শ্রীসত্যজিৎ রায় এই বাক্যবন্ধটি কেন জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলির মুখে এই বাক্যবন্ধটি বসিয়েছিলেন বা ব্যাবহার করেছিলেন? এমনি এমনি? সবিনয়ে বলি; না! হিউমারের জন্য বসালেও এই বাক্যবন্ধটির উৎপত্তি “স্পুনারিজম” থেকে। শ্রীসত্যজিৎ রায়ের পড়াশোনা ছিল অগাধ। বাঙ্গালী পাঠকদের “স্পুনারিজম” সম্বন্ধে একটু ধারণা দিতে এই কথাগুলি জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলির মুখে বসিয়েছিলেন। জটায়ু আরও একটি গল্পে ঘাবড়ে গিয়ে “হ্যাঁয়েস” বলেছিলেন। “হ্যাঁয়েস” = হ্যাঁ+ Yes। এটিও “স্পুনারিজম” এর অন্যতম উদাহরণ। তা, এরকম ভাষা কি সত্যি সত্যি কেউ ব্যাবহার করতেন! করতেন! এবং তাঁর ব্যবহৃত বাক্যবন্ধ গুলি এখন “স্পুনারিজম” নামে বিখ্যাত! নিউ কলেজ, অক্সফোর্ডের, রেভারেণ্ড উলিয়াম আর্চিবল্ড স্পুনার (২২ শে জুলাই,১৮৪৪-২৯ শে আগস্ট,১৯৩০) এইরকম শব্দ ব্যাবহার করতেন! তাঁর এই বিখ্যাত দোষের(?) জন্য “স্পুনারিজম” শব্দটি ইংরেজি ভাষার অভিধানে স্থান পেয়েছে।বিদ্যাসাগরের মত খর্বকায়, মাথা বড় এবং গোলাপী মুখ, গায়ে শ্বেতী, সহৃদয় এই ভদ্রলোক অনেক ব্যাপারে সুপণ্ডিত ছিলেন।মূলত ভক্তিবাদ, দর্শন ও প্রাচীন ইতিহাস পড়াতেন রেভারেণ্ড উলিয়াম আর্চিবল্ড স্পুনার।
একবার তিনি তাঁর ছাত্রদের বললেন:- You have hissed all my mystery classes. So you must leave the campus by the town drain! ছাত্ররা হতবাক! পরে বোঝা গেল তিনি বলতে চেয়েছিলেন:- You have missed all my history classes. So you must leave the campus by the down train! ক্লাসে পড়াতে ঢুকে তিনি একবার দেখলেন একটি চিঠি পড়ে রয়েছে ডেস্কের ওপর। তিনি বললেন:- Who has speed the most? আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন:- Who has missed the post? এরকম আরও মজার মজার কথা তিনি বলেছিলেন। পরে অবশ্য অনেক কথা যেগুলো তিনি বলেননি তাঁর মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়।তাঁর আসল কতকগুলি কথার নমুনা:- Come and wook out of the lindow ( Come and look out of the window)Go and shake a tower( Go and take a shower)leed of spight(Speed of light), Minting Pristake (Printing Mistake)এরকম আরও অজস্র উদাহরণ আছে। মজার ব্যাপার হলো আমরাও কিন্তু অজান্তে এই “স্পুনারিজম” টা করি। যেমন:-“চারটে” ভাত, এক গ্লাস জল “দেখি”, “উইলটার ফিলস্” (ফিলটার উইলস্),বিনা খয়ের “দিয়ে” পান, ‘বাই’ ট্রেনে করে, ‘আপটু’ শেয়ালদা পর্যন্ত্য, । উৎসাহী পাঠকরা যদি আরও কিছু যোগ করতে পারেন, কৃতজ্ঞ থাকব।রেভারেণ্ড উইলিয়াম আর্চিবল্ড স্পুনারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রবন্ধটি শেষ করলাম।

