Saturday, February 7, 2015

রেফ্রিজিরেটার



ওডিশা ও আন্ধ্রার সীমান্তবর্তী শহর – পারলাখেমুণ্ডি । এখন অবশ্য সরগরম শহর । তবে, ষাটের দশকে সেটা একটা ছোট শহরই ছিল ।

বাবা সেই শহরের কলেজে, দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন ।

রাজা শ্রী ক্রুষ্ণচন্দ্র গজপতি ( কৃষ্ণচন্দ্র)  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই কলেজ তবে,  পরে  বাবা থাকা কালিনই ওডিশা রাজ্য সরকার সেই কলেজকে সরকারী করে নেয় । এখন ভীষণ নাম সেই কলেজের ।
 শহরে, ইলেকট্রিক থাকলেও, বাড়ী বাড়ীতে বিদ্যুৎয়ের যোগান ছিল না ।
 সারা শহরে, তখন মোটে চারটে   রেফ্রিজিরেটার ছিল ।
রাজার, সরকারী হাসপাতাল, পশু হাসপাতাল এবং এক মিশনারীর বাড়ীতে ।

না ! ওগুলো বিদ্যুৎ চালিত ছিল না ।  ব্র্যাণ্ড ছিল- সুর ফ্রিজ, সবকটাই । বাঙালি কোম্পানির তৈরি এই ঠাণ্ডা যন্ত্রের চাহিদা এবং নাম তুঙ্গে । কালের নিয়মে, এই সুরফ্রিজ আর নেই বর্তমানে ।
কেরোসিনে চলতো এই সব ফ্রিজ । যন্ত্রের একদম পেছন দিকে একটা ল্যাম্প জ্বলতো কেরোসিনে ।
সামনে একটা টানা ষ্টিলের লাঠিতে আয়না ফিট করা থাকতো । সেটা টেনে দেখে ল্যাম্প ঠিক মত জ্বলছে কিনা দেখা হতো । ল্যাম্পের ফিতেও বাড়ানো কমানো যেত- ঠাণ্ডাকে কন্ট্রোল করার জন্য ।

গরমের দিনে- মিশনারির বাড়ীতে গিয়ে বরফ ঠাণ্ডা জল খেয়ে আসতাম । সাথে কিছু বরফ ।
কলকাতায় এসে বিদ্যুৎচালিত রেফ্রিজিরেটর প্রথম দেখি । ধারণা ছিল- এসব বড়লোকদের বাড়ীতেই থাকে ।
ধীরে এই যন্ত্র “ফ্রিজে” পরিণত হলো ।
চাকরি পাবার পর, নানা সহকর্মীদের বাড়ীতেও দেখতাম এই ফ্রিজ ।

আমার যে কোনদিন হবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবি নি । আমার ছোট ভাই রামানুজ, জোর করে মালদায় কেনালো ।
অবশ্য – চেনা শোনা থাকার সুবাদে এক লপ্তে টাকাটা দিতে হয় নি । চারটে কিস্তিতে টাকা নিতে রাজী হয়েছিল  দোকানদার ।

ফ্রিজ তো এলো বাড়িতে । ছেলেদের উত্তেজনা চরমে ।  ঠাণ্ডা জলের আর অভাব হবে না । রসনা মিক্সও চলে এলো , সাথে কিলো খানেক চিনি ।

অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি – আমার ফ্রিজ । পাড়ার অনেকেই দেখতে এলো   তাকে ।
একজন ফুট কেটে দিল কম্প্রেসর বার্ষ্ট করতে পারে ।  ২৪ ঘন্টা অন করে রাখলে যদি না ফাটে তবে আর হবে না কিছু ।
ব্যাস্ ! হয়ে গেল আমার । কেন যে মরতে কিনতে গেলাম ।
ভাই, ছেলেরা এই সম্ভাবনার কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেও আমার ভয় আর যায় না ।

শেষে সারা রাত্তির জেগে কাটালাম ।
না কিছু হয় নি, তবে নতুন কেনা চারটে ব্যাটারি যন্ত্রের ভেতর রেখেছিলাম- ভালো থাকবে বলে ।





Wednesday, February 4, 2015

টেনিদার পুজো

আজ প্রয়াত তারক নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ৯০ তম জন্মদিন ।  ১৯১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী দিনাজপুর জেলার বালিয়াডিঙ্গি গ্রামে জন্ম। পৈত্রিক নিবাস বরিশালের বাসুদেব পাড়া গ্রামে।

বাবা  প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন পুলিশ কর্তা ।

তাই স্বর্ণেন্দু সেন অত ভালো বাঙাল ভাষা বলতে পারে ।

 ওহো !  তারক বাবু কিন্তু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নামে লিখতেন ।
উনি নেই, আর আমার কৈশোর কালও হারিয়ে গেছে ।

অক্ষম ভাবে, সম্পূর্ণ কল্পনায় লিখলাম- চারমূর্তি বড় হলে কি হতে পারতো । বেশ কিছুদিন আগে লেখা । মালদার একটি পত্রিকায় ( আমাদের মালদা) বেরিয়েছিল লেখাটা ।
আজকের দিনে – এটাই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি ।


