১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর, ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী, বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্বের আদায়ের ভার পেয়ে গেল।ফলে, কয়েক বছরের মধ্যেই কোম্পানী; দেশের রাজশক্তি,একেবারে কুক্ষীগত করে ফেলে।“বণিকের মানদণ্ড পরিণত হলো রাজদণ্ডে”। পরবর্তী কালের নিরীখে, সূচনা হলো এক নতুন যুগের। এ সময়ের কিছু আগে থেকেই, বাংলায় গদ্য রচনা আরম্ভ হয়ে গেছিল। শুধু, খ্রীষ্টান মিশনারীরা নয়; ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও এ বিষয়ে যত্নবান হয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য, স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রের কয়েকটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদের কাজ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই শুরু হয়েছিল।বৈদ্য চিকিৎসকরাও, কয়েকটি কবিরাজী বই, বাংলা গদ্যে লিখেছিলেন। তেতো লাগলেও, এটা মেনে নিতে লজ্জা নেই যে ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অভ্যুদয় না ঘটলে; এ প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসু হতো, তা গবেষনার বিষয়বস্তু।কারণ,ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত নমুনা হলেও; বাংলা গদ্য সাহিত্য এই সাম্রাজ্যবাদের কাছেই ঋণী।ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী, রাজ্যভার পেয়েই, দেশে আইনকানুন প্রণয়ণ করতে লাগল। সবটাই অবশ্য নিজেদের সুবিধের জন্য। চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজের বাইরে, এটাই হলো বাংলা গদ্য ভাষার প্রথম কার্য্যকর ও ব্যাপক ব্যাবহার।
তারপর, বাঙ্গালিকে, ইংরেজী আর ইংরেজকে বাংলা শেখাবার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে, ব্যাকরণ আর অভিধান রচনা করা হতে লাগল। এ পর্যন্ত, হাতে লেখা বইয়ের ব্যাবহার ছিল। প্রচুর নকলনবীশ ছিলেন, যাঁরা এই বই গুলো হাতে নকল করে লিখতেন। কিন্তু, এগুলো ছিল, সময় ও ব্যায়সাপেক্ষ। তাই, ছাপার যন্ত্র আর বাংলা টাইপের প্রয়োজন অনিবার্য্য হয়ে উঠল।
বাংলা টাইপের সর্বপ্রথম ছেনী কাটেন একজন ইংরেজ।ইনি ছিলেন,ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একজন কর্মচারী। নাম- চার্লস উইলকিনস। পরে অবশ্য ইনি স্যার উপাধি পেয়েছিলেন। এই সাহেব, শ্রীরামপুরের শ্রী পঞ্চানন কর্মকারকে বাংলা টাইপের ছেনী কাটান শিখিয়ে দেন। এইভাবে, বাংলা টাইপের আবির্ভাব হলো।বাংলা টাইপের প্রথম ব্যাবহার হয়; হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণে।১৭৭৮ সালে এটি হুগলি থেকে প্রকাশিত হয়। ফলে, বই আর সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্বসাধারণের কাছে উন্মুক্ত হল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, আমরা দেখতে পাই-দু- একটি আইনের বই; বাংলায় লেখা হয়েছিল। বইগুলো দলিল পত্রের মত, আরবী-ফার্সী শব্দে ভরা। তাই, পরবর্তীকালে এগুলোকে ঠিক সাহিত্যের কোঠায় ফেলা হয় নি।ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ঢল নামল।খাস বিলেত থেকে আসা ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের(এদের সিভিলিয়ান বলা হত) শিক্ষার জন্য ১৮০০ খ্রীঃ এ কোলকাতায় কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হল।এই কলেজে প্রাচ্য ভাষার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন-শ্রীরামপুরের মিশনারী পাদ্রী উইলিয়াম কেরী।১৮০১ সালের মে মাসে;উইলিয়াম কেরীর সহকারী পণ্ডিত ও মুনশী কয়েকজনকে নিযুক্ত করা হলে; কলেজের প্রকৃত কাজ শুরু হয়।
সিভিলিয়ানদের বাংলা পড়াতে গিয়ে, দেখা গেল- বাংলা বই গুলো সবই কাব্য। এখন প্রয়োজন হয়ে পড়ল বাংলা গদ্যের।কারণ, ব্যাবহারোপযোগী বাংলা গদ্য না পড়ালে সিভিলিয়ানরা তথাকথিত নেটিভদের সাথে কথা বলবে কি করে?
উইলিয়াম কেরী, তাঁর মুনসী এবং পণ্ডিতদের বললেন ব্যাবহারোপযোগী বাংলা গদ্যের বই লিখতে। নিজেও লেগে গেলেন। লিখে ফেললেন- একটা ব্যাকরণ, একটা অভিধান, একটা কথোপকথনের বই আর একটা গদ্য গ্রন্থ সংকলন। সূচনা হলো, বাংলা গদ্যের। নিজেদের রাজ্য শাসনের জন্য, এগুলো তৈরী করলেও; ভবিষ্যতের বাংলা গদ্য সাহিত্য ঋণী হয়ে থাকল এঁদের কাছে। যে বছর কলেজ কাজ আরম্ভ করল, সেই বছরেই প্রকাশিত হলো; কেরীর “ব্যাকরণ”, রামরাম বসুর “প্রতাপাদিত্যচরিত্র”, আর গোলোক শর্মার “হিতোপদেশ”।রামরাম বসুর “প্রতাপাদিত্যচরিত্র”,[u]বাংলা অক্ষরে ছাপা প্রথম মৌলিক গদ্য গ্রন্থ।[/u] এর আগে, পোর্তুগীজ পাদ্রীরা যে সব গদ্য গ্রন্থ বের করেছিলেন, সে সবই ছিল ইংরাজী বা রোমান হরফে ছাপা।
এ প্রসঙ্গে, জানিয়ে রাখা যেতে পারে; অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে যে তিনখানা আইনের অনুবাদ গ্রন্থ এবং ১৮০০-০১ সালে বাইবেলের যেটুকু অনুবাদ, শ্রীরামপুর মিশন প্রকাশ করেছিল, তা কিন্তু বাংলা অক্ষরে ছাপা হয়েছিল।
রামরাম বসুর আর একটি গদ্য গ্রন্থ- “লিপিমালা”, প্রকাশিত হয়; পরের বছর অর্থাৎ ১৮০২ সালে। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয়,চণ্ডীচরণ মুন্সীর- “তোতা ইতিহাস”। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের- “ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম্” ।
সবাইকে ছাপিয়ে গেছিলেন- মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। কলেজের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ছিলেন এই মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ এই মহাপণ্ডিত, কেরী সাহেবের ডান হাত ছিলেন। দেশী লোকের লেখা প্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাস- “রাজাবলি”, এনারই রচনা। ১৮১৯ সালে ইনি প্রয়াত হন।
তারপর, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে আজ আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে।
তথ্যসূত্র ও প্রভূত ঋণ- শ্রী সুকুমার সেন রচিত “বাংলা সাহিত্যের কথা”। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে প্রকাশিত সংষ্করণ।
Tuesday, March 16, 2010
দেশলাই
“নমামি বিলাতি অগ্নি ---- দেশলাই রূপী
চাঁচাছোলা দেহখানি , শিরে কালো টুপী”
বলুন তো কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা?কবি হেমচন্দ্র ১৮৮৪ সালে দেশলাই কাঠির এই স্তবটা রচনা করেছিলেন।আমাদের এই বাংলাতে দেশলাই কবে এসেছে, তা বলা বেশ মুশকিল। ১৮৬৪ সাল নাগাদ রসরাজ অমৃতলাল বসুর স্মৃতি কথায় পাড়ায় পাড়ায় দেশলাই ফেরী করার উল্লেখ আমরা পাই।
