শিরোনামে যা আছে, সেটা ঠিকই পড়েছেন!!! এমন কি চশমা চোখে দিয়ে পড়লেও। বাঙ্গাল আর ঘটির লড়াই কবে থেকে চালু হয়েছে, তা ঐতিহাসিকরাই বলতে পারবেন। এই বিষয় নিয়ে বহু পত্র পত্রিকায় লেখালেখি, চলচিত্র তৈরী, মুখে মুখে ছড়া চালু-ও হয়েছিল। সরলীকরণ করে বলা যায়, দেশভাগের পর, বাঙ্গালী হলেও দুই ভিন্ন মুখী সংস্কৃতির সংঘর্ষ, বিশেষ করে রান্না বান্না আর ফুটবলের ক্ষেত্রে এই তথাকথিত সংঘাতের সৃষ্টি। দুটো প্রচলিত ছড়া বলি।
বাঙ্গাল মনুষ্য নহে
বিদঘুটে জন্তু
লাফ দিয়ে গাছে ওঠে
ল্যাজ নাই কিন্তু!!!!!!
উত্তরে, এই ছড়াটি চালু হলো
বাঙ্গাল মনুষ্য নহে
দেবতার তুল্য
এ দেশের ঘটিরা
বুঝিবে কি মূল্য!!!!
৬৪ বছর পর এসবের আর মূল্য সত্যিই নেই। সবই ইতিহাস! যেটা আছে, সেটা পুরোনো স্মৃতি নিয়ে হাসাহাসি। আসুন, সেই ভুলে যাওয়া দিনগুলোকে নিয়েই এই ভুলভাল লেখাটা শুরু করি।
দেশভাগ হয়ে গেছে। মদনেরও চাকরী গেল! ওপারের জমিদার বাবু মদনকে ডেকে বললেন-( কথপোকথন বাঙ্গাল ভাষাতেই হয়েছিল, কিন্তু আমি সেটা ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলাম)
-বুঝলি রে! তোর রান্না খেয়ে খেয়ে আর কারো রান্না মুখে রুচবে না জানি, কিন্তু আমার আর মাইনে দিয়ে তোকে রাখার সামর্থ্য নেই। তাছাড়া, আমি ঘটি বাটি বেচে দিয়ে কোনরকমে ওপারে চলে যাচ্ছি। কোথায় থাকব জানি না। তোকে বাপ পিতেমোর রাখা এই দুটো মোহর দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস।
মদন কিছু দিন ধরেই আঁচ পাচ্ছিল এরকম কিছু একটা ঘটবে। বিয়ে সাদী করে নি। বাপ মাও মরে ভূত। তিনকূলে কেউ নেই। থাকার মধ্যে পিতৃপুরুষের দেড় কাঠার ভিটেটা। তিন চার দিন ভেবে চিন্তে, মদন আবদুল চাচাকে ভিটেটা বেচেই দিলো।
যে টুকু পয়সা পেলো, সেটাই নিয়ে পাড়ি দিয়ে এসে মদন এসে পৌঁছল এপারের এক জেলাতে। ছোট্ট এক চিলতে বাসা ভাড়া করে মদন থিতু হলো।
রান্না ছাড়া কিছু জানা নেই!!!! রোজই কাজের সন্ধানে বেরো্য় আর ফেরে এক বুক হতাশা নিয়ে।
ঘুরে ঘুরে মদন ভাবল, এপারে আসাটা কি ভুল হলো! ওপারে থাকলেও বা কি হতো!!! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পড়ল জমে থাকা জলের ওপর! কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি! ঠিক সেই সময় মোটোর গাড়ীতে উঠছিলেন স্থানীয় জমিদার গৃহিণী। চলকে ওঠা জল গিয়ে পড়ল তাঁর দামী শাড়ীর ওপর! আর যায় কোথায়! পায়ের চটি খুলে সপাটে মদনের গালে। তারপর গটমট করে মোটোর গাড়ীতে উঠে চলে গেলেন! সঙ্গে তীর্যক মন্তব্য-
বাঙ্গাল গুলো রাস্তাটাও দেখে চলতে পারে না!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
মদন ভেবে অবাক! তাকে বাঙ্গাল বলে চিনলেন কি করে ওই মা জননী? ভেবে কোনো কূল কিনারা পেল না! শেষে রাস্তার ধারের মুদি দোকানে বসে ১ পয়সার মুড়ি কিনে চিবোতে লাগল। অন্তত পেটের জ্বালাটা তো মিটুক! অপমানের জ্বালাটা আপাতত থাক!
দোকানী হেসে বলল: -বাপু হে! ওই ছোট্টো টিনের বাক্সর ওপর “ ভালেবাসা” কথাটা কেন লিখেয়েছ? তুমি তো দেখছি এক্কেরে খাজা বাঙ্গাল!!!
মদন,বাড়ী থেকে বেরুলে তার সমস্ত টাকা পয়সা, জামা কাপড় বাবার বিয়ের এই ছোট বাক্সটাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিদ্যুৎ খেলে গেল মদনের মাথায়!!!!!!
