Friday, September 12, 2014

কালাপাহাড়




বাংলা ও বিহারের শাসনকর্তা তখন সুলেইমান কারনানী (কেউ আবার বলেন কারারানী)   । সুলেমান কারনানী নামটা সিন্ধী হলেও, ইনি ছিলেন আফগান।
কাররাণীরা মাত্র বারো বছর (১৫৬৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) বাংলা শাসন করে । এই সময়টুকু কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাজ খান কাররাণী তার জীবনের শুরুতে আরেক আফগান শের শাহ্‌ সূরীর অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন।

 তার প্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সূরীদেরই শাসক মুহাম্মদ আদিল শাহ্‌ সূরীকে আক্রমণ করে উত্তর প্রদেশের কিয়দংশ দখল করেন। পরবর্তীতে মুহাম্মদ আদিল শাহ্‌ আর সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের সম্মিলিত আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে পূর্ব দিকে সরে যান। পরে বাংলার দুর্বল শাসক তৃতীয় গিয়াস উদ্‌ দীন শাহকে কৌশলে হত্যা করে বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কাররাণীদের গোটা সময়টাই বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক অ সম্প্রীতিতে পূর্ণ।
তাজ খান কাররাণীর আগমন বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কুর্‌রম থেকে।

বাংলা আক্রমণের সময় তার সাথে তার তিন ভাই ইমাদ, সুলাইমান ও ইলিয়াস সাথে ছিলেন। সাম্রাজ্য স্থাপনের পর তিনি সেটি ভোগ করার জন্য দুই বছরেরও কম সময় পান। ১৫৬৬ খ্রীস্টাব্দে তাজ খান কররাণী মারা যাবার পর তার ছোট ভাই সুলাইমান খান কররাণী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সুলাইমান কাররানীদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় (প্রায় সাত বছর) শাসন করেছিল।

রাজধানী গৌড় থেকে পদ্মার তীরের  ট্যাঁড়া বা তান্দায় স্থানান্তর করণ ও শরীয়া আইন প্রচলন অন্যতম। ট্যাঁড়া বা তান্দা প্রায় দশ বছর বাংলার রাজধানী থাকলেও এর নাম আজ প্রায় কেউ জানে না। শহরটি পরিত্যক্ত হবার পর এক সময় পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। (ট্যাঁড়ার খাজা নামে একটা তিলের খাজা এখনও পাওয়া যায় মালদাতে)  কাররাণীরা বাংলার ক্ষমতায় বসার পর দলছুট আফগানেরা তাদের কাছে জড়ো হতে থাকে। গৌড়ের আবহাওয়া আফগানদের ও তাদের ঘোড়াদের জন্য সহনীয় ছিল না। তাছাড়া কৌশলগত কারণে বাংলার রাজধানী মুঘলদের কাছ থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে রাখা দরকার ছিল। গৌড় থেকে রাজধানী স্থানান্তরের প্রধান কারণ ছিল এইগুলো।
সুলাইমানের সেনাপতি কালা পাহাড় আমৃত্যু মুঘলদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কেউ কেউ লোদী সম্রাট সুলতান বাহ্‌লুল লোদীর ভাগ্নে মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীকে তার হিন্দু মন্দির ধ্বংসের প্রবণতার জন্য কালা পাহাড় নামে আখ্যায়িত করেন।

কিন্তু এখানে আলোচ্য কালা পাহাড় মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীর প্রায় একশত বছর পরের মানুষ।
রাজীব লোচন রায় উত্তরবঙ্গের মালদার হরিশচন্দ্রপুরের ( কেউ বলেন পাণ্ডুয়ার রাজবংশে) এক বাঙালী বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তিনি বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও অস্ত্র চালনায় পারদর্শী ছিলেন । তার কর্মজীবন শুরু কিভাবে হয়েছিল সেকথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। পরে গৌড়ের সেনানীতে যোগ দিয়ে, সৈন্য পরিচালনা ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা দেখান ।

ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তিনি সুলাইমানের শাসনামলে গৌড়ের ফৌজদারের পদ লাভ করেন। এভাবে তিনি সুলাইমানের কাছাকাছি আসার সুযোগ পান এবং তার কন্যার প্রেমে পড়েন। রাজীব লোচন রায় সুলাইমানের কন্যার পাণিপ্রার্থী হলে সুলাইমান তাকে ধর্মান্তরিত হবার শর্ত দেন।

কারো কারো মতে রাজীব লোচন রায়ের যুদ্ধ দক্ষতা দেখে সুলাইমান নিজেই তার নিকট নিজের কন্যার বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। উচ্চাভিলাষী রাজীব লোচন রায় সুলাইমানের প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে সুলাইমানের কন্যাকে বিবাহ করেন।

এর ফলে রাজীব লোচন রায় নিজ সমাজে জাতিচ্যূত হন। শাহজাদীও বলেন, একজন নারীর জন্য ধর্ম পরিবর্তন করার কোনো কারণ ছিল না ।

 কিছুদিন পর তিনি বাংলার ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তারা কোন বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে রাজীব পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাকে ও তার স্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং তার কোন প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে জানিয়ে দেন। এতে রাজীব লোচন রায় মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সুলাইমান এই রকম

 সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।  ওডিশার রাজা মুকুন্দ দেবের সাথে যুদ্ধে রাজীব লোচন রায়কে একজন সেনাপতি বানানো হয়। এতে তিনি উড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানের উপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পান।
১৫৬৭ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দ দেবের বিরুদ্ধে সুলাইমান কররাণীর পুত্র বায়েজিদ খান কাররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার উজবেকের যুদ্ধে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালা পাহাড় উড়িষ্যা ও তার নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান।

১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কালা পাহাড় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান, প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা যায়, কালা পাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন।


 কালা পাহাড় ওডিশার বালেশ্বরের     গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। কালা পাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘন্টা মন্দিরের ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমাদের হাতগুলো খসে পড়ত। এতে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। কালা পাহাড় মন্দির সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালা পাহাড় সম্বলপুরের মা সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। সমলেশ্বরী মন্দিরের পূজারীরা মন্দির রক্ষার্থে এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন। একজন নারীকে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালা পাহাড়ের ছাউনিতে পাঠানো হয়। তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিষ মিশ্রিত দুধ, দই, ছানা, বিক্রি করে।

পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালা পাহাড়ের বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যান।


কালা পাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের ঘটনা ঊড়িষ্যা ও মেদেনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কাররাণীরা কোচ বিহার আক্রমণ করলে সেখানে তিনি কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালা পাহাড় কররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান কররাণীর আমল পর্যন্ত কররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলোতে অংশগ্রহন করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীদের পতনের পর কালা পাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালা পাহাড়ও নিহত হন।
=============

তথ্যসূত্র :- ইন্টারনেটের বিভিন্ন  সাইট ও ব্লগ

No comments: