ডি লা গ্র্যান্ডি, মেফিষ্টোফেলিস, ইয়াক্ ইয়াক্ ! সকাল ১১ টায়,দমদমে প্লেন থেকে নেমে,ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের বাইরে এসে, ডঃ কুশল মিত্রের, চিৎকার ।
মাষ্টারমশাই ভজহরি মুখুজ্জে, ডাঃ বাবুকে রিসিভ করতে গেছিল আ্যরপোর্টে । গেটের বাইরে , দাঁড়ানো অন্য লোকজন একটু অবাক ,এই দুজনের এইরকম চিৎকার শুনে।
ভজহরি বলল:- দাঁড়া, কুশল! পরের ইণ্ডিগো ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু থেকে আসছে- ইঞ্জিনিয়ার স্বর্ণেন্দু সেন ।
হাতে, গাড়ীর চাবি দোলাতে দোলাতে সফ্টওয়ার কোম্পানীর মালিক কমলেশ ব্যানার্জ্জিও হাজির ।
কমলেশের গাড়ী করে, সকলে মিলে যাবে, পটলডাঙ্গায় ! কমলেশের দুই বোন, আধুলি আর পুঁটি ; এখন বিবাহিত । একবার, ওদের বাড়ী দুটোতেও হাজির হবার প্ল্যান আছে ওদের ।
আধুলির বরের নাম – ভোলা । পুঁটির বর- বঙ্কা !
দমদমের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে, কমলেশের স্করপিও গাড়ী করে ওরা তিনজন চলে এলো ডোমেষ্টিক টার্মিনালের বাইরে । ডিসপ্লে বোর্ডে জ্বল জ্বল করছে, ইণ্ডিগোর প্লেন নামার তথ্য ।
নীল আকাশের পেঁজা মেঘের টুকরোর মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে হালকা ধূপ ধুনোর গন্ধ।
বৃষ্টি ভোর বেলা পর্যন্ত তাড়ু ব্যাটিং করে, আউট হয়ে, প্যাভিলিয়নে ফেরত । এখন জেন- এক্স, রোদ্দুর আকাশ পাত্র থেকে উছলে উছলে পড়ছে । আজ চতুর্থী ! মাত্র দুদিন বাকী দুগ্গোপুজোর !!!!
স্বর্ণেন্দু বেরিয়ে আসার পর ভজহরি চিৎকার করল-ডি লা গ্র্যান্ডি, মেফিষ্টোফেলিস !!
বাকী তিনজন সমস্বরে বলল :- ইয়াক্ ইয়াক্ ।
টেনিদা মোবাইল কানে গুঁজে, ঘনাদাকে ফোনালো । ঘনাদার বাড়ী, আ্যরপোর্টের কাছেই । বনমালী নস্কর লেনের টঙ্গের ঘরে আর থাকেন না ।
-ঘনাদা?
- হ্যাঁ বল্
- আমি, ভজহরি বলছি ।
- চোপ্ ! ব্যাটা মাষ্টার হয়ে কেতা ধরেছে ! আমাদের কাছে, তুই টেনি ! এবার বল, কি বলবি ?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ ! আমি টেনি ! প্যালা, ক্যাবলা, হাবুল সব চলে এসেছে ।
- বেশ ! এবার তালে একদিন আড্ডানো যাক । তোরা, লর্ডসের মোড়ে আসবি । তারপর, চিনি কম রেষ্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যে গলি, সেই গলির মধ্যেই আছে লর্ডস রেস্তোঁরা । ওখানকার বিরিয়ানীটা জম্পেশ ।
- কবে বলো ?
- আজকেই কর । প্যালা, ক্যাবলা, হাবুল তো সাউথ সিটিতে ফ্ল্যাট কিনেছে । ওদেরও সুবিধে হবে । তুই তো, এখন বাঘাযতীনে থাকিস । আমার অসুবিধে হবে না । প্যালাকে বলবি, তোদের সঙ্গে আমাকে ওর গাড়ীতে করে তুলে নিয়ে যেতে ।
ফোনানোর পরে, চারমূর্তি পটলডাঙ্গার দিকেই রওনা দিল । চাটুজ্জেদের রোয়াক আর নেই । বাড়ীটা ভেঙ্গে প্রোমোটিং হয়েছে । তাও ঘুরে আসা, সেই ছোটবেলার দিনগুলোকে চেখে দেখার জন্য । রাস্তায়, ঘনাদাকে তুলে নেবে ।
ক্যাবলা এখন নামকরা ডাক্তার লণ্ডনে । টেনিদাকে জিজ্ঞেস করল:- তালে টেনিদা, তুমি কি কি সাবজেক্ট পড়াও ইস্কুলে ?
ইংরেজী বাদে সব ।
সেকি ! ওটাই তো তুমি একটু বুঝতে !
ওই জন্যই তো পড়াই না- টেনিদার ঝটিতি জবাব ।
হাবুল বলল :- খাইসে ! টেনিদা ! অঙ্ক শেখাইত্যাসেন?
চোপ্ ! এক চড়ে , তোর নাক নাসিকে পাঠাবো ! আমি শেখাতে পারি ভালো ! যা, প্যালা, গাড়ীটা থামিয়ে কিছু খাবার কেন্ তো ! সক্কালে মাত্র ৩০ টা লুচি খেয়েছি । খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে ।
ক্যাবলা বলল:- বিকেলে হাতীবাগান গিয়ে এগপ্লানটাইটিস্ খাবো !
হেইডা আবার কি? হাবুলের জিজ্ঞাসা ।
আরে!!!! ডাক্তারি পরিভাষায় শব্দের শেষে “আইটিস” থাকলে, সেটাকে ফোলা বলে । এগ্ প্ল্যান্ট মানে বেগুন । তোদের আবার কালচারাল শক্ লাগতে পারে । তোরা তো ব্রিঞ্জাল বলিস । সে যাক গে । বেগুনি গুলো ফুলো ফুলো হয় তো ! তাই-এগপ্লানটাইটিস্!
ক্যাবলার উত্তর !
প্রাক পূজোর ভীড়ে, চারিদিকে গমগম করছে । গাড়ীর জ্যাম । সব মিলিয়ে ভজকট অবস্থা ! প্যালা, গাড়ীটাকে পার্ক করতে পারছে না ।
বাগুইআটির “জাষ্ট বেকড্” এর দোকানটাতেও অকথ্য ভীড় । ওখানে ঢুকে যে একটু কোল্ড কফি খাবে, তারও উপায় নেই । প্যালা, গাড়ীটাকে কোনোরকমেও এগিয়ে নিয়ে, চালপট্টির মধ্যে দিয়ে ঘনাদার বাড়ীর দিকে যেতে শুরু করল ।
ঘনাদার বাড়ীর কাছেই একটা দোকান ঘেঁসে গাড়ীটাকে পার্ক করে একটা দোকান থেকে “ মোবাইল মুড়ি” কিনল প্যালা ।
আইসক্রিম কোণের মত দেখতে প্যাকেটটা ।
এগুলো ছোটো । বড়গুলো সিঙারার মত দেখতে । মুড়ি, আগে থেকেই মেখে রাখা আছে এই প্যাকেট গুলোতে ।
প্যালা আনতেই, সবাই অবাক । মুড়িও আজকাল রেডিমেড !!!!!! টেনিদা বলল:- হাবুল!
তুই আর বলতে পারবি না – মেকুরে হুড়ুম খাইয়া হৈক্কর করসে ।
হাবুল কি একটু উদাস !
যে রেটে চলছে তাতে অচিরেই করিম্সের বিরিয়ানি, সাবিরের রেজালা, ম্যাকডোনাল্ড, কে এফ সির রমরমা আসবে ।
প্যাকেটের শেষ নুনটুকু আর চাটার সুযোগ নেই ।
ঘনাদা, মাঞ্জা মেরে এসে উঠে পড়লেন গাড়ীতে । চারিদিকে, ঢাকের শব্দ- তবে মাইকে আস্তে করে বাজছে । শাড়ী পরা মেয়েরা সংখ্যায় কম । সবাই জিনস আর সার্ট ! কে যে মেয়ে, আর কে যে ছেলে সেটা বোঝাই যাচ্ছে না ।
ক্যাবলা, “ডানহিল” সিগারেটের তিনটে ফ্লিপ প্যাকেট ঘনাদার হাতে তুলে দিল । গাড়ীর এ.সি.টা বন্ধ করে জানলার কাঁচগুলো নামিয়ে দিল প্যালা ।
ক্যাবলা বলল :- ঘনাদা, আমাদের গল্পগুলো আজকালকার নতুন প্রজন্মের কিশোর- কিশোরীরা আর পড়ে না বোধহয়, তাই না?
ঘনাদা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অর্ন্তযামীর মত বলল:- সবেতেই ঠেসেঠুসে সমসাময়িক সমাজ, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক পটভূমি মায় ভূমার প্রভাব ভরে দিতে হবে এইটা এই সময়ের একটা আজব দাবি।
এর চেয়ে স্মার্ট ফোনের বিজ্ঞাপন পড়লেই হয়, আমাদের গপ্প পড়তে যাওয়া কেন বাপু !!!!
এই মূল্যায়ণটা দামড়ারা করছে । পটলডাঙার চারমূর্তির সঙ্গে এই সময়ের আত্মিক যোগ নেই ! আজকের কোচিং দৌড়নো, হায়ার সেকন্ডারি দেয়া, কম্পু-স্যাভি, মোবাইল-কানে ব্যাচের সঙ্গে আর কোন যোগ নেই।
নির্মল হাস্যরস টেনি দিত। খুব সিম্পল কমিক,চারমূর্তির সাথে অনেক বেশি
আইডেন্টিফাই করতে পারত সেই সময়ের ছেলে- মেয়েরা।
টেনিদা - ঘোয়াং ঘাং ! বললে, আজ আর কেউ হাসে না !
প্যালা গাড়ী চালাতে চালাতে বলল :- পেশোয়ার কি আমীর? ঈশ্বরের দান সেই আমগাছ যা পরের কালবৈশাখীতেই পড়ে যায়। ঐ আমের জোরেই তো টেনিদার কুট্টিমামার (?)
হবু বসের বাত সেরে গেছলো আর মামা চাকরী পেয়েছিলেন। এটার কথা মনে নেই !
ঘনাদা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল:- সূর্য্য কাঁদলে সোনাতে জম্পেশ করে গপ্পো বললাম ।
এখনকার সব লোকেরা হাসে ।
একটা বিশাল ভীড় । সিভিক পুলিশে থুক্কু গার্ড ছয়লাপ । হাবুল মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল:- কি হইসে ভাই !
পোসেনজিৎদা আসছে পূজোর উদ্বোধন করতে । এখন যেতে পারবেন না । দেরী হবে ।
ক্যাবলা বলল:- পুঁটি মেল পাঠিয়েছিল । পটলডাঙ্গা থাণ্ডার ক্লাবে মুখ্যমন্ত্রী আসছেন পূজোর উদ্বোধন করতে । আজ বোধহয় আর পটলডাঙ্গায় ঢুকতে পারবো না !
বাঙুর দিয়ে, সোজা, উল্টোডাঙ্গা হয়ে হাতিবাগান ক্রসিং পেরিয়ে পটলডাঙ্গার দিকে চলল প্যালা ! পথে তেলেঙ্গাবাগান পূজো, হাতিবাগানের পূজো । ভীড়ে ভীড়াক্কার ।
ঘনাদা বলল :- চল প্যারাডাইসের কচি ডাবের সরবত খাই ।
প্যালা গাড়ী ঘোরাল কলেজ স্ট্রীটের দিকে । যাবে কি? এত ভীড় ঠেলে মানুষ হাঁটতেই পারছে না, তো গাড়ী !!!!!
টেনিদা শুকনো গলা দিয়ে বলার চেষ্টা করল -ডি লা গ্র্যান্ডি ! শব্দ বেরুলো না !
মনে মনেও কেউ বলল না – ইয়াক্, ইয়াক্ !
শালপাতার বদলে, কাগজের থালা ভিড়ে চিপ্টে গেছে । বড় হয়েও সুখ নেই !
কোলকাতায় না এলেই বোধহয় ভালো হতো
No comments:
Post a Comment