+++++++++++++++++
ডি লা গ্র্যান্ডি, মেফিষ্টোফেলিস, ইয়াক্ ইয়াক‌্ ! সকাল ১১ টায়,দমদমে প্লেন থেকে নেমে,ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের বাইরে এসে, ডঃ কুশল মিত্র, চিৎকার করে উঠল ।
মাষ্টারমশাই ভজহরি মুখুজ্জে, ডাঃ বাবুকে রিসিভ করতে গেছিল আ্যরপোর্টে । গেটের বাইরে , দাঁড়ানো অন্য লোকজন একটু অবাক ,এই দুজনের এইরকম চিৎকার দেখে
ভজহরি বলল:- দাঁড়া, কুশল‍! পরের ইণ্ডিগো ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু থেকে আসছে- ইঞ্জিনিয়ার স্বর্ণেন্দু সেন ।
হাতে, গাড়ীর চাবি দোলাতে দোলাতে সফ্টওয়ার কোম্পানীর মালিক কমলেশ ব্যানার্জ্জিও হাজির ।
 কমলেশের গাড়ী করে, সকলে মিলে যাবে, পটলডাঙ্গায় ! কমলেশের দুই বোন, আধুলি আর পুঁটি ; এখন বিবাহিত । একবার,  ওদের বাড়ী দুটোতেও  হাজির হবার প্ল্যান আছে ওদের । আধুলির বরের নাম – ভোলা । পুঁটির বর- বঙ্কা !
দমদমের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে, কমলেশের স্করপিও গাড়ী করে ওরা তিনজন চলে এলো ডোমেষ্টিক টার্মিনালের বাইরে । ডিসপ্লে বোর্ডে জ্বল জ্বল করছে, ইণ্ডিগোর প্লেন নামার তথ্য ।
নীল আকাশের পেঁজা মেঘের টুকরোর মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে হালকা ধূপ ধুনোর গন্ধ ।  বৃষ্টি ভোর বেলা পর্যন্ত তাড়ু ব্যাটিং করে, আউট হয়ে, প্যাভিলিয়নে ফেরত । এখন জেন- এক্স, রোদ্দুর আকাশ পাত্র থেকে উছলে উছলে পড়ছে । আজ চতুর্থী !  মাত্র দুদিন বাকী দুগ্গোপুজোর !!!!
স্বর্ণেন্দু বেরিয়ে আসার পর ভজহরি চিৎকার করল-ডি লা গ্র্যান্ডি, মেফিষ্টোফেলিস !!
বাকী তিনজন সমস্বরে বলল :- ইয়াক্ ইয়াক্ ।
টেনিদা মোবাইল কানে গুঁজে, ঘনাদাকে ফোনালো ।  ঘনাদার বাড়ী, আ্যরপোর্টের কাছেই ।  বনমালী নস্কর লেনের টঙ্গের ঘরে আর থাকেন না ।
-ঘনাদা?
- হ্যাঁ বল্
- আমি, ভজহরি বলছি ।
- চোপ্ ! ব্যাটা মাষ্টার হয়ে কেতা ধরেছে  ! আমাদের কাছে, তুই টেনি ! এবার বল, কি বলবি ?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ ! আমি টেনি ! প্যালা, ক্যাবলা, হাবুল সব চলে এসেছে ।
- বেশ ! এবার তালে একদিন আড্ডানো যাক । তোরা, লর্ডসের মোড়ে আসবি । তারপর, চিনি কম রেষ্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যে গলি, সেই গলির মধ্যেই আছে লর্ডস রেস্তোঁরা । ওখানকার বিরিয়ানীটা জম্পেশ ।
- কবে বলো ?
- আজকেই কর । প্যালা, ক্যাবলা, হাবুল তো সাউথ সিটিতে ফ্ল্যাট কিনেছে । ওদেরও সুবিধে হবে । তুই তো, এখন বাঘাযতীনে থাকিস । আমার অসুবিধে হবে না । প্যালাকে বলবি,  তোদের সঙ্গে আমাকে ওর গাড়ীতে করে তুলে নিয়ে যেতে
ফোনানোর পরে, চারমূর্তি পটলডাঙ্গার দিকেই রওনা দিল । চাটুজ্জেদের রোয়াক আর নেই । বাড়ীটা ভেঙ্গে প্রোমোটিং হয়েছে । তাও ঘুরে আসা, সেই ছোটবেলার দিনগুলোকে চেখে দেখার জন্য । রাস্তায়, ঘনাদাকে তুলে নেবে ।
ক্যাবলা এখন নামকরা ডাক্তার লণ্ডনে । টেনিদাকে জিজ্ঞেস করল:- তালে টেনিদা, তুমি কি কি সাবজেক্ট পড়াও ইস্কুলে ?
ইংরেজী বাদে সব ।
সেকি ! ওটাই তো তুমি একটু বুঝতে !
ওই জন্যই তো পড়াই না- টেনিদার ঝটিতি জবাব ।
হাবুল বলল :- খাইসে ! টেনিদা ! অঙ্ক শেখাইত্যাসেন?
চোপ্ ! এক চড়ে , তোর নাক নাসিকে পাঠাবো ! আমি শেখাতে পারি ভালো ! যা, প্যালা, গাড়ীটা থামিয়ে কিছু খাবার কেন্ তো ! সক্কালে মাত্র ৩০ টা লুচি খেয়েছি । খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে ।
ক্যাবলা বলল:- বিকেলে হাতীবাগান গিয়ে এগপ্লানটাইটিস্ খাবো !
হেইডা আবার কি? হুনলে পরে ভাউয়া ব্যাঙ মনে লয় !- হাবুলের জিজ্ঞাসা ।
আরে!!!! ডাক্তারি পরিভাষায় শব্দের শেষে “আইটিস” থাকলে, সেটাকে ফোলা বলে । এগ্ প্ল্যান্ট মানে বেগুন । তোদের আবার কালচারাল শক্ লাগতে পারে । তোরা তো ব্রিঞ্জাল বলিস । সে যাক গে । বেগুনি গুলো ফুলো ফুলো হয় তো ! তাই-এগপ্লানটাইটিস্ ! ভাউয়া ব্যাঙ আবার কি ? ক্যাবলার উত্তর  এবং জিজ্ঞাসা!
ভাউয়া ব্যাং কয় ভাউয়া ব্যাঙরে। - হাবুলের উত্তর ।
প্রাক পূজোর ভীড়ে, চারিদিকে গমগম করছে । গাড়ীর জ্যাম । সব মিলিয়ে ভজকট অবস্থা ! প্যালা, গাড়ীটাকে পার্ক করতে পারছে না ।
বাগুইআটির “জাষ্ট বেকড্” এর দোকানটাতেও অকথ্য ভীড় । ওখানে ঢুকে যে একটু কোল্ড কফি খাবে, তারও উপায় নেই । প্যালা, গাড়ীটাকে কোনোরকমেও এগিয়ে নিয়ে, চালপট্টির মধ্যে দিয়ে ঘনাদার বাড়ীর দিকে যেতে শুরু করল ।
ঘনাদার বাড়ীর কাছেই একটা দোকান ঘেঁসে গাড়ীটাকে পার্ক করল প্যালাএকটা দোকান থেকে “ মোবাইল মুড়ি” কিনল  । আইসক্রিম কোণের মত দেখতে প্যাকেটটা ।
এগুলো ছোটো । বড়গুলো সিঙারার মত দেখতে । মুড়ি, আগে থেকেই মেখে রাখা আছে এই প্যাকেট গুলোতে ।
প্যালা আনতেই, সবাই অবাক । মুড়িও আজকাল রেডিমেড !!!!!! টেনিদা বলল:- হাবুল! তুই আর বলতে পারবি না – মেকুরে হুড়ুম খাইয়া হৈক্কর করসে ।
হাবুল কি একটু উদাস !
যে রেটে চলছে তাতে অচিরেই করিম্‌সের বিরিয়ানি, সাবিরের রেজালা, ম্যাকডোনাল্ড, কে এফ সি উঠে আসবে । প্যাকেটের শেষ নুনটুকু আর চাটার সুযোগ নেই ।
ঘনাদা, মাঞ্জা মেরে এসে উঠে পড়লেন গাড়ীতে । চারিদিকে, ঢাকের শব্দ- তবে মাইকে আস্তে করে বাজছে । শাড়ী পরা মেয়েরা সংখ্যায় কম । সবাই জিনস আর সার্ট ! কে যে মেয়ে, আর কে যে ছেলে সেটা বোঝাই যাচ্ছে না ।
ক্যাবলা, “ডানহিল” সিগারেটের তিনটে ফ্লিপ প্যাকেট ঘনাদার হাতে তুলে দিল । গাড়ীর এ.সি.টা বন্ধ করে জানলার কাঁচগুলো নামিয়ে দিল প্যালা ।
ক্যাবলা বলল :- ঘনাদা, আমাদের গল্পগুলো আজকালকার নতুন প্রজন্মের কিশোর- কিশোরীরা আর পড়ে না বোধহয়, তাই না?
ঘনাদা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অর্ন্তযামীর মত বলল:-  সবেতেই ঠেসেঠুসে সমসাময়িক সমাজ, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক পটভূমি মায় ভূমার প্রভাব ভরে দিতে হবে এইটা এই সময়ের একটা আজব দাবি। এর চেয়ে চ্যবনপ্রাশের বিজ্ঞাপন পড়লেই হয়, আমাদের গপ্প পড়তে যাওয়া কেন বাপু !!!! এই মূল্যায়ণটা দামড়ারা করছে । পটলডাঙার চারমূর্তির সঙ্গে এই সময়ের  আত্মিক যোগ নেই !  আজকের কোচিং দৌড়নো, হায়ার সেকন্ডারি দেয়া, কম্পু-স্যাভি, মোবাইল-কানে ব্যাচের সঙ্গে আর কোন যোগ নেই।
নির্মল হাস্যরস টেনি দিতখুব সিম্পল কমিক,চারমূর্তির সাথে অনেক বেশি আইডেন্টিফাই করতে পারত সেই সময়ের ছেলে- মেয়েরা
টেনিদা - ঘোয়াং ঘাং !  বললে, আজ আর কেউ হাসে না !

