Friday, May 24, 2013

আমার শ্বশুরবাড়ী যাত্রা!


***এই লেখাটি এপ্রিল ২০১০ সালে লেখা এবং প্রকাশিত
-----



ট্রেন থেকেই শুরু করি। শিয়ালদা থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস সন্ধ্যে ৭.৩৫ এ ছাড়বে।কোচবিহার যাব। খুড়তুতো শালাবাবুর বিয়ে। কোচবিহারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ৩৬ বছরের সর্ম্পক। সৌজন্য- বিবাহ।মনটা খুব ভালো নেই। গচ্চা গেছে অনেক পয়সা। কি সব উপহার কিনেছেন আমার উনি। সান্তনা দিলেন- আরে আমরা তো সিনিয়ার সিটিজেন। ভাড়া তো কম লাগছে যেতে।বুঝলাম, সান্তনা দিচ্ছেন। জনান্তিকে ভাবলাম, মরে তো গেছি; মাথার চুল কামালে আর কতটুকু হালকা হব?যথারীতি, শেয়ালদা পৌঁছলাম। জানি প্ল্যাটফর্ম ৯শেষ মুহূর্তে মাইকে বলল প্ল্যাটফর্ম ৮যৌবনের সেই সার্ভিস উইথ এ স্মাইলেরকথা মনে পড়ল। সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছেরং বদলায় নাহুড়মুড় করে প্ল্যাটফর্ম ৮কোচ নং ৯প্ল্যাটফর্ম না হোক, কোচ তো হল। এবার দেখলাম, যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানেই কোচ টা দাঁড়াল। কোচবিহারে বিহার করতে যাচ্ছি, কোচ তো সামনে দাঁড়াবেই। কি বলুন? তা, ধীরে ধীরে সীটে গিয়ে বসে,জম্পেশ করে একটা সিগারেট ধরালাম। হাঁ হাঁ করে উঠলেন, সামনের ভদ্রলোক।খাবেন না, খাবেন না!”“কেন?”“দেখছেন না! এই যে, আমার প্যাকেট। আমি বলে খাচ্ছিনা, আর আপনি খাচ্ছেন?”“তাতে, আপনার কি? আমি তো আপনার কাছে সিগারেট চাই নি।”“বুঝবেন ঠ্যালা, যখন পুলিশ ধরবে!!!”“কেন, পুলিশ ধরবে কেন, আমি কি চুরি করেছি নাকি ,আপনার সিগারেট?”“কোন বেকুবের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা!!! কোত্থেকে আসচেন? দেখে তো হটেনটট মনে হচ্ছে না”“দেখুন! গালাগালি করবেন না!বেকুবটা বুঝি, হটেনটট মানে কি?”“যা ইচ্ছে বুঝুন, শুধু সিগারেটটা খাবেন না”“আরে মশায়, আপনি কি আমার গার্জেন নাকি? উনি তো সাথেই আছেন, কিছু তো বলছেন না!! আপনি কে মশাই?”

এবার হাসতে হাসতে পাশের কিউবিকল থেকে ভদ্রলোকের মেয়ে ( পরে জেনেছি) এসে সামনে এসে বলল- জেঠু, অনেকদিন হলো রেলের প্ল্যাটফর্ম আর কামরায় সিগারেট খাওয়া বন্ধ। পুলিশ দেখতে পেলে, হয় ফাইন না হয় জেলে পুরবে আপনাকে। জানেন না? অনেকদিন ট্রেনে চড়েন নি, না?ধাঁ আ আ-- করে মনে পড়ল। চট করে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে, আমার পক্ষে যতটা সম্ভব মোলায়েম মুখে বললাম- আগে বলবেন তো!!! খালি হেঁয়ালি করে যাচ্ছিলেন!!! ভদ্রলোক স্বভাবতই গম্ভীর।বললাম- আমার চেহারা দেখেছেন? (যাঁরা আমায় লাইভদেখেছেন, তাঁরা জানেন, আমি গোরিলাদের সাক্ষাৎ বংশধর)কেন? মারবেন নাকি?ছিঃ! ছিঃ! কি যে বলেন!!!!আরে না মশাই। আমার যেমন দেহে ফ্যাট, সেরকম ব্রেনেও ফ্যাট! তাই ব্রেনের হার্ড ডিস্কের ফাইল আ্যলোকেশন টেবল”(FAT) কাজ করে না আমার। ফলে,এই ধূমপায়ীদের বিরূদ্ধে ফরমানটা ভুলে মেরে দিয়েছি।এবার মেয়ে হেসে বলল- NTFS বা New Type File System, Brainএ লাগিয়ে নিন। অনেক তাড়াতাড়ী কাজ করবে। আমি বললাম- বুঝলে হে, আমার সবই Unmovable Files. কিস্সু কাজ হবে না!বাবার পালা এবার- কি ভাষায় কথা বলছেন আপনারা?আমি- হটেনটটদের ভাষা!করে, করে; অবশেষে রাতের খাওয়া। রুটি একদম খেতে পারি না, সেই শুকনো রুটি! আর আলুর দম! উনি বললেন- খরচা বাঁচাচ্ছেন!!! ( আলু ৪ টাকায় নেমে এসেছে)যাই হোক, খেয়ে, টয়লেটে গিয়ে সিগারেটে সুখটান দিয়ে; শুয়ে পড়লাম।
বোধহয়, মালদা হবে। রাত নিঝুম। আমাকে কে যেন দূর থেকে ডাকছে। ও মশাই,ও মশাই.......নিশির ডাক হতে পারে ভেবে ঘাপটি মেরে অনেক ক্ষণ পড়ে থাকলাম। জোর ঠ্যালা খেয়ে হুড়মুড় করে উঠতে হলো। উনি, দেখি মাথা নিচু করে বসে। ওই ভদ্রলোক, সঙ্গে আরও কিছু লোক---- মশাই, আপনার নাকের সাউণ্ড বক্সের বাসটা কমাবেন?“হটেনটটদের ভাষা জানলেন কি করে?”“রাখুন তো, কোচে কেউ ঘুমতে পারছে না”“কেন?”“অত জবাব দেবনা! আর ঘুমোবেন না। এবার আমরা ঘুমোই”“এ তো তুঘলকি ফরমান”!“পরিবর্তনের জমানা! বুয়েছেন?????”“এই এক প্যাকেট সিগারেট দিলাম, টয়লেটে মাঝে মাঝে গিয়ে খেয়ে আসবেন, কিন্তু খবরদার!!!!! ঘুমোবেন না!!!! আপনি হৃদয়হীন হতে পারেন, কিন্তু আমরা নই। তাই সিগারেট দিলাম”“নাকের আমি, নাকের তুমি, নাক দিয়ে যায় চেনা”--- একজন ফুট কাটলেন।আরও একজন--- ঘুম পেয়েছে? বাড়ী যান! ট্রেনে কেন স্যার!বাউনের ছেলে- সব সইতে পারি, এমনকি চর্মপাদুকার প্রহার পর্যন্ত, কিন্তু অপমান???? কদাপি নয়! রেগে গিয়ে টয়লেটের সামনে মোবাইল চার্জ করতে লাগলাম!সক্কাল বেলায় নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে প্রায় অর্ধেক কোচ খালি! যাবার সময় ওই মেয়েটি বলে গেলবোফোর্স কামান দেখি নি। আওয়াজটা শুনে গেলাম।
গোটা উত্তরবঙ্গে, দোলের দিন আবীর খেলা হয়।আর তার পরের দিন রং খেলা।কোচবিহারও তার ব্যতিক্রম নয়।ফলে, যে দিন কোচবিহার পৌঁছলাম, সে দিন কোলকাতায় দোল খেলা হলেও, কোচবিহার নিরাপদ।কোচবিহার নামে ষ্টেশন থাকলেও, নিউ কোচবিহার ষ্টেশনে নামতে হয়।ওখানেই উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের যাত্রা শেষ। নিউ কোচবিহার ষ্টেশন থেকে কোচবিহার শহর প্রায় ৯ কি.মি.রিক্সা, বাস আর প্রচুর পরিমাণ ভাড়া গাড়ী, আপনাকে শহরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।এমনিতে, চাটার্ড গাড়ীতে, ষ্ট্যানডার্ড ভাড়া-১৫০ টাকা।স্থানীয় ভাষা, বাঙ্গাল না হলেও, একটু অন্যরকম। পরে, তারও উদাহরণ পাবেন।আস্তে আস্তে মালপত্র নিয়ে, বড় শালাবাবুর ( ষ্টেশনে এসেছিল, রিসিভ করতে, নাম- রাহুল) সঙ্গে ওভারব্রিজ পার হয়ে, আমার ওনার সঙ্গে যখন বাইরে এলাম, তখন প্রায় সব গাড়ী অদৃশ্য। বসার উপযুক্ত করে নেওয়া,একটা টাটা এসগাড়ীকে, ডাকল রাহুল।ড্রাইভার- জামবাবু না? এই গাড়ীতে আসচেন? বসেন, বসেন। দিদিও বসেন। রাহুলদা, আমারে বসায়ে ইষ্টিশনে গেল্, আপনাদের আনতে। মজবুত গাড়ী।ভয় নাই।বলে, সিটটা বাড়ি দিতেই,একটা মেঘ উড়ে এল। ধূলো না নস্যি, বুঝলাম না! হাঁচতে, হাঁচতে প্রাণ অতিষ্ঠ।ড্রাইভার- তা অনেকদিন পরে আসতিছেন, জামবাবু।কোচবিহারের অবস্থা একটু পালটিছে।আপনিও মোটা হই গেল্ মেঘটা আস্তে আস্তে কাটছে! হাঁচিটাও কমছে!ড্রাইভার, এবার তুরীয় মেজাজে।বলল- জামবাবু, একটা নতুন টিভি কিনসি। কালারিং। বউ পোস্কার করতে যাতিছিল, আমি মানা করসি। করসে কি, কাপড়ে সোডার জল দিয়া ঘসতে যাতিছিল, ওই ইস্ক্রিনটা। মাথ্থা খারাপ! সোডা দিয়া ঘষলে যদি রং উইঠ্যা গিয়া সাদা কালো হইয়া যায়! সোডা দিয়া আজকাল খুব রং উঠতিসে। কি দিয়া পোস্কার করব, বলি ফ্যালান তো!গম্ভীর হয়ে বললাম, বিয়েটা মিটে যাক, তোর বাড়ী গিয়ে সব বলে দেব।কোচবিহার শহরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব রাস্তা সোজা। সুপারী গাছ প্রচুর। আর প্রায় প্রত্যেক বাড়ীর সামনে বাগান।
যাই হোক, শ্বশুর বাড়ী পৌঁছলাম। ওনাকে গ্যারেজ করে, বেরুলাম দাড়ী কাটতে। বাক্সের মধ্যে কোথায় সব যন্তর সেঁধিয়ে আছে!!! কে আর খোঁজে?কাছেই প্রিন্স হেয়ার কাটিং সেলুনমালিক- পরমেশ্বর। ছাপরার লোক! কিন্তু, কোচবিহারে থেকে ৯৯% বাঙ্গালী। সেই ১৯৭৪ থেকেই আমার বন্ধু। গিয়ে দেখি, ও গতকালই দেশে গিয়েছে। ছেলে রামেশ্বর। ছোট্ট করে রামু। লম্বায় ৪ ফুট ৫ ইঞ্চি। দেখেই, চিনতে পারল।বাপ্পা, রাহুলের বন্ধু। ওখানে বসেছিল।শুনতিচীলাম, আপনে আসতিচেন। নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে আসিচেন?”‘হ্যাঁতা- আচেন কেমুন?ওই ডাল ভাত খেয়ে কোনরকমে আছি আর কি!জামবাবু, আপনে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দ্যান?কেনো রে?না, ডাল চালের যা দাম! বড়লোকেরাই খেতে পারে। ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন না দিলে, আপনারে ধরবে। বুঝচেন নি??? রামু- কি কাটবেন?আমি- যাঃ!! বাবা! আমি কাটব কেন? তুই তো কাটবি!বাপ্পা- কিন্তু, জামবাবু, রামু তো লাফিয়ে, লাফিয়ে আপনার চুল বা দাড়ী কাটবে।সেলুন, ভর্তি লোক চেয়ে রইল।
তা, পরের দিন রং খেলা। বাইরে যেতে পারছি না।এদিকে কম্পিউটারও নেই, যে অরকুটে ঢুকব।মেয়ে মহলে উত্তেজনা। নানারকম প্ল্যানিং চলছে।যার বিয়ে,(সুষ্মিত) গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ, একটা শন্না নিয়ে এসে বলল- আয়না দিয়ে দেখলাম,ঘাড়ে একটা ছোটো পাকা চুল দেখা যাচ্ছে, তুলে দাও তো!চশমা পরে, তন্ন তন্ন করে সেই অদৃশ্য পাকা চুল খুঁজে পেলাম না। তাই একটা কলপ করা চুলই তুলে দিলাম। শালাবাবু, খুব খুশী। বলল- যাক, আপদ বিদেয় হলো। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও পারছিলাম না।ভেতরের বারান্দায়, একটা ইজিচেয়ার। বসে পড়লাম। সামনের ছোটো টুলে পা দিয়ে বেশ আরাম। ননীবালা, সংক্ষেপে ননী, চা নিয়ে এলো। বুঝলাম, কিছু বলতে চায়।বলো, ননীকইলকাতায় কি রোজই হাট বসে, জামবাবু?কেন রে, ননী?শুনিসি, ইষ্টিশনে প্রচুর লোক, আমাদের ইআনে , প্রচুর লোক মানি তো হাট করতি যাওয়া!!!আস্সা, তোমারে পুছ করি, ওই যে আলা ( আলো, সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প) নাগাসে না, আমদের পঞ্চরঙ্গী মোড়োত!, এই টা কিসের আলা?ক্যানো রে ননী?লোকোত বলিসে, ওড্ডা নাকি ইলেকটিরি!হ্যাঁ তো!মস্করা করতিস? ইলেকটিরি হলি তো তার থাকিবে। ওড্ডা তো দেখত্ পারি না। ( কনসিলড্ অয়ারিং)তোর কি মনে হয়?ওড্ডা হলো কেচ্চিন ( কেরোসিন)ওড্ডা তে ঢাউয়া (বড়) বাস্ক আছি না!!! হলদা আলা তো কেচ্চিনেই হয়।দুক্কুর বেলাত আসি মিনিস পালির লোকেরা ঢাউয়া বাস্কত ঢালি। বুঝিছ?ইতিমধ্যে লোডশেডিং ( ওখানে এটা না হলে, লোকে ৭ দিন আশ্চর্য হয়ে থাকে, কারণ, আমাদের কারেন্ট যায়, ওদের আসে!)ভেতরের বারান্দায় একটা খোলামেলা উঠোন আছে। ফলে, ওখান দিয়েও ঢোকা যায়। একটা কুকুর ঢুকে পড়ে আমাকে দেখে ল্যাজ নাড়ছিল। কুকুরে আমার ভীষণ আ্যালার্জি।তাড়াতে গেলাম। রাহুল বাধা দিল।জামবাবু,একটা পাখা ওর ল্যাজে ব্যাঁধে দিতেসি। তুমি বিস্কুট দাও, ল্যাজ লাড়লেই তুমি পাখার বাতাস পাবা।
একটু পরেই, কালোদা এন্ট্রি নিলেন। কালোদা,(ইনি প্রায় চলতি বাংলাই বলেন) প্রায় আমার বয়সী, একটু বড়ই হবেন। মেজ খুড়শ্বশুরের থেকে বয়সে অনেক ছোট হলেও,ওনার বন্ধু। নাটক করার শখ আছে। অনেকদিন আগে, কোচবিহারেই ওনার একটা ঐতিহাসিক নাটকের রিহার্সাল দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।জাঁহাপনাকে হাজাপোনাবলেই যাচ্ছিলেন। আর একটা ডায়ালগ ছিল, রক্ষী---বন্দী কর। কালোদা বারবার বলছিলেন, বন্দী- রক্ষী কর।বুঝলে হে জামাই! এবার একটা জব্বর লাটক লামাচ্ছি-কালোদা উবাচ।কি নাটক, কালোদা?নিজেই লিখেসি।বাঃ! বাঃ!হনুমানের ওপর বেস করে, বুঝলে? তা কত্তদিন থাকিসঅ?ক্যানো কালো দা?না, তোমাকে ভাবতিছিলাম, ওই লিড রোল টা দিব। সিরিয়াসলি বলছি। ওর্রম চেহারা!!! ( কালোদা, কিন্তু সিরিয়াস ছিলেন)একটু আসছি বলে, উঠে বসার ঘরে গেলাম।কালোদা একটু অবাক হলেন, আমার এই ব্যাবহারে।রাহল বলল- জামবাবু, মনে ব্যাথা পাসে।ক্যান?????আরে হাটের গল্প ভুলা গেলা?কোনডা রে?
এবার রাহুলের পালা ( আমি কোচবিহারের ভাষা থেকে কিছুটা অনুবাদ করে দিলাম)হাটে, কলাওয়ালা আর পানওয়ালা বসে। কলাওয়ালা, একটু ভুলো মন।একদিন, পানওয়ালা একটু আগে এসে হাটে বসেছে। কলাওয়ালা, আসছে দেখে, মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল।পানওয়ালা- ও কলাওয়ালা, তোর মাথায় ওড্ডা কি?কলাওয়ালা- কলাপানওয়ালা- কাটি দিম, তোর গলাকলাওয়ালার খুব দুঃখ হল। বাড়ীতে বৌ বলল- কি হয়েছে?শুনে বলল- তুই আগে যাবি। জিজ্ঞেস করবি- ও পানওয়ালা তোর মাথায় ওড্ডা কি?যেই বলবে, পানবলবি- কাটি দিম তোর কানকলাওয়ালা খুব মুখস্থ করে পরের দিন, আগে হাটে গেল।পানওয়ালা আসছে দেখে ও পানওয়ালা, তোর মাথায় ওড্ডা কি?পানওয়ালা- পানকলাওয়ালা- তোর পিছত ঢেঁকি।পানওয়ালা- মিলল না,মিলল না,মিলল না।কলাওয়ালা- মিলল না তো কি? পিছত ব্যাথা তো লাগসে!বুঝলা, কালো কাকু, জামবাবুর পিছত ব্যাথা তো লাগসে! তারপর, বিয়ের গপ্পো! তা সেটা না হয়, অন্য কোনো সময়!


বাকী মশলা




আমার যৌবনের একটা শোক মাঝে মাঝেই মনে উথলে উঠে! সেই কালে বড্ড ব্যাথা পেয়েছিলাম। এখন হাসি।

কারণ, সেই পৃথুলা ( বর্তমানে) মহিলার সঙ্গে বছর দুই আগে পার্ক ষ্ট্রিটে দেখা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল- ওনার ১৭/১৮ বছরের সুন্দরী নাতনী।
আমাকে দেখে, কুশল বিনিময়ের পর নাতনীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলেছিলেন- ইনি তোর হলেও হতে পারতঠাকুরদা!
নাতনী তো হেসেই খুন! বলল- গ্র্যানি, তুমি না খুব সুইট! এইরকম লোকের সঙ্গে আমি একটু আড্ডা দিয়ে, তোমাদের পুরোনো প্রেমের গপ্পো শুনবো।
তো, আমরা গিয়ে বোসলাম সিলভার ড্রাগনে।
নাতনী আমাকে বললো- সুইটস, তুমি বিয়ার না জিন নেবে?
আমার তো শুনেই জিভ লকলক করে উঠলো। তাও একটু লজ্জা ভাব করে, বললাম- দেবে? তা দাও !

আমার কাছ থেকে শুনে নিয়ে অর্ডার দিল:- দুটো জিন উইথ ফ্রেস লাইম। একটা কোক! আর তিন প্লেট চিলি চিকেন।
জিন দুটো আমার আর ওই মহিলার জন্য। নাতনী নিল- কোক! আমি ভদ্রতা করে বললাম:- তুমি জিন নিলে না কেন?
উত্তর পেলাম:- আমি এখনও খাই না! খেলে নিতাম। আমার গ্র্যানি খুব লিবারেল। গ্র্যাণ্ড পাও তাই।
নাও! নাও শুরু করো!
বলতে লাগলাম!!!!
তোর গ্র্যানি বেশ সুন্দরী ছিলেন।
বলতেই বাধা!
হোয়াট ডু ইউ মিন? আমার গ্র্যানি, এখনও বেশ সুন্দরী!!
থতমত খেয়ে বললাম:- না! মানে ইয়ে, তখন আরও বেশী ছিল।
বেশ বেশ- নো তক্কো! চালাও পানসী বেল ঘরিয়া
শুরু কোরলাম:-
প্রেম হবার পর বহরমপুরে ( গঞ্জাম, ওড়িশা) পোষ্টিং পেলাম। চিঠিতে তো বটেই, আর কোলকাতায় এলে প্রেমটা আরও জমতো।
করে, করে, বেশ চলছিল!!!!!
হঠাৎ একদিন একটা টেলিগ্রাম তোর গ্র্যানির কাছ থেকে।
কাম শার্প । মাই ম্যারেজ হ্যাজ বিন ফিক্সড! মিট মি আ্যাট যাদবপুর কফি হাউস আ্যট ওয়ান পিএম শার্প টু ফিক্স দ্য নেক্সট কোর্স অফ আ্যকশানস।
দুপুরে টেলিগ্রাম পেয়ে, সেই দিন-ই - বিকেলের ম্যাড্রাস মেল ( তখন ওই নামই ছিল) ধরে হই হই করে চলে এলাম কোলকাতায়!
ভোরবেলা হাওড়ায় নেমে,চলে গেলাম ঠিক দুপুর একটার সময়! যাদবপুর কফি হাউসের পাশেই একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ ছিল সেই সময় ( এখনও আছে কিনা, জানি না)
টুকটাক অন্য গল্প কোরতে কোরতে তোর গ্র্যানি লাঞ্চ খাচ্ছে, কিন্তু আসল কথা আর বলে না!
শেষ হলে মুখ টুখ মুছে বলল:- শোনো, আমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ে হলেই আমি আ্যমেরিকা চলে যাচ্ছি। তুমি না, আজ থেকে আমাকে বোনের চোখে দেখ।
আমার মটকা গরম হয়ে গেল! একে তো লাঞ্চের বিল দিয়েছি, তার ওপর বহরমপুর থেকে আসা যাওয়ার খরচ!!!!!!!
বললাম:- কোনো চোখে যদি দেখতেই হয়, তবে আজ থেকে তোমাকে রক্ষিতার চোখে দেখবো!!!!!!!!!!
তোর গ্র্যানি হেসে বলেছিল- আহা চটছো কেন? মশলা খাও!
আমার বলা শেষ হতেই একজন হ্যাণ্ডসাম বৃদ্ধ ঢুকলেন। হেসে হাত মিলিয়ে বললেন- সেল ফোনে আপনার খবর পেয়ে চলে এলাম। আমি প্রেজেন্ট, আপনি পাষ্ট!
সেদিনের বাকী মশলা একটু খান!
বেয়ারা! অওর তিনঠো জিন উইথ ফ্রেস লাইম !

