একটু ধান ভাঙ্গতে শিবের গান গাই। মনে হয়, অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঋগ্বেবেদের বিবাহ সূক্তে (১০/৮৫) যে সব উক্তি আছে তার থেকে প্রমাণ পাই যে সেকালে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। প্রাসঙ্গিক অংশটিতে পাই, বধূকে আশীর্ব্বাদ সূচক একটি ঋক্ (৪৬) । তাতে যা লেখা আছে, তার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়- “তুমি শ্বশুরের উপর প্রভুত্ব কর, শ্বশ্রুকে বশ কর, ননদ ও দেবর গণের উপর সম্রাটের মত আধিপত্য কর।” বধূ বিবাহের পর এক বিরাট পরিবারের অঙ্গীভূত হত; তাকে শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ, দেবরদের নিয়ে সংসার করতে হত। এই গুলো ব্যবহারিক প্রয়োজন দ্বারা যে অনুপ্রাণিত ছিল, তা পাঠক মাত্রেই বুঝতে পারবেন। আমার মনে হয়, একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে অনেক গুলো আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে আত্মপ্রকাশ করত। মানুষ হতেও মানুষের যে প্রতিকূলতা আছে তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য একটি শক্তির প্রয়োজনীয়তা, এবং সেই শক্তি হল যৌথ পরিবার, আর সেই যৌথ পরিবার কে সযত্নে রক্ষা করা।
আমি সমাজতাত্ত্বিক বা শব্দ বিশেষজ্ঞ নই, তবুও আমার মনে হয় “পাড়া” এই ধারণাটা এই যৌথ পরিবার থেকেই এসেছে। তা প্রত্যেক যৌথ পরিবারেই একজন করে অভিভাবক থাকতেন, যাঁরা যৌথ পরিবারের প্রত্যেকের অভাব অভিযোগের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। সাধারণত তাঁদের পরিচিতি “কত্তা” নামেই হত। “পাড়া” হত ( ইচ্ছে করেই অতীত ব্যবহার করলাম) কতক গুলো যৌথ পরিবারের সমষ্টি। এখানেও একাধিক “কত্তা” থাকতেন, যাঁদের ‘দাদা’ বলা হত।‘দাদা’ মানেই বড় ভাই আর এটা ষ্পষ্ট যে এঁরা কিন্তু রক্তের সর্ম্পকের না হলেও , ‘দাদা’ হিসেবেই আমাদের দায়ে অদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
তা যা বলছিলাম, সেই ঋগ্বেদের যুগ থেকে কিছুদিন আগে পর্য্যন্ত যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব ছিল। আর সেই যৌথ পরিবারে কিছু এমন সদস্যও থাকতেন, যাঁরা আবার গ্রাম সর্ম্পকে বা দূর সর্ম্পকের আত্মীয়। সব মিলিয়ে একটা জমজমাটি ব্যাপার।বেকার, সকার, নিষ্কর্মা, সব ছিল।
দেশ ভাগ হবার পর চেহারাটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙ্গে পড়তে লাগল।(শ্রী প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাস আর গল্পে এর প্রতিফলন আছে)
যৌথ পরিবারে সব মজার মধ্যে, কোথায় যেন সুর,তাল, লয় কেটে যাচ্ছিল। যারা রোজগার করেন, তাদের পাতে একটু ভালো মন্দ জিনিস, আর যারা করেন না; তাদের পাতে ওই থোড় বড়ি খাড়া বা খাড়া বড়ি থোড়।“পাড়া”তেও কিন্তু এর প্রভাব পড়তে শুরু করল। নিমন্ত্রণ বাড়ীতে কোমোরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করার সময়, গানও তৈরী হলো—“ আরে যাদের পাতে মাথা মুড়ো, ওরাই কি তোদের জ্যাঠা খুড়ো?” ফলে,ম্যাটিনী শো এর টিকিট, মা, জেঠাইমা, খুড়ীমাদের কেটে দেওয়ার লোকের অভাব। ঘরে বসে, রঙ্গ মিলন্তি তাস আর কাঁহাতক খেলা যায়? পরনিন্দা, পরচর্চা শুরু হলো, আর জমতে লাগলো ধূমায়িত অসন্তাষ। আরও একটা ব্যাপার শুরু হলো, খুব আস্তে।“লভ ম্যারেজ”।“কত্তা”রা এই “লভ ম্যারেজ” ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতেন না; নানা কারণে। জাত, পাত, সম্ভ্রম, আভিজাত্য সব মিলিয়ে একটা ভজকট ব্যাপার। ব্যাপারটা যেখানে গিয়ে দাঁড়াল,যারা “লভ ম্যারেজ” করত, তারা আলাদা হতে থাকল। একটা আপাত স্বাধীনতা, এদের কে আর যৌথ পরিবারের দিকে আকর্ষণ করতে পারল না।
এরপর, জীবিকার প্রয়োজনে.. দেশে, বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল যৌথ পরিবারের লোকেরা। প্রথম প্রথম চিঠি- চাপাটি, তারপর প্রাথমিক উচ্ছাস কেটে গেলে; কমে যেতে লাগল যৌথ পরিবারের বন্ধন। জীবন যাত্রার মানও বদলাতে লাগল । স্বাভাবিক ভাবেই একই যৌথ পরিবারের লোক হলেও একটা অলিখিত ফারাক চলে এল। বাংলা ও বাঙ্গালি বদলাতে লাগল। বদলাতে লাগল, রুচি, ভাষা। রান্নাঘরেও এল অন্য স্বাদ। যে বাঙ্গালি অর্দ্ধেক ডিম খেত, যৌথ পরিবারে; তাদের সন্তানরা খেতে লাগল দুটো করে ডিম। মুড়ি, বাদাম হটে গিয়ে এল চাউমিঁএ। মুরগী আর বাইরে রান্না করতে হল না। বড় বাড়ী, প্রমোটিং এ চলে গেল। “যত্ত সব ফালতু সেন্টু” বলার লোক বেড়ে চলল। অণু পরিবারে ২ টাকায় সারাজীবন বসে খাওয়ার পিঁড়ি অদৃশ্য।
নিমন্ত্রণ খাওয়াবার জন্য গামছা পড়া পাড়ার ছেলে ছোকরা? তারাও যাদুবলে ভ্যানিশ। ক্যাটারারের আবির্ভাব হল। “দাদা, এদিকে আরও দশ পিস মাছ” বলা উঠেই গেল। সব ক্যালরি কনসাশ!“দাদা, এদিকে জল দেখি” আর কেউ বলে না। “এই যে, জল টা নাচান তো” বলার লোক বেড়ে চলল।
বাবা, মা গর্ব করে বলতে লাগল--- ছেলে না, বাংলাটা বলতে পারে; কিনতু পড়তে লিখতে পারে না।
পাড়ার রক আর নেই। ফলে, টেনিদা, ঘনাদা নেই। ঠাকুমার ঝুলি নেই। হ্যারি পটারের লেটেস্ট এডিশন কেনার জন্য ভোর থেকে লম্বা লাইন।
ঠাকুমা, ঠাকুরদারা সব বৃদ্ধাশ্রমে। যৌথ পরিবার?????? “যত্ত সব ফালতু সেন্টু”!!!!!!!!!!
খালি আমরা কিছু পাগল লোক, লবেঞ্জুসের মত তারিয়ে তারিয়ে স্মৃতি টাকে চুষে চুষে খাচ্ছি।
আর কাজ নেই হে????? “যত্ত সব ফালতু সেন্টু”!!!!!!!!!!
No comments:
Post a Comment