প্যালা গাড়ী চালাতে চালাতে বলল :- পেশোয়ার কি আমীর? ঈশ্বরের দান সেই আমগাছ যা পরের কালবৈশাখীতেই পড়ে যায়। ঐ আমের জোরেই তো টেনিদার কুট্টিমামার (?) হবু বসের বাত সেরে গেছলো আর মামা চাকরী পেয়েছিলেন। এটার কথা মনে নেই !
ঘনাদা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল:- সূর্য্য কাঁদলে সোনাতে জম্পেশ করে কত কি বললাম । এখনকার সব লোকেরা হাসে ।
একটা বিশাল ভীড় । গ্রীণ পুলিশে ছয়লাপ । হাবুল মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল:- কি হইসে ভাই !
পোসেনজিৎদা আসছে পূজোর উদ্বোধন করতে । এখন যেতে পারবেন না । দেরী হবে ।
ক্যাবলা বলল:- পুঁটি মেল পাঠিয়েছিল । পটলডাঙ্গা থাণ্ডার ক্লাবে মুখ্যমন্ত্রী আসছেন পূজোর উদ্বোধন করতে । আজ বোধহয় আর পটলডাঙ্গায় ঢুকতে পারবো না !
 বাঙুর দিয়ে, সোজা, উল্টোডাঙ্গা হয়ে হাতিবাগান ক্রসিং পেরিয়ে  পটলডাঙ্গার দিকে চলল প্যালা ! পথে তেলেঙ্গাবাগান পূজো, হাতিবাগানের পূজো । ভীড়ে ভীড়াক্কার ।
ঘনাদা বলল :- চল প্যারাডাইসের কচি ডাবের সরবত খাই ।
প্যালা গাড়ী ঘোরাল কলেজ স্ট্রীটের দিকে । যাবে কি? এত ভীড় ঠেলে মানুষ হাঁটতেই পারছে না, তো গাড়ী !!!!!
টেনিদা শুকনো গলা দিয়ে বলার চেষ্টা করল -ডি লা গ্র্যান্ডি ! শব্দ বেরুলো না !
মনে মনেও কেউ বলল না – ইয়াক্, ইয়াক্ !
শালপাতার বদলে, কাগজের থালা ভিড়ে চিপ্টে গেছে । বড় হয়েও সুখ নেই !
কোলকাতায় না এলেই বোধহয় ভালো হতো











Tuesday, February 3, 2015

হাতে গরম





বাড়িতে বসে থাকা আর শুয়ে থাকা, তাও চিৎ হয়ে  বা ডান দিকে কাৎ হতে পারা যায় কিছুটা ডাক্তারের নির্দেশে ।
 বাঁ দিকে কাৎ হতে এখনও কষ্ট হয় একটু । গরম পড়লে নাকি সেটাও থাকবে না- ডাক্তারের ভবিষ্যবাণী ।

মাঝে মাঝে বেরুবেন, তবে এক নাগাড়ে  গাড়ীতে ঘন্টা দেড় দুইয়ের বেশী বসবেন না।
 বেশ – এত কড়াকড়ি আর ভালো লাগছে না । 

ছেলে বলল – আজ  আমার বিকেলে কোনো কাজ নেই, চলো বেড়িয়ে পড়ি ।

তা, যাবোটা কোথায় ?

কেন ? বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস ওয়েতে !

সেটা কোথায় ?