আমার বিয়ে




দু- দুটো প্রেমে ল্যাং খেয়েছি । তাই আর প্রেমের পথে নয় । এদিকে, বন্ধু বান্ধবদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আমার বিয়ে হচ্ছে না! কি যে দুঃখ!!! এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁৎকে উঠি। বাবা, নির্ব্বিকার, মাও তথৈবচ। সবাই প্যাঁক দিচ্ছে।কেউ খাট কাটার গপ্পো শোনাচ্ছে তো কেউ বলছে- চশমা খুলে, বাপকে পিসে বল।
শেষে কপাল ঠুকে আনন্দবাজার পড়ে কোচবিহারের ঠিকানায়, বাবার বয়ানে একটা চিঠি ছেড়ে দিলাম।

১০ দিন পর, কন্যার ( বর্তমানে আমার গৃহিণী) পিতৃদেবের উত্তর এলো।
বাবার হাতেই পড়লো চিঠিটা। তিনি কি উত্তর দিয়েছিলেন, তা লিখছি। কি করে জানলাম?
রেডিও তে অনুরোধের আসর হচ্ছে। মান্না দের সেই বিখ্যাত গান- ও ললিতা........., আর বাবা, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাকে চিঠির উত্তর শোনাচ্ছেন ( আমাকেও কি?)বাবা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং বর্তমানে আমার ফাদার নং টু বাংলায় স্নাতকোত্তর।
অশেষগুণালঙ্কৃতেষু,
আপনার প্রেরিত, পত্র পাইয়া যুগপৎ আনন্দিত ও বিষ্মিত হইলাম।আপনি বিদোৎসাহী, মননশীল এবং সদাশয়; তাহা আপনার পত্রপাঠে অবগত হইলাম। আপনার বংশ পরিচয় পাইয়া এবং সাণ্ডিল্য গোত্র সম্ভুত বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ জানিয়া, একান্ত বাধিত ও সাতিশয় হর্ষ অনুভব করিলাম।
অপিচ, ( ইংরাজী- However এর সমতুল্য) এই পরিদৃশ্যমান বাহ্যজগতে; ওহো! কি আশ্চর্য্য ঘটনা প্রতিনিয়ত সংগঠিত হইয়া থাকে!!!!!!
আপনি প্রতারিত। এবংবিধ পত্র, স্বয়ং তো নহে, আপনাকে মদীয় ঊর্দ্ধতন চতুর্দশ পুরুষেরাও কেউ লেখে নাই। তবে অনুমান করিতে পারি, এই কার্য কাহার দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছেইহা মদীয় শাখামৃগ ( বানর) সদৃশ জেষ্ঠ্য পুত্র , ........ কর্তৃক লিখিত।

মদ্যপ, গঞ্জিকা সেবন কারী ও আরও গুণালঙ্কৃত(?) মদীয় এই পুত্রটি বর্তমানে ভাদ্র মাসের সারমেয়র ন্যায় হইয়াছে বলিয়া এমত আচরণ করিয়াছে।
ঔষধ প্রস্তুতকারী কোন একটি সংস্থায়, বিপননের কার্য্য করিতেছে বলিয়া শুনিয়াছি।
"ওষুধ লিবে মা!!!! বলে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ওষুধ বিক্রী করে আর কি!!!”"
ক্রোধ সংবরণ করিতে না পারিয়া, কিঞ্চিৎ দেশীয় ও তদ্ভব শব্দ ব্যাবহারের জন্য দুঃখিত। ঔষধের গুণাবলীর প্রচারের নিমিত্ত অনৃত ভাষণের ( মিথ্যা কথা বলা) জন্য পুত্রটি তাহার প্রাপ্য মাসিক অর্থ পাইয়া থাকে। তাহার প্রদত্ত ঔষধে, মদীয় পত্নীর যে পীড়া ৭ দিনে উপশমিত হইবার কথা, তাহা ১ সপ্তাহে উপশম হইয়াছে।
এমত পুত্রের সহিত, আপনার সুলক্ষণা কন্যার বিবাহ উপযুক্ত নহে বলিয়া বোধ হইল।
সাদর সম্ভাষণান্তে

ভবদীয়
রামনারায়ণ ভট্টাচার্য (সান্ন্যাল)

M.A. (Triple), কাব্যব্যাকরণ শাস্ত্রী।

(আগে লোকে, নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা লিখতেন)

এরপরও, যে কি করে আমার বিয়েটা হয়েছিল; তা কল্পনা করতে পারবেন না।
বালেশ্বরে, (ভারতের অঙ্গরাজ্য, ওড়িশায়।তখন বাবা ওখানে থাকতেন, আমার হেড কোয়ার্টার কটক হলেও, বালেশ্বরে কাজের জন্য আসতে হত, আর দিন ১৫ র কাজও থাকত) একদিন বর্তমান ফাদার নং ২ (তখনও হলেও হতে পারেন) থেকে বাবার কাছে টেলিগ্রাম এলো, Reaching 24th with wife, please arrange an hotel.
আমি বাড়ী ঢুকতেই, গম্ভীর মুখে বাবা; টেলিগ্রামটা ধরিয়ে বললেন- Take action.
আমাদের বাড়ীতে টেলিফোন ছিল না, কিন্তু পাশের বাড়ীর উদয় দাসের টেলিফোন নং আমি আগেই, আমার ওই বিতর্কিত চিঠিতে দিয়ে দিয়েছিলাম।
পরের দিন, সক্কাল বেলা উদয়ের বাড়ী থেকে ডাক! এই তোর টেলিফোন, কোচবিহার থেকে। তোকেই চাইছে। মন ধকধক করতে লাগল। কি বিপদ!!!!!!!
যাঁরা জানেন তাদের নয়, নতুনদের জন্য বলছি ( ৭৪ সালের ঘটনা তো!!!!!!)--------তখন ট্রাঙ্ক কল মানে চেঁচিয়ে কথা বলতে হত। (টেলিফোনে যে জোরে কথা বলতে হত, তাতে বোধহয় এমনিই লন্ডন পর্যন্ত শোনা যেত!!)
......
ঘনা (আমার ডাকনাম) বলছ?
.......
হ্যাঁ
.......
তা, শোনো বাবা; আমরা ২৪ তারিখ পৌঁছচ্চি। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে, আমরা পুরী যাব। শুনেছি, তুমি ওখানেও ট্যুরে যাও। তা আমাদের একটা ভালো হোটেল ঠিক করে দিও, ওখানে। কেমন?
.......
তা করব, কিন্তু!
........
আবার, কিন্তু কিসের?
........
মানে, আপনারা কি বিয়ের কথা বলতে আসছেন?
........
হ্যাঁ, এটা আবার বলতে হবে?
.........
বাবার চিঠি পেয়েছিলেন?
........
হ্যাঁ
........
মানে, আপনারা তারপরেও আসছেন?
........
মানে? উনিই তো আমাদের আসতে বলেছেন। আরও বলেছেন, আগে ছেলে দেখুন। তারপর আপনাদের ছেলে পছন্দ হলে, না হয় আপনার মেয়েকে দেখব।
........
তো, তো,তো,তো,তো,তো,তো,তো,তো,
........
তুমি তোতলা নাকি? তোমার বাবা তো বলেন নি।
-
না, মানে।
-
তোমার কি বিয়েতে মত নেই?
-
কে বলেছে? ( রেগে)
-
তুমি, যে ভাবে কথা বলছ, তাতে মনে হচ্ছে।
-
আরে ধূ্স্ । কি ভাবে বোঝাব, বুঝতে পারছি না।
-
কি বোঝাবে?
-
বাবার চিঠি পেয়েছেন?
-
হ্যাঁ, বললাম তো!
-
তারপরেও আসছেন?
-
না আসার কি আছে? উনি সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ওই চিঠিতে।
-
ও! ঠিক আছে, আপনারা আসুন। সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
পুরো কেসটা হজম করতে টাইম নিয়েছিল। এখনও শিউরে উঠি।
বলে রাখি, বাবা কিন্তু সত্যি সত্যি ওই চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু, ওই চিঠির ওপরে আরও একটা চিঠি ছিল।
অনুজকল্পেষু,
পত্রের, নীচের পত্র খানি, আমার জেষ্ঠ্য পুত্রকে ভীতি প্রদর্শন করাইবার হেতু লিখিয়াছি।
আপনার কন্যার রাশিচক্র বিচার করিয়াছি। সর্ব্বতো ভাবে রাজযোটক। কিন্তু, বর্তমান যুগ, বিজ্ঞানের যুগ। উভয়ের অসৃক( রক্ত) পরীক্ষা করিয়া যদি, কোনরূপ বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত না হয়, তবে এই বিবাহ হইবেই।
আমার পুত্রের অসৃক পরীক্ষার সমুদায় সারণী, অত্র পত্রের সহিত প্রেরণ করিলাম।
শুনিয়াছি, আপনার শ্যালক, ইংলণ্ডীয় মতে বড় চিকিৎসক। দেখাইয়া লইবেন।
আসিবার সময়, আপনার কন্যার অসৃক পরীক্ষার সমুদায় সারণী আনিবেন। আমি আর কন্যা দেখিতে যাইব না। পুত্রই যাইবে।
আমি নিশ্চিত, আপনার কন্যাকে আমার পুত্রের পছন্দ হইবে।
শুধু, অনুরোধ; বাটির কোন নিভৃত কক্ষে, তাহাদের কথোপকথনের সুযোগ দিবেন।
ভবদীয়
...........
বাবার এই রসিকতা আর বিজ্ঞান চেতনায়, আমি স্তব্ধবাক হয়ে গিয়েছিলাম।