আগুন আবিস্কারের পর জ্বালানটা মানুষের কাছে কঠিন ছিল। তাই অনবরত আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হত, মানুষকে।চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে হত। তারপর, সহজ দাহ্য পদার্থ তে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত। যেমন- কাঠের গুঁড়ো, তুষ, দড়ি। কিন্তু যে প্রয়োজন মানুষ অহরহ অনুভব করত, সেটা হলো তাৎক্ষণিক আগুন বা চাওয়া মাত্র আগুন। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ এই অসুবিধার সন্মুখিন হচ্ছিল।
১৬৬৯ সালে সাদা ফসফরাস আবিস্কারের পর আয়ারল্যাণ্ডের রবার্ট বয়েল ১৬৮০ সালে দেখলেন; সাদা ফসফরাসের সঙ্গে গন্ধক মেশালে আগুন জ্বলে ওঠে। রাসায়নিক বিক্রিয়া তীব্র এবং অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে এই পদ্ধতিকে বাতিল করতে হয়। ১৮০৫ সালে ফ্রান্সের শঁষেল দেখলেন যে কাঠির মাথায় চিনি আর পটাশিয়াম ক্লোরোটের মিশ্রণ লাগিয়ে, ওই কাঠি গাঢ় সালফিউরিক আ্যাসিডের সংস্পর্শে আনলে আগুন জ্বলে ওঠে।
যাই হোক, এরপর বিভিন্ন বিজ্ঞানী নানাভাবে চেষ্টা করেছেন, আগুন জ্বালাতে, কিন্তু আগুন জ্বললেও সে গুলো নিরাপদ ছিল না।
অবশেষে, লাল ফসফরাসের আবিস্কারের পর (১৮৪৫) সুইডেনের জে লুন্ডষ্ট্রম ১৮৫৫ সালে সেফটি ম্যাচ বা নিরাপদ দেশলাইয়ের পেটেন্ট নেন। এটাই আমরা এখন ব্যাবহার করি।
দেশলাই বাক্স জমানোর অনেকের অভ্যাস আছে। এই শখকে বলা হয় “ফিলুমেনি”। আর যাঁরা জমান তাঁদের বলা হয়- “ ফিলুমেনিষ্ট”। ল্যাটিনে “লুমেন” মানে আলো, আর তার থেকেই এই শব্দটির উৎপত্তি।
জাপানের তেইচি ইয়োসিজাওয়া, দেড়শোরও বেশি দেশের ৭ লক্ষেরও বেশি দেশলাই জমিয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে ডঃ উৎপল সান্ন্যাল ৩৫ বছর ধরে ১০০ এরও বেশী দেশের ২৫ হাজার দেশলাই বাক্স জমিয়েছেন। এটা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
হলান্ডে একটি দেশলাই কাঠি তৈরী হয়, যার ওজন ছিল ১০০০ কিলোগ্রাম আর লম্বায় ছিল- ৬২ ফুট। ২৫ শে জুন, ১৯৮৮ সালে এটি একনাগাড়ে ৬ ঘন্টা ৪৫ মিনিট জ্বলেছিল।
দেশলাই বাক্সতে নানারকম বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছাপা হয়েছে। তবে সে অন্য আর এক কাহিনী।
তথ্যসূত্র ও গভীর ঋণ- সাপ্তাহিক বর্তমান, ৬ ই ফেব্রু-২০১০। পৃষ্ঠা -৩৯। লেখক- ডঃ উৎপল সান্ন্যাল। প্রবন্ধের নাম- দেশলাইয়ের দেশে।
চাঁচাছোলা দেহখানি , শিরে কালো টুপী”
বলুন তো কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা?কবি হেমচন্দ্র ১৮৮৪ সালে দেশলাই কাঠির এই স্তবটা রচনা করেছিলেন।আমাদের এই বাংলাতে দেশলাই কবে এসেছে, তা বলা বেশ মুশকিল। ১৮৬৪ সাল নাগাদ রসরাজ অমৃতলাল বসুর স্মৃতি কথায় পাড়ায় পাড়ায় দেশলাই ফেরী করার উল্লেখ আমরা পাই।
আগুন আবিস্কারের পর জ্বালানটা মানুষের কাছে কঠিন ছিল। তাই অনবরত আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হত, মানুষকে।চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে হত। তারপর, সহজ দাহ্য পদার্থ তে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত। যেমন- কাঠের গুঁড়ো, তুষ, দড়ি। কিন্তু যে প্রয়োজন মানুষ অহরহ অনুভব করত, সেটা হলো তাৎক্ষণিক আগুন বা চাওয়া মাত্র আগুন। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ এই অসুবিধার সন্মুখিন হচ্ছিল।
১৬৬৯ সালে সাদা ফসফরাস আবিস্কারের পর আয়ারল্যাণ্ডের রবার্ট বয়েল ১৬৮০ সালে দেখলেন; সাদা ফসফরাসের সঙ্গে গন্ধক মেশালে আগুন জ্বলে ওঠে। রাসায়নিক বিক্রিয়া তীব্র এবং অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে এই পদ্ধতিকে বাতিল করতে হয়। ১৮০৫ সালে ফ্রান্সের শঁষেল দেখলেন যে কাঠির মাথায় চিনি আর পটাশিয়াম ক্লোরোটের মিশ্রণ লাগিয়ে, ওই কাঠি গাঢ় সালফিউরিক আ্যাসিডের সংস্পর্শে আনলে আগুন জ্বলে ওঠে।
যাই হোক, এরপর বিভিন্ন বিজ্ঞানী নানাভাবে চেষ্টা করেছেন, আগুন জ্বালাতে, কিন্তু আগুন জ্বললেও সে গুলো নিরাপদ ছিল না।
অবশেষে, লাল ফসফরাসের আবিস্কারের পর (১৮৪৫) সুইডেনের জে লুন্ডষ্ট্রম ১৮৫৫ সালে সেফটি ম্যাচ বা নিরাপদ দেশলাইয়ের পেটেন্ট নেন। এটাই আমরা এখন ব্যাবহার করি।
দেশলাই বাক্স জমানোর অনেকের অভ্যাস আছে। এই শখকে বলা হয় “ফিলুমেনি”। আর যাঁরা জমান তাঁদের বলা হয়- “ ফিলুমেনিষ্ট”। ল্যাটিনে “লুমেন” মানে আলো, আর তার থেকেই এই শব্দটির উৎপত্তি।
জাপানের তেইচি ইয়োসিজাওয়া, দেড়শোরও বেশি দেশের ৭ লক্ষেরও বেশি দেশলাই জমিয়ে গিনেস বুকে নাম তুলেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে ডঃ উৎপল সান্ন্যাল ৩৫ বছর ধরে ১০০ এরও বেশী দেশের ২৫ হাজার দেশলাই বাক্স জমিয়েছেন। এটা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
হলান্ডে একটি দেশলাই কাঠি তৈরী হয়, যার ওজন ছিল ১০০০ কিলোগ্রাম আর লম্বায় ছিল- ৬২ ফুট। ২৫ শে জুন, ১৯৮৮ সালে এটি একনাগাড়ে ৬ ঘন্টা ৪৫ মিনিট জ্বলেছিল।
দেশলাই বাক্সতে নানারকম বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছাপা হয়েছে। তবে সে অন্য আর এক কাহিনী।
তথ্যসূত্র ও গভীর ঋণ- সাপ্তাহিক বর্তমান, ৬ ই ফেব্রু-২০১০। পৃষ্ঠা -৩৯। লেখক- ডঃ উৎপল সান্ন্যাল। প্রবন্ধের নাম- দেশলাইয়ের দেশে।
Subscribe to:
Posts (Atom)