জানো না ? চলো দেখাই ।

সারথী সুরজিৎ আমাকে শিখিয়েছে, এখন কি ভাবে গাড়ীতে উঠতে হয় ।
ওঠবার সময় পেছনটা সিটে রেখে তারপর দুটো পা ভেতরে রাখতে হবে । নামার সময় ঠিক উল্টোটা ।
 গাড়ী চলল ।
এয়ারপোর্ট আড়াই নম্বর পেরিয়ে, বিরাটির আগের বাস ষ্টপেজের  ঠিক আগে বাঁ দিকে ঘুরলেই- বিশাল চওড়া টু লেনের রাস্তা,  ।

মনে পড়ল এতক্ষণে । কতবার, ডানকুনি  আর দক্ষিণেশ্বর গেছি, এই রাস্তা দিয়ে ।
নাঃ ! অ্যামনেশিয়া হচ্ছে, বুঝতে পারছি ।
বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে , যাওয়ার সময় রাস্তার ডান দিকে । একটা ফাইভ ষ্টার বড় হোটেলও আছে, ঝকঝকে নতুন ।
একটা ব্রিজ পেরুতেই  বাঁ দিকে ( ডান দিকেও আছে) অজস্র দোকান । সব, চা আর  জলখাবারের । প্রচুর লোক যাবার  সময়, দু দণ্ড দাঁড়িয়ে  ভাঁড়ের গরম চায়ে চুমুকের সঙ্গে, টুকটাক মুখও চালাচ্ছে ।

বেশ কয়েকটা দোকান পেরিয়ে জয়ন্তর ঠেক  । বাঁশের খুঁটি আর ওপরে টিন ।
 এত বাঁশ কোথায় পায়রে বাবা !মুখ দিয়ে, সট্ করে বেরিয়ে গেল !
সুরজিৎ কানের কাছে মুখ এনে বলল – চেপে যান জেঠু ।  “এশব পোসনো করতে নেই”
কেন রে ? মার ধোর খাবো নাকি ?

হতেও পারে, সব হাওড়া থেকে আসে কিনা !


 সে যাক্  জয়ন্ত নাকি খুব ভালো ফ্রেঞ্চ টোষ্ট বানায়, শুনলাম । আমার অভিজ্ঞতা বলে- কোনো দোকানই সোনালি রঙের অমলেট বানাতে পারে না ঠিক ঠাক ভাবে । হয়, দরকাঁচা নয় পোড়া । তা, জয়ন্ত বানাবে ফ্রেঞ্চ টোষ্ট ? ছ্যা ছ্যা ছ্যাঃ ।
কাগজের প্লেটে অবশেষে সুগন্ধ ছড়িয়ে বস্তুটি এলো ।
 বেশ সুন্দর করে পিস করা ।

আহা ! কি রঙ ! একেবারে  হলমার্কা সলিড সোনা ! হাল্কা কাঁচা লঙ্কার সুবাসের সাথে ভাজা পেঁয়াজের সুগন্ধ ! দিল একেবারে তর্ !
 আমি সুনামির মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম প্লেটটার ওপর ।

চাকুম চুকুম করে খেতে শুরু করতেই, ওনার ভুরু কোঁচকালো । গোৎ গোৎ করে জল খাই বলে একটা অভিযোগ আছে ওনার । আমি- ভদ্রলোক সমাজের উপযুক্ত নই , এটা ওনার বদ্ধ ধারণা । যাই বলুন আমাকে – খ্যাসখ্যাস করে চুলকিয়ে আরাম পাই, চোখ বুঁজে আসে মৌতাতে । চা খাই শব্দ করে ‍!‍

খাবো তো আমি, নাকি ? তো আরামই যদি না পেলাম- তালে কিসের চুলকুনি আর খাওয়া ?

আশে পাশে খলিসাকোটা । সব বরিশালের আদি বাসিন্দা এককালের ।
জয়ন্তর হাত খালি হতেই ডাকলাম ওকে ।

কি দাদু, কি বলবেন ?

বলছিলাম- তোর আদি বসত কোথায় ?

এখানেই জন্ম আমার !

 ------------বুঝলাম প্রশ্নটা ওয়াইড হয়ে গেল ।

মানে, বলছিলাম – তোর বাপ ঠাকুর্দা কোথাকার লোক ?

ও ! ওনাদের তো বাংলাদেশ !

বাংলাদেশের কোথায় ?

বরিশাল বলে শুনেছি
মনে মনে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ালাম ।

তো- শিখলি কোথায় এই রকম ভাবে মামলেট বা ফ্রেঞ্চ টোষ্ট বানানো ?

 সে অনেক কথা দাদু !

------- এবারেও বুঝলাম প্রশ্নটা বাউন্সার না হয়  !

অ ! তা তুমিও কি মানস সরোবরে গিয়ে অন্নপূর্ণার হাতা পেয়েছিলে নাকি ?
 মানে ?
না না – ওটা এমনি বললাম ।

ও ! আমাকে পথ চলতি একজন শিখেয়েছিলেন । ফ্রাইং প্যানে একটু বেশী তেল দিলেই করা যায় এটা ।
 এরপর ভাঁড়ে চা । বড় ভাঁড় – ১০ টাকা ।
 এটাতেও চায়ের ফ্লেভার আছে ।

------------
হাতে গরম ফ্রেঞ্চ টোষ্ট আর চা খেয়ে বাড়ী ফেরা । উদাস ভাবে দেখলাম- মুনলাইট বার আর রেস্তোরাঁর আলোর বিজ্ঞাপন ।

এরাও কি বরিশালের ? উত্তরটা, শিখর ধাওয়ানের সেঞ্চুরির মত অধরাই থেকে গেল ।




  








Tuesday, January 20, 2015

বৃক্ষছায়া

কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ট্রেনে নামল, অমল হাসিমারা ষ্টেশনে । ষ্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখল- অমল বোস “ ডুবপাড়া টি এষ্টেট” লেখা একটা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে, একজন। প্লেনে যাবার কথা বলেছিল কোম্পানি, কিন্তু বাবার বাধা  । কে জানে, প্লেনে আবার কি সব গণ্ডগোল হচ্ছে আজকাল ।
কাছে যেতেই লোকটা নমস্কার করে বলেছিল :- স্যার, আপনিই তো অমল বোস? আমাদের বাগানের নতুন সায়েব ?
মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলতেই, একটা হুডওয়ালা মারুতি জিপের কাছে নিয়ে বলেছিল :- উঠুন স্যার!
প্রায় জনহীন ছিমছাম ছোট ষ্টেশনের বাইরের দোকান থেকে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট কিনে উঠে পড়েছিল জীপে- অমল । একটা সুন্দর সুবাস ভেসে আসছে – চারিদিক থেকে ।

হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে গর্জন ।  অমল জানতো- হাসিমারা ভারতীয় বায়ু সেনার এয়ার বেস । বুঝলো- একটা জেট উড়ে গেল, মাথার ওপর দিয়ে ।

তারপর চিলাপাতার জঙ্গল দিয়ে যাত্রা শুরু । ড্রাইভারের নাম, খগেন বর্মনকথায় কথায় নিজের পরিচয় দিল । কোচবিহারের আদি বাসিন্দা । ত্রিশ বছর ধরে কাজ করতে করতে এখন হেড ড্রাইভার ।   সারা রাস্তা, বকবক করে বুঝিয়ে গেল চা বাগানের কালচার ।  চিলাপাতা জঙ্গলের হাতী আর বাইসনের কথা ! কয়েকটা অজানা পাখী ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না যদিও ।

বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে অমল বলেছিল- আচ্ছা, খগেন বাবু এবারে একটা হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেলে হতো না ?

খগেন পান চিবোতে চিবোতে হেসে বলেছিল :- আমাকে, বাবু বলবেন না, নাম ধরেই ডাকবেন । এই জঙ্গলে আপনি হোটেল খুঁজতিসেন ? চলেন চলেন-  আগত্ বাগানে চলেন । আপনার বাংলো তে চান টান করে লাঞ্চো খাবেন ।

মানে ?
আরে কোম্পানীর কাজ তো সকাল  বিকেল ! হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেলে কাজ করবেন কখন  ?  তা ছাড়া, কোম্পানিরই তো সব পরপাটি ! মালি, কেয়ার টেকার আছে । সব ব্যবস্থা আছে ,  কোম্পানিরই করা ।
অমল বুঝল – পরপাটি মানে প্রপ্রার্টি ।

কথা বাড়ায় নি অমল । সুন্দর মাখনের মত রাস্তা পেরিয়েই ফরেষ্ট চেক পোষ্ট । সেটা পেরিয়ে একটু যেতেই ডুবপাড়া টি এষ্টেটের মোরামের রাস্তা শুরু । বাঁ দিকে একটা কালি মন্দির । খগেন ষ্টিয়ারিং এক হাতে রেখে, অন্য হাত দিয়ে একটা নমস্কার ছুঁড়ে দিল, ভক্তি ভরে ।

দু ধারে চা গাছ ।  ধার গুলোতে সিট্রোনিলা গাছ দিয়ে বেড়ার মত করা । এই গাছ চেনে অমল। এই গাছ থেকেই মশা মারার তেল বের করা হয় । ঝাঁঝাল গন্ধ বেশ ।   
চা গাছের মাঝে মাঝে লম্বা গাছ ।  কোর্সে পড়া ছিল, তবে চাক্ষুষ দেখল এই প্রথম- শেড ট্রি । চা গাছকে ছায়া দেওয়াই কাজ ওদের । চা গাছ খুব সুখী, একটুতেই এলিয়ে পড়তে পারে । চা গাছকে আগলে রাখাই কাজ এই শেড ট্রিদের ।

 শেড ট্রি গুলোর গুঁড়ি থেকে একটু ওপর পর্যন্ত সাদা রঙ করা । জেনেছিল- সাদা রঙটা, গুঁড়িতে পিঁপড়ের আনাগোনা আটকানোর জন্য । বাগানের গাড়ীটা দেখে  বড় গেট টা খুলে দিল গেটকিপারএকটা স্যালুটও পেল  অমল । 

ডান দিকে সশব্দে চলা, চায়ের  সুগন্ধ ছড়ান ফ্যাকটরির পাশ দিয়ে  বাঁদিকে একটা বড় দোতালা কাঠের বাড়ীর সামনে খগেন দাঁড় করিয়েছিল গাড়ীটা ।

বড় সায়েবের আপিস দোতালায় ।  সিনিয়ার ম্যানেজার হিসেবেই পরিচিত ।

যান, দেখা করে আসেন । আমি অপেক্ষা করতেসি, আপনাকে বাংলো পৌঁছে আমি চলে যাব খেতে । -খগেন বলেছিল ।

ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে এই চা বাগানে প্রথম আসা, অমলের । শান্তিনিকেতন থেকে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর পাশ করার পর , কাগজ দেখে একটা দরখাস্ত দিয়েছিল, কপাল ঠুকে ।

চাকরীটা হয়েও যায়, বেশ কড়া ইন্টারভিউর পর । বেশ কয়েকজনকে ডেকেছিল কোম্পানি । দুজন সিলেক্টেড, তার মধ্যে অমল একজন । অন্যজন আসামের চা বাগানে পোষ্টিং পেয়েছে ।

উত্তর বঙ্গ, তার ওপর চা বাগানে কাজ শুনে মার প্রচণ্ড আপত্তি ছিল । বাবা খুব একটা বাধা দেয় নি ।   তাই মায়ের আপত্তি ধোপে টেঁকে নি ।
হিন্দি সিনেমায় রঙীন চা বাগান দেখে আকর্ষণটা বরাবরই ছিল অমলের ।
বাবার আর মাত্র এক বছর চাকরি ছিল তখন । প্রাইভেট একটা আপিসে কাজ । মাইনে পত্তর তেমন না হলেও চলে যেত ওদের তিনজনের ।
হাতি বাগানে বাবার পৈত্রিক বাড়ীটা থাকার ফলে , খুব একটা কষ্ট হয় নি । তবে অমল বুঝতে পারছিল, শান্তিনিকেতনের হোষ্টেলে থেকে ওকে পড়ানোর জন্য বেশ চাপে ছিল বাবা।
তাই আর রিস্ক নেয় নি
একটু অপেক্ষা করতেই ডাক এলো বড় সায়েবের কাছ থেকেজুতো, মোজা আর বেল্ট পরা হাফ প্যান্টের ওপর  হাফ হাতা সার্ট গোঁজা । উনিই বাগানের সর্বেসর্বা । সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবেই তাঁর পরিচয় ।
চেয়ার থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে বললেন- গুড আফটার নুন মিঃ বোস ! ওয়েলকাম টু আওয়ার টি এষ্টেট !  দিস ইজ এ গ্রুপ অফ মফারসন লিমিটেড ।
অমল হাত মিলিয়ে বলল :- গুড আফটার নুন স্যার ।
ওকে !! প্লিজ গো টু দি আদার রুম অ্যাটাচড্ টু মাই অফিস । সাইন দেয়ার ফর ইয়োর প্রেজেন্স ওভার হিয়ার অ্যাণ্ড গো টু ইয়োর বাংলো অ্যাণ্ড ডিপোজিট এ কপি অফ ইয়োর অ্যাপয়েণ্ট লেটার প্রোভাইডেড উইথ দ্য অরিজিনাল ওয়ান । হ্যাভ ইয়োর থ্রি এস অ্যাণ্ড লাঞ্চ । রিপোর্ট হিয়ার অ্যাট ফোর পি. এম ।

অমল প্রয়োজনীয় কাজ সেরে  কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে  খগেনের জীপে উঠলো । ঘড়িতে সময় তখন বেলা একটা ।


ভালো করে স্নান করে , বেরোতেই বেয়ারা কিষণ  বলল :- টেবিল পে খানা লাগাউঁ সাব ? ইয়া চায় দুঁ পেহলে ?  কিষণের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে খগেন ।
ট্রেনেই অনেকবার চা খাওয়া হয়ে গেছে তার । তাই চা আর খেলো না । বলেই দিল

হাঁ ! খানা  লগাও ।

রান্নাটা আহামরি কিছু নয়, তবে সাজানো টেবিল আর প্লেট , ছুরি চামচ দেখে মনে মনে হেসে ফেলেছিল অমল ।
ঠিক করে ফেলেছিল – মা – বাবাকে নিয়ে আসবে । তারপর না হয় কিষণকে মা রান্না শিখিয়ে দেবে । এই রান্না  বেশীদিন খাওয়া যাবে না ।

তার আগে দেখে নিয়েছে- একটা সাজানো গোছানো গেষ্ট রুম আছে । সাধারণত কোম্পানির লোকেরা বাইরে থেকে এলে পদমর্যাদা অনুযায়ী গেষ্ট রুমে থাকে । তবে, অমল জুনিয়ার, তাই এখানে গেষ্টের আসার সম্ভাবনা কম । অসুবিধে হবে না, মা-বাবা এলে । এলেও আরও একটা ঘর আছে । আসবাব পত্র সবই কোম্পানির । মায়, তোয়ালে, সাবান, দাড়ি কাটার সরঞ্জাম, তেল, সাবান সবই মজুদ।
ঠিক চারটের সময় খগেন গাড়ী নিয়ে এলো । চালাতে চালাতে বলল :- এবার আপনাকে পৌঁছে দিয়েই আমার ডিউটি শেষ । কাল থেকে আপনার ব্যবস্থা নিজেই করতে হবে ।
মানে, এতবড় চা বাগানটা আমি কি হেঁটে ঘুরবো নাকি, দেখাশোনা করতে ?

 হা হা হা ! আগে তো সায়েবরা সাইকেলে চড়ে ঘুরতেন সারা বাগান । ট্রাক্টরে করে যেতেন, কাছে পিঠের বাজারে ।  পাতা নিয়ে যাবার জন্য একটা বড় চার চাকার ট্রলি থাকে, ট্রাক্টরের সঙ্গে । এখন অবশ্য সবাই মোটোর সাইকেলে ঘোরে ।  আপনি মোটোর সাইকেল কেনার জন্য ব্যাংক লোন পাবেন, আর মাসে বিশ লিটার তেলও পাবেন- তবে, এক বছর বাদে ।
এক বছর বাদে কেন ?
পার্মিনেন্ট হলেই তো পাবেন !
অফিসে পৌঁছতেই, বড় সায়েব সব ম্যানেজার দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন  । ফ্যাক্টরি তো বটেই, তার সাথে বাগানের ইরিগেশন, গুয়াটেমালা গ্রাসের পাতা বা সিট্রোনিলা গাছ ছেঁটে মাটিতে ফেলে জৈবিক সার করা, পেষ্টিসাইড স্প্রে , ওয়ার্কারদের ওয়েলফেয়ার, ফ্রি রেশন, দরকারে রেশন মাপা পর্যন্ত, জ্বালানি কাঠ, ফ্রি চা , চা গাছের স্যাপলিংস্ জমিতে লাগান, ইয়ং ট্রিস্ নারচার করা-  সব বুঝে নিতে হবে ওঁদের কাছ থেকে একে একে, এই এক বছরে ।

অমল হেসে ঘাড় নাড়ল  ।
নাও গেট রেডি টু গো টু আওয়ার ক্লাব, হুইচ ইজ ওয়ান্স ইন এ উইক টাইম । উই মিট দেয়ার এভরি থার্সডে  ।  দি ক্লাব ইজ ইন আ গাডের্ন,  জাষ্ট টোয়োন্টি কিলোমিটারস্ ফ্রম হিয়ার । ইউ উইল বি ইনট্রোডিউসড্ দেয়ার ।

হাও কান আই আকপ্মানী ইউ স্যার ?

নো প্রোবলেম , ইউ উইল বি পিকড্ আপ বাই মিঃ মিশ্রা আওয়ার সিনিয়ার অ্যাসিন্টান্ট ম্যানেজার টু হুম ইউ উইল রিপোর্ট নাও অনওয়ার্ডস ।
ক্লাবে গিয়ে কোম্পানির আরও যে সব বাগান আছে ডুয়ার্সে, তাদের অফিসারদের সাথে পরিচয় হলো ।
বড় গ্লাসে একটা পাতিয়ালা পেগ হুইস্কি ঢেলে-  কোম্পানির অন্য বাগানের একজন অ্যাসিণ্টান্ট ম্যানেজার বললেন – চীয়ার্স !

