Monday, July 6, 2009

বঙ্গে ব্রাহ্মণদের আগমন

প্রথমেই বলে রাখা ভাল এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য বাঙ্গালীদের সাথে বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের সম্পর্কের উৎস সন্ধান।“বাংলার ইতিহাস পাওয়া যায় না।ঋকবেদেও বাংলার নাম পাওয়া যায় না।ঋকবেদে ঐতরেয় আরণ্যকে ৩ টি জাতির নাম পাওয়া যায়।..... জাতি অর্থে Caste নয়; Ethnic Race।.... এই ৩ টি জাতির নাম বঙ্গ, বগধ ও চের।চের রা যে আসলে দ্রাবিড় জাতির ১ টা বড় অংশ, সে বিষয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতভেদ নেই।.....” প্রাসঙ্গিকভাবে একটি কথা এখানে বলা দরকার। “খ্রীস্টপূর্ব ৬০০ হতে ৩০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ৯০০ বছর আমরা দ্বিতীয় পর্ব বা যুগ বলে গ্রহণ করতে পারি। এই যুগের সূচনায় ভারতীয় আর্যসমাজে সর্ব্বোচ্চ স্থান লাভের জন্য ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় এই দুই বর্ণের মধ্যে এক সঙ্ঘাত লক্ষ্য করা যায়।ব্রাহ্মণেরা অবশ্যই শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ এবং মহাকাব্যের মধ্যে দিয়ে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেছিলেন। কিন্তু, এই যুগে রচিত বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে, ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি সমাজে সর্বজনস্বীকৃত ছিল না।ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ-প্রাধান্যের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের প্রতিবাদই সূচিত হয়েছে এবং এই দুই বর্ণের লোকেই অন্তত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়েছিলেন।‌ এই কথাগুলো কেন লিখলাম, তা পাঠকরা পরে বুঝবেন। আর্যরা বলেছিলেন- তীর্থযাত্রা বাদে বঙ্গদেশে গেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। শ্রাদ্ধের পংক্তিতে বাঙ্গালীকে একসঙ্গে বসতে দেবে না। আর্যরা বঙ্গদেশকে বড় ভালোবাসতেন!!!!!এহেন বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি আমাকে বিষ্মিত করেছিল । তাই,কোন বিশেষ জাতির বা ব্রাহ্মণ্যধর্মর গুণকীর্তন বা দোষবিচার নয়।স্বামীজী বলেছিলেন:-“Religion is realization, not talk or doctrine, nor theories however beautiful they may be. It is being and becoming, not hearing or acknowledging, but, it is the whole human soul becoming changed into what it believes.”স্বামীজী আরও বলেছিলেন:- “Religion is the highest plane of human thought and life.” এটাকে মাথায় রেখে এবং যেহেতু,আর্যদের আচার আচরণের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের একটা যোগাযোগ দেখা যায়, এবং বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্যান্য ব্রাহ্মণদের আচার আচরণের এবং পদবীর একটা তফাৎ পাই, তাই একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস এই লেখক করেছে। ইতিহাস প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতে চায় না। এক তাম্রশাসনে দেখা যায়, ৪৩৬ খ্রীষ্টীয় সালে মহারাজাধিরাজ কুমারগুপ্তর সময়ে রাজসাহী অঞ্চলে একজন ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করা হয়। এর ১০০ বা ১৫০ বছর পর ফরিদপুরে কিছু ব্রাহ্মণ জমিজমা নিয়ে বাস করতেন। এটাও তাম্রশাসনে দেখা যায়। কিছু পণ্ডিত এই তাম্রশাসন গুলোকে জাল বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু জাল হলেও , এই জাল গুলো ১০০০ বা ১২০০ বছর আগে হয়েছে এটা মেনে নিতে হয়।কিন্তু এই ব্রাহ্মণরা ছিলেন এবং ৭০০ ঘর ছিলেন। এঁরা, তখন এবং এখনও “সপ্তশতী” ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। এঁদের হেলা করা হত, কারণ বলা হত এঁরা বেদ সম্বন্ধে কিছু জানতেন না। কিন্তু রাবণ তো বেদ জানতেন! তার ওপর তিনি দ্রাবিড় এবং ব্রাহ্মণ!! তাহলে এই অবহেলার কারণ কি? তাই আমি; খ্রীস্টপূর্ব ৬০০ হতে ৩০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ৯০০ বছরের কথা আগেই বলেছি। এবার দেখা যাক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্ কি লিখেছিলেন? তিনি বঙ্গদেশে ৬২৯ – ৬৪৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ১৬ বছর ছিলেন।তিনি বলছেন, তখন বঙ্গদেশে ১,০০,০০০ এর বেশী বৌদ্ধ ভিন্ন ভিন্ন সঙ্ঘারামে বা বিহারে বাস করতেন।
এছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বী ভিক্ষুরাও ছিলেন- মানে জৈন প্রভৃতি ভিক্ষুরাও ছিলেন। এবার এই ভিক্ষুরা ভিক্ষা ছাড়া অন্য কোন রোজগার করতেন না বা নিষেধ ছিল। ৩ বাড়ীতে ভিক্ষার পর, ৪র্থ বাড়ীতে ভিক্ষা করার নিয়ম ছিল না। আবার ১ বাড়ীতে ভিক্ষা করার পর, সেই বাড়ীতে ১ মাস পর ভিক্ষা করতে পারতেন; তার আগে নয়। এটাও নিয়ম ছিল (কি সুন্দর অর্থনীতি!)। সুতরাং একজন যতি (এই ভিক্ষুদের তাই বলা হত; কারণ তাঁরা ইন্দ্রিয় সংযম করতেন) প্রতিপালন করতে অন্তত ১০০ ঘর গৃহস্থ বৌদ্ধ থাকা চাই!তাহলে, লক্ষাধিক যতিকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্য ১ কোটি গৃহস্থ বৌদ্ধ থাকা চাই। আর ছিলও তাই! প্রায় গোটা বঙ্গদেশ তখন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের(মাত্র ৭০০ ঘর! যাঁদের কেউ পাত্তা দিত না বলে আস্তে আস্তে তাঁরা সব ভুলে যাচ্ছিলেন?)তারা গ্রাহ্য করতেন না। আর পুঁথিপত্র ঘাঁটলে দেখা যায় যে এই আন্দোলনটা সারা ভারতেই হচ্ছিল।(এই প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা বুদ্ধদেব এবং তীর্থংকর জৈন করে গেছিলেন।)তাই কুমারিল ভট্ট; মীমাংসা সূত্রের শবর ভাষ্যর ১ টীকা লিখে আবার বৈদিক ধর্মের প্রচারের চেষ্টা করছিলেন। কুমারিল ভট্ট তখন কনৌজের ব্রাহ্মণদের নেতা। কনৌজ তখন ১ জন প্রবল পরাক্রান্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী মহারাজার রাজধানী।
সুযোগও এসে গেল। বাংলার রাজা আদিশূর পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন বলে ঠিক করলেন। আবার ইতিহাসের গুঁতো!বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকরা বললেন বাংলার রাজা আদিশূর বলে কেউ ছিলেন না! কারণ কোন তাম্রশাসনে আদিশূরের নাম পাওয়া যায় না। কেউ বললেন; তাম্রশাসনেই কি সব পাওয়া যায়? জনশ্রুতির কোন মূল্য নেই! আর ইতিহাস কি সব সময় সব নিয়ম মেনে চলে!! অনেক বাকবিতণ্ডার পর ঐতিহাসিকরা প্রায় এক মত হলেন, যে “জয়ন্ত” বাংলার রাজা আদিশূরের অপর নাম ।(এসম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা বারান্তরে করা যাবে, না হলে প্রবন্ধটির কলেবর বৃদ্ধি পাবে, আর পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতি হতে পারে!)
তা এই যে বাংলা বলছি, এটার ঠিক অবস্থানটা কোথায় ছিল? তখনকার বাংলায় ২টো বড় বড় নগর ছিল। একটা পৌন্ড্রবর্ধন; আরেকটি তাম্রলিপ্তি। তাম্রলিপ্তির আরও প্রাচীন নাম দামলিপ্তি।অর্থাৎ, তামিলদের শহর। তাই আমি রাবণের কথা প্রসঙ্গিকভাবে আগে উল্লেখ করেছিলাম। যাই হোক, এই পৌন্ড্রবর্ধন বর্তমানে মালদহের পাণ্ডুয়া। তাম্রলিপ্তি এখন তমলুক- পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর।এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। আবার আগে ফিরে যাই।
তা কনৌজের ২ টি ভাগ ছিল। মূল কনৌজ এবং কোলাঞ্চ। কনৌজের রাজা ছিলেন রাজা আদিশূর বা জয়ন্তর শ্বশুর “চন্দ্রদেব”। আর পূর্বাদ্ধ কোলাঞ্চের রাজা ছিলেন “চন্দ্রদেবের” ভাই “বীরসিংহ”। এই বীরসিংহের রাজ্য কোলাঞ্চ থেকে ৫ জন ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক এসেছিলেন বঙ্গদেশে। এঁরা এসেছিলেন কুমারিল ভট্ট ও তাঁর শিষ্য ভবভূতির নির্দ্দেশে। কারন, বাংলার রাজা আদিশূর যখন ওই ৭০০ জন ব্রাহ্মণকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করতে বলেন, ব্রাহ্মণরা তখন বলেন তাঁরা অনভ্যাসের ফলে বেদবিহিত যজ্ঞ করতে পারবেন না। (এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, প্রক্ষিপ্ত। কারন, কুমারিল ভট্ট ও তাঁর শিষ্য ভবভূতির প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বাংলাতে আবার বৈদিক ধর্মের প্রচারের চেষ্টা। ) এবার এই ৫ জন ব্রাহ্মণদের নাম এবং গোত্র কি? ২ টো মত আছে। বারেন্দ্র মত এবং রাঢ়ীয় মত। (বারেন্দ্র এবং রাঢ়ী কি, এব্যাপারে পরে বলছি।)
বারেন্দ্র মত:-
. ক্ষিতিশ, গোত্র:- শাণ্ডিল্য।
. তিথিমেধা/ মেধাতিথি, গোত্র:-ভরদ্বাজ।
. বীতরাগ, গোত্র:- কাশ্যপ।
. সুধানিধি, গোত্র:-বাৎসব।
. সৌভরি, গোত্র:- সাবর্ণ।
রাঢ়ীয় মত:-
. ভট্টনারায়ণ, গোত্র:- শাণ্ডিল্য।
. শ্রীহর্ষ, গোত্র:-ভরদ্বাজ।
. দক্ষ, গোত্র:- কাশ্যপ।
. ছান্দোড়:- গোত্র:-বাৎসব।
. বেদগর্ভ, গোত্র:- সাবর্ণ।
(গোত্র এবং প্রবর সম্বন্ধে একটু বলে নেই।যে ঋষির যে বংশধর, সেটা গোত্র। যেমন শাণ্ডিল্য গোত্র মানে শাণ্ডিল্য ঋষির বংশধর। আর প্রবর মানে সেই গোত্রের যাঁরা খ্যাতিলাভ বা অন্য ভাষায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাঁরা প্রবর। গোত্র এবং প্রবর মালা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা দেখলেই পাওয়া যাবে।সাধারনতঃ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার খ১১৯ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়।বর্ষবিশেষে ২-১ পাতা এদিক ওদিক হতে পারে। বর্তমানে ৫১ টি গোত্র এবং তার সংশ্লিষ্ট প্রবর গুলি দেওয়া আছে।)
অনেকে এদের পিতাপুত্র বলে জানান। কিন্তু এই দ্বন্দের মীমাংসা করেছেন “বাংলার সামাজিক ইতিহাস” প্রণেতা শ্রী দুর্গাচরণ সান্ন্যাল।তিনি লিখেছেন:-
“প্রত্যেক ব্রাহ্মণের ২টি করিয়া নাম থাকে। একটি প্রকাশ্য নাম, অপরটি পূজার সংকল্পের নাম।রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণগণ প্রকাশ্য নাম এবং বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ পূজার সংকল্পের নাম গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া এইরূপ নামভেদ হইয়াছে।‍”
আসলে এইখান থেকেই কিন্তু ডাকনাম এবং ভালোনামের উৎপত্তি।( আমার সংযোজন)
এবার তাঁরা কবে এসেছিলেন?বিদ্যাসাগরের মতে ১০৭৭ খ্রীস্টাব্দ বা ৯৯৯ শক।পরবর্তী কালে “গৌড়ের ইতিহাস” প্রণেতা শ্রীরজনীকান্ত চক্রবর্তী ৭৩২ খ্রীস্টাব্দ বা ৬৫৪ শক বলেছেন। ঘটক অনুশাসন বিচার করলে ৭৩২ খ্রীস্টাব্দ বা ৬৫৪ শক বেশী গ্রহণযোগ্য।পরবর্তী বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকরা এটা মেনে নিয়েছেন।
পুত্রেষ্টি যজ্ঞ হয়েছিল, বর্তমান মালদহের পাণ্ডুয়ায়। মালদহ টাউন বা ইংলিশবাজার থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরত্বে এই ধূমদিঘী বা হোমদিঘী গ্রামটি আজও বর্তমান। যজ্ঞ থেকে প্রচুর ধূঁয়ো বা ধূম হয়েছিল বলে এই নাম। আবার যজ্ঞর অপর নাম হোম।প্রচুর সমিধ( যজ্ঞের বেলকাঠ) পোড়ানর জন্য দিঘীর আকারে মাটী খোঁড়া হয়েছিল। তাই ধূমদিঘী বা হোমদিঘী, নাম।
এবার এই ৫ জন ব্রাহ্মণকে নিয়ে একটি কাহিনী বলি। কাহিনীটি, নবভারত পাবলিশার্স কর্ত্তৃক প্রকাশিত; “তারা রহস্য” বইয়ের ভূমিকাতে দেওয়া আছে।
সেই কালে ব্রাহ্মণদের কি কি করা নিষেধ ছিল; ১ বার দেখে নেওয়া যাক:-

• শীলিত(সেলাই করা) বস্ত্র পরিধান।
• চর্ম পাদুকা (চামড়ার জুতো) পরিধান।
• তাম্বুল চর্বণ ( পান চিবোন বা খাওয়া)।
• অশ্ব বা অশ্বেতর পশুর উপর আরোহণ।
এবার, আদিশূর চরমুখে খবর পেলেন যে, ৫ জন ব্রাহ্মণ যাঁরা আসছেন, তাঁরা ফতুয়ার মত জামা পরে, ঘোড়ার ওপর চড়ে, পান চিবোতে চিবোতে আসছেন। আদিশূরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, এ কাদের আমি আনলাম? এরা তো ব্রাহ্মণ্যধর্মের কিছুই মানে না! তাই মন্ত্রীদের নির্দ্দেশ দিলেন যে, ৫ জন ব্রাহ্মণ এলে, তাঁদের অতিথি শালায় যেন রাখা হয়। রাজা সময়মত তাঁদের সাথে দেখা করবেন।
তা ৫ জন ব্রাহ্মণ রাজবাড়ীর দুয়ারে এসে এই খবরটা পেলেন। রাজাকে আশীর্বাদ করার জন্য তাঁদের হাতের মুঠিতে জল ছিল। রাজা সেই সময় দেখা করবেন না দেখে তাঁরা আশীর্বাদ করার জন্য জল ফেলে দিলেন। জল গিয়ে পড়ল এক শুকনো গাছের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সেই শুকনো গাছ জীবিত হয়ে উঠল। এই চমৎকার ঘটনার কথা শুনে আদিশূর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সাথে দেখা করলেন।
এবার “তারা দেবী” মূলত বৌদ্ধ দেবী। সেই দেবীর সাধনা গ্রন্থে এই কাহিনীর অবতারণা কেন? এটা কি ব্রাহ্মণ্যধর্মের অলৌকিক ক্ষমতার প্রচার? সত্যাসত্য জানা যাবে না, তাই বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম।
এবার ৫ জন ব্রাহ্মণ এসে যজ্ঞ করলেন, আদিশূরের সন্তানও হলো, কিন্তু তাঁরা আর কনৌজের কোলাঞ্চতে আর ফিরতে পারবেন না। কারণ, সেই বাংলা যেখানে অবৈদিক কাজকর্ম হয়। তাঁরা ফিরে গেলে পতিত হয়ে যাবেন! কিন্তু সত্যিই কি তাই? না। ওপর ওপর এই কথাটা বলা হলো বটে, আসলে তাঁরা রয়ে গেলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রচার করতে!
পঞ্চব্রাহ্মণের বসবাস করার জন্য রাজা আদিশূর তাঁদের জমিদারী দিলেন তদানীন্তন বাংলার বিভিন্ন জায়গায়। অবশ্যই জীবন যাপন এবং বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রচার করার জন্য।
তখনকার গৌড় রাজ্য ৫ ভাগে বিভক্ত ছিল।
• গৌড়
• দেবকোট
• মহাস্থান
• সন্তোষ
• রংপুর

রাজা আদিশূর পঞ্চব্রাহ্মণের বসবাস করার জন্য যে জায়গাগুলো দিলেন; নাম এবং ধাম অনুসারে নীচে লিপিবদ্ধ করলাম:-
. ক্ষিতিশ /ভট্টনারায়ণ,পিতা-অজ্ঞাত, গোত্র:- শাণ্ডিল্য।
জমিদারী- পঞ্চকোট, মানভূম (এখনকার পুরুলিয়া)।
ক্ষিতিশ /ভট্টনারায়ণ; নিজে তীর্থাবাস এবং চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন: কালীঘাটে।
. বীতরাগ/দক্ষ, পিতা- রত্নাকর, গোত্র:- কাশ্যপ।
জমিদারী- কামকোটি, বীরভূম। নিজে তীর্থাবাস এবং চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন: ভতিপুর, মালদহ।
. সুধানিধি/ছান্দোড়, পিতা-উষাপতি, গোত্র:-বাৎসব।
জমিদারী- হরিকোটি, মেদিনীপুর। নিজে তীর্থাবাস এবং চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন: ত্রিবেণী।
. তিথিমেধা/ মেধাতিথি//শ্রীহর্ষ,পিতা- দিণ্ডি গোত্র:-ভরদ্বাজ।
জমিদারী- কঙ্কগ্রাম, বাঁকুড়া। নিজে তীর্থাবাস এবং চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন:অগ্রদ্বীপ, বাঁকুড়া।

. সৌভরি/বেদগর্ভ,পিতা- শ্রীমান প্রিয়ঙ্কর, গোত্র:- সাবর্ণ।
জমিদারী- বটগ্রাম, বর্ধমান। নিজে তীর্থাবাস এবং চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন: গুপ্তিপাড়া, হুগলী।
স্বাভাবিক ভাবেই এঁদের সন্তান সন্ততির কথা আসে। এঁদের সংখ্যা এরকম:-
ক্ষিতিশ /ভট্টনারায়ণ-১৬
বীতরাগ/দক্ষ-১৬
সুধানিধি/ছান্দোড়-৮
তিথিমেধা/ মেধাতিথি//শ্রীহর্ষ-৪
সৌভরি/বেদগর্ভ-১২
এই প্রত্যেক সন্তানকে রাজা বসবাসের জন্য গ্রাম দান করেছিলেন। এই সন্তানরা পরষ্পর অমুকগ্রামীন বা অমুকগাঁই হিসেবে পরিচিত হন। পরে এটাই “পদবী” বলে পরিচিত হয়।এর পরে কর্ম ও জীবিকা অনুসারে “উপাধি”র প্রচলন হয়।
“উপাধি”র কিছু নমুনা:-
হিন্দু উপাধি- ভট্টাচার্য্য, চক্রবর্তী, রাজগুরু প্রভৃতি।
মোঘল আমলে- মজুমদার, সরকার, কারকুন প্রভৃতি।
ইংরেজ আমলে- রায়, চৌধুরি প্রভৃতি।

মূল পদবী গুলো হল:-

ক্ষিতিশ /ভট্টনারায়ণ-১৬(অমুকগ্রামীন বা অমুকগাঁই হিসেবে),গোত্র:- শাণ্ডিল্য।
বন্দ্য/বাড়ুরী(বন্দোপাধ্যায়),কুসুম,দীর্ঘাঙ্গী,ঘোষলী, বটব্যাল, পারিহা, কুলকুলি, কুশারী,কুলভি,সেয়ক, গড়গড়ি, আকাশ, কেশরী, মাষচটক, বসুয়ারী,করাল।

বীতরাগ/দক্ষ-১৬ (অমুকগ্রামীন বা অমুকগাঁই হিসেবে),গোত্র:-কাশ্যপ।
চট্ট(চট্টোপাধ্যায়), অম্বুলি, তৈলবাটী, পলসায়ী, পীতমুণ্ডি, পোড়ারী,হড়, গূঢ়, ভুরিষ্ঠাল, পালধি, পাকড়াসী, পূষলী, মূলগ্রামী, কোয়ারী, সিমলাই/সিমলায়ী, ভট্ট।

সুধানিধি/ছান্দোড়-৮ (অমুকগ্রামীন বা অমুকগাঁই হিসেবে),গোত্র:-বাৎসব।
কাঞ্জিলাল, মহিন্তা, পতিতুণ্ড/পইতুণ্ডি, পিপলাই, ঘোষাল, বাপুলি, কাজ্ঞারী,শিমলাল/শিমলাই।


তিথিমেধা/ মেধাতিথি//শ্রীহর্ষ-৪(অমুকগ্রামীন বা অমুকগাঁই হিসেবে),গোত্র:-ভরদ্বাজ।
মুখুটি(মুখোপাধ্যায়), ডিংসাই, সাহরী, রাই।

সৌভরি/বেদগর্ভ-১২(অমুকগ্রামীন বা অমুকগাঁই হিসেবে),গোত্র:- সাবর্ণ।
গংগুরী(গঙ্গোপাধ্যায়), পুংসিক, নন্দিগ্রামী, ঘন্টেশ্বরী, দায়ী, নায়েরী, পারিহাল, বালিয়া, সিদ্ধল,কুন্দগ্রামী,সিয়ারী,সাটেশ্বরী।

এরপর যা হয়! ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই! অমোঘ নিয়মে জমি নিয়ে ঝগড়া হলো সবার মধ্যে।

পাঁচজন চলে গেলেন উত্তরবঙ্গের দিকে!মূলত, রাজসাহী, বগুড়া, রংপুর, পাবনার দিকে। এই স্থান গুলো বরেন্দ্রভূম নামে পরিচিত। সুতরাং এরা বারেন্দ্র নামে পরিচিতি লাভ করলেন। বাকী যাঁরা পদ্মার এই পারে থেকে গেলেন;যা রাঢ়ভূম নামে পরিচিত, তাঁরা হলেন রাঢ়ী। এই পাঁচজন বা পাঁচগ্রামীন কারা, তা নিয়ে ইতিহাস নীরব! তবে, এঁদের গ্রাম/পদবী হল:-
সান্ন্যাল(বাৎসব গোত্র), মৈত্র(কাশ্যপ গোত্র), লাহিড়ী(শাণ্ডিল্য গোত্র), বাগচী(শাণ্ডিল্য গোত্র), ভাদুড়ী(কাশ্যপ গোত্র।
রাজা বল্লাল সেন তাঁর সময়ে এক আদমশুমারী(Census) করেছিলেন। ৩৫০ ঘর – রাঢ়ী, ৪৫০ ঘর- বারেন্দ্র ছিলেন। এর ওপর, কিছু সপ্তশতী, কিছু পাশ্চাত্য, কিছু দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মণ ছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০০ হাজারের বেশী ব্রাহ্মণ ছিল না।
এবার রাজা বল্লাল সেনের আমলে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের মধ্যে এক ঝগড়া শুরু হয়, তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ?
বল্লাল সেন এবার ডেকে পাঠালেন তাঁদের। একদল তাড়াতাড়ী আহ্নিক প্রভৃতি সেরে রাজার দরবারে হাজির হলেন। আর এক দল অর্ধেক আহ্নিক প্রভৃতি সেরে রাজার দরবারে হাজির হলেন।সবশেষে, পুরো আহ্নিক প্রভৃতি সেরে রাজার দরবারে হাজির হলেন আর এক দল।
যাঁরা শেষে এলেন তাঁরা হলেন- কুলিন।কারণ তাঁরা পুরো পূজাপাঠ সেরে এসেছিলেন। যাঁরা মধ্যে এলেন তাঁরা হলেন ভঙ্গ কুলিন। আর যাঁরা আগে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন শুধুই ব্রাহ্মণ।
বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের সাথে রাঢ়ীদের একটা ঝগড়া লেগেই থাকত, সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার জন্য। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা, রাঢ়ীদের বলতেন যে এরা মুখে মিষ্টি, কাজের বেলায় অস্টরম্ভা। আর রাঢ়ীরা বলতেন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা মাথায় এত প্যাঁচ রাখেন যে, মাথায় পেরেক ঢোকালে নাকি সেটা স্ক্রু হয়ে বেরিয়ে আসবে। শেষে তাদের মধ্যে বৈবাহিক সর্ম্পক একেবারে হত না। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পেশা যজন, যাজন ও অধ্যাপনা হলেও তাঁরা জলদস্যুতাও করতেন। তাই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা বেশীর ভাগই কালী ভক্ত ছিলেন।
পরিশেষে বলে রাখি, এই অপণ্ডিত লেখক ১ জন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ! পদবী- সান্ন্যাল, উপাধি- ভট্টাচার্য্য। ভট্ট= শ্রেষ্ঠ। আচার্য্য= শিক্ষক।
অতএব সাধু সাবধান!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
অলমিতিবিস্তরেণ.......................



এই প্রবন্ধটি লেখার অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ চিত্তে ধন্যবাদ জানাই শ্রী শঙ্খশুভ্র চক্রবর্তী ও তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণীকে।

গ্রন্থ ঋণ:- শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শ্রী অমিতাভ মুখোপাধ্যায়,উদ্ধোধন;শতাব্দী জয়ন্তী নির্বাচিত সঙ্কলন, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, গৌড়ের ইতিহাস- শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তী, তারা রহস্য, বাংলার সামাজিক ইতিহাস- শ্রীদুর্গাচরণ সান্ন্যাল, উইকিপেডিয়া, বাবা এবং কাকার মুখে শোনা ইতিহাস, শারদীয় বর্তমানে(১৪১৩) প্রকাশিত সাহিত্যিক শ্রীসঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ, ক্ষিতীশ চরিতাবলী।

পাণিনি ও অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ (একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা)

সংস্কৃত ভাষাটা খুবই খটোমটো, অন্তত আমার কাছে। তার ওপর ব্যাকরণ!!!! উরেঃ ব্যাস্‌! মা সরস্বতীর সঙ্গে আমার ছোটবেলা থেকে যে কেস চলছে, সেটা চলছে তো চলছেই। তবে ৬০ বছর পর, সম্প্রতি আমার উকিলবাবু আমায় একটা খবর দিয়েছেন। তাতে আমি সান্তনা পেয়েছি। মা সরস্বতী কেসটা হেরে গিয়েছেন। তাই টুকলী কোরে পাণিনি সম্বন্ধে লিখছি। কাদের কাছ থেকে টুকলী কোরেছি, সেটা শেষে লিখব। সংস্কৃত শিখে নাকি পাণিনি পড়তে হয়। তা, সংস্কৃত আমি শিখিনি। তাই সাহস করে এবারে আসল বিষয়ে আসি। আমরা কোলকাতার বিড়লা তারামণ্ডলে গেলে, পাণিনির একটি আবক্ষ মূর্ত্তি দেখতে পাব। তা এই পাণিনি ভদ্রলোকটি কে? কি বা তাঁর পরিচয়? আমাদের এই পোড়া দেশটার একটা দুর্ভাগ্য আছে। গ্রীকদের হেরোডেটাস ছিল, কিন্তু কলহন ছাড়া কেউ আর আমাদের প্রাচীন ইতিহাস লেখেন নি বা লিখলেও তা আর নানা কারণে পাওয়া যায় না। তাই কলহনের আগে জানতে হলে, আমাদের বিভিন্ন বিদেশী পর্য্যটকদের লেখা বিবরণ, জনশ্রুতি, উপকথার ওপর নির্ভর করতে হয়।
এই সবের ওপর ভিত্তি করে, বলা যায় যে, পাণিনি খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৯ম থেকে খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৪র্থ শতাব্দীর মধ্যে কোন এক সময় জীবিত ছিলেন। তবে গবেষকরা একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে, পাণিনির জীবনকাল খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষে বা খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে ছিল। পাণিনির জন্মস্থান নিয়েও একই রকম বিভ্রান্তি থাকলেও গবেষকরা মোটামুটি ভাবে একমত যে তিনি, গান্ধার প্রদেশের (বর্তমান- পাকিস্তান) শালাতুর (বর্তমান- লাহোর) গ্রামে জন্মেছিলেন।
পাণিনির জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে মগধের রাজধানী পাটলীপুত্রে। তাই কিছু পণ্ডিতের মতে পাণিনির পূর্বপুরুষেরা শালাতুর গ্রামের হলেও পাণিনির জন্ম হয়েছিল, পাটলীপুত্রে।
পাণিনি ছিলেন একজন শিষ্ট। শিষ্টেরা ছিলেন এক ধরণের ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রের ওপর ছিল তাঁদের অসামান্য অধিকার।
পার্থিব সুখ, স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে তাঁরা একটি বিশেষ অঞ্চলে বসবাস করতেন(গবেষণা? ) । বাস স্থানের উত্তরে ছিল হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতমালা, পূর্বে বঙ্গভূমি এবং পশ্চিমে আরাবল্লী পাহাড়ের রেখা।
পাণিনি ছিলেন, পণি নামে এক ঋষির সন্তান। এবার পণি বা পাণিন্‌ একটি গোত্র নাম। সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়।
পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক এবং ফিনিসীয় গোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসবাস করতেন।
পাণিনির বাবা ছিলেন ফিনিকিয় পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর নাম ছিল, শলঙ্ক। তাই পাণিনির আর এক নাম ছিল শালাঙ্কি। পাণিনির মা ছিলেন ডেসিয়ান। দক্ষ জাতির মহিলা। তাই তাঁর নাম দাক্ষি। তিনি রূপে গুণে অতুলনীয়া ছিলেন। পাণিনির আর এক নাম তাই দাক্ষিপুত্র। পাণিনির ভক্ত পতঞ্জলি পাণিনি কে এই নামে বিখ্যাত করেছেন।
পাণিনি ছিলেন অহিগলমালা শিবের উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।
অতএব, পাণিনির পুরো নাম হলো:-
আহিক দাক্ষিপুত্র শালাঙ্কি শালাতুরীয় পাণিন্‌ পাণিনি।
এই নামের মধ্যে পাণিনির ইষ্ট,মাতা,পিতা, জন্মস্থান, গোত্র সবকিছুর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, তাঁর ব্যাকরণ সম্বন্ধে।পাণিনির আগে কি ব্যাকরণ ছিল না? ছিল। বেদের যে ষড়ঙ্গ অর্থাৎ ৬ টি অঙ্গ (শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত ও জ্যোতিষ) তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাকরণ।
বেদ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে, ভাষাতত্ত্ব, (Linguistics), উচ্চারণ বিধি বা (Phonetics ) এবং ব্যাকরণ শাস্ত্র(Grammar) এই তিনটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাণিনির আগে মোট ৮ টি ব্যাকরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলি হলো:- ঐন্দ্রং, চান্দ্রং, কাশকৃৎস্নং, কৌমারং,সারস্বতং , আপিশলং, শাকলং এবং শাকটায়নং। এর মধ্যে শাকটায়নং ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।
পাণিনি এইসব ব্যাকরণ ভালভাবেই পড়েছিলেন এবং এইসব ব্যাকরণ থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন। তিনি এইসব ব্যাকরণের ভুল ধারণা গুলিকে বাদ দিয়েছেন এবং শেষ পর্য্যন্ত সবাইকে অতিক্রম করে গেছেন।
পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে বৈদিক ভাষা (ছান্দস) এবং আঞ্চলিক ভাষা ( লৌকিক) এই ২টি ভাষাকে গ্রহণ করেছেন। এই ব্যাপারটি পৃথিবীর কোন ব্যাকরণে আগেও ঘটেনি এবং পরেও না।
এখানে বলে রাখা ভাল, রামায়ণে যখন সুগ্রীব ছদ্মবেশে হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন রামচন্দ্রের পরিচয় জানতে, তখন হনুমানের কথা শুনে, রামচন্দ্র লক্ষণকে বলছেন যে হনুমান পরিশীলিত ও ব্যাকরণ সম্মত কথা বলছেন। রামচন্দ্র এও বলছেন যে হনুমান ব্যাকরণ বেশ ভালভাবে আয়ত্ত করেছেন।
সুতরাং প্রাচীন যুগে যে ব্যাকরণের চর্চা ছিল, এব্যাপারে কোন বিতর্ক উঠতে পারে না।
এখন স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, পাণিনি কি এমন করেছিলেন? এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।
পাশ্চাত্যের প্রাচীন ভাষা হল, প্রধানত গ্রীক ও ল্যাটিন। ভারতবর্ষের প্রাচীন ভাষা হল সংস্কৃত। আমাদের দেশে, প্রধান ভাষা হল ১৫ টি। এই ১৫ টি প্রধান ভাষার উৎপত্তি কিন্তু সংস্কৃত।
সংস্কৃত সাহিত্যের যে ভাণ্ডার, তা অকল্পনীয়। এই সংস্কৃত সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ হলো ঋগ্বেদ।
বেদোত্তোর যুগে পাণিনি তাঁর সমসাময়িক বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন।
বলা হয় পাণিনি হিমালয়ে গিয়ে ১৮ দিন ধরে শিবের তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। নৃত্যের ভঙ্গীতে শিব ১৪ বার ঢক্কা বা ঢাক বাজান।প্রতিবার ঢাক বাজানোর সাথে এক একটি নতুন শব্দের সৃস্টি হলো। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, নটরাজ মূর্ত্তি শিবের আর একটি প্রতিরূপ। নটরাজ মূর্ত্তি পৃথিবীর ছন্দ এবং তালের রূপক।ঢাকের শব্দ ছন্দ এবং তালের সমার্থক।
এখানে মনে হতে পারে, তালবাদ্য থেকে কি বর্ণের সৃষ্টি হওয়া কি সম্ভব? বলে রাখা ভাল প্রতিটি তালবাদ্যের বোল অথবা বাণী বিভিন্ন বর্ণের সাহায্যেই তৈরী হয়েছে।
তবলার বোল ‍‌ : ‘ধিন ধাগে তেরে কেটে’, পাখোয়াজের বোল: ‘তেটে কতা গদি ঘেনে’, ঢোলের বোল: ‘টাক ডুমা ডুম্ ডুম্’ , খোলের বোল: ‘ঝাগুড় ঝাগুড় ঝিনি ঝিনি ঝিনি’, ইত্যাদি সব কিছুই বিভিন্ন বর্ণের সমাহার। তালবাদ্যের বোল অথবা বাণীর মাধ্যমে সমস্ত বর্ণকে প্রকাশ করা যায়।
এবার, নৃত্যের ভঙ্গীতে শিব ১৪ বার ঢক্কা বা ঢাক বাজানর পর এক একটি নতুন শব্দের সৃষ্টি হলো। প্রতিটি শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি। শব্দগুলো হল:-
১) অ ই উ ণ্ ২) ঋ ৯ ক্ ৩) এ ও ঙ্ ৪) ঐ ঔ চ্ ৫) হ য ৱ র ট্ ৬) ল ণ্ ৭) ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্ ৮) ঝ ভ ঞ ৯) ঘ ঢ ধ ষ্ ১০) জ ব গ ড দ শ্ ১১) খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্ ১২) ক প য্ ১৩) শ ষ স র্ ১৪) হ ল্ ।

বলা হয়, শিবের উপদেশে, পাণিনি এই শব্দগুলিকে ১৪ টি সূত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন।
এই ১৪ টি সূত্র শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র । এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। এই শিবসূত্রজালের জন্য পাণিনি বিখ্যাত, এবং তাই তিনি অন্যান্য বৈয়াকরণদের থেকে একেবারে আলাদা।
শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা।সেজন্য, এটির আর ১ টি নাম সংজ্ঞাসূত্র। মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এগুলোকে আরো সংক্ষিপ্ত করলেন। নাম দিলেন:- প্রত্যাহার সূত্র। প্রত্যাহার মানে সংক্ষেপিত।
এক বা একাধিক সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণটি জোড়া দিয়ে যে শব্দটি তৈরী হয় তাকে প্রত্যাহার বলে। যেমন ‘অণ্’ একটি প্রত্যাহার,যার অর্থ অইউ । অক্ একটি প্রত্যাহার যার অর্থ অইউঋ৯।
আবার ‌‘অচ্’ প্রত্যাহারটির মানে অইউঋ৯এওঐঔ। প্রকৃতপক্ষে অণ্, অচ্, অল্, ইক্, উক্, জশ্, হল্ প্রভৃতি প্রত্যাহারগুলি এক ধরণের ‘কোড’বা ‘ক্রিপ্টোগ্রাফি’(সাংকেতিক ভাষা) যার সাহায্যে পাণিনির ব্যাকরণের অনেক সূত্র তৈরী করা হয়েছে। পাণিনির ব্যাকরণে এরকম ৪৪ টি প্রত্যাহার আছে। প্রথম প্রত্যাহারটি ‘অণ্’ হওয়ায় শিবসূত্রকে অণাদি(অণ্-আদি) সূত্রও বলা হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ‌‘অচ্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত স্বরবর্ণ এবং ‘হল্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ‘অল্’ প্রত্যাহার টির মধ্যে সমস্ত বর্ণগুলি রয়েছে। সুতরাং ‘অল্’ মানে ALL বোঝা যেতে পারে। তাহলে শিবসূত্রজালের বিভিন্ন নামগুলি হোলো:-
শিবসূত্র
মহেশ্বরসূত্র
সংজ্ঞাসূত্র
প্রত্যাহারসূত্র
অণাদিসূত্র
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার আছে। চর্তুদশ সূত্রের প্রত্যেকটির শেষে হসন্তযুক্ত যে বর্ণগুলি আছে সেগুলি ‘ইৎ’ হয়। পাণিনির ব্যাকরণের ভাষায় ‘ইৎ’ মানে লোপ পাওয়া, কিন্তু বিনষ্ট হওয়া নয়। উদাহরণ:- ‘অণ্’ মানে অইউ। এখানে ‘ণ্’ বর্ণটি ‘ইৎ’হয়েছে। সমস্ত প্রত্যাহারের শেষের বর্ণটি ‘ইৎ’ হবে, যা পৃথিবীর অন্য কোন ব্যাকরণেই নেই।

শিবসূত্র জালের বর্ণমালাকে ভিত্তি করে সমকালীন বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার ওপর পাণিনি তাঁর সুবিখ্যাত অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেন। পাণিনির ব্যাকরণে মোট ৩৯৭৮ টি সূত্র আছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লেখা এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাকরণ সারা বিশ্বের কোনও পণ্ডিত রচনা করতে পারেন নি। পরবর্তী কালে পাণিনির ধারণা নিয়ে অন্যান্য দেশের ব্যাকরণ গুলি লেখা হয়েছে।
অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ শুধু ব্যাকরণ নয়, এটি হলো ভাষার বিজ্ঞান। পাণিনির সংস্কৃত বেদের ভাষা থেকে সরল হলেও তা একটি জটিল ভাষা। তাই প্রবন্ধের আরম্ভেই বলেছিলাম; সংস্কৃত শিখে পাণিনি পড়তে হয়। না হলে পাণিনির সন্ধির সূত্রগুলি বুঝতে অসুবিধা হয়। প্রচুর পড়াশোনা এবং কোন ভাষ্যকারের সহায়তা ছাড়া পাণিনির সূত্রগুলি বোঝা যায় না। পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে শব্দের উৎপত্তি, ধ্বনিতত্ত্ব, বর্ণমালা, উচ্চারণবিধি, সন্ধির নিয়ম নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর সমকালীন প্রতিটি শব্দের ব্যূৎপত্তি নির্ণয় করেছেন এবং ৩৯৭৮ টি সূত্র সাহায্যে অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণটি রচনা করেছেন। ব্যাকরণের প্রধান বিষয়বস্তু হলো ভাষা। তাই ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণ নিয়ে পণ্ডিতেরা পুরুষানুক্রমিক ভাবে পাণিনির ব্যাকরণে ওপর চিন্তাভাবনা করে চলেছেন। পাণিনির সূত্রগুলি বহুদিন ধরে ব্যাকরণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে।বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্ বলেছেন পৃথিবীর সমস্ত ভাষার উৎস হলো পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ। পাণিনির সময় থেকে ভাষা একটা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে।
তাঁর সময় থেকেই এই ভাষার নাম হয়েছে সংস্কৃত (মার্জিত) যা প্রাকৃত (অমার্জিত) থেকে আলাদা।প্রাকৃত ভাষা প্রাকৃতিকভাবেই অর্থাৎ নিজের থেকেই গড়ে উঠেছিল।
এবার পতঞ্জলির কথায় আসা যাক। পতঞ্জলির কথা না বললে পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।পতঞ্জলি ছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর লোক এবং ভোজপুর নিবাসী ব্রাহ্মণ। পতঞ্জলি ছিলেন পাণিনির একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি পাণিনিকে আচার্য্য, ভগবান, মহর্ষি এইসব নামে সম্বোধন করেছেন। পাণিনির ব্যাকরণের ৩৯৭৮ টি সূত্রর মধ্যে পতঞ্জলি মাত্র ১৭২০ টি সূত্র বেছে নিয়েছিলেন, যে গুলো সমালোচিত হয়েছিল। কে প্রধানতঃ সমালোচনা করেছিলেন? ইনি হলেন বার্ত্তিককার কাত্যায়ন। পাণিনির উত্তরসূরিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলেন এই কাত্যায়ন। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম হলো বার্ত্তিক। তাই তিনি বার্ত্তিককার কাত্যায়ন নামে পরিচিত। তাঁর জীবনকাল সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। কিন্তু তিনি যে পাণিনির চেয়ে ন্যূনতম ১ শতাব্দী পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। তার কারণ বার্ত্তিককার কাত্যায়ন তাঁর গ্রন্থে বেশ কিছু ভাষা ব্যবহার করেছেন যেগুলি পাণিনির সময়ে প্রচলিত ছিল না। বার্ত্তিককার কাত্যায়ন ব্যাকরণের অন্য এক শিক্ষাধারায় গড়ে উঠেছিলেন যার নাম কাতন্ত্র বা কলাপ ব্যাকরণ। বলা হয়, দেবসেনাপতি কুমার কার্ত্তিক এর স্রষ্টা। কাত্যায়ন, পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের কিছু সূত্রের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি কিছু সূত্রের পরিবর্তন, কিছু সূত্রের পরিবর্ধন এবং কিছু সূত্রকে পরিত্যাগ করেন।তাছাড়া তিনি তাঁর সময়ে প্রচলিত কিছু নতুন শব্দগুলির জন্য অতিরিক্ত কিছু সূত্র গঠন করেন।

এবার যাঁরা পাণিনিকে অনুসরণ করতেন তাঁদের মনে হলো কাত্যায়ন, পাণিনির ওপর সুবিচার করেন নি, উপরন্তু তাঁকে বিকৃত করেছেন।অনেকেই চেস্টা করেছিলেন এই বিকৃতি থেকে পাণিনিকে বাঁচাবার, কিন্তু সফল হন নি। প্রথম যিনি সফল হয়েছিলেন, তিনি পতঞ্জলি। তাই পতঞ্জলি এখানে প্রাসঙ্গিক। পতঞ্জলি যে ৪ টি বই লেখেন, সেগুলো হলো ১) যোগদর্শন(এটি ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম; সাংখ্য, বেদান্ত, যোগ, বৈশষিক, ন্যায় এবং মীমাংসা)।২) মহাভাষ্য, এগুলি তিনি লিখেছিলেন চিত্তশুদ্ধির জন্য।৩) আয়ুর্বেদ, দেহশুদ্ধির জন্য।৪) ব্যাকরণ, বাক্ শুদ্ধির জন্য।(এই ৪ পতঞ্জলি ১ ই ব্যক্তি কিনা; তাই নিয়ে মতভেদ আছে, তবে সেটা প্রসঙ্গান্তরে আলোচনা করা যাবে সময় এবং সুবিধা মত।)
পতঞ্জলির মহাভাষ্য প্রন্থটি গ্রীক পণ্ডিত প্লেটোর মত সংলাপের ভঙ্গিতে লেখা। তাঁর গ্রন্থে পাণিনির কিছু সূত্রকে বিকল্পভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর বর্ণনা দেখলে মনে হয় পাণিনির বিরুদ্ধবাদীদের নিরস্ত করার জন্যই তিনি এই কাজ করেছিলেন।
পাণিনির সমালোচনা করে বার্ত্তিককার কাত্যায়ন যা লিখেছিলেন এবং কাত্যায়নকে সমালোচনা করে পতঞ্জলি যা লিখেছিলেন সবগুলোই শেষ পর্য্যন্ত পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণেরই অঙ্গ হয়ে উঠল। সেই জন্য পাণিনির অস্টাধ্যায়ী ব্যাকরণকে ত্রিমুনি ব্যাকরণ বলা হয়। এই ৩ জনের সম্মিলিত অবদানের জন্য সাধারণভাবে এই ব্যাকরণকে পাণিনি ব্যাকরণ, পাণিনি তন্ত্র বা পাণিনিনয় নামে বলা হয়ে থাকে।
পাণিনির এই বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয়েছে:- “ AHIK DAKHSHIPUTRA SALANKI SALATURIYA PANIN PANINI was not only the best grammarian of Vedic and Sanskrit language, but also a Sacrificer, Priest, Logician, Philosopher, Mathematician, Astronomer, Poet and politician. He was the precursor of the most intelligent and powerful computing system and the probability for Physics of the Cosmos. In that way his ‘PANINI MACHINE’ is the most powerful model of recent Computers.”
আহিক দাক্ষিপুত্র শালাঙ্কি শালাতুরীয় পাণিন্‌ পাণিনির প্রতি আমাদের অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও শতকোটি প্রণাম জানিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধটি শেষ করলাম।



ঋণ- বন্ধুবর ডঃ প্রদীপ চক্রবর্তী(পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুযোগ্য শিষ্য) রচিত প্রসঙ্গ পাণিনি এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট।