Thursday, July 24, 2014

জিও গুরু




( বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ :- এই ফটো আমার বন্ধু বাসুর ( বিমোচন ভট্টাচার্যের ) ব্যক্তিগত সংগ্রহের থেকে নেওয়া। ব্যবসায়িক কারণে ব্যবহৃত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।)







মাইরী বলছি, গুরু বলতে আমাদের একজনই ছিল ! যে সে গুরু নয় !!!! এক্কেরে খোদ মহাগুরু !

কত মেয়ে যে নীরবে চোখের জল ফেলেছে, গুরুর জন্য! সব জল জমেই তোএখনও পর্যন্ত কোলকাতার বুকে জলের অভাব নেই !
সারা পশ্চিমবঙ্গে, এমনকি খোদ বাঁকুড়া-পুরুলিয়াতে জল-জল বলে যে মাঝে মাঝে হাহাকার ওঠে, গুরুর সময় সে সব ছিল না ।
আমরা যারা গুরুর কাছে ইনডায়রেক্টলি দীক্ষা নিয়েছিলাম- সব সময় গুরুর হেয়ার এষ্টাইল, সার্ট, পেণ্টুলুন পরার টুকলি করতাম ।
কারণ একটাই ! আঠেরো থেকে আশি সব মেয়ে/ মহিলা / নারী ফিদা গুরুর জন্য ! উডু উডু অ্যালবাট চুল,পেছনে ইউ কাট; বঙ্কিম গ্রীবা, হৃদয় তোলপাড় করা হাসি নিয়ে গুরু আমাদের সক্কলকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল ।


ধুতি পরলে, গায়ে গোটানো হাতা কলার দেওয়া ফুলজামা ! নিজেকে ঘ্যামা লাগত !

আড়ে – আগে দেখতাম- মেয়েরা তাকাচ্ছে কিনা !
গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবী, কোঁচান ধুতি পরে গুরু, পুরো রূপকথার রাজপুত্তুর !!!!
চোখ চিনচিন করে, মাথা টনটন করে, বুক ধঢ়পঢ় করে সে সব কথা ভাবলে ! গুরু যখন হাফসোল খেয়ে আমাদের দিকে তাকাত- জান, লবেজান‌্-হালাকান্ ! ওফ্ ! ভাবলেই পেটের মধ্যে গুড়গুড় !

গুরুর গাড়ী ছিল প্রথম ছিল হাফ সাদা, হাফ কালো স্টুডিবেকার, তারপর ইমপালা, তার অনেক পরে

অ্যামবাসাডর। নাম্বার, ডব্লুউ এম সি ৮৭৮৭।
বনেটের নিচে দুটো ফগ লাইট, প্রথম থেকেই ছিল। এ গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়িতে চড়তেন না আমাদের পরম আরাধ্য।
রাস্তায় যদি দৈবাৎ চোখে পড়ত, তখন সেই রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে পিচের আলকাতরা গায়ে মেখে নিতাম ।


ট্র্যাফিক জাম্ ! পেছনে পুলিশের রুল কোনোকিছুই “দ্যাবায়ে” রাখতে পারত না !!!!!!!
গুরুর পদ-রজ না পাই, গাড়ী-রজ তো পেতাম, সেটাই বা কে দ্যায় ? রোদে পুড়েছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, শীতে কেঁপেছি- খালি গুরুকে একপলক নিজের চোখে দেখার জন্য ।
গুরু ম্যাজিক আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বাঙালিকে !

আর কোনো গুরু হালে পানি পেতো না ! আশ্রম সব খাঁ খাঁ করছে !
গুরু তো আর একদিনে হয়ে ওঠেন নি !
ম্যাট্রিক পাশ করে, কলকাতা বন্দরে কেরানির কাজ আর একই সময় বেশী রোজগারের আশায় স্কুলের ছেলেমেয়েদের গান শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে,কেজো জীবন শুরু হয়েছিল এই রাজপুত্তুরের ।
মেট্রো সিনেমাতে টর্চ লাইট নিয়ে “ আশারের” কাজ করতেন বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় ।
উত্তর কোলকাতার আহিরী টোলায় মামার বাড়িতে, ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯২৬ এ জন্ম । বাবা নাম রেখেছিলেন অরুণ কুমার ।

জীবনের উত্থান পতন ছিলো তাঁর নিত্য সঙ্গী । পাড়ার নাটকে অভিনয় করার সুবাদে পা রেখেছিলেন


সিনেমার আঙিনায় । আজও মুক্তি পায় নি তাঁর প্রথম অভিনীত হিন্দী ছবি- মায়াডোর ।
১৯৩৯ সাল। দেশজুড়ে তখন এক অশান্ত অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা। সেই উত্তপ্ত সময়ের মধ্যে কৈশোর


পেরিয়ে যৌবন উত্তমের। একচল্লিশের ২২ শ্রাবণ।
১৫ বছরের অরুণ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায়, লক্ষ মানুষের মিছিল। পরের বছরই ‘


ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের উন্মাদনায় ভবানীপুরের অলিগলিতে বের হতো অরুণের নেতৃত্বে স্বদেশি
]
প্রভাতফেরি।
অরুণেরই লেখা গান তারই সুরে গাওয়া হতো। সে বছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং পাস। ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন কলকাতার সাউথ সুবাবরণ মেইন স্কুল থেকে। ভর্তি হন গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। এখানে পড়েন কমার্স নিয়ে। ১৯৪২ সালেই নিদান ব্যানার্জির কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন।
১৯৪৪ সালে পোর্ট কমিশনারস অফিসে খিদিরপুর ডকে ক্যাশিয়ারের চাকরি পান, ২ হাজার টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে জমা দিয়ে।


