প্লেনে চড়াটা আজকাল জলভাত! কিন্তু আমাদের বালক,কৈশোর বা যৌবন বয়সে সেটা ছিল না! মধ্যবিত্ত পরিবারে প্লেনে চড়াটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছিল। ট্রেনে, এখন কার মত স্লিপার ছিল না! ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা ট্রেনে আনরিজার্ভড অবস্থাতেই উঠত, বেশির ভাগ! গুঁতোগুঁতি, মারামারি। আমার তো অনেকদিন পর্য্যন্ত ধারণা ছিল, ট্রেনে ওঠার দরজা নেই। জানলা দিয়ে উঠতে হয়!!!!!!!! (তখন ট্রেনের কামরার জানলাতে রড লাগানো থাকতো না, পরে বোধহয় আমাদের মত লোকের কথা ভেবে লাগানো হয়েছে)। এহেন আমি প্লেনে চড়ব!!!!!! আপনারা কি ভাবছেন জানি না, কিন্তু আমার প্রচণ্ড ভয় করছিল। কলেজ/ইউনির্ভাসিটির ক্যান্টিনে রাজা উজির মারা লোক, ভয়টা প্রকাশও করতে পারছিনা!ওদিকে নতুন চাকরী। আ্যপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে গেছে। তার সাথে নির্দ্দেশিকা, অমুক দিন জয়েন করতে হবে। নির্দ্দেশিকার শেষে লেখা ছিল, Please come by air, to avoid delay in training program. Expenses will be reimbursed. [বলে রাখি, Please come by air, ব্যাপারটা বুঝতেও সময় লেগেছিল।] অগত্যা, পাড়ার এক দাদাকে ধরলাম। তখনকার দিনে, দাদা ক্যাপষ্টান সিগারেটের টিন আর এবোনাইটের লাইটার হাতে নিয়ে ঘুরতেন। তা শুনেই তিনি বললেন- টিকেট( টিকিট নয় ) কিনেছিস? আমি বললাম, না। তারপর বললাম, ও তো যাওয়ার দিন দমদমাতে গিয়ে কিনব।[ আগেই বলেছি, ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা!!] দাদা অনুকম্পার দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক দেখলেন।দাদা উবাচ:- “তুই কি সত্যিই বোম্বের (তখন মুম্বই হয় নি) ওই কোম্পানীতে চাকরী পেয়েছিস?” দাদার ওই কথা শুনে আমার নিজেরও কেমন সন্দেহ হতে লাগল। হাতের ফাইলটা খুলে দেখে নিলাম! কাগজে তো আমার নাম, ঠিকানা সবই ঠিক লেখা আছে!!!!! দাদা, ফাইলটা নিয়ে দেখলেন। একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস। স্বগতোক্তি করলেন- “ভগবান!!” তারপর বললেন- দেখিস, ওখানে আবার ইষ্টিশন বলিস না!! প্লেন যেখান থেকে ছাড়ে, ওটাকে বলে এ্যারপোর্ট। বুঝলি? আমি বিদ্যাসাগরের সুবোধ বালকের মত মাথা নাড়লাম। “ট্যাক্সি ধর”- দাদার হুকুম! তা ট্যাক্সিতে উঠে দাদা সর্দ্দারজীকে বললেন- চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ। আমার দিকে তাকিয়ে- “ তোকে কিছু প্রাথমিক পাঠ দেব। প্রথমেই কিভাবে ইংরাজী বলবি শোন! তোর তো আবার ভেতো বাঙ্গালী উচ্চারণ!!” আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “প্লেনে উঠতে গেলে,ইংরাজী উচ্চারণ শিখতে হয় নাকি?” দাদার চাউনি দেখে তখন আমার ধরণী ...... অবস্থা।
দাদার বোধহয় দয়া হলো। বললেন- ওরে ,সেই ম্যারিকান ভদ্রলোকের গল্প জানিস তো? বলতো!!! There was a cool day মানে কি? বা There was a brown crow!!! বলতে যেতেই, দাদা হাত তুলে থামালেন! “হবে না! তুই যেটা বলতে চাইছিস, সেটা নয়! ওই দুটো বাক্য,ম্যারিকান উচ্চারনে হবে- দরওয়াজা খুল দে আর দরওয়াজা বন্ধ্ করো!” [ গল্পটা বস্তাপচা, কিন্তু ৩৯ বছর আগে দাদার কাছ থেকেই প্রথম এই গল্পটা শুনি]
এ্যার হোসটেস রা যখন কোনো আনাউন্স করবে, তখন তো তোকে বুঝতে হবে, কি বলতে চাইছে!!! ( অনেক পরে অবশ্য, দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চারনে- মি. ভাটাচারাইয়া, ভাই ভার ইউ ভাণ্ডারিং ইন দা ভারাণ্ডা [Why are you wondering in the verandah,] শুনতে হয়েছে।) তা শুনতে শুনতে অবশেষে চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ পৌঁছলাম। ভিতরে ঢুকলাম, দাদার পেছন পেছন। বাবা বলেছিলেন- ট্রাঙ্ক আর হোল্ড অল কিভাবে নিবি, জেনে আসবি। সব টাই পরা, সাদা সার্ট, কাঁধের আ্যপুলেন্টে (পরে জেনেছিলাম ওটা আ্যপুলেন্ট) কালো কালো কি সব লেখা! বুকে লেখা- “সার্ভিস উইথ এ স্মাইল”। সবার মুখ গম্ভীর। একটা ডেস্কের সামনে দাদা দাঁড়ালেন। ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন- ইয়েস?? দাদা আমার যাবার দিনটা গোদা বাংলায় বলে বললেন ওই দিন বোম্বের টিকেট আছে কিনা!! ( আমার ইংরাজী শিক্ষাটা ধাক্কা খেল)।ভদ্রলোক একটা জাবদা খেরো খাতার মতো খুলে বললেন- ২ হ্যান আছে, কটা লাগবো? বলতে ভুলে গেছি- দাদা বাংলা বললে বাঙ্গাল ভাষা বলতেন! টাকা, বের করে দিলাম। ভদ্রলোক একটা লম্বা আয়তাকার বিল বইয়ের মত কি একটা তে মন দিয়ে লিখলেন। মধ্যের থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে পুরো বিল বইটা দাদার হাতে দিলেন। দেখলাম, পরের কাগজ গুলোতে কার্বনে সব লেখা! আশ্চর্য্য, কাবর্ন নেই, অথচ কার্বনে লেখা?????? যাই হোক, রিপোটিং টাইম, বলল- ভোর ৫.৩০ টা। সিটি অফিস! এ্যারপোর্ট না গিয়ে সিটি অফিস?? ব্যাপার কি? দাদা বললেন, তোকে গর্দভ বললে, ওই অবলা জীবদের অপমান করা হয়। আরে সিটি অফিস মানে তোকে এখানে আসতে হবে ভোর ৫.৩০ টাতে। এখান থেকে তোকে ঢাউস বাসে করে এ্যারপোর্ট নিয়ে যাবে। এটা এদের দায়িত্ব! আর ট্রাঙ্ক,হোল্ড অলের কথা কি বলছিলি? আরে তোকে তো কোম্পানী হোটেলে রাখবে। শুধু স্যুটকেশ নিয়ে যাবি! বুঝলি?
ঘাড় নাড়লাম! দাদা বললেন, প্লেনে কি পরে যাবি? তাই তো! এটা তো ভেবে দেখিনি!!!!!
সেজমামা এক্স এয়ার ফোর্স। তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন- এই গরমকালে তুই ব্লেজার পরবি? আমি বললাম- তা হলে? উপদেশ এল- সার্ট, প্যান্ট পরে যা! তা ছাড়া ব্লেজার পরলে তোকে সবাই কাকতাড়ুয়া বলবে। গরমে কেউ ব্লেজার পরে?
নির্ধারাত দিনে ভোর ৩টেয় উঠে, ফ্রেস হয়ে কপালে দইয়ের ফোঁটা পরে , বেরুলাম। শুধু সেজমামা বললেন- বিয়ে না হতেই দধি মঙ্গল? সিটি অফিস! ঢাউস বাস! উঠলাম। প্রচুর যাত্রী। যাই হোক, এ্যারপোর্ট পৌঁছলাম। প্লেনের পেটেও ঢুকলাম। গ্যালি সিট। পাশের ভদ্রলোককে দেখলাম কি একটা টিপে সামনে একটা ছোট টেবিলের মত বের করলেন। আমিও চেষ্টা করলাম। বোতাম টিপতেই পাশের ভদ্রলোক ধপাস করে সিট শুদ্ধু শোয়ার মত হয়ে গেলেন। দাঁত কড়মড় করে কি যে বলেছিলেন, এ্যাতোদিন বাদে আর মনে নেই। কান তখন ভোঁ ভোঁ করছিল। ইষ্টনাম জপ করতে করতে কথাবার্তা শুনে বুঝলাম প্লেন আকাশে। ৩ ঘন্টা বাদে প্লেনের গর্ভযন্ত্রণা শেষ হলো। তবে সে অন্য কাহিনী।
পুনশ্চ:- আমি এখনও একটু গেঁয়ো!
No comments:
Post a Comment