Thursday, May 23, 2013

বাউনের খাদ্যপ্রেম



আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে।
হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।।
এইটা যখন প্রথম পড়ি, তখন মনে হয়েছিল, মনের কথা- পেটের কথা। পেটের কথা মানে- পেটের প্রেম।
অমৃত কাকে বলি জানি না! তবে মালদার গোপালভোগের আমসত্ত্ব দুধে ফেলে ১ ঘন্টা পর দেখেছি, সেই দুধ পুরো আমের ঘন সরবত হয়ে গেছে। তারপর সেটা ফ্রীজে রেখে ঠাণ্ডা করে, আস্তে আস্তে চুমুক মেরে মনে হয়েছেঃ- ওরে দুধ গোলা রে! তুঁহু মম শ্যাম সমান!
শ্যামের কথাই যখন এলো, তখন পুরোনো একটা গানের কথা বলি।

লুচির কোলে পড়ল চিনি
যেন শ্যামের কোলে সৌদামিনী!
প্রেম, ভালোবাসা- সব লুচি আর চিনির লালাসিক্ত রসায়ন।
তারপর-

লুচির কোলে পড়ল ডাল
বামুন নাচে তালে তাল
ভজ গৌরাঙ্গবলে বামুনদের সে কি প্রেমের নাচ!!
সবার পাতে দই পড়ছে দেখে- বামুন আর থাকতে পারল না!
রেগে বলল-

হাতে দই, পাতে দই, তবু বলে কই কই
ওরে ব্যাটা হাঁড়ি হাতে, দে দই দে দই!
দই পেয়ে বামুন, সে কি খুশী!!!!!!
নাচতে নাচতে গাইলো-

পান্তুয়া লম্বা, রসগোল্লা গোল
হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল!
লেখাটা পড়ে Horrible মনে হতে পারে, কিন্তু খাওয়ার প্রতি বামুনদের যে ভালোবাসা, সেটা যে নিখাদ- তার প্রমাণ, তার উন্মত্ত নাচ! আর সেই নাচ, প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে!
সেকালের খাদ্যপ্রেমী বামুনরা পেট ভরেছে কিনা- সেটা জানার জন্য, পৈতেতে একটা চাবি বেঁধে রাখতেন।
এক নৈয়ায়িক, বামুনদের এক প্রতিভূকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ- আপনার ঈদৃশ কার্যের কারণ কি? উপবীতের সহিত কুঞ্চিকাঠির যোগ কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন?
বামুনঃ- মান্যবর! খাদ্যগ্রহণ কালে মদীয় উদর পূর্ত্তি হইয়াছে কিনা তাহা বোধ করিতে পারি না। এই কারণে, সংকেতের নিমিত্ত এই উপবীতের সহিত কুঞ্চিকাঠির যোগ করিয়াছি।
নৈয়ায়িকঃ -সংকেতটি কী প্রকার?
বামুনঃ-উদরের সহিত কুঞ্চিকাঠি সমকোণে উত্থিত হইলে, বোধগম্য হইবে যে- মদীয় উদর পূর্ত্তি হইয়াছে।
(কুঞ্চিকাঠি= চাবি)
বুঝুন! কী রকম খাদ্যপ্রেম!
সেই বামুনের আবার এরকমই খাদ্যরসিক যে কহতব্য নয়!
নিয়মমত গায়ত্রী জপ করতে বসেছে!
প্রথমেই বললঃ-

ওঁ প্রজাপতি ঋষি, পাতা পেড়ে বসি।
চিপিটক সহিত রম্ভা চর্বণে বিনিয়োগঃ।।
(চিপিটক= চিড়া, রম্ভা = কলা)
খাদ্যরসিক সৈয়দ মুজতবা আলি আবার এককাঠি ওপর দিয়ে গিয়েছেন!
অমৃতের সন্ধান, বলতে গিয়ে, সংস্কৃত সাহিত্যের উপমা সহ বলছেনঃ-

কেচিদ বদন্তি অমৃতস্তোসি সুরালয়ে
কেচিদ বদন্তি অমৃতস্তোসি প্রিয়াস্য অধরে।
ময়া পঠিতানি নানা শাস্ত্রাণি
অমৃতস্তোসি জম্বুর নীর পুটিত
ভর্জিত মৎস খণ্ডে।
অস্যার্থঃ- কেউ কেউ বলেন- অমৃত আছে সুরালয়ে। ( এখানে, সুরালয়ে- শব্দটার দুটো মানে আছে।সন্ধির খেলা আর কি! প্রথমটা পড়তে হবে- সুর+ আলয়= দেবতার মন্দির। দ্বিতীয়টা- সুরা+ আলয়= ভাঁটিখানা) আবার কেউ কেউ বলেন- অমৃত আছে, প্রিয়ার অধরে মানে চুম্বনে। অনেক শাস্ত্র পড়েছি- কিন্তু অমৃত আছে লেবুর রস দেওয়া ভাজা মাছের মধ্যে।
অহো! চুম্বনের সাথে- ভাজা মাছ! কী অপূর্ব মেলবন্ধন! এটা নিশ্চয়ই কোনো বাঙালী পণ্ডিতের লেখা! না হলে মাছের এই তুলনা আর কোন পণ্ডিত করতে পারতো না।
এক বাউন গিয়েছে বিয়ে বাড়ীতে। খেতে খেতে শুয়ে পড়ে হাঁসফাঁস করছে।
বোঝাই গেল- আর খেতে পারছে না! একজন বললেন- ঠাকুরমশাই! একটা হজমের বড়ি দি! কী বলেন?
অতিকষ্টে উত্তর এলো- হজমের বড়ি যদি খাওয়ার জায়গা থাকতো হে, তা হলে তার বদলে আমি আরও ১০ টা পান্তুয়া খেতাম।
আগেই বলেছি, মুজতবা সাহেব খাদ্যরসিক ছিলেন! একবার তিনি, চাঁদনী রাতে তাজমহল না দেখতে গিয়ে রামপাখীর মাংস খাচ্ছিলেন- রেস্তোঁরায় বসে।
জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন- বাপু হে! ওই তাজমহল, কড়কড়ায়তে-মড়মড়ায়তে করে খাওয়া যায় না। তাই যাই নি!
বৈষ্ণব বাউনরা মাছ যাতে খেতে পারেন- তার জন্য নীচের বিধান এলোঃ-

ইল্লিশ, খল্লিস, ভেটকী, মদগুর এব চ।
রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ।।
অস্যার্থঃ- ইলিশ, খলসে, ভেটকী, মাগুর এবং রুই- এই পাঁচরকম মাছ নিরামিষ। খেলে দোষ নেই!
সাথে, আরও জুড়ে দিলেন:- কাঁচকলা দিয়ে রান্না করলে, সব রকম মাছই খাওয়া যায়!
বুঝুন! কি জাত বদমাশ বিধানদার ঠাকুরমশাই! সব ভালো ভালো মাছগুলোকেই নিরামিষ বলে চালিয়ে দিলেন!!
তন্ত্রশাস্ত্র আরও সরেস! তাঁরা কী বলেছেন বিধান দিতে গিয়ে!!!!!!
মৎস্য তিন প্রকার। উত্তম, মধ্যম ও অধম।
উত্তম মৎস্য= প্রায় কন্টক বিহীন।
মধ্যম মৎস্য= কিছু পরিমাণ কন্টক।
অধম মৎস্য= প্রচুর কন্টক হইলেও উত্তম রূপে ভর্জিত হইলে অতীব উপাদেয়। মানেটা হলো, কাঁটা মাছ কড়কড়ে করে ভেজে খেতে পারো!
কী মৎস্যপ্রেম! কাউকে ছাড়া নেই! বাউন বলে কথা!
বাউনদের খাওয়ার প্রতি লোভ এবং তাদের বিধানদের ওপর একটু যদি নজর দেওয়া যায়, তবে দেখবেন- কী সুন্দর রাজনীতি এর মধ্যে মিশে আছে।
এবার বিধানটা কী?
যে কোনো পূজোতে অব্রাহ্মণরা পক্কান্ন দিতে পারবে না!
বেশ! তা না হয় হোলো!
এবার নৈয়ায়িকরা প্রশ্ন তুললেন- অন্নের অর্থ সংকোচন পূর্বক তাহাকে পক্ক চাউলে (ভাত) পরিণত করা হইয়াছে। কিন্তু, অন্নের অর্থ হইলো- যাহা কিছু, উদর পূর্ত্তি করে, তাহাই অন্ন। উদর পরিতোষ বিনা কিভাবে পূজা সম্ভব?
বামুনরা নৈয়ায়িকদের বেশী ঘাঁটাল না। তারা বললঃ-
কৃষরান্ন( খিচুড়ি) ও পক্ক চাউলে পূজা নিবেদন করিতে পারিবে না। অপিচ( ইংরেজী- However এর সমতুল্য) গোধূমপিষ্টক ( লুচি) সহ পরমান্ন (পায়েস) প্রদান করিতে পারিবে।
নৈয়ায়িকদের মধ্যে বেশীর ভাগই বাউন। তাঁরাও আর যুক্তি-তর্কের জাল বাড়ালেন না। এরই মধ্যে কিছু নৈয়ায়িক মিউ মিউ করে বললেন- পরমান্ন, পক্কান্নের নামভেদ! সমস্যার সমাধান কী রূপে হইবে?
উত্তরও এলো- চাউল যেহতু দুগ্ধে পক্ক, সে হেতু প্রত্যব্যয় ( দোষ) নাই। কারন, দুগ্ধ গোমাতা হইতে প্রাপ্ত।
রাজনীতি এর মধ্যে কী? কিছুই না! নিজের পয়সায় খিচুড়ি খাও আর পরের পয়সায় লুচি, পায়েস সাঁটাও! ব্যস্। খরচ হলে তোর হবে, আমার কী?
চালাকিটা ধরে ফেলে, কিছু নৈয়ায়িক সংস্কৃত শ্লোক রচনা করলেনঃ-

পরান্নং প্রাপ্যে মূঢ়, মা প্রাণেষু দয়াং কুরু।
পরান্নং দুর্ল্লভং লোকে, প্রাণাঃ জন্মণি জন্মণি।।
অস্যার্থঃ- পরের অন্ন ( কেউ কাউকে সহজে ডেকে খাওয়ায় না) এই পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। অতএব, হে মূর্খ! যত পারো খাও! আর প্রাণ? সে তো জন্মজন্মান্তরেও পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই-রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিথেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ-
আমাদের জলখাবার সম্বন্ধেও তাহার অত্যন্ত সংকোচ ছিল। আমরা খাইতে বসিতাম। লুচি আমাদের সামনে একটা মোটা কাঠের বারকোশে রাশকরা থাকিত। প্রথমে দুই-একখানি মাত্র লুচি যথেষ্ট উঁচু হইতে শুচিতা বাঁচাইয়া সে আমদের পাতে বর্ষণ করিত। দেবলোকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতান্ত তপস্যার জোরে যে-বর মানুষ আদায় করিয়া লয় সেই বরের মতো, লুচি কয় খানা আমাদের পাতে আসিয়া পড়িত তাহাতে পরিবেশনকর্তার কুণ্ঠিত দক্ষিণহস্তের দাক্ষিণ্য প্রকাশ পাইত না। তাহার পর ঈশ্বর প্রশ্ন করিত,আরো দিতে হইবে কিনা। আমি জানিতাম, কোন্ উত্তরটি সর্বাপেক্ষা সদুত্তর বলিয়া তাহার কাছে গণ্য হইবে। তাহাকে বঞ্চিত করিয়া দ্বিতীয়বার লুচি চাহিতে আমার ইচ্ছা করিত না। বাজার হইতে আমাদের জন্য বরাদ্দমত জলখাবার কিনিবার পয়সা ঈশ্বর পাইত। আমরা কী খাইতে চাই প্রতিদিন সে তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইত। জানিতাম, সস্তা জিনিস ফরমাশ করিলে সে খুশি হইবে। কখনো মুড়ি প্রভৃতি লঘুপথ্য, কখনো-বা ছোলাসিদ্ধ চিনাবাদাম-ভাজা প্রভৃতি অপথ্য আদেশ করিতাম। দেখিতাম, শাস্ত্রবিধি আচারতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে ঠিক সূক্ষ্মবিচারে তাহার উৎসাহ যেমন প্রবল ছিল, আমাদের পথ্যাপথ্য সম্বন্ধে ঠিক তেমনটি ছিল না।
তাহলেই বুঝুন! কী কেলোর কীর্ত্তি!!!!!!!!!
আরে বাপু খাবি তো খা না! কে বারণ করেছে? পয়সাও মারবি, বিনে পয়সায় খাবি, আবার বড় বড় বাতেলাও মারবি, এটা কি ঠিক?
এবার দেখা যাক, সংস্কৃত সাহিত্যে খাবারের কী রকম বর্ণণা আছে! সাহিত্য তো আর খাবার ছাড়া হয় না। প্রেমও খাবার ছাড়া হয় না! আজকাল প্রেম করতে গেলেও একটা রেস্তোঁরায় বসতে হয়!
প্রেম- সাহিত্য- খাবার, এটা ত্রিকোণ! যাবে কোথায় বাছা? আড্ডা মারতে গেলেও খাবার! এই যে পলার বাড়ীতে আড্ডা মেরে এলাম, সেদিন! সেখানেও তো এক কিলো চাউমিনে, এক কিলো চিলি চিকেন আর গোটা দশেক সন্দেশ সাঁটিয়ে এলাম! সবাই আড্ডা মারবে কি! ওরা আমার খাওয়া দেখতেই ব্যস্ত! জল টল খেয়ে মনে হলো- নাঃ! এবার বোধহয় পেটে কিছু দানাপানি পড়েছে!!!!!!!
নাম বলবো না! বললেই ক্ষেপে যাবে! এই তো সেদিন-সল্ট লেকের ভজহরি মান্নাতে, একজন আমায় হেব্বী খাওয়ালো! আমার খাওয়ার সময় রেস্তোঁরার লোকগুলো কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল!
একজন ওয়েটার তো আর এক ওয়েটারকে ফিসফিস করে বলেই ফেল্লো- শুনেছিলাম- ভীম নাকি বক রাক্ষসকে মেরে ফেলেছে!!!!!!
কোথায়? এই তো সে!!!!!! এই লোকটা চলে গেলে মালিক কে বলে দোকান বন্ধ করে দে! আর তো খাবার নেই!
যাক! আসল কথায় আসি! আজকাল মাঝে মাঝে একটু বেলাইন হয়ে যাই আর কি!!!!!!
খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে- দুজন বড় মাপের বাঙালী কবি বিরাট বিরাট সংস্কৃত কাব্য লিখেছিলেন।
এঁদের মধ্যে একজন- কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন। বাড়ী কাঞ্চনপল্লীতে মানে আজকাল যাকে কাঁচরাপাড়া বলে। বিরাট বড়লোকের ছেলে আর খুব গুণী( বদ্যিরা এরকমই হয়)।
শ্রীশ্রীকৃষ্ণাহ্নিক- কৌমুদীনামে একটা কাব্য লিখেছিলেন। এই কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে ৮৫ থেকে ১১৮ শ্লোকে বসন্ততিলক আর পুষ্পিতাগ্রা ছন্দে শ্রী রাধার রান্নার মনোরম বর্ণণা আছে।
আর একজন লেখক হলেন- শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ। এনার লেখা বইটির নাম হলো- শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতএবং গোবিন্দলীলামৃত
এই গোবিন্দলীলামৃততেই নানাধরণের খাবারের বর্ণণা আর রান্নার প্রণালী দেওয়া আছে।
তবে, শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ বেশ কিছুদিন বৃন্দাবনে থাকার ফলে একটু কম বর্ণণা দেওয়া আছে। কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন বাংলাতে বসে লিখেছিলেন বলে বর্ণণাটা বেশ বিস্তৃত।
কবিকর্ণপুর বাথুয়া ( বাস্তুক), নটে ( মারিষ), নতির পত্র( পটলশাক) কলায়লতার শাক( কলায়বল্লী শিখা), ছোলার শাকের কচি ডগা ( চনকাগ্র শিখা), মটরশিখা, কোমল লাউডগা ( তুম্বিশিখা) আর পদিনার শাকের কথা উল্লেখ করেছেন- ৮৭ নং শ্লোকে। এই শাকগুলো নাকি শ্রীরাধা, শ্রীকৃষ্ণের জন্য ভালো সরষের তেলে ভেজেছিলেন ( ওই সরষের তেলটা আর পাওয়া যায় না বলে- আজকাল চারিদিকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা, ব্রততীঞ্চ সব কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন)।
আমি নিজে পদিনার চাটনী খেয়েছি, কিন্তু পদিনা শাকভাজা আমার নিজের রাধা কোনোদিন ভেজে খাওয়ান নি! পড়ে বলেছিলাম, রান্না করতে! তা! যা প্রতিক্রিয়া হলো! যাক! অন্য দশ কথা এসে পড়বে!
ছোলার শাক আর মটর শাকের যে ঘন্ট হতে পারে, সে কথা কিন্তু কবিকর্ণপুর বলেন নি! শ্রীকৃষ্ণ কি ঘন্ট খেতেন না? কে জানে!!!!!! ঘন্ট খেলে যদি শ্রীরাধার প্রেম উবে যায়! তা হলেই তো ঘন্ট ঘেঁটে যাবে।
আমার শ্রীরাধা কিন্তু যে কোনো শাকই বড়ই ভালো রাঁধেন। এক থাল ভাত উড়ে যায় খালি ওই শাক দিয়ে।
কবিরাজ গোস্বামী আবার পাকা তেঁতুলের রস দিয়ে কলমি শাক, আর কাঁচা আম দিয়ে কালো নালতে পাতা রাঁধার কথাও বলেছেন।
এ ভাবে আমি খেয়েছি- উল্লুস!!!!!! জিভে জল এসে, কী বোর্ড পুরো ভিজে গেল।
কিন্তু, এই দুই কবির লেখাতে- পুঁই, পালং, মূলোর শাকের কথা পাই নি! কে জানে কেন!!!!! কবিরা কি এই শাকগুলো খেতে ভালোবাসতেন না! নাকি শ্রীকৃষ্ণের দৈববাণী হয়েছিল- বুঝলে হে- আমি ওই সব শাক খাই না! তাই লিখো না।
এবার আসি ভাজার কথায়!
ভাজার কথা বলতে গিয়ে কবি কর্ণপুর লিখেছেন ( শ্রীরাধা প্রেমে ভাজা ভাজা হয়েছিলেন কিনা!) – ( গোবিন্দলীলামৃত-৩.৯২-৯৩)

বার্তাকু সূরণক মানক কর্করোথৈ
রম্ভামুঘোত্থ কণিশৈঃ কচুভিঃ পটোলৈঃ।
কুষ্মাণ্ডকৈর্লবলবৈঃ শিতসূচিরাজী
বেধেন নীরসতমৈর্বিবিধাহ্স ভাজী।।
—————-
বার্তাকু= বেগুন। সূরণক= ওল। মানক= মান। কর্করোথ= কাঁকরোল।
রম্ভামুঘোত্থ = গর্ভমোচার ছোট ছোট কাঁচা কলা। পটোলৈঃ= পটল। কুষ্মাণ্ড= চালকুমড়ো।
এই আনাজগুলো ছোট ছোট করে কেটে ( কী ধৈর্য্য!!!!!! প্রেমে অধৈর্য্য হলে হয় না, এটাই বোধহয় কবি কর্ণপুর বোঝাতে চেয়েছেন!) সরু সূঁচ দিয়ে বিঁধিয়ে ভেতরের রস গুলো বের করে নিতে হবে। এরপর ডালের বেসনে চুবিয়ে সেগুলো সরষের তেলে ভাজতে হবে। এটা অবশ্য কবিরাজ গোস্বামীর বিধান।
সেই সময়ে আলু পাওয়া যেত না। গোল আলু- যেটা এখন আমরা খাই, সেটা টমাস রো জাহাঙ্গীরের সময় ভারতে এনেছিলেন। তাই বিভিন্ন শ্লোকে যে আলুককথাটা আছে সেটা রাঙ্গা আলু বলে ধরতে হবে বলে গবেষকরা একমত।
কবিরাজ গোস্বামী, “ডিঙ্গিশ’( ঢ্যঁ¡ড়শ) চাকা চাকা করে কেটে ডালের বেসনে চুবিয়ে ঘিয়ে ভাজার কথা বারবার বলেছেন।
প্রেমের যে কত লাফড়া! উফস্। রান্নাঘরেই যদি সময়টা গেল, তবে প্রেমটা করবে কখন? যাক! ওনাদের ব্যাপার, ওনারা বুঝবেন! আমরা বরং সেই রান্নার রেসিপি গুলো দেখে নি!
একাল হলে, টিভিতে একটা প্রোগ্রাম করিয়ে নেওয়া হত, শ্রীরাধাকে নিয়ে! টি. আর.পি-র জন্য ভাবতে হতো না!!!!!! বকফুলভাজা নাকি- শ্রীকৃষ্ণের খুব প্রিয় ছিল! শ্রীরাধাকে তো শেষমেষ বক’- ই তো দেখিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। মানে, আজকের ভাষায় যাকে বলে- হাফসোল।
বকফুলকে সংস্কৃতে, কাঞ্চনকলিকা বলে। শ্রী রাধা, বকফুলকে ঘিয়ে ভেজে টক দইতে ভিজিয়ে, নুন-লংকা মিশিয়ে একরকম ডিসতৈরী করেছিলেন। আমি টেষ্ট করেছি! দারুণ খেতে!
আপনারাও টেরাইকরতে পারেন। কাসুন্দি, আদা- বাটা, নারকেল-বাটা দিয়ে কাঁঠালের বিচিও টেরাইকরতে পারেন। নতি পত্রমানে নলতে পাতার শুক্তুনির রেসিপি চাই!!!!! কুছ পরোয়া নেহি!

যস্মিন্ প্রতপ্ত-কটু তৈল্যা-তিক্তপত্রীঃ।
সৎকাসমর্দদলিতার্দ্রক-সাধুমৈত্রীঃ।।
কাসুন্দি, মিহি করে আদা বাটা দিয়ে , নলতে পাতাকে ম্যারিনেট করতে হবে। তারপর সরষের তেল গরম করে ছেড়ে দিয়ে, নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন। অহো!!!! কীসাধুমৈত্রীঃ’- অর্থাৎ, কাসুন্দি, মিহি করে আদা বাটা, সরষের তেল আর নলতে পাতার কী অসাধারণ বন্ধুত্ত্ব!!!!!
এবার দেখি, শ্রী রাধা, আর কী কী বানিয়েছিলেন! শ্রীকৃষ্ণ আসছেন- প্রেমটা একটু মাখো মাখো করতে হবে না? মাখো মাখো করতে গেলে তো দুধের দরকার! শ্রীরাধা, দুগ্ধালাবু বা দুধলাউ তৈরী করতে বসলেন।

সৌস্মেণ জীরকং- নিভং পরিকৃত্য তুম্বীং
সিদ্ধাঞ্জকেন পয়সা চ নিধায় কম্বীম্।
আলোড্য দত্তঘনসারমপাচি দুগ্ধাহ-
লাবুঃ সিতামরিচ জীরক হিঙ্গুমুগ্ধাঃ।।
———–
লাউকে জিরের দানার মত ঝিরিঝিরি করে কেটে, জল এবং দুধ মিশিয়ে সেদ্ধ করবে, আর সেদ্ধ করার সময় বারবার হাতা দিয়ে নাড়তে হবে। তারপর, কর্পূর, চিনি, মরিচ, জিরা, হিং দিয়ে ঘন হয়ে গেলে নামিয়ে নেবে।
তবে কবিরাজ গোস্বামী হিং দিতে কিন্তু বলেন নি। এটার নাম তিনি দিয়েছিলেন- দুগ্ধতুম্বী ( তুম্বী= লাউ)। এরপর, শ্রীরাধার মনে হলো- নাঃ! কম পড়ে যাচ্ছে!!!! আবার তিনি কচি মোচা কেটে ,” মরিচাঘ্যরাঁধতে বসলেন। মোচার ছোটো ছোটো শস্য গুলো ঝিরি ঝিরি কেটে জলে ডুবিয়ে খানিকক্ষণ রেখে দিলেন। তারপর, দুধ, মরিচ আর হিং দিয়ে ঘন ঘন নেড়ে ফুটে গেলে নামিয়ে রেখে ঠাণ্ডা হতে দিলেন।
কবিরাজ গোস্বামী হিং দিতে এখানেও বলেন নি! শ্রীকৃষ্ণ হিং ভালোবাসতেন কিনা জানা যায় না, তবে কবিরাজ গোস্বামী হিং ভালোবাসতেন না- এটা পরিস্কার! এত কিছু করে, শ্রীরাধার মনে হলো, এবার কিছু অম্লবা টক তৈরী করতে হবে। আজকাল হলে শ্রীকৃষ্ণ এত কিছু খাবার পর জেলুসিল খেতেন! কিন্তু, তখন তো ওসব পাওয়া যেত না! দেখি! শ্রীরাধা কী কী রাঁধলেন!!

পাকা কুমড়ো খণ্ড খণ্ড করে কেটে, সরষের তেলে ভেজে নিয়ে ঘোল ( তক্র), আদা (আর্দ্রক), মৌরী ( মৌরিকা) ও হিং (হিঙ্গু) দিয়ে মিশিয়ে রাখলেন। তারপর ছানা আর মুগের বড়া দিয়ে পরিবেশন।
মূলা, পাকা চালতা চাকা চাকা করে কেটে, তক্র, গুড় এবং ভব্যখণ্ড ( পাকা তেঁতুল) দিয়ে আর রকম অম্ল
মিষ্টি পাকা আম, জলে ভালো করে মেখে- তারপর আদাবাটা, চিনি আর দুধ!
এরকম আরও বারো রকম অম্লর বর্ণণা পাওয়া যায়! এদের আবার মোট তিন রকমের ভাগও রয়েছে!

ঈষদম্ল( অল্প টক)
মধুরাম্ল ( মিষ্টি টক)
মধ্যাম্ল ( মাঝামাঝি টক)

চিধ্যাম্রাতকচুক্রাম্রৈস্তত্তদ্ ব্যাদিযোগতঃ।
ঈষন্মধুরগাঢ়াম্লভেদাম্ল দ্বিষড়বিধঃ।।
অর্থঃ- তেঁতুল,আমড়া,আমরুল ও আম এই চার রকমের টক, মুগের বড়ার সাথে মিলিয়ে বারো রকমের টক হত!
কিছু বুঝতে পারছেন? কোথায় লাগে আজকালকার বোতোলবন্দী সব সফ্ট ড্রিংকস?!!!!!!!!!!!!!
শেষে আসি মিষ্টির কথায়! যাকে বলে, মধুরেণ সমাপয়েৎ।
এই দুই কাব্যে- শাক, ভাজা, তরকারি, ডাল, টক ছাড়াও, নানা রকমের পিঠে আর পায়েসের বর্ণণাও আছে। পিঠেগুলোর নাম ভারী সুন্দর, কিন্তু সব সময় এর রেসিপি আমরা পাই না! ( কী দুঃক্কু!) কয়েকটা পিঠের নাম বলছি!

হংসকেলি
শোভারিকা
বেণী
চন্দ্রকান্তি
ললিতা! ( মাননীয় মান্না দে, আমার মনে হয়, এই পিঠেটা খেয়েছিলেন, না হলে ওই বিখ্যাত গানটা হতো না)
চিত্রা
কর্পূরকেলি
অমৃতকেলি
এখন আমরা যে মিষ্টিগুলো খাই, চারশ বছর আগেও সেই মিষ্টিগুলো ছিল!

জীলাবিকা মউহরি পুরু পূপগূজা
নাড়ীচয়াঃ কৃত সরস্বতি* কাদি পূজাঃ।
খর্চুরদাড়িমক শর্করপালমুক্তা
লাড্ডুৎকরান্ বিধতি রেহত কলাভিযুক্তাঃ।।

(*সরস্বতি- এই বানানটা সম্বোধনে বলে- ই কার হয়েছে)
জীলাবিকা=জিলিপি
পুরু= পুরী ( আটার তৈরী)
গূজা= গজা/ গুজিয়া
খর্চুর= খইচুর
দাড়িমক= কদমা ( মনে হয়)
যাই হোক, এবার বুইলেন তো!!!!!!!!! প্রেমের কী ল্যাঠা!!!!!!! খাও আর খেয়ে যাও! তারপর প্রেম করো!
শেষে ওই বিখ্যাত কবিতাটার দুই লাইন বলি!

এত খেয়ে তবু যদি নাহি ভরে মনটা
খাও তবে কচুপোড়া, খাও তবে ঘণ্টা!
সমাপ্ত
ঋণঃ- উদ্বোধন শতাব্দী জয়ন্তী সঙ্কলনে, বিমান বিহারী মুখোপাধ্যায়ের রচনাঃ- সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলার খাবার।