১৯৪৭ সালে প্রথম ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওর ফ্লোরে আসেন উত্তম কুমার। প্রথম অভিনীত ছবি ‘মায়াডোর’ (হিন্দি)। এ ছবিতে কাজ করে দৈনিক পাঁচ সিকি পেতেন। নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় ‘কামনা’ ছবিতে (১৯৪৯)।
নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। ‘কামনা’ মুক্তি পাওয়ার পর এটি ফ্লপ করল। সেই লড়াইটা ছিল ভয়ঙ্কর। ফ্লপ এবং ফ্লপ। হাত থেকে কনট্রাক্টের কাগজ ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রযোজক। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার চেহারাটা নায়কোচিত নয়’।
তুলনাটা চলে আসত প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়ার সঙ্গে। দ্বিতীয় প্রতিপক্ষও তখন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে সেই ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।’ তাঁর ‘মাচো-হিম্যান’ ইমেজে গত শতাব্দীর পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিরা তখনও আত্মহারা।
হৃদয়ের কুঠুরিতে লেখা হয়ে গেছে ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ কিংবা ‘প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া’ এই দুই নাম। তাদের পাশে নবাগত অরুণ কুমার। নাম পালটে হলেন উত্তমকুমার । ভাগ্যিস বসু পরিবার (১৯৫২) বক্স অফিসের মুখ দেখেছিল। ।
উত্তম কুমার বিয়ে করেন ১৯৫০ সালের ১ জুন পদ্ম পুকুরের বাসিন্দা গৌরী দেবীকে। একমাত্র ছেলে গৌতমের জন্ম ১৯৫১ সালে। এই সংগ্রামের সময় গৌরী দেবী, উত্তমকুমারকে সব সময় সাহস যোগাতেন ।
কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় থাকতেন উত্তম কুমার। কাছাকাছি পাড়ায় সেকালের রূপবান নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য, পুরনো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (বড়), চরিত্রাভিনেতা ইন্দু মুখার্জি বসবাস করতেন। তাদের কাজ দেখে শিখেছেন উত্তম কুমার। আর তার সঙ্গে অবচেতন মনে ছিল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস, জ্যোতি প্রকাশ, অসিত বরণ ও রবীন মজুমদারের মতো রোমান্টিক সব নায়কের রূপালি পর্দায় দেখার অদৃশ্য শিহরণ।
অবশেষে ১৯৫৩ তে এলো- ৭৪।।০ ( সাড়ে চুয়াত্তর) । ১৯৫৪ তে অগ্নিপরীক্ষা । দুটোতেই নায়িকা সুচিত্রা সেন ।

ব্যাস্ ! পেছনে পড়ে রইলো দৃষ্টিদান (১৯৪৮), কামনা (১৯৪৯), মর্যাদা (১৯৫০), ওরে যাত্রী (১৯৫১), নষ্ট নীড় (১৯৫১), সঞ্জীবনী (১৯৫২)- এদের মত সব ফ্লপ ছবি ।
উডু উডু অ্যালবাট চুল, বঙ্কিম গ্রীবা, হৃদয় তোলপাড় করা হাসি আর অভিনয়ের চূড়ান্ত আধুনিকতা এগুলোই ছিল উত্তমের তুরুপের তাস । সব মেয়ে ফিদা ।
তবে, যে বাঙ্গালী উত্তমকুমারকে আবেগের স্রোতে ভেসে 'শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা'র তকমা দিতে ব্যস্ত, তাঁরাই কিন্তু উত্তমকুমারের প্রকৃত অভিনয়-সম্বলিত চলচ্চিত্রের (বক্স অফিস অনুযায়ী) দাম দেন নি।
শেষের দিকে যখন উত্তমকুমার একজন পরিণত অভিনেতা হিসাবে বেশ কিছু ছবিতে চরিত্রাভিনয় করেছেন, সেগুলি আশ্চর্যজনকভাবে ফ্লপ। উদাহরণ হিসাবে নবরাগ, বিকেলে ভোরের ফুল, নগরদর্পণে, যদুবংশ, বাঘবন্দী খেলা-র নাম উল্লেখ করা যায়।
উত্তমকুমারের দর্শক তাঁকে শুধুমাত্র 'নায়ক' হিসাবে, 'গুরু' হিসাবেই দেখতে চেয়েছি আমরা (ব্যক্তিগত ধারণা) ।
এতে বাংলা সিনেমার অর্থিক দিক থেকে লাভ হলেও গুণগত দিক থেকে ঈষৎ ক্ষতিই হয়েছে বলে মনে হয়।


ঝাড়া ৩২ বছর ধরে গুরু রাজত্ব করে চলে গেল মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ! দিনটা ছিল ১৯৮০ সালের ২৪ শে জুলাই, বৃহস্পতিবার রাত ৯-৩০ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে !
বৃদ্ধ উত্তমকে ভাবাই যায় না । ভাবতেই পারি না ।




ইষ্টনাম :- উ-ত্ত-ম-কু-মা-র ফুটুস ! আর আমাদেরও ফুটুর ডুম্ !!!!
-

No comments: