একটা প্রশ্ন অহরহ মনে ঘুরপাক খায় ! এই যে খিদে আর উপবাস নিয়ে চারিদিকে এত হৈ চৈ, তালে বৈদিক যুগে কি হতো ? সবাই কি দুধে ভাতে থাকতো, নাকি সেকালেও খাবারের অভাব ছিল ?
সেটাই দেখা যাক না ! লোকে তো বলে :- সবই “ব্যাদে” আছে । তাহলে, এটাও কি থাকবে না ? ঐ যে আজকাল কম্পুতে কোনো কোনো অ্যাপসে বলে- টেক এ ট্যুর ! তাই করি বরং ।
“সুজলাং সুফলাং” এই ভারত । সেখানে তো খাদ্যের অভাব হওয়ার কথা নয় । অতীত এবং বর্তমানে তো প্রচুর গৌরব গাথা শুনি আমরা । সেটা কতখানি ঠিক ?
দেখা যাচ্ছে, খাদ্যের জন্য অসংখ্য প্রার্থনা !! শুধু সংহিতা ব্রাহ্মণে নয়, আরণ্যক উপনিষদেও আছে এই সব ।
প্রচুর খাবার বা উদ্বৃত্ত থাকলে তবেই খাদ্য সঞ্চয় করা যায় । সেটা তো কোনোদিন সাধারণ “ জনসাধারণ” করতে পারে নি । অথচ, এই সব জন সাধারণের জন্যই সব কিছু ।
এরা সারা পৃথিবীতেই “ দিন আনি- দিন খাই” জনগণ । দ্রারিদ্র্য, ক্ষুধা, অভাব এদের নিত্য সঙ্গী। প্রাচীন মিশর, চীন – কোনো জায়গাতেই চাষি- মজুর সারা বছর পেট ভরে খেতেই পেত না । ভারতও তার ব্যতিক্রম নয় ।
বৈদিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, আর্যরা আসার (?) চার পাঁচ শতাব্দীর মধ্যেই উৎপাদন ব্যবস্থায় কৌশল গত প্রকরণে বিপ্লব এসে যাওয়ায়, উৎপাদনের মাত্রা বেড়েছে । প্রয়োজনকে ছাপিয়ে উদ্বৃত্তও থেকেছে । মনে রাখতে হবে, আলোচ্য সময়কার “ আর্য” মানে পশুচারণের, মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতো- এমন একটা গোষ্ঠীবদ্ধ জনগোষ্ঠী যারা পরে কৃষিতে মন দেয় ।
এর সাথে সাথেই সমাজে শ্রেণীবিভাগও এসে গেল , আর উদ্বৃত্ত জমা হতে লাগল মুষ্টিমেয় ধনীদের হাতে ।
নিরন্ন মানুষদের না দিয়ে এই উদ্বৃত্ত খাদ্য পণ্য হিসেবে ব্যবহার হল, নিজস্ব আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়াতে । এর ফলে, সাধারন মানুষ খাবার আর পেলো না ।
“ খেতে যেন পাই” এই প্রার্থনাটা আছে সমস্ত বৈদিক সাহিত্য জুড়ে । প্রশ্ন উঠতেই পারে, সাধারণ মানুষের তো এসব জানার কথা নয়, তারা প্রার্থনাটা করল কি ভাবে ?