এই জায়গায় বিনোদন বলতে,  সপ্তাহে একবার দেখা করা সবার সাথে ।   জম্পেশ ক্রিকেট বা ফুট বল ম্যাচ হলে বড় স্ক্রীনে সে সব দেখা হয়, একসাথে । ম্যানেজারদের ,মিসেসদের  মধ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতাও হয় । আলপনা দেওয়া থেকে শুরু করে, মায় বড়ি দেওয়া, আচার থেকে, ওয়াইন তৈরি করা পর্যন্ত ।
প্রাইজের ব্যবস্থাও থাকে ।




============
===========



সন্ধে বেলায় ডুয়ার্সের এই চা বাগানের অফিসার্স  বাংলোতে  একা বসে টিভি দেখছিল অমল ।  ডি.টি.এইচ কানেক্সান আর টিভিও কোম্পানির ।
মূল চা বাগান থেকে একটু দূরে এই বাগানটা  আউট ডিভিশন নামেই পরিচিত ।  অনেকটা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন , আন্দামানের মত । বাংলোটা তাই একটেরে । পাশে একটা কাঠের উঁচু বাড়ীতে থাকেন আউট হাসপাতালের কম্পাউণ্ডার ।  আশে –পাসে চা গাছের সারি । রাতের বেলা চৌকিদার থাকে ।
খবরের কাগজ আসে  আঠেরো কি মি দূরের সদ্য জেলা হওয়া শহর থেকে ।  আসতে আসতে বেলা এগারটা । সেই সময় অমল থাকে ফিল্ডে । মনে হয়, কোলকাতার সূর্য এখানে উদয় হয় বেলা এগারটায়  ! লাঞ্চে, ফিরে উত্তরবঙ্গ সংস্করণের কাগজে চোখ বুলোয় ।

কিষণ এসে জিজ্ঞেস করল- আজ ডিনারমে কেয়া লেঙ্গে সাব ?
ফ্রিজ মেঁ কেয়া হ্যায় ?

য়্যাদা সব্জী নেহী , লেকিন চিকেন হ্যায় সাব !

ঠিক হ্যায়, চিকেন কারি অওর চাওল বনাও । শুনো- ফ্রিজ সে বরফ ,পানি অওর কাবার্ডসে হুইস্কিকা বটল লানা , সাথমে গ্লাস । স্যালাড‌্ ভি বনাকে লানা । কল, কিসি কো ভেজেঙ্গে বাজার মেঁ । ইদানীং এই অভ্যেসটা হয়ে গেছে  তার । অবশ্য কিনতে হয় না । বিভিন্ন ম্যানেজাররা কোলকাতার হেড অফিসে গেলে উপহার পান । তার থেকে জুটে যায় অমলের ।

========
========

সেল ফোনের শব্দে চটকা ভাঙল অমলের । সিনিয়র অ্যাসিটাণ্ট মানেজার মিশ্রজীর ফোন নং টা ভেসে উঠলো সেল ফোনের স্ক্রীনে কোম্পানীর

গুড ইভনিং স্যার !
গুড ইভনিং ! শুনো বোস, কল বিএলআরও কো লোগ আয়েঙ্গে । গার্ডেনকা  জো জমিন হ্যায়, ও কুছ সিভিল লোগোঁনে ক্যাপচার কর রক্খা হ্যায় । উধার আভি স্যাপলিংস্ লগানা হ্যায় । মৈঁ আপকো, পর্চা ভেজতা হুঁ অভি, ও জরা সাথ মেঁ রখনা । কাম মেঁ আয়েগা শায়দ ।

ইয়েস স্যার !

এই কয়দিনে অমল বুঝে গেছে – কোম্পানি কালচার । দেখা হলেই বা ফোন এলে উইস করতে হয়।

সকাল সাতটা থেকে ডিউটি শুরু  । আউট ডিভিশনে একটা চক্কর মারে অমল । একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটোর সাইকেল কিনে নিয়েছে আপাতত ।  পেট্রলটাও পাচ্ছে কোম্পানি থেকে।
মিশ্রজি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ।


চা বাগানে তোলা চা পাতার ওজন হচ্ছে । স্থানীয় ভাষায়- মেলা । তা মেলাই বটে । বেলা বারোটায় কাজ শেষ ওয়ার্কারদের । মধ্যে  এক ঘন্টা খাওয়ার ছুটি, তারপর আরও দু থেকে তিন ঘন্টা চলে দুটো পাতা, একটা কুঁড়ি তোলার কাজ ।
নতুন চা গাছ লাগান দরকার । বেশীর ভাগ চা গাছ প্রায় একশো বছরের ওপর পুরোনো । তাই ফলন কম ।
সাড়ে এগারটা নাগাদ , বিনাপুর লাগোয়া বাগানের জমিতে বিএলআরওর লোকজন এসেছে ।
শাসক দলের স্থানীয় এক নেতা কি সব বোঝাচ্ছে ওদের ।
একটা জায়গায় দোকান করার তোড়জোড় চলছে, গুয়াটেমালা গ্রাস কেটে  । অমল গিয়ে বলল :- একি ! আপনারা বাগানের জমিতে  দোকান করছেন কেন ?

নেতা মাড়ী বের করা হাসি হেসে বলল :- ওই যে আপনাদের বড় সাহেব, আমাদের দুর্গা পুজোর চাঁদা হাজার টাকা দিয়েছেন ! তাই । চাঁদাটা বাড়াতে বলুন, আমি চলে যাব । না হলে কিন্তু, ওয়ার্কাররা ঝামেলা বাধাবে ।

বিএলআরওর লোকেরা চুপ । অমল পর্চা দেখিয়ে বলল – এই দেখুন, আমাদের এটা রেকর্ডেড জমি বাগানের । এটা ইলিগাল এনক্রোচমেন্ট ।
অবাক হয়ে দেখল অমল, তাও কথা  সরছে না ওনাদের ।

হঠাৎ কোত্থেকে বুধিয়া সোরেন মাটি ফুঁড়ে দাঁড়াল, কিছু ওয়ার্কার নিয়ে
তুরা টাকা লিয়ে কি করিস হামাদের জানা আছে । বেশী কথা বলবি না ।  ই মাটি হামাদের খেতে দেয় । ঝামেলা করবি তো হামরা  একশো লোক লিয়ে তুর কেলাবে ঝামেলা করব , বুঝলি ? ওই দিক যানা কেনে, দুকান করবি তো !
নেতা একটু পেছিয়ে গেলে , আপিসের বাবুরাও নড়ে চড়ে বসল ।
মিশ্রাজী কোথা থেকে খবর পেয়ে চলে এসেছেন ।
নেতাকে বললেন :- আপ অগর হাজার রুপেয়া লেঙ্গে তো ঠিক হ্যায় । আশপাশ অওর ভি পুজা হোতা হ্যায় । সব কো দেনা পড়তা হ্যায়, সমঝে নেতাজী ?
বুধিয়া ঘাড় নেড়ে বলল – ঠিক! নেতা বেগতিক বুঝে মোটোর সাইকেলে ষ্টার্ট দিলেন।

বুধিয়া সোরেন থুতু ফেলে বলল শালা !
একটু পরেই বড় সাহেব ফোন করলেন অমলকে :- গুড ইভনিং । ওয়েল ডান । নাও প্লিজ কাম টু দা অফিস । আই হ্যাভ এ গুড নিউজ ফর ইউ ।

=====
আজই কনফার্মেশনের চিঠি পেল অমল ।
  
তপতীর সাথে তার প্রেমটা অনেকদিনের । শান্তি নিকেতনের দু বছরের জুনিয়র তপতী । কলেজেই পরিচয় । মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তারই মত । বার্ণপুরে বাড়ী ওদের ।  ইদানীং আর ফোন করা হয়ে ওঠে না । তপতী মাঝে মাঝে ফোন করে ঠোঁট ওল্টায় অভিমানে । দু পক্ষের অভিভাবকরা জানলেও , এখনই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ছিল না দু জনেরই ।
মাকে ফোন করে কনর্ফামেশনের খবরটা জানিয়ে, তপতীকে ফোন করল ।

বাব্বা, সাহেবের ফুরসত হলো ! তপতীর ফিরতি জবাব ।

অত জানি না !  তুই  আমার সারাজীবনে, শেড ট্রি হয়ে থাকবি ? জবাব দে ।

কেন রে ? এত তাড়া কিসের, আর তা ছাড়া তোর ওই ধ্যাদ্দাড়া ডুবপাড়া যাব না আমি। বয়েই গেছে আমার ।

আমি এখন নিজেই চা গাছ, এই খানেই প্ল্যান্টেড হয়ে গেছি । আসবি না, বৃক্ষছায়া হতে ?

খিল খিল করে হেসে তপতী বলল – যাঃ !










Friday, January 16, 2015

মকরসংক্রান্তি



কথাটা শুনলেই আমার পিলে চমকে ওঠে ।

আমার মাতামহ প্রয়াত জিতেন্দ্র নাথ মৈত্র প্রায়ই আমাকে এই সময়ে ইংরেজী ট্র্যানশ্লেসন ধরতেন ।

পৌষ মাসে পুলি পিঠে, খেতে লাগে ভারি মিঠে ।

পালিয়ে চলে আসতাম । এটা আমি এখনও অনুবাদ করতে পারি না ।

যাই হোক

তিলাড়ু একটা অতি আবশ্যকীয় মিষ্টি, যা দিয়ে মকরসংক্রান্তিতে নারায়ণকে ভোগ দেওয়া হয় ।

বাস্তুদেবতার পুজোও করা হয় এই দিন । তিল কিংবা খেজুড় গুড় দিয়ে তৈরি তিলুয়া এবং নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চাল থেকে তৈরি পিঠের অর্ঘ্য দেওয়া হয়।

খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে- দুজন বড় মাপের বাঙালী কবি বিরাট বিরাট সংস্কৃত কাব্য লিখেছিলেন।

এঁদের মধ্যে একজন- কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন। বাড়ী কাঞ্চনপল্লীতে মানে আজকাল যাকে কাঁচরাপাড়া বলে। বিরাট বড়লোকের ছেলে আর খুব গুণী( বদ্যিরা এরকমই হয়)।

শ্রীশ্রীকৃষ্ণাহ্নিক- কৌমুদীনামে একটা কাব্য লিখেছিলেন। এই কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে ৮৫ থেকে ১১৮ শ্লোকে বসন্ততিলক আর পুষ্পিতাগ্রা ছন্দে শ্রী রাধার রান্নার মনোরম বর্ণণা আছে।
আর একজন লেখক হলেন- শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ। এনার লেখা বইটির নাম হলো- শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতএবং গোবিন্দলীলামৃত

এই গোবিন্দলীলামৃততেই নানাধরণের খাবারের বর্ণণা আর রান্নার প্রণালী দেওয়া আছে।

তবে, শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ বেশ কিছুদিন বৃন্দাবনে থাকার ফলে একটু কম বর্ণণা দেওয়া আছে। কবিকর্ণপূর পরমানন্দ সেন বাংলাতে বসে লিখেছিলেন বলে বর্ণণাটা বেশ বিস্তৃত।
পিঠে পুলিতে যাই ।

এই দুই কাব্যে- শাক, ভাজা, তরকারি, ডাল, টক ছাড়াও, নানা রকমের পিঠে আর পায়েসের বর্ণণাও আছে। পিঠেগুলোর নাম ভারী সুন্দর, কিন্তু সব সময় এর রেসিপি আমরা পাই না! ( কী দুঃক্কু!) কয়েকটা পিঠের নাম বলছি!

হংসকেলি
শোভারিকা
বেণী
চন্দ্রকান্তি
ললিতা! ( মাননীয় মান্না দে, আমার মনে হয়, এই পিঠেটা খেয়েছিলেন, না হলে ওই বিখ্যাত গানটা হতো না)
চিত্রা
কর্পূরকেলি
অমৃতকেলি

এখন আমরা যে মিষ্টিগুলো খাই, চারশ বছর আগেও সেই মিষ্টিগুলো ছিল!

জীলাবিকা মউহরি পুরু পূপগূজা
নাড়ীচয়াঃ কৃত সরস্বতি* কাদি পূজাঃ।
খর্চুরদাড়িমক শর্করপালমুক্তা
লাড্ডুৎকরান্ বিধতি রেহত কলাভিযুক্তাঃ।।

(*সরস্বতি- এই বানানটা সম্বোধনে বলে- ই কার হয়েছে)
জীলাবিকা=জিলিপি
পুরু= পুরী ( আটার তৈরী)
গূজা= গজা/ গুজিয়া
খর্চুর= খইচুর
দাড়িমক= কদমা ( মনে হয়)

তা আজকাল, এসব তৈরি করার বড় ল্যাঠা ।
কিনতে পাওয়া যায় বিভিন্ন পুলি পিঠে । কে আর ঝামেলা করে বলুন তো ? ব্যাপারটা ওই ইংরেজি ট্র্যানশ্নেসনের মত ।

ধুরোঃ

=========
ঋণঃ- উদ্বোধন শতাব্দী জয়ন্তী সঙ্কলনে, বিমান বিহারী মুখোপাধ্যায়ের রচনাঃ- সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলার খাবার।