পশ্চিম বাংলার, আর পাঁচটা মফঃস্বল শহরের মতই সাতক্ষীরা
! অবিভক্ত বাংলায় প্রথমে এটা ২৪ পরগণার মহকুমা ছিল, পরে খুলনার মহকুমাতে আসে তারপর
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে জেলার মর্যাদা পায় ।
ফলে, কথার টান সেই ২৪ পরগণার মতই । সাধারণ লোকে বলতো-
৬ গণ্ডা ( গণ্ডা =৪) পরগণা বা কেউ কেউ বলতো- ৬ হালি পরগণা ( হালি মানেও চার)।
তখন বেশ পরিস্কার ছিমছাম শহর । যুদ্ধে, এই শহরের খুব একটা
ক্ষতি হয় নি, বললেই চলে ।
তবে, খুলনা যাওয়ার রাস্তা খান সেনারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াতে,
ভারতের সৈন্যবাহিনী মেরামত করতে ব্যস্ত ।
মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লোকেরা শহরে তাদের প্রয়োজনের
জন্য আসা যাওয়া করছে ।
আমাদের হেলিকপ্টার চালকরা কাছারির সামনে নিয়ে গেল । সেখানে,
তখন মাত্র গেটাকয়েক খাবার হোটেল খোলা ।
চালক সহ আমরা ঢুকে পড়লাম একটা হোটেলে । খিদেতে পেটের নাড়িভুঁড়ি
হজম হওয়ার উপক্রম ।
হোটেলের নামটা, যতদূর মনে আছে- সেলিম হোটেল বা ঐ রকমই
কিছু । পাশেই একটা ষ্টেশনারি ষ্টোর্স ।
নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মনোহর ভাবে সাজানো সেই মনোহারি
দোকানে । অনেক খানি জায়গা জুড়ে বিরাট বড় দোকানটা ।
টিনে ভরা বিলিতি হরলিক্স থেকে জন প্লেয়ারর্স সিগারেট সব
আছে ।
আমরা ঢুকতেই, দোকানের একটি লোক সালাম দিয়ে বলল :- আসেন
চ্যার । ইণ্ডিয়া থিকি আসচেন মনে হচ্চে ।
আমরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই জবাব এলো – কিন্তু, এটা মুসলমানদের
হোটেল । আপনারা কি এখানে খাবেন ? হিন্দু হোটেল গুলা সব বন্ধ । কি যে করি !
হেসে উড়িয়ে দিলাম । বললাম – আমরা এসব মানি না । তবে, একটা
মুশকিল !
কি?
আমাদের কাছে তো ইণ্ডিয়ার টাকা ! পাকিস্তানি টাকা তো নাই
!
সে – হয়ি যাবে । চিন্তা করেন কেন ? আগে খান , তারপর ওসব
হবে । কি খাবেন- মাছ না মাংস, ভাতের সাথে ? একটা কথা- আমরা কিন্তু গরুর মাংস রান্না
করি না ।
সে ঠিক আছে, তবে আমরা মাছই খাবো !
আচ্ছা, ইলিশ খাবেন তো ?
নিশ্চয়ই ! দ্যান্, দ্যান্ ।
এর মধ্যেই, উর্দ্দি পরা চারজন সর্দার ঢুকলেন হোটেলে ।
প্রত্যেকের কোমোরে রিভলভার ঝুলছে ।
রোটি হো গয়া ভাই ? সুবে আকে অর্ডার দিয়া থা ! খয়াল হ্যায়
আপকা ?
জি জি, খেয়াল আছে, সাথে মোর্গাও বানিয়েছি ।
সর্দাররা হাসি মুখে বসতেই আমাদের ৮ জনকে দেখল ।
আপ চার লোগ ভারতসে আয়েঁ হ্যায় কেয়া ?
জি হাঁ !
ঠিক হ্যায়, লেকিন শাম হোনে সে পহলে নিকল যাইয়ে ! বর্ডার
পঁহুচনা জরুরি হ্যায়!
কিঁউ জি ?
রাস্তে পর ইহাঁ উঁহা মাইন হ্যায়, খান সেনা লোগোঁকা কারোয়ার
। বহোত খতর নাক চিজ সব !
হামলোক সোঁচতে হ্যায়, ইধর এক রোজ ঠহরেঙ্গে !
তো ঠিক হ্যায় ! লেকিন কহাঁ ?
ও তো মালুম নেহি ! ই সাইকেল ওয়ালে লোগ বতায়েঙ্গে !
দরাজ হাসি হেসে বললেন ওদেরই একজন :- কোই বাত নেহি ! আপলোগ
হমারে ক্যাম্প মেঁ ভি ঠহর শকতে হ্যায় ।
জি সুক্রিয়া । দেঁখতে হ্যায় !
ঠিক হ্যায় ।
---
খাবার সব দিয়ে গেল ! সুবাস আসছে ইলিশ মাছের । ভাত মেখে
মুখে তুলতেই, হঠাৎ সেই বাসী মৃতদেহদের বোঁটকা গন্ধ ভেসে এলো নাকে । কেন যে এলো, কে
জানে ।
তাকিয়ে দেখি, মামা আর বন্ধুরাও খেতে পারছে না ।
কোনো রকমে খেলাম ।
খেয়ে হাত ধুয়ে টাকা দিতে গেলে, দোকানদার হাত জোড় করে বলল
– নিতে পারবো না ।
কেন ?
জি, আপনারা আমাদের মেহমান, তার ওপর আমাদের বন্ধু । একদিন
টাকা না নিলে না খেতে পেয়ে এন্তেকাল হবে না আমার ।
ওই মিলিটারিদের কাছ থেকেও টাকা নাও না ?
কি যে বলেন ! খান সেনারা খেয়ে টাকা দিত না, এরা দ্যায়
। তবে, প্রথম দিন আমি নিজে নেই নি !
অনেক জোরাজুরি করলেও নিল না টাকা ।
-
বোঁটকা গন্ধটা সরানোর জন্য পাশের দোকানে সিগারেট কিনতে
গেলাম ।
দোকান মালিক- জলিল আহমেদ ( আসল নামটা বললাম না, হয়তো তিনি
আছেন এখনও )।
তিনি বললেন :- আপনারা আজ রাতে এখানে থাকবেন শুনলাম, সেলিম
বলল ।
আমাদের বাসায় থাকবেন?
সম্মতির জন্য তাকালাম হেলিকপ্টার চালকদের দিকে । তারা
ইশারায় সম্মতি জানালো ।
জলিল সাহেব আমাদের বললেন :- জানি, আমাকে আপনারা বিশ্বাস
করবেন না, তবে, একটা কথা বলি । আমার আব্বা এখানে নাম করা লোক । প্রায় ৮০ বছর বয়স।
যেদিন দেশভাগ হলো, সেদিন থেকে উনি কথা বন্ধ রেখেছিলেন
। বাংলাদেশ হবার পর থেকে কথা বলছেন । আমার আব্বাকে অন্তত দেখে যান । দরকার হলে কোনো
হিন্দু বাসায় রাখার ব্যবস্থা করবো আপনাদের ।
লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল ।
দোকান বন্ধ করে আমাদের নিয়ে চললেন জলিল সাহেব । আমাদের
সকলের থেকে বয়সে বড় বলেই মনে হলো তাঁকে ।
হেলিকপ্টার চালকদের বলে দিলেন – কাল আসবি তোরা । ওরা টাকা
নিয়ে চলে গেল। আমরাই দিলাম ।
সিগারেট খেতেও ইতস্তত বোধ করছি আমরা ।
নিজেই সিগারেট এগিয়ে দিলেন ।
ওই যে সংস্কৃত ভাষায় আছে না – প্রাপ্তেষু ষোড়ষে ----
পরিমলদা বলল – আপনি সংস্কৃত জানেন ?
দরাজ হাসি দিলেন ।
পরে বলবো ওসব কথা । এখন চল তোমরা আমার বাসাতে ।
কখন যে আমরা “ তুমি” হয়ে গেছি বুঝতেও পারি নি ।
-
বাসায় ঢুকেই হাঁক দিলেন বাবাকে ।
আব্বাজান দ্যাখো, কাদের এনেছি !
পরিচয় হলো ওনার সাথে । শরবত, চা সব এলাহি ব্যাপার ।
তারপর হাসান সাহেব বললেন :- রাতে তো এরা খাবে । জলিল,
এক কাজ কর এদের জন্য চাল , ডাল, মাছ, মশলা, প্রাইমাস ষ্টোভ, হাঁড়ি- কড়াই আর যা সব লাগবে,
দিয়ে দে । আমাদের হাতের রান্না ওনাদের খাওয়ানো উচিত হবে না !
মাথায় হাত, আমাদের সকলের ।
----
পড়ার সুবিধের জন্য আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি নি
-
(চলবে)
No comments:
Post a Comment