এবার বুঝতে পারল, মা জননী কেন তাকে বাঙ্গাল বলেছিলেন!!!!!
দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল. মা জননী কার স্ত্রী!!! ভদ্রলোক বিশাল পয়সার মালিক আর তাঁকে সবাই জমিদার বাবু বলেই ডাকে। মা লক্ষ্মীর কৃপায় পয়সার কোন অভাব নেই! রোজ বেলা ১২ টা থেকে ৩ টে কাছারী বাড়ীতে বসেন, পাত্র মিত্র সহ। বিশাল পয়সার মালিক হলেও ভদ্রলোক বেশ দয়ালু! রোজ তাঁর বাড়ীতে প্রায় ১০০ জনের পাত পড়ে, আর বেশ কিছু বেকার লোক জনও থাকেন ওনার বাড়ীতে।
তখন বাজে বেলা একটা। জল খেয়ে মদন কপাল ঠুকে বেরিয়ে পড়ল জমিদারবাবুর কাছারী বাড়ীর দিকে।
তখন লোকজন একটু কম। বাবু আয়েস করে গড়গড়া টানছেন!!! মদনকে দেখে বাবু ভুরু কুঁচকে বললেন- কি চাই? গম্ভীর স্বরের সঙ্গে মদন পরিচিত। তাই না ঘাবড়ে বলল- হজুর, আমি ওপার থেকে আসছি। রান্না ছাড়া তো কিছু জানি না! হজুর যদি দয়া করে একটা রান্নার কাজ দেন!!!!
-ওহে! তোমার ওই বাঙ্গাল রান্না এখানে কারুর মুখেই রুচবে না! আর তা ছাড়া, আমার চার চার জন রান্নার লোক! তোমাকে রেখে কি লাভ?
- হজুর আমার রান্না একবার খেয়েই দেখুন!!!
-বেশ! খেতে পারি, কিন্তু এমন জিনিস তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে, যেটা আমি জীবনে খাই নি!! পারবে???
মদন এক মুহূর্ত্ত ভেবে বলল- পারব হজুর! কিন্তু দশ দিন সময় দিতে হবে!
বাবু বললেন- বেশ! তা যদি পার, তবে তোমাকে আমি কাজে বহাল করব। ওরে! কে আছিস! এ ব্যাটাকে নিয়ে গিয়ে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দে! আর রান্নার জিনিস কিনতে যা পয়সা লাগবে দিবি! যাও বাপু! এখন আর বিরক্ত করো না!
মদন লাফাতে লাফাতে গিয়ে ওর ভাড়া বাড়ীটা ছেড়ে দিয়ে বাবুর বাড়ী এসে উঠল।
সেই যে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল, খাওয়া আর টুকটাক কেনাকাটি করা ছাড়া মদন আর বাবুর বাড়ীর বাইরে আর বেরোয় না।
ক্রমে ক্রমে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। দশদিনও হয়ে গেল। বাবুর আর মনে নেই! কে কার খবর রাখে? মদন কিন্তু ঠিক মনে রেখে সময় মত তার নতুন রান্না এক বিরাট কড়াই করে হাজির করল বাবুর সামনে।
বাবুকে একটা বড় বাটী করে মদন খেতে দিল। মুখে দিয়েই লাফিয়ে উঠলেন!
-অমৃত! অমৃত! ওরে গিন্নীমাকে ডেকে নিয়ে আয়! ওনাকেও চাখাই! গিন্নীমা এলেন, খেলেন কিন্তু মদনকে চিনতে পারলেন না! চেনার কথাও নয়। দশদিনে গরীবের কথা কে আর মনে রাখে? রান্না খেয়ে গিন্নীমাও লাফিয়ে উঠলেন!
একই কথা মুখে-অমৃত! অমৃত! পারিষদেরাও খেল। তাদেরও একই কথা! রান্না যারা করত, তারা দৌড়ে এসে ঘটনা দেখে হতভম্ব! ওদের মধ্যে একজন বলল- সবই তো হল!! কিন্তু বাবুকে নতুন জিনিস কি খাওয়ালে হে, মদন?
বাবুরও মনে পড়ল। ঞ্যাঁ!! তাই তো! বল হে, কি সেই নতুন জিনিস!!!! গিন্নীমাও সুরে সুর মেলালেন!
মদন শুরু করল-
কাছারী বাড়ীতে ঢোকার সময় দেখি একগাদা পুরোনো জুতো! জিজ্ঞেস করে জানলাম- ওগুলো চাকর বাকরদের বাতিল জুতো!!! তা ওই জুতো গুলো থেকে গোড়ালী গুলো খুলে নিয়ে, এই দশদিন ভিনিগারে ভিজিয়ে রেখে রান্না করেছি!! অনেক ভেবে দেখলাম বাবু আর গিন্নীমা, আপনারা তো অনেক জিনিস খেয়েছেন, কিন্তু বাঙ্গাল রান্না আর চাকরের জুতো তো আর খান নি!!!!!!! তাই আর কি!!!!
............সমাপ্ত..........