Friday, October 31, 2014

লো পাওয়ার ট্র্যান্সমিটার




১৯৮২ সাল !

সে সময়, আমি মালদায় ।  শহরের ঠিক বাইরেই রবীন্দ্রভবন । সেখানে দেখলাম, একটা ছোট টাওয়ার বসানো হচ্ছে , ভবনের মাথায় ।

মাটিতে মাছ ধরার জালের মত, কোকাকোলার  একট হাফ সার্কেল । সেটাই নাকি অ্যান্টেনা । ভেতরের দিকে উল্টো করে কি সব যন্ত্র লাগানো ।

মালদায় যে টেলিভিশন সেট ছিল না, তা নয় । তবে, বুষ্টার অ্যান্টেনা দিয়ে বাংলাদেশ টিভি দেখা যেত ।

একটা হাল্কা ঝিরিঝিরি ভাব থাকতো বটে ছবিতে, তবে দূরের ছবি দেখা যাচ্ছে বলে উত্তেজনার বহরে, সেসব কেউ গায়ে মাখতো না ।

কিছু লোকের বাড়ী গিয়ে টিভি দেখতাম । একবার বিশ্বকাপ ফুটবলও দেখেছিলাম, একজন ডাক্তার বাবুর বাড়ী ।

কোন সুদূর দেশে খেলা হচ্ছে, আর মালদায় বসে সেটা সরাসরি দেখছি, এটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল ।

কুল্লে তিন রকম কোম্পানীর সেট পাওয়া যেত, তখন মালদায়। একটা ওয়েবল‌্, আর একটা ভারত টিভি আর একটা আপট্রন ।

সাদা কালো বেশীর ভাগই ওয়েবল্ সেট আর আপট্রন, আর রঙীন  ছিল ভারত টিভি ।

ভারত টিভির আবার সাটার ডোর ছিল ।

এও শুনলাম, বরকত সাহেবের বিশেষ নির্দ্দেশে  এই এল.পি.টি. স্টেশন তৈরি হচ্ছে দিল্লির দূরদর্শন দেখানোর জন্য । বাংলা দূরদর্শন আসবে না । তাই সই লোকের ।

এই রকম সময়ে,  একদিন নেতাজী রোডের রোগমুক্তি বলে একটা দোকানে ( আমার কোম্পানির ষ্টকিষ্ট) বসে আছি, সেই সময় দেখি একজন রিক্সা করে একটা বিশাল কার্ডবোর্ডের বাক্স নিয়ে যাচ্ছে । সাথে অ্যালুমিনিয়ামের কিছু সরঞ্জাম ।

রোদ্দুরে সে গুলো চকচক করছে । যে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে, তার মুখে গর্বিত মুচকি হাসি ঝুলে  ।

আমার মফঃস্বলী কৌতুহলি মন ভরে গেল অনেক অজানা জিজ্ঞাসায় ।

জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, সেইদিন থেকেই সম্প্রসারণ শুরু হবে মালদা শহরে আর দেখা যাবে, বারো কিলোমিটার ব্যাসার্ধের আকাশ পথে যে সব জায়গা পড়বে ।

চলে গেলাম দোকানে । মালিক, পরিচিত ননীদা । দোকানের নাম – বেতার । মূলত রেডিও আর টেপ রেকর্ডার বিক্রি হত সেখানে ।

ঢুকতেই, ননীদা বললেন – কি রামকিসনো বাবু  টিভি লিবেন না ?

কি রকম দাম?

স্যানকাচেন ( ভয় পাচ্ছেন) ক্যানে ? লিয়ে যান, মাসে মাসে দাম দিয়েন ।

কেন? আপনার টিভি বিক্রি হচ্ছে না ?

কি আর বুলবো বলেন ? লোকে কহছে, বরকত মিঞাঁর কারবার ! ওই যে দিল্লিতে কি সব খেলা হছে, ওগুলা হতেই ইষ্টিশন তুলে দিবে । তাই বেশী বিক্রি লাই ! এদিকে অনেক সেট কুম্পানি দিয়ে গেছে ।

তা হয় নাকি ? একবার বসলে, এটা আর উঠবে না । বরং আরও উন্নতি হবে ।

ঠিক কহছেন । লিয়ে যান একটা সাদা কালো টিভি । হাপনি কিনছেন দেখলে, অনেকেই লিবে ।

এখন কত দিতে হবে ?

হাজার টাকা হবে ?

তা হবে । কিন্তু, পরে ?

বাকী পাঁচ মাসে হাজার বা পাঁচশো করে দিয়েন । সব লিয়ে ছ হাজার টাকা !

বিরাশী সালে ছ হাজার টাকা বিশাল ব্যাপার । মাইনেই পাই মাত্র বারশো টাকা, টিএ বিল থেকে ম্যানেজ করে মেরেকেটে আরও শ চারেক কি পাঁচেক টাকা ।

তখন কিছু না বলে, ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখি ষোলশ টাকা মত আছে ।  হিসেব করে দেখলাম- দু চারদিনের মধ্যেই টি এ বিলের টাকা ঢুকবে ।

মাথায় খুন চেপে গেল ।

 হাজার টাকা তুলে নিলাম।

অতএব চালাও পানসী বেলঘরিয়া !

