“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
***
প্রবাদ কাকে বলে, এ ব্যাপারে সবারই
জানা আছে । ব্যাপারটা হলো, কেউ ঠিক এর সংজ্ঞা নির্দেশ করতে চাইবেন না ।
প্রবাদ বলতে, সাধারণত আমরা যা বুঝি-
সেটা এত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা রকম বিচিত্র ভাষায় প্রকাশ হয়, তাদের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে
কোনো একটা সাধারণ লক্ষণ খুঁজে পাওয়া বড় মুশকিল ।
অসংখ্য উৎসমুখ থেকে আসা, ক্ষীণ স্রোত
ধারাতে প্রবাহিত হয়ে, যা কিছু একসঙ্গে মিশেছে- তাদের একের সঙ্গে অপরের কোনো মিল বা
যোগাযোগ নেই ।
এগুলোই প্রবাদ নামে চিহ্নিত হয়ে এসেছে
। সহজে, পৃথক করা মুশকিল !!!
তবুও আমাদের পূর্বসূরিরা এই বিষয় নিয়ে
যে সব নির্দেশ বা দিক দিয়েছেন বা দেখিয়েছেন- সে সবের সাহায্যে, কিছু কিছু সাধারণ লক্ষণের
সন্ধান আমরা পাই যার থেকে আমরা একটা সংজ্ঞায় আসতে পারি ।
সাধারণ লোকের মুখে সচরাচর যে সব বুলি
বা বচন শোনা যায়, তার অল্প অংশ স্বরচিত হলেও হতে পারে কিন্তু বেশীর ভাগই পরের কাছ থেকে
শোনা বা উত্তরাধিকার সূত্রে শুনে এসেছে ।
যে সব উক্তি বা বচনে চিরন্তন সত্য বা
নির্ভুল তথ্য আছে আর যা আকারে সংক্ষিপ্ত , ভাষার মনোহারিত্বে মর্মস্পর্শী এবং জনগণের
মধ্যে বহুল প্রচার পেয়েছে, তাকেই খাঁটি প্রবাদ বলে স্বীকার করা হয়েছে ।
এই সব লক্ষণের মধ্যে কোনো একটার অভাব
থাকলে, তাকে প্রবাদ না বলা গেলেও – লোকোক্তি বা জনশ্রুতি বলে নেওয়া হয়ে থাকে ।
আগামীতে আমার চেষ্টা থাকবে, এই প্রবাদ
–প্রবচন নিয়ে লেখার ।
***
এটা দেখা গেছে- জ্ঞান আর সত্যের প্রচার
এবং সেই সঙ্গে ভাষার লালিত্য দিয়ে জনগণের মনোরঞ্জনের যোগ্যতা – এই দুটো কিন্তু সার্থক
কবিতার লক্ষণও বটে ।
সব সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা গেছে- আদিতে
কবিতারই জন্ম হয়েছে । শব্দ নিয়ে গড়া বাক্য যখন রসাত্মক হয়, তখন সেটা কাব্য হয়ে দাঁড়ায়
।
শব্দ বিন্যাসের সংযত সংক্ষিপ্ততাও কাব্যের
অপরিহার্য্য লক্ষণ । এই সংক্ষিপ্ততার চরম পরিণতি দেখা যায় প্রবাদে ।
যে প্রবাদ যতো অল্প শব্দে রচনা করা
হয়েছে, তার সার্থকতা ততোই বেশী ।
কাব্যের ধ্বনি বা ব্যঞ্জনাও প্রবাদের
এক বিশেষ উপাদান । তাই, এক একটা প্রবাদকে কবিতার ঘনীভূত নির্যাস বা কাব্য কণিকা বলা
যেতে পারে ।
প্রবাদে সত্য প্রচারের চেষ্টা হয়েছে,
নানা ভাবে । ধর্ম, নীতি, কৃষিকাজ, বাজারের দাঁড়িপাল্লা, সামাজিক , পারিবারিক কর্তব্য
করার উপদেশ, স্বাস্থ্যরক্ষা- সব বিষয়েই ব্যবস্থা নেবার এবং তার সাথে পরামর্শ দেওয়া
হয়েছে ।
যেমন :-
“কখনো খেয়ো না তালে আর ঘোলে
কখনো ভুলো না ঢ্যামনার বোলে”
-
পথ চলবে জেনে
কড়ি নেবে গুণে
-
রুয়ে কলা, কেটো না পাত
তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত
-
যার হাতে দাঁড়ি পাল্লা
নাই তার খোদা তাল্লা
-
অনেক প্রবাদে সরাসরি উপদেশ না দিয়ে
অন্যায় বা অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করে করণীয় করার দিকে মন দিতে বলা হয়েছে
।
উদাহরণ :-
যার ধন, তার ধন নয়
নোপোয় মারে দই
-
বজ্র আঁটুনি- ফস্কা গেরো
-
আপনি পায় না, শঙ্করাকে ডাকে
-
যতো ছিল নাড়া বুনে
সব হলো কীর্তুনে
-
আগেই বলেছি, স্বল্প পরিসরের মধ্যে-
ভাবের প্রকাশ, প্রবাদের একটা প্রধান গুণ । দু চারটে শব্দের মধ্যে দিয়ে বক্তব্য এলে
অনেক গ্রহণযোগ্য এবং হৃদয়গ্রাহী হয় – এটা অস্বীকার করা যায় না ।
তাই ছোট ছোট প্রবাদ- প্রবচনের প্রচণ্ড
আদর । এর প্রচুর উদাহরণ আছে । যেমন :-
পরচিত্ত অন্ধকার
মন না মতি
নারীর বল, চোখের জল
ধরি মাছ, না ছুঁই পানি
কেবল ব্যতিক্রম দেখা যায়, মেয়েলী বচনে
। ( এটা কোনো রেসিয়াল কমেন্ট নয় !! লক্ষ্য করে দেখা গেছে )
নারীজাতির অলঙ্কার প্রিয়তার খ্যাতি,
আর প্রগলভতার অখ্যাতি – এই দুটোই আছে । ( আবার মাফ চাইছি)
তাই এদের তৈরী প্রবাদ- প্রবচন অনেক
ক্ষেত্রেই বেশ অলঙ্কার মণ্ডিত হয়ে, শব্দবহুল হয়ে গেছে।
দেখা গেছে, অনেক জায়গায় বড় ছড়ার জন্ম
দিয়েছে- এই সব মেয়েলী বচন ।
একটা উদাহরণ :-
যার হাতে খাই নি, সে বড় রাঁধুনী
যার সঙ্গে ঘর করি নি, সে বড় ঘরণী
নানা রকমের বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গীর জন্য
প্রবাদ- প্রবচন সাধারণ জনগণের মন কাড়ে ।
যাঁরা এই সব প্রবাদ- প্রবচন তৈরী করেছেন,
নিঃসন্ধেহে বলা যায়, তাঁদের বক্তব্য সরস এবং হৃদয়গ্রাহী করার জন্য সবরকমের আপ্রাণ চেষ্টা
করেছেন ।
ঠিক, এই কারণেই সরল জনসাধারণের সহজ
রসবোধ বংশপরম্পরায় এই প্রবাদ প্রবচনকে সাদর স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে এবং আসছে ।
একটা শাস্ত্র আছে- অলঙ্কার শাস্ত্র
। এই সব প্রবাদ- প্রবচনে শাস্ত্র নির্দিষ্ট সব রকমের প্রয়োগে কোনো ভুল নেই । এটা হয়তো
জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাত সারে হয়েছে ।
শব্দালঙ্কারের প্রধান কৌশল- অনুপ্রাসের
সাহায্য নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশী পরিমাণে ।
অন্ত্যানুপ্রাস বা মিল, যা সকল ভাষায়,
সকল যুগে কাব্যের অপরিহার্য্য লক্ষণ বলে আমরা জানি, প্রবাদ- প্রবচনের সংকীর্ণ পরিসরেও
তার উপস্থিতি, সেটা প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে হোক বারবার দেখছি ।
কেবল মনোহারিত্বের জন্য নয়- মনে রাখার
সুবিধের জন্য মিলের প্রয়োজন সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে ।
সব ব্যাপারেই এই কারণে মিত্রাক্ষর ছন্দের
ব্যাপক ব্যবহার । জনগণের সুদীর্ঘ কাল মনে রাখাটা এই কারণেই হয়েছে । ছোট প্রবাদ- প্রবচনেও
এই মিলের জন্য শ্রুতি সুখকর ।
নুন খাই, গুণ গাই
-
ধন জন পরিবার