উদারবাদী লোকেরা সব সময়েই আছে এবং একটা প্রতিরোধও ছিল ।
“ অপরিহবৃতাঃ সনুয়াম্ বাজম্” (১।১০০।১৯) – সরলচিত্ত আমরা খাদ্য লাভ করবো । অর্থাৎ - আমরা যদি কুটিলতা পরিহার করে, নৈতিক জীবন যাপন করি, তা হলে দেবতা আমাদের খাদ্য যোগাবেন , এমন একটা বিশ্বাস ছিল মানুষের অন্তর্নিহিত চেতনায় ।
শুনলে অবাক লাগে, উপনিষদের যুগে – যখন আধ্যাত্মিকতাই জয়যুক্ত, যখন ব্রহ্মই পরম সত্য, তখন “ নেহাৎ তুচ্ছ” প্রয়োজনীয় বস্তু “অন্ন”কে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে ।
যত দিন গেছে, ততই মানুষ বুঝেছে- যতই উচ্চকোটীর চিন্তা বা দার্শনিক চিন্তা হোক না কেন, সেই চিন্তা করার জন্য দরকার শরীরের । আর শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে – অন্ন ( সব কিছুই যাহা উদর পরিপূর্ত্তি করে, অর্থ সংকোচার্থে – ভাত ) ।
এই অন্ন মহ বা মহৎ । অন্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে- প্রাণের মহিমা । “অন্নে হীমানি সর্বানী ভূতানি বিষ্টানি- বৃহদ আরণ্যক উপনিষদ (৫।১২।১) অন্নেই এই সমস্ত প্রাণী নিহিত ।”
বৈদিক যুগে মানুষ- পশু শিকার, পালন, ফলমূল সংগ্রহ বা চাষ, যে করেই হোক খাবার বা খাদ্য সংগ্রহ করত ।
সেখানে আবার অনেক অনিশ্চিয়তাও ছিল । ঝড়, বৃষ্টি , চাষ ঠিক ভাবে না জানা – এই সব । তাই এক অজ্ঞাত শক্তির কাছে বারবার মাথা নোয়ানো । তিনি যদি খুশী হয়ে পেটে খাদ্য যুগিয়ে দেন !!
আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে আমাদের- সে যুগে মানুষ চেষ্টায় প্রকৃতিকে বশ করতে পারতো না বলেই যজ্ঞের উদ্ভাবন । ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বারবার এর উদাহরণ আমরা পাই ।
স্পষ্টতই মানুষের চেষ্টাতে যেটুকু খাদ্য উৎপাদন হতো, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম। তাই দেবতা আর যজ্ঞই ছিল ভরসা ।
সংহিতা ব্রাহ্মণে অর্থাৎ বেদের কর্মকাণ্ডে ক্ষুধার খাদ্যের জন্য সরাসরি প্রার্থনা আছে । খাদ্য ছিল মুখ্য কাম্য বস্তু ।
ক্ষুধা সম্বন্ধে বারবার আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে কারণ, যজ্ঞ দিয়ে- দেবতার স্তব দিয়ে-তীব্র প্রার্থনা দিয়ে ক্ষুধা জনিত মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাবার প্রার্থনা বারবার দেখতে পাই ।
আরণ্যক- উপনিষদে অর্থাৎ বেদের জ্ঞানকাণ্ডে কি ছবিটা পাল্টে গেল ?
তখন তো লোহার লাঙলের ফলা ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ! অল্প পরিশ্রমে বেশী জমি চাষ করা যাচ্ছে ।ফসলও ফলছে বেশী । ক্ষুধার প্রকোপ কি কমলো কিছু ? এযুগে মুখ্য কথাটা যজ্ঞ নয়- ব্রহ্মজ্ঞান ! এই সব তত্বকথা যখন এসেছে সমাজে তখন কি খাদ্যের জন্য আকুলতা কি কমেছে ?
আরণ্যক- উপনিষদে ক্ষুধার অন্নের জন্য একই রকম আগ্রহ । জন্মান্তর বাদ এসে গেছে চেতনায়, তবুও এই আগ্রহ ।
নানা উপাখ্যানে ক্ষুধার গুরুত্ব এবং অন্নের মহিমা ব্যক্ত করা হয়েছে । এর সংখ্যা এত বেশী যে , এ যুগেও নিরন্ন মানুষের সংখ্যা, সমাজে অন্নের ব্যাপক অভাব, ক্ষুধায় মৃত্যুর আতঙ্ক সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আর বজায় থাকে না ।
তত্ব আলোচনার যুগে মাঝে মধ্যেই ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য রাজা জনকের সভায় এসে খেজুর আলাপ করতেন ।
একবার, তেমন আসার পর জনক জিজ্ঞেস করলেন :-
কি মনে করে ঠাকুর ? ব্রহ্ম তত্বের জন্য এলেন না গাভীর জন্য ?
যাজ্ঞবল্ক্য :-দুইয়ের জন্য মহারাজ ।
কথাটা উনি নিঃসঙ্কোচে বলেছিলেন । এবারে ভেবে দেখুন স্বয়ং যাজ্ঞবল্ক্যের যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে তখনকার সাধারণ মানুষের কি অবস্থা ছিল ?
ঋষিরা তাদের ইষ্টসিদ্ধি গুছিয়ে নিতে পারতেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের অভাবের দিনে উপোস করে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, কারণ রাজার কাছে তাদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ ।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন কোনো বিধান ছিল না, যে খরা- অজন্মা – দুর্ভিক্ষর সময় রাজকোষ উন্মুক্ত করে তাদের খাদ্য যোগাতে হবে ।
এমন নয় যে কোনো কোনো রাজা বা ভূস্বামী এটা করতেন না, তবে সেটা ছিল ব্যতিক্রম । এমন বহু তথ্য পাওয়া যায়, যখন মানুষ ভিক্ষা সংগ্রহ না করতে পারলে, তাদের অনাহারেই মরতে হত।এই সময় থেকে এগিয়ে এলে দেখতে পাবো-
“ দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে
জাগিয়া উঠিল হাহা রবে
বুদ্ধ নিজ ভক্তগণে
শুধালেন জনে জনে
ক্ষুধিতের অন্নদান সেবা
তোমরা লইবে কেবা ?”
রাষ্ট্রে কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকলে, বুদ্ধ তাঁর ভক্তদের এই দায়িত্ব নিতে বলতেন না, এটা এখন স্পষ্ট ।
উত্তর বৈদিক তত্বের যুগেও যাঁরা ব্রাহ্মণ্য এবং ব্রাহ্মণ্যেতর প্রস্থানের বড় বড় প্রবক্তা, তাঁরা ইহকাল- পরকাল-জন্মান্তর-কর্ম- কর্মফল নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন, কিন্তু যে মানুষ গুলো দিনভর খেটে তাঁদের অন্ন যুগিয়েছে, তাদের খবর আর তাঁরা রাখেন নি ।
অনিবার্য্য ফল হিসেবে , ক্ষুধার প্রকোপ রয়েই গেল সমাজে । খাদ্য সংস্থান না থাকলে এই সব আলোচনা একেবারেই নিরর্থক ।
মহাত্মা গাঁধি বলেছিলেন :-Before the hungry even God dares not come except in the shape of bread.
ক্ষুধিতের সামনে স্বয়ং ভগবানও খাদ্য ছাড়া অন্য চেহারায় আসতে সাহস পান না ।
সরাসরি খাদ্য দিয়ে ক্ষুধার মোকাবিলা সেই বেদের যুগেও হয় নি, আজও হচ্ছে না । সেদিন মৃত্যু আসতো “ অশনায়াপিপাসের” ( ক্ষুধা এবং পিপাসা) চেহারায় । মানুষ সেদিন যজ্ঞে দেবতাকে মাথা খুঁড়েও অন্ন পায় নি ।
আজ, তাদের উত্তর পুরুষ আমরা এখনও সরকারের কাছে মাথা খুঁড়ছি, অথচ আমাদের আরও উপোস করতে হবে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে ।
“কোথায় পাবো তারে”?
=====================================
- সর্বাত্মক ঋণ :- সুকুমারী ভট্টাচার্য রচিত “ বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য” বই । ( চিরায়ত প্রকাশন)