চানক্য ,সংস্কৃত: चाणक्य

চানক্য (সংস্কৃত: चाणक्य খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০- খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ ) প্রাচীন ভারতের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।জন্মএই বিজ্ঞ ও প্রতিভাধর ব্রাহ্মণের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলায়; যেখানে উপমহাদেশে উচ্চতর জ্ঞান আহরণের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপীঠ অবস্থিত ছিল। রাজনৈতিক দর্শনের বাস্তব চর্চা ও রাষ্ট্রীয় কৌশলের প্রয়োগ পদ্ধতির নির্দেশনা দানে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসে তার অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী।বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। কারণ এ নামটিই দিয়েছিলেন তার বাবা মা। এছাড়া তার বিখ্যাত ছদ্মনাম 'কৌটিল্য', যা তিনি তার বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্র' এ গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতির কৌশলের সারসংক্ষেপ বলা যায় 'অর্থশাস্ত্রকে'। যেহেতু তিনি 'কূটিলা গোত্র' থেকে উদ্ভুত ছিলেন, অতএব তা টিকিয়ে রাখার জন্যে তিনি 'কৌটিল্য' ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে তার অধিকতর প্রিয় নাম 'চানক্য' এর উদ্ভব 'চানকা' থেকে, যে গ্রামে তার জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে।নন্দ বংশকে উৎখাততার অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উত্খাতত করে সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যকে ভারতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যকেই উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চন্দ্র গুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পাটলিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পারিণত করেন। পাটলিপুত্র বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই অবস্থিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্র গুপ্ত রাজ্য শাসন করেন। তার সময়কালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিল, প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করে গেছেন চন্দ্র গুপ্তের দরবারে গ্রীক দূত মেগাস্থিনিস তার 'ইন্ডিকা' গ্রন্থে।
নন্দ বংশের সর্বশেষ রাজা প্রজা সাধারণের কাছে প্রিয় ছিলেন না। একবার তিনি চানক্যকে অপমান করেছিলেন। চানক্য এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেন। এদিকে তরুণ ও উচ্চাভিলাষী চন্দ্র গুপ্ত, যিনি নন্দ রাজার পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও ষড়যন্ত্র করছিলেন সিংহাসন দখলের। কিন্তু তার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং জীবন বাঁচাতে তাকে পালাতে হয়। চন্দ্র গুপ্ত যখন বিন্ধানের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে চানক্যের সাথে তার সাক্ষাত্‍ হয়। চন্দ্র গুপ্ত তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন চানক্যকে এবং তখনই তাকে তার গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।চানক্যের সক্রিয় সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরুর তৈরি সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত নন্দ রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে সক্ষম হন। অতঃপর মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য।প্রধানমন্ত্রী চানক্যএর আগে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে গ্রীক শাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয় এবং এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্র গুপ্ত গ্রীক বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন ও পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরে চন্দ্র গুপ্ত একে একে পশ্চিম ভারতের সকল রাজ্য বিজয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্যে তিনি একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন চানক্যকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন।যে পরিস্থিতিতে চন্দ্র গুপ্ত নন্দ বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তা অত্যন্ত চমত্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে পঞ্চম শতাব্দীতে লিখিত একটি রাজনৈতিক নাটক 'মুদ্রা রাক্ষস'এ। এ নাটকের রচয়িতা বিশাখাদত্ত নামে এক প্রাচীন নাট্যকার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নাটকটি পঠিত, মঞ্চস্থ ও প্রশংসিত হয়েছে।
চন্দ্র গুপ্তের শ্রদ্ধেয় গুরু ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চানক্য অবলীলায় বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারতেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে। কিন্তু তিনি এর পরিবর্তে খুব সাধারণভাবে একটি কুঁড়েঘরে বসবাসের জীবন বাছাই করে নিয়েছিলেন। এই কুঁড়েঘরটি অবস্থিত ছিল এক শ্মশানে। সেখানে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে দূরে অবস্থান করে তিনি বহু শিষ্যকে রাজ্যশাসনের কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন এবং নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। এসব ছাড়াও তিনি তার রাজার দেয়া দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্বস্ততার সাথে। চন্দ্রগুপ্তের জীবনে তিনি ছিলেন অভিভাবক স্বর্গীয় দূতের মতো এবং সত্যিকার বন্ধু, দার্শনিক ও গুরু।চানক্যের অর্থশাস্ত্রচানক্যের বিরাট সাহিত্য কর্ম 'অর্থশাস্ত্র', যার শব্দগত অর্থ 'পৃথিবীতে সাধারণ কল্যাণ বিষয়ক বিবরণী।' এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে শাসকের উদ্দেশ্যে পরামর্শ যে, কিভাবে একজন শাসককে তার প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবন মান উন্নত করার জন্যে কাজ করতে হবে এবং কিভাবে আরো ভূখন্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে হবে। চানক্য যে সব পরামর্শ বা নির্দেশনা সেই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন সেসবের অধিকাংশই শুধু রাজ্যশাসন নয় বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চানক্য উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা এবং তার কিছু নীতি বিশ্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন দার্শনিক ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন। এসবের কিছু কিছু অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহীত হয়েছে। এ ধরণের একটি সংকলনের নাম 'চানক্য নীতি দর্পণ'। তার কথাগুলো হয়তো আধুনিক যুগের পরিশীলিত কথাবার্তা থেকে ভিন্ন, কিন্তু দুই হাজার বছরের অধিক সময়ের ব্যবধানেও সেগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেনি।
চানক্য তার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্রে' রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন, "যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।" অর্থনৈতিক দুর্নীতি সর্বকালেই ছিল এবং চানক্যের যুগেও তা নতুন কোন বিষয় ছিল না। সে কারণে তিনি লিখেছেন, "সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরূপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে। জিহ্বা'র ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজ কর্মচারির পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার।জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজ কর্মচারির তহবিল তসরূপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজ কর্মচারির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।"চানক্য তার নীতিকথায় বলেছেন, "বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী - এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।""মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।""যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্যে কোনকিছু হাসিল করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোন ব্যক্তির জন্যে কোন দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।""বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সবসময় তাকেই অনুসরণ করে।""মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।"
অনাড়ম্বর জীবন-যাপনচানক্য তার জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরও ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী পণ্ডিত, সাধু, দেশপ্রেমিক, গুরু ও কর্মবীর হিসেবে শ্রদ্ধেয়। প্রথমেই তিনি পাঞ্জাবকে বিদেশী শাসন (গ্রীক) মুক্ত করতে রাজাকে সাহায্য করেন। এরপর অযোগ্য শাসক নন্দ রাজাকে উত্খা ত করে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের সাথে আরো রাজ্য যুক্ত করেন এবং সাম্রাজ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তার ভূমিকা পালন করেন। সন্যাসীর মতো জীবন যাপন করেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেও। অসংখ্য শিষ্যকে তিনি জ্ঞান দান করেন। তিনি শিষ্যদের দেশপ্রেম, রাজার প্রতি আনুগত্য শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সবসময় রাজাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের মতোই চানক্যের চেহারাও সুন্দর বা আকর্ষণীয় ছিলনা এবং দৈহিক গড়নও ছিল আকর্ষণহীন। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি, যদিও সক্রেটিসের মতোই পন্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, "দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।" অন্যদিকে চানক্য ছিলেন দক্ষ পরিকল্পনাবিদ। সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল এবং অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিল না তার কাছে। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।
ঋণ এবং উৎস:-• Philosophy of Chanakya• Kautilya's Arthashastra (full 1915 Shamasastry text, divided into 15 books)• Kautilya: the Arthshastra - Chanakya's revered work• Philosophy and Biography

Sunday, January 3, 2010

ইংরাজী সাল নিয়ে কিছু কথা

আমরা ইংরাজী নববর্ষ এলেই খুব মাতামাতি করি। ২০০৯ পেরিয়ে ২০১০ এ পড়লাম। এটা আমরা এখন সবাই জানি যে, যীশু খ্রীষ্টের জন্ম থেকে এই ইংরাজী সালের হিসাব চলে আসছে। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আগের সময়কে খ্রীষ্টপূর্ব এবং জন্মের পর থেকে খ্রীষ্টাব্দ বলা হয়।

যাই হোক, যে কোন ইংরাজী সালের শেষ থেকেই আগামী নতুন বছরের ক্যালেন্ডার নিয়ে আমরা খুব মাতামাতি করি। কে কটা ক্যালেন্ডার পাব, তাই নিয়ে চলে অলিখিত এক রেশারেশি।

আমরা চেষ্টা করি, এই ক্যালেন্ডারের ইতিহাসটা জানতে। ক্যালেন্ডার সৃষ্টির পেছনে দুইজনের নাম ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। একজন রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার, আর একজন পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি। আমরা জানি, ১২ মাসে ১ বছর, বা ৩৬৫ দিনে ১ বছর। এই সাধারণ গণণাকে ইংরাজীতে “সিভিল ইয়ার”; বাংলায় “লৌকিক বছর” বলে। কিনতু, বিজ্ঞানের দৌলতে এখন আমরা জানি, পৃথিবীর সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে, ৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৪৮ মিনিট,৪৭.৫ সেকেণ্ড। এটাকেই “সোলার ইয়ার” বা “সৌরবছর” বলে বিজ্ঞানীরা বলেন; আর এটাকেই আসল বছর হিসেবে গণ্য করা হয়। (প্রসঙ্গত বলে রাখি, বরাহমিহির তাঁর “সূর্য্যসিদ্ধান্ত” গ্রন্থে আর পরে ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে আর্য্যভট্ট কিনতু ঠিক এই হিসেবটাই দিয়ে গেছেন। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের গুরু বর্ধমানের শ্রী বিশুদ্ধানন্দ বলেছিলেন, হিমালয়ের আড়ালে,এক গোপন জায়গায়; একটি সূর্য্যমন্দির আছে। সেখানে শেখানো হয় সূর্য্যবিজ্ঞান।মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ বেনারস সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে শেষ চাকরী করেছিলেন। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। পরে না হয় আলোচনা করা যাবে।)

আগে ধারণা ছিল, পৃথিবী সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন নেয়। খ্রীস্টপূর্ব ৪৬ এ রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার জানতে পারলেন যে ওটা ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা হবে। তা তখনই তিনি ঘোষণা করলেন- বছর ৩৬৫ দিনই হবে, আর বাকী ৬ ঘন্টা প্রতি ৪ বছর পরে পরে ১ দিন করে যোগ হবে। ৬x৪=২৪ ঘন্টা= ১ দিন। প্রতি ৪ বছর অন্তর,যে বছরে এই ১ টা দিন যোগ হবে, তাকে লিপ ইয়ার বলা হবে।

সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে এই ক্যালেণ্ডারের নাম হলো- জুলিয়েন ক্যালেণ্ডার। এই ক্যালেণ্ডারের হিসেবে বছরে গড় দিন দাঁড়ালো-৩৬৫.২৫ দিন। কিন্তু, এই হিসেবটাও ভুল বলে প্রমাণিত হলো, যখন সৌর বছর ৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৪৮ মিনিট,৪৭.৫ সেকেণ্ড বলে প্রমাণিত হলো। এবার; ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা থেকে ৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৪৮ মিনিট,৪৭.৫ সেকেণ্ড বিয়োগ করলে দাঁড়ায়- ১১ মিঃ ১২.৫ সেঃ। এবার ২৪x৬০x৬০=৮৬,৪০০ সেঃ।সুতরাং, দিনের হিসেবে ১১ মিঃ ১২.৫ সেঃকে,৮৬,৪০০ ভাগ করলে হলো ০.০০৭৭৮৩৫৬ দিন(প্রায়)। তার মানে দাঁড়াল, প্রতি বছর ১১ দিন করে দিন এগোচ্ছে, কিন্তু সেটার হিসেব থাকছে না। এবার ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির এই হিসেব অনুযায়ী, ইংলাণ্ড ২রা সেপ্টেম্বর পরে ৩রা সেপ্টেম্বর না করে ১৩ ই সেপ্টেম্বর করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার চালু করে দিল। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সারা দেশে এটা চালু হয়ে গেল। সুতরাং আমরা এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুসরণ করি। এই ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী আমরা, আসুন ক্যালেণ্ডার সংগ্রহ করি! কেমন?