কেউ নয় আপনার
তথ্যঋণ :- সত্য রঞ্জন সেন রচিত, প্রবাদ
রত্নাকর । প্রকাশক – ওরিয়েন্ট লংম্যান্স । সাল- ১৯৫৭ ।
-
অন্তানুপ্রাসের পরই দেখতে পাই-আদ্যানুপ্রাসের
আদর । সব দেশেরই কবিতায় এটা দেখা যায় ।
=
চাল নেই চুলো নেই
পরের বাড়ী হবিষ্যি
যেমন:-
বামুন, বাদল, বান
দক্ষিণা পেলেই যান
-
প্রবাদে আরও যেটা দেখা যায়- মধ্যানুপ্রাসের
প্রাদুর্ভাব ।‘
যেমন:-
খুচরো কাজের মুজরো নেই
-
ঘোমটার ভেতর খেমটা নাচ
-
বাড়া ভাতে নেড়া গিন্নী
-
যদি হয় লুচি, মুচীর ঘরেও রুচি
আবার অর্থালঙ্কারের মধ্যে, উপমা আর
রূপকের ছড়াছড়ি – প্রবাদে ।
অতিশয়োক্তি,সমাসোক্তি(যে অলংকারে প্রাসঙ্গিক
বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের ব্যবহার বা ধর্ম আরোপ করা হয়),ব্যাজস্তুতির ( নিন্দাচ্ছলে
প্রশংসা) প্রয়োগও বেশ ভালো ভাবে দেখা যায় ।
উদাহরণ :-
চাঁদের হাট
-
ঘরের ঢেঁকি কুমীর
-
বাছার কি বা মুখের ছাঁই
তবু হলুদ মাখেন নাই
অত্যুক্তি বা অতিশয়োক্তির প্রয়োগে প্রবাদের
চমৎকারিত্ব ফুটেছে ।
যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় দুজন
কুরগা মরা গরু, মাগ্গো লারতে উদয় চাঁদ
( কুঁড়ে মরা গরু, পেছন নাড়াতেই চাঁদ উঠে যায়, বরিশাল ) কুঁড়েদের প্রতি এই প্রবাদটা
বলা হয়ে থাকে ।
-
হোগা নাই মেয়া উদ্দার হইররা পাদে।
(বরিশালের প্রবচন) অর্থ: সামর্থ নাই ফুটানি কতো! ঋণ:- যথা ক্রমে ধ্রুবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়
ও ডঃ মোস্তাক আল মেহেদি
এই ভাবে, প্রবাদের প্রকৃত যে বক্তব্য
অর্থালঙ্কারের পেছনে লুকিয়ে থাকে না । ঠিক, এই জন্যেই প্রাকৃত জনগণের কাছে এদের আবেদন
কখনোই ক্ষুণ্ণ হয় না ।
একটা জিনিষ লক্ষ্য করা গেছে :- প্রবাদের
কৌলিন্য, তার প্রাচীনত্বে ।
ইদানীং একটা প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায়
– যদির কথা নদীতে । ( অনিশ্চিত )
ভাবের গৌরব, আকারে সংক্ষিপ্ত, মধ্যানুপ্রাস
উপস্থিত- সবই আছে, কিন্তু কেবল নবীন বলে এটা তত প্রাচীন নয় বলে প্রবাদ কৌলিন্য পায়
নি ।
হতে পারে, এটা কিছু জায়গায় চলে, বেশ
কিছু লোক বলে- কিন্তু মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে- দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ে নি সেভাবে ।
এই প্রাচীনত্বের জন্যই আবার রচয়িতার
নাম খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর ।
যত হাসি, তত কান্না
বলে গেছে রামশর্মা
এই রকম কিছু প্রবাদের মধ্যে রচয়িতার
নাম পাই বটে, তবে সময়ের প্রভাবে জনগণ এই সব রচয়িতার নাম বাদ দিয়েছে ।
এদের মধ্যে ছিলেন – শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ
পণ্ডিত, বিচক্ষণ গ্রাম্য মৌলবী, মোড়ল, কৃষক বা শিল্পী ।
আবার শুদ্ধ অন্তঃপুর বাসীনী গৃহকর্ত্রী
থেকে, মেয়ে বউ রচনা করেছে –সরস ও সুতীব্র মন্তব্য- আর তার থেকেই হয়েছে প্রবাদ ।
নিম্ন আয়ের গৃহকর্ত্রী বাজার দর দেখে
ক্ষেপে গেছেন, সাথে ছেলের বৌয়ের ঘন ঘন বাপের বাড়ী যেতে চাওয়ার জন্য – ছড়া কাটছেন
:-
বাজার করবি ঘুরে ঘুরে/ শ্বশুর করবি
দূরে দূরে ।
বাজার করতে গেলে একজায়গায় না কিনে ঘুরে
ঘুরে কিনতে হয়, যাতে একটু সাশ্রয় হয় । আর শ্বশুর বাড়ী দূরে হলে, ক্যাচাল কম এবং বৌ
ঘন ঘন বাপের বাড়ী যেতে চায় না।
বাজারে দাঁড়িপাল্লায় ওজনে ঠকাচ্ছে দেখে
মৌলবী বলছেন :-
যার হাতে দাঁড়ি পাল্লা/ নেই তার খোদা
তাল্লা
-
প্রবাদ- প্রবচনে বহু ধর্মীয় উপদেশ বাণী
দেখা যায় । স্রষ্টারা স্বাভাবিক ভাবেই এগুলোতে চটুলতা এড়িয়ে চলেছেন ।
এদের ভাব – গভীর, ভাষা গম্ভীর ও সংযত
।
সত্যের প্রকাশকে, আপ্তবাক্য হিসেবে
সমাজ শ্রদ্ধার সাথেই নিয়েছে ।
তৎসম শব্দ থাকায়, প্রাকৃত জনগণ এখানে
হস্তক্ষেপ করেছে কিন্তু কোনো রকম বিকৃতি বা মর্যাদা হানি হয় নি ।
তার মধ্যে কয়েকটা:-
অভাবে, স্বভাব নষ্ট
-
চক্ষু বিনা যেমন অঙ্গ
ভক্তি বিনা সাধু সঙ্গ
-
কৃপণের ধনক্ষয়
চুরি কিংবা ডাকাতি হয়
-
গবেষকরা মনে করেন- কোনো আকস্মিক ঘটনা
বা কারও খারাপ ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে গ্রাম্য কবি তার কাব্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছে
। সৃষ্টি হয়েছে রসগর্ভ এই সব বচন:-
ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি
-
বড়ো হাতী গেল তল
মশা বলে কত জল
-
হায়রে কপাল একপেশে
সবাই বলে ফেন খসে
-
সামাজিক বা পারিবারিক নানা ব্যাপারে
অনেক কাল ধরে জড়িয়ে থেকে, প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ।
সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকেরা তাই নিজের
মত প্রকাশের জন্য , এক একটা মন্তব্য করতে গিয়ে , তাঁদের অজ্ঞাত সারেই প্রবাদের সৃষ্টি
করে গেছেন ।
এগুলিকে ভূয়োদর্শন জাত প্রবাদ বলা যায়
।
ছোট একটা মেয়েকে বারবার পুকুর থেকে
ঘটি ভরে জল এনে জালায় ( জল রাখার বড় পাত্র ) রাখছে দেখে, কৃষিজীবী প্রবীণ গৃহকর্তা
ফুট কাটলেন :-
এমন করে ছাগল দিয়ে কি ধান মাড়ান হয়
?
সঙ্গে সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর উত্তর :- হয়
গো হয় । কিছুটা তো হয় !! কেন, কাঠবেড়ালিতে সাগর বাঁধেনি ?
এই দুটো পরস্পর বিরোধী কথা, পরিবারের
লোকেরাও শুনে বহু জায়গায় ব্যবহার করতে করতে, একসময় প্রবাদ প্রবচনের ভাঁড়ারে ঢুকে গেল
।
বা
বাড়ীতে, নতুন বিয়ে হয়ে আসা বৌ- একটু অলস,
সহজে বাড়ীর কাজ করে না, ঝগড়াও করে একটু আধটু । তাই, তাকে বাড়ীতে গঞ্জনাও সইতে হয় ।
সূত্রধর ( কাঠমিস্ত্রি) শ্বশুর কিন্তু
স্নেহ প্রবণ । র্যাঁদা চালাতে চালাতে বললেন :-
ও সব কালে ঠিক হয়ে যাবে খন । “ কুঁদের
মুখে আর বাঁক থাকবে না” ।
জন্ম হলো- আরও একটা প্রবাদের !!
এসব দেখে মনে হয়- প্রবাদ বচনের বেশীর
ভাগই সাধারণ লোকের রচনা ।
নানা বিষয় নিয়ে রকমারি বিভিন্ন ভঙ্গীতে
প্রকাশ পেয়েছে ।
সেজন্য – যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে-
কথাটা বোধহয় প্রবাদের ক্ষেত্রে বেশী করে খেটে যায় ।
আমাদের তখনকার গ্রাম সর্বস্ব সমাজ জীবনের
নানা স্তরের অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করেই প্রবাদ বচনের সৃষ্টি ।
তাদের স্বাভাবিক সহজ জীবনের তথ্যই প্রবাদ
সাহিত্যের উপজীব্য ।
ঠিক এই কারণেই , এমন কোনো বিষয় বস্তু
নেই যা প্রবাদ সাহিত্যে স্থান পায় নি ।
-
প্রবাদের সর্বজনীন ভাণ্ডার সাধারণের
সম্পত্তি । এই ভাণ্ডার থেকেই সকলেই যেমন জানতে পারেন, সেই রকম নিজের সাধ্যমত দান দেবারও
অধিকারী ।
যদি ভালো করে দেখা যায়, তবে বুঝবো-
এই অধিকারের প্রয়োগে কারও কোনো ত্রুটি হয় নি বা এখনও হচ্ছে না ।
একটু আধুনিক কালে এগিয়ে আসি । ইদানীং
টিভিতে বাংলা সিরিয়াল দেখে একটা বচন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন সোসাল নেট ওয়ার্কিং সাইট মারফত
:-
আতা গাছে তোতা পাখি,ডালিম গাছে মৌ
বাংলা সোপে, একটা ছেলের দুটো করে বৌ
খুব উন্নত মানের নয়, তবে পাবলিক “খেয়েছে” আপাতত এই সমালোচনার জন্য ।
সকলের অধিকার যে সমান, সেটা অস্বীকার
করার কোনো জায়গাই নেই ।
সমাজের / প্রশাসনের সর্বোচ্চদের অপ্রিয়
সমালোচনার অধিকার আছে “ হীনতম” গ্রামীন
বা শহুরে লোকেদের ।
অসাক্ষাতে রাজার মাকেও “ ডাইন” বলার অধিকার, কার ছিল না সেকালে ? এখনও আছে ।
পরের দোষ ধরতে তো সকলেই ওস্তাদ খলিফা
। তাই সমাজের প্রত্যেকেই অন্যের সমালোচক ।
যে যখন সমালোচক হয়েছে- সমাজের যে স্তরে
তার স্থান, সেই পরিবেশের মধ্যে থেকেই পরিচিত ব্যক্তি, বস্তু বা ঘটনাকে ঘিরে দ্বিধাহীন
ভাবে বক্তব্য রেখেছে ।
অভ্যস্ত ভাষা আর নিজস্ব ভঙ্গীতে প্রয়োগ
করার ফলে- অনেক সময়েই মনে হয়, এগুলো “বিকৃত রুচির” প্রতিফলন ।
অনেক সময়ে নগ্ন অশ্লীলতাও এসে পড়েছে
অনিবার্য্য ভাবে ।
-
মজার ব্যাপার হলো একই অর্থবহ প্রবাদ
ওপার বাংলাতেও আছে । কারা যে কার দ্বারা প্রভাবিত, এটা বের করা দুঃসাধ্য ব্যাপার, তবে
আছে ।
আইসো শাল- মাগ্গে বও । ঝাড়ের বাঁশ-
গাঁড়ে আয় - ( যেচে বিপদ ডেকে আনা )
-
চালৈন কয়- সুইজেরে, তর পন্দে একডা ফুডা
! চালুনি বলে- সূঁচ, তোর পাছায় একটা ফুটো !! ( নিজের প্রচুর দোষ, তাও অপরের দোষ খোঁজা
)
-
পোঁদে গু নিয়ে দৌড়নো – (অত্যন্ত তাড়াহুড়ো
করে দৌড়নো ) । পন্দে গু লইয়া দৌড়ায় ।
-
এরকম সমালোচনা করতে গিয়ে কাউকেই ছাড়া
হয় নি । যে “বাউন”কে ভগবানের মত পুজো করতো সেকালের লোক,
তারা কি বলেছে- একবার শুনি :-
লাখ টাকায় বাউন ভিখারি
-
বামুনের মড়া ভাসে জলে
ফলারের নামে উঠে বসে
-
বাউনে দক্ষিণা ধরে
ঢেঁকির নামে চণ্ডী পড়ে
-
রাজা , রাণীকেও ভয় করা হতো না । খুব
বেশীদিন আগে নয় । একটা দীর্ঘদিনের অনশন চলেছিল ।
তখন শুনেছিলাম :-
বারো কাঁদি নারকেল, তেরো কাঁদি কলা
আজ আমাদের রাণীর উপবাসের পালা ।
-
এটা পুরোনো প্রবাদ- কিন্তু অনশনের সময়
মুখে মুখে ফিরতো !!! শুনেছেন হয়তো কেউ কেউ।
মন্ত্রীদের ব্যাপারেও প্রাচীন প্রবাদকে
একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বলা হত :-
রাজার আঙ্গুল মোটা মোটা
তাই দেয়, ফোঁটা ফোঁটা – এটা আসল । পরিবর্তিত
রূপ হল :-
-
মন্ত্রীর আঙ্গুল মোটা মোটা
তাই দেয়, ফোঁটা ফোঁটা
=
সমাজের শীর্ষ স্থানীয়দের প্রতি যখন
প্রবাদ প্রবচন – নদারৎ, তখন সাধারণ মানুষকে যে নাকের জলে, চোখের জলে হতে হয়েছে- সেটা
বলাই বাহুল্য ।
এই গুরু সাইটেই সিকি ,টইয়ের একটা লিংক
দিয়েছে । সেটাতেও প্রচুর প্রবাদ আছে। সেখানে প্রচুর প্রবচনের উল্লেখ আছে ।
কলমও চালানো হয়েছে সেই সব পুরোনো প্রবাদে
। এভাবেই বহু প্রবাদের রূপান্তর ঘটেছে ।
টইয়ের লিংক থেকেই দিচ্ছি :-
পশ্চিম বঙ্গে ২০১১ র বিধান সভা নির্বাচনের
পর একটা প্রবাদ আবার ভীষণ ভাবে চালু হয়েছিল :-
হেলে ধরার মুরোদ নেই, ধরতে গেছে কেউটে.....
আসলটা অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট ।
আগে ছিল – ল্যঙ্গোটের আবার বুকপকেট
!!
এখন:-
জাঙ্গিয়ার আবার বুক পকেট
তাতে আবার ক্রেডিট কার্ড।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ও তৈরি
হচ্ছে :-
খ্যাপা খাবি কি ঝাঁঝে মরে যাবি
-
ছিঁড়তে পারে না লোম, দেওয়ালে ছুঁড়বে
বোম
-
কি বদল আনলে কাকা/আলুর কেজি তিরিশ টাকা
-
প্রবাদ প্রবচনের বিবর্তন। প্রাচীন কাল
থেকে।
পাগল না পায়জামা।
পাগল না হাপপ্যান্ট
পাগল না বার্মুডা
পাগল না মাথাখারাপ
পাগল না সিপিএম
বাকি গুলো লিখলে জেল হবে আমার ।
-
প্রবাদ প্রবচনের গুরুত্ব পেয়েছে- দুষ্কৃতকারীরাও
। সবচেয়ে মনোযোগ পেয়েছে- চোর !!! ডাকাত- বাটপাড়- গাঁটকাটা নয়, সিঁদেল চোর এবং ছিঁচকে
চোর ।
পরের জিনিস অপহরণ যারা করে, সেই বিদ্যায়
পারদর্শীদের সম্বন্ধে জন সাধারণের কৌতুহলের সীমা নেই ।
কোনো চোর ধরা পড়লে- গৃহস্থ কে সাহায্য
দানের যত না বেশী ইচ্ছে, তার চেয়েও নিজের হাতের সুখ করে নেওয়ার জন্য প্রচুর লোক রবাহুত
হয়ে ছুটে যায় ।
তাই- চোর, এই রহস্যজনক লোকটিকে নিয়ে
যত বচন প্রচলিত, তেমন বোধহয় আর কাউকে নিয়ে আর হয় নি।
চুরি বিদ্যে বড়ো বিদ্যে, যদি না পড়ে
ধরা- এই সত্য সকলেই মুক্তকণ্ঠে মেনে নেবে , বিশেষ করে যারা নিজে ধরা পড়ে নি ।
অবশ্য ধরা না পড়ার কৃতিত্বর ফলে যত
চুরি হয়, ধরা পড়াটা তার একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র ।
চোরের মনস্তত্ত্ব, কর্মকুশলতা ও জীবন
দর্শন সম্বন্ধে এত সূক্ষ্ম গবেষণা আর বিশ্লেষণ হয়েছে যে, যারা এতটা কৃতিত্ব দেখিয়েছে,
তারা ঐ ধরা না পড়ার দল ভুক্ত ।
যেহেতু- “চোরে চোরে মাসতুতো ভাই” এবং “ এক চোরে বিয়ে করে আর এক চোরের শালী”- একে অপরের হাঁড়ির খবর অজানা নয় ।
তাই এই মহাবিদ্যা বিশারদেরা (এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ)
সাধু পরিচয়ে যেমন সমাজে প্রতিষ্ঠা বজায় রেখে চলে, তেমনই পরহিতৈষণায় প্রেরণার তাগিদে
যাবতীয় গোপন রহস্য প্রকাশ করে দিয়ে ইঙ্গিত করেছে – “সাধু সাবধান” ।
সবাই জানে- চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী
। তাকে যত উপদেশই দেওয়া যাক না কেন- সব এ কান দিয়ে ঢুকে, ও কান দিয়ে বের করে ফেলে ।
এই রকম অবস্থায়, তাকে নিরস্ত করার উপায়
নেই দেখে, অগত্যা গৃহস্থের সাবধান হওয়া ছাড়া আর কোনো চারাও নেই ।
কিন্তু, মানুষ আর কতো সাবধান হতে পারে
?
এমন শুভানুধ্যায়ী, আত্মীয় বন্ধুদের
অভাব নেই – যারা চোরকে চুরি করতে বলে আর গৃহস্তকে বলে সজাগ থাকতে ।
প্রসিদ্ধি যে, মহাকবি কালিদাস, স্বীয়
অসাধারণ কবি প্রতিভা সত্ত্বেও একদা রাজসভায় কয়েকটি সমস্যা পূরণে অপারগ হইয়াছিলেন ।
মহারাজা বিক্রমাদিত্য ( মতান্তরে মহারাজা
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত) তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, কালিদাস উত্তর দিয়াছিলেন:-
“ দরিদ্রস্য গুণাঃ সর্বে ভস্মাচ্ছাদিতবহ্নিবৎ ।
অন্নচিন্তা চমৎকারা কাতরে কবিতা কুতঃ
।।”
ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় দরিদ্রের
গুণাবলী প্রকাশ পাইতে পারে না । অন্নাভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্তের নিকটে কবিতা কোথা হইতে
আসিবে ?
ইহা হইতেই বঙ্গীয় ভাষায় প্রবাদ রচিত
হইল :-
“অন্নচিন্তা চমৎকারা,ঘরে ভাত নাই জীয়ন্তে মরা”
যাঁহারা রসিক, তাঁহারা এক পদ আগাইয়া
মন্তব্য করিলেন :-
“অন্নচিন্তা চমৎকার, বস্ত্রচিন্তা নৈরাকার (নৈরাকার = একাকার)
তার চেয়ে বেশী চিন্তা, তামাক নাই যার”
+++++++++++++++++++++++++++++
সমাপ্তম্
+++++++++++++++++++++++++++++
সমাপ্তম্
==================
তথ্যঋণ :- সত্য রঞ্জন সেন রচিত, প্রবাদ
রত্নাকর । প্রকাশক – ওরিয়েন্ট লংম্যান্স । সাল- ১৯৫৭ । দুর্লভ এই বইটি আমাকে সংগ্রহ
করে দিয়েছেন বলে আমি শ্রী পরিচয় সেনগুপ্তের ( আগরপাড়া) কাছে ঋণী ।
No comments:
Post a Comment