ননীদাকে হাজার টাকা দিয়ে বললাম- – পাঠিয়ে দিন বাড়ীতে টিভি সেট্  । বুষ্টার থাকবে তো ?

সব থাকবে, ঘাবড়াছেন কেনে ?

বাড়ীতে গিয়ে শবরীর প্রতীক্ষা । ছেলেরা স্কুলে । সারপ্রাইজ দেবো বলে, বৌকেও কিছু বলি নি ।

অবশেষে তিনি এলেন । সব ঠিকঠাক করে বসার ঘরে টিভি ফিট হলো ।  বুষ্টারের জন্য একটা বেকেলাইটের চেঞ্জ ওভার ।

এক দিক ওল্টালে বুষ্টার দিয়ে বাংলাদেশ টিভি, অন্য দিকে দিলে দিল্লি দূরদর্শন ।

আমার বৌ বলল :- এসব তো পরের বাড়ীতে থাকে, আমাদের বাড়ীতেও এলো ?

একে একে  আমার দুই ছেলে বাড়ী ফিরল । বাড়ীওয়ালা হেমেনদার ছেলে- মনোজ আর বাপী আমার বসার ঘরে বসেই আছে ।

যারা স্কুল থেকে ফিরে, খিদেয় ছটফট করে, তারা আজ সব ভুলে গেছে উত্তেজনায় ।

তাদের বাবাদেরও একই দশা ।

দিল্লি দূরদর্শন শুরু হবে সন্ধে সাতটায় । তাই বাংলাদেশই সই ।

বিভিন্ন খবর দেখতে দেখতেই অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । চেঞ্জ ওভার করতেই দিল্লি দূরদর্শনের লোগো ।

কিছু পরেই শুরু হলো এশিয়ান গেমসের খেল্, মাঝে খবর ।

==========
দিনটা ৩১ শে অক্টোবর ১৯৮৪ ।

সেদিন রাতে আমি কোলকাতায় আসবো, কোম্পানির মাসিক মিটিংয়ে । সকাল সাড়ে নটাতেই বসে গেলাম, কিছু পেপার ওয়ার্কস সারতে ।

পৌনে দশটা হবে- হঠাৎ শুনি রাস্তা দিয়ে একজন মাইকে বলতে বলতে যাচ্ছে – ইন্দিরা গান্ধী – গুলি বিদ্ধ ।

বেরিয়ে এলাম ।

রাস্তায় প্রচণ্ড ভীড় । পুলিস এসে মাইক বন্ধ করে  লোকটকে ধরে নিয়ে গেল । আমি একটা রিক্সা নিয়ে চললাম – রেষ্ট হাউসের দিকে ।

চারিদিকে উদভ্রান্ত অবস্থা । নানা গুজব ।

শুনলাম – ইন্দিরার হত্যাকারীরা নাকি শিখ । হাইওয়েতে ধরে ধরে লরী থেকে শিখদের নামিয়ে  মারা হচ্ছে ।

কয়েকজন মিলে দৌড়লাম- মঙলবাড়ী গুরুদোয়ারার কাছে ।

এদিকে গুরুদোয়ারাতে ঘন ঘন ইট আর পাথর ছোঁড়া অব্যাহত ।

আমরা হতভম্ভ । কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না । ওই জনতাকে কিছু বলতে যাওয়া মানে মার খাওয়া ।

ভাগ্য ভালো । সেই সময়েই কিছু লোক এসে এদের থামানোর চেষ্টা করল ( পরে শুনেছিলাম – বরকত সাহেব টেলিফোনে নির্দ্দেশ পাঠিয়েছিলেন , যাতে গণ্ডগোল হলে রোখা হয়) ।

 একটু দূরের স্থানীয় বি এস এফ ক্যাম্প  থেকেও বেশ কিছু জোওয়ান চলে এল ।

সবাই মিলে চেষ্টা করাতে পরিস্থিতি অনেকটা আয়ত্বে । জখম শিখদের তুলে মালদা সদর হসপিটাল ।  তারা জানেও না – কি জন্য তারা মার খেয়েছে বা খাচ্ছে ।

বিকেলে বাড়ী ফিরে এলাম । সামনের পোষ্ট আপিস থেকে আমার বস হেমেনদার বাড়ীতে ট্রাংক কল বুক করে অনন্ত প্রতীক্ষায় ।

অবশেষে পেলাম লাইনটা । ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এলো হেমেনদার স্ত্রীর । বললেন – এখনও বাড়ী ফেরে নি । কোলকাতার রাস্তা ঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ।

বললাম :- বাড়ী ফিরলে বলবেন, এই অবস্থাতে আমি আর কোলকাতা যাচ্ছি না ।

লাইন কেটে গেল ।

টিভিতে ততক্ষণে বলা হচ্ছে- ইন্দিরা গান্ধীকা নিধন ..............................।

শিউরে উঠে টিভি বন্ধ করেছিলাম ।

No comments: