ভাত না হলে, বাঙালির পেট ভরে না । এই অভ্যেসটা কোত্থেকে এলো? এটা, অস্ট্রিক ভাষাভাষী, আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান।
বাংলা এবং বাঙালির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যেসব তথ্য রয়েছে সেসবের শুরু হয়েছে খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর পর থেকে।
অর্থনৈতিকভাবে বিভক্ত, বাঙালি ধনী-গরীব সবারই খাবারের প্রধান মেনু ছিল ভাত, এখনো তাই আছে। তবে হাঁড়িতে ভাত নেই,
বাঙালির এই চির দুঃখের ব্যাপারটিও নিত্যকালের সঙ্গী এবং তা সমাজের স্তর বিন্যাসের কারণেই।
প্রবাদ তৈরি হলো – অন্নচিন্তা চমৎকারা, ঘরে ভাত নাই, জীয়ন্তে মরা ।
পোর্টো-অস্ট্রেলয়েড ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিল বাংলা। ধান চাষ আর চাল উৎপাদন এই জাতিগোষ্ঠীরই অবদান।
ধান চাষের ইতিহাস পৃথিবীতে শস্য উৎপাদনের আদি ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রশান্ত— মহাসাগরীয় দেশগুলো আর চিন দেশে ধানের উৎপাদনের শুরুর সময় নির্ধারণ করা কঠিন। তবে চাল তৈরি করে ভাত রান্না করার কায়দা এই অঞ্চলের সব স্থানেই ঠিক এক রকম নয়। ঘি দিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খাওয়ার কদর ছিল প্রাচীনকালে।
গরম ভাতের প্রতিটি কণা থাকত অভিন্ন, একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন, ঝরঝরে এবং অন্ন ছিল সুসিদ্ধ সুস্বাদু, শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়।
ভাত তৈরী করার জন্য রকমারী হাঁড়ি আছে । ভাতের ফ্যান যারা ফেলে দেয়, তাদের হাঁড়ি এক রকম, আর যারা ফেলে না, তাদের হাঁড়ি আর এক রকম ।
খেয়াল করলে দেখবেন, এই উপমহাদেশে- যেখানে ভাতের চলন নেই খুব একটা, সেখানে কিন্তু হাঁড়ি নেই । থাকলেও “ ভাটাইটিটি” বা ভ্যারাইটি নেই ।
ভাত তো হলো, এবার তার সাথে কি খাবো , কি-ই বা তার প্রণালী রাঁধার ?
চলুন, ধাক্কা পাশপোর্টে ময়মনসিংহ ঘুরে আসি । (যদিও অনেকে বলেন এটা আসাম অঞ্চলে চালু )
আঞ্চলিক রেসিপি “ ডাকের বচন” নামেই প্রসিদ্ধি পেয়েছে ।
শুরু করছি :-
“নিমপাতা কাসন্দির ঝোল । তেলের উপর দিয়া তোল ।
পলতা শাক রুহি মাছ । বলে ডাক ব্যঞ্জন সাঁচ।। ( সাঁচ = সত্যি)
মদগুর মৎস্য দায়ে কাটিয়া । হিং আদা লবণ দিয়া ।
তেল হলদি তাহাতে দিব । বলে ডাক ব্যঞ্জন খাবো ।।
পোনামাছ জামিরের রসে । কাসন্দি দিয়া যেজন পরশে । (জামির = টক বাতাবি লেবু, পরশে = পরিবেশন করে )
তাহা খাইলে অরুচ্য পালাএ। আছক মানবের কথা দেবের লোভ যাএ।।
ইচিলা মাছ তৈলে ভাজিয়া। পাতি লেবু তাতে দিয়া।। ( ইচিলা >ইচা = চিংড়ি)
যাহাতে দেই তাতে মেলে। হিঙ্গ মরিচ দিহ ঝোলে।।
চালু দিহ যত তত। পানী দিহ তিন যত।। (চালু = চাল)
ভাত উৎলাইলে দিহ কাটী। তবে দিহ জ্বালে ভাটী।।
বড় ইচিলা দাএ কুটি। হিঙ্গ দিআ তেলে ভাজি ।।
উলটি পালটি দিহ পীট। হই খাইলে যোজন দিঠ।। (যোজন দিঠ = এক যোজন [মোটামুটি ১৭ কিমি] পর্যন্ত দৃষ্টি যাবে )
রৌদ্রের বেলা বুনি আইসে। আমন ভাত কাসন্দি চোষে।।
পোড়া মাছে লবণ প্রচুর। আর বেঞ্জনে পেলাহ দুর।। ( পেলাহ = ফেলে দাও)
পাকা তেতলি বৃদ্ধ বোয়াল। অধিক কর্যা দিহ জ্বাল।। (তেতলি = তেঁতুল )
কাটী দিআ করিহ ঝোল। খাবার বেলা মাথা নাহি তোল।।
(ডাকের বচন- অষ্টম শতাব্দী, কৃতজ্ঞতা – চিত্রিত পদ্মে, অরুণ নাগ)
বচনের চরিত্রে উপদেশও আছে- কোন ঋতুতে কি খেতে হবে !!! ( ডাকের বচন = মোটামুটি প্রবাদ প্রবচনের কালেকশান – বলা যায় )
কার্তিকে ওল, মার্গে বেল
পৌষে কাঞ্জি, মাঘে তেল ( কাঞ্জি = ভাতের ফ্যান)
জ্যৈষ্ঠে ঘোল, আষাঢ়ে দই
শ্রাবণে চূড়ান্ত খই
ভাদ্রে তাল, আশ্বিনে শসা
ডাক বলে – এই বারো মাসা ।।
কোন খাবারের কোন অংশ বা কি অবস্থায় সুস্বাদু ,সেই বচনও আছে ।
শাকের ছা, মাছের মা, ডাক বলে বেছে খা
ডাইলের মধ্যে মুশুরি / সাগাইর (আত্মীয়) মধ্যে শ্বাশুড়ি।
=====
দুধে রান্না করা চালের বর্ণনাও পাওয়া যায়। বস্তুত চালের প্রকারভেদে বর্তমানে অতীতের চালের তৈরি ভাতের সঙ্গে কিছুটা তারতম্য দেখা গেলেও এখনো বাঙালির ভাত রান্নার প্রক্রিয়াটি অপরিবর্তিত আছে।
অতীতেও শাক ও অন্যান্য তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার নিয়ম ছিল। বিশেষ করে দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে শাক ও সব্জি তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার প্রথা ছিল। তরকারির মধ্যে বেগুন, কুমড়া, ঝিঙা, করল্লা, কচু (কন্দ) এইসব পোর্টো-অস্ট্রেলয়েড ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর অবদান।
তবে বেগুন, লাউ, মূল জাতীয় তরকারি (taro) এবং তেতো শাক, বিশেষ করে পাট শাক খাওয়ার প্রচলন হয়েছিল সম্ভবত প্রাক-আর্য-সভ্যতার প্রভাবে।
অতিথি আপ্যায়নের সময় শাকান্ন পরিবেশন প্রথাবিরুদ্ধ ছিল। অতিথি আপ্যায়নের জন্য বহুরকমের রান্না করা তরকারি পরিবেশন করা হতো। অনেক সময় এই সব তরকারি, পরিবেশন সংখ্যার দিক থেকে এতটাই বেশি হতো যে তা গুণেও শেষ করা যেত না।
বড় বড় সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে খাদ্যের প্রচুর অপচয় হতো। রাই-সরষের তৈরি ঝাল দিয়ে তৈরি তরকারি খেতে খেতে মানুষ মাথা ঝাঁকিয়ে এবং তালুতে মাথা চাপড়িয়ে, প্রচণ্ড ঝাল থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করত।
ওই ধরনের ঝাল খাবার পরিবেশনও প্রথাগত ছিল। খাঁটি সরষের তেলের ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে। তারপরও ঝাঁঝযুক্ত সরষের তেল এবং পেঁয়াজ দিয়ে মাখানো মুড়ি খেতে খেতে মাথা চাপড়ানোর কথাটা আমরা অবশ্য এখনো ভুলে যাইনি।
হরিণ, পাঁঠা এবং পাখীর মাংসের পরিবেশন ছিল অতিথি আপ্যায়নের বিভিন্ন উপকরণ। মাংসোপম বিবিধ মসলাযুক্ত ব্যঞ্জনও পরিবেশন করা হতো। পরিবেশন করা হতো দই, দুধের তৈরি পায়েস, ক্ষীর, ছানার তৈরি বিবিধ মিষ্টান্ন। কর্পূর মিশ্রিত সুগন্ধি জল পরিবেশন করা হতো। খাওয়ার শেষে পরিবেশন করা হতো সুপারি ও নানা মসলাযুক্ত পান।
তন্দুরী রুটি আর তন্দুরী মোর্গা বা মুর্গী খান নি এরকম পাঠকের সংখ্যা বোধহয় কম।
এই তন্দুরে বানানো রুটি বা মাংস কি হালের না পুরোনো ?
দেখাই যাক, ঐতিহাসিকরা কি বলছেন !!
সাড়ে চার থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, মানে কি হরপ্পার আগে বা হরপ্পার যুগেই তন্দুর ছিল ।
এই সংস্কৃতির অনেক জায়গাতেই পুরো তন্দুরের সন্ধান পাওয়া গেছে ।
সংস্কৃত সাহিত্যেও “ কন্দুপক্ক” নামে এক রকমের খাবারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে । এটা বোঝাই যাচ্ছে অর্থ হচ্ছে :- কন্দুতে পক্ক । এখন প্রশ্ন হলো, কন্দু কি ?
গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ তাঁর “ প্রাচীন শিল্প- পরিচয়” বইতে একটা অধ্যায় লিখেছেন।
“পাকবিদ্যা” শিরোনামে এই অধ্যায়ে তিনি কন্দু প্রসঙ্গে দেওয়া অন্যান্য অর্থের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন- কালিদাসের লেখা “ মালবিকাগ্নিমিত্র” নাটকে বিদূষকের উক্তি ।
বিদূষক বলছে:- বিপণিস্থিত কন্দুর ন্যায় আমার উদরের অভ্যন্তর দগ্ধ হইতেছে ।
পণ্ডিত মশাই বলছেন :- এর দ্বারায় বোঝা যায় কন্দু বিপণিতে ( দোকানে) থাকত আর তার মধ্যভাগ দগ্ধ হত ।
তিনি আরও বলছেন -“ সম্ভবতঃ কালের পরিবর্তনে, কোনও অপরিজ্ঞাত কারণে আমাদের দেশ হইতে নির্বাসিত “কন্দুই” বর্তমানে “তুন্দুর” নামে পরিচিত হইয়া আমাদের সন্মুখে বিদেশীয় আগন্তুকরূপে প্রতিভাত হইতেছে ।”
আমাদের দেশ বলতে এখন তিনি কি বুঝিয়েছিলেন সেটা জানা নেই, তবে তন্দুর বহাল তবিয়তে আছে, এই উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ।
এক বিদেশী বলেছিলেন- কোনো একটা খবর পাঠানোর মাধ্যম হচ্ছে রান্নাটা কি ভাবে হচ্ছে সেটা জানা । যদিও এই তত্ব বহুদিন আগে খারিজ হয়ে গেছে ।
সেদ্ধ করতে গেলে খাবার আর আগুনের মাঝে থাকে পাত্র আর জল । এই রকম হলে, আত্মীয়দের মধ্যে পড়বে খানে ওয়ালা ।
আর সিধে আগুনে ঝলসানো হলে, সেটা নাকি অনাত্মীয়দের জন্য ।
=======================
হে বঙ্গ !!!! ভান্ডারে তব বিবিধ রতন !!!!!!!!
No comments:
Post a Comment