না, এবারে ক্রিকেট নয় । নিজের কিছু অনুভূতি/ অভিজ্ঞতার
কথা বলছি।
দেশ ভাগ হবার পর, এপারে যখন আসি, সেই বয়সে কেন দেশ ছেড়ে
আসা হয়েছিল- সেটা বোঝার মত বুদ্ধি, বিশ্লেষণী ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না এবং এখনও নেই ।
এখন, শুধু এটুকু বুঝতে পারি, ১৯৪৭ য়ের আগে ভারতে ছিলাম,
আর তার পরে আবার ভারতে এসেছি ।
বারবার, প্রহসন বলেই মনে হয়েছে আমার ।
বাবা, কাকা, মাতামহ সবাইকে বিমর্ষ দেখেছি দেশ ছেড়ে আসার
কারণে ।
এমন নয়, যে ওপার বাংলাতে গোলাভরা ধান , পুকুরভরা মাছ,
বা বিশাল স্বচ্ছল অবস্থা ছিল আমাদের ( শোনা কথা ) ।
মোটামুটি খেয়ে পরে বাঁচার অবস্থা অবশ্য ছিলই , নাটোরের
আগদীঘা গ্রামে, দেবোত্তর সম্পত্তির কারণে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, তখন রাগ হতো “মুসলমান” দের ওপর এই মুষল পর্বে ।
মালাউন নামটা তখনই প্রথম শুনি ।
কারণ, বাবা- কাকা- মাতামহরা সংগ্রাম করছেন এক নতুন জায়গায়
এসে সংগ্রাম করছেন বেঁচে থাকার জন্য সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে । এই সংগ্রাম তখন ঘরে
ঘরে ।
এখানকার বাঙালিরা আমাদের মানিয়ে নিতে পারে নি- এটাও সত্যি
কথা ।
আর কেনই বা মেনে নেবে ? তাই, আমাদের রাগ এদের প্রতিও ।
রুজি- রোজগারে টান পড়লে না মানাটাই স্বাভাবিক ।
তার ওপর সংস্কৃতির দুস্তর ব্যবধান ।
আমরা যে ভাষাই বলি না কেন- সেটা, শাখামৃগর কিচির মিচির
মনে হতো এদেশীয়দের কাছে ।
কেউ কেউ গালাগালিও ভাবতো !
মানসিক ব্যবধান বিরাট হয়ে দাঁড়াচ্ছিল , তাচ্ছিল্যের বহিঃপ্রকাশে
।
সে সময় সন্ত্রাস বাদ ছিল না, কিন্তু এই মানসিক অত্যাচার
দুঃসহ সন্ত্রাসবাদের চেহারাই নিয়েছিল তখন ।
তবু, সেই যুগে শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে
দেওয়ার লোকেরও কোনো খামতি ছিল না ।
আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি- শুভ বুদ্ধি বারবার হেরেছে
অশুভ শক্তির কাছে ।
উদ্বাস্তু বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছে- ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে
। সেখানেও একই অবস্থা ।
ধীরে ধীরে বিশ্বস্ত লোকেদের কাছে শুনে, ইতিহাস পড়ে মাথায়
আসল কারণটা ঢোকে ।
তখন তো কিছুই করার উপায় নেই ।
আমার মত অনেকেরই বিদ্বেষ টা পুরোপুরি না হলেও ৯৮% কাটে,১৯৭১
য়ে ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, এপারের বাঙালিদেরও উদ্ধুদ্ধ
করেছিল ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে পরেই টাকী দিয়ে ঢুকেছিলাম,
আমার ছোটমামা এবং আরও কিছু এদেশীয় বন্ধুর সঙ্গে ।
সবে আত্মসমর্পণ করেছে- পাকিস্তানি সৈন্যরা ।
চারিদিকে ছড়িয়ে নারকীয় দৃশ্য । কোথাও হাতকাটা, মাথাকাটা
পচা মৃতদেহ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, কোথাও বা অসহায় শিশু বসে আছে মৃতা মায়ের পাশে ।
অসহ্য পরিস্থিতি ।
পেটে মোচড় দিচ্ছে, বমি হবার উপক্রম ।
বাহন বলতে – হেলিকপ্টার । সাইকেলের পেছনের বড় কেরিয়ারে
বস্তা বাঁধা ।
সেই কেরিয়ারে বসে এক একজন করে সাইকেল প্রতি । কত টাকা
নিয়েছিল, এখন আর মনে নেই ।
এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় চলতে চলতে সাইকেল চালক দিয়ে চলেছে
ধারাবিবরণী । তেমন “আলোকপ্রাপ্ত” নয় তারা ।
“মুসলমান” সেই চালকের প্রশ্ন ছিল- ধর্ম যদি একই হয় তবে পচ্ছারা ( পশ্চিমারা) আমাদের
এই ভাবে মারল কেনে ?
এদের পথ দেখাছে- এখানকার রাজাকাররা । জানেন এটা ?
উত্তর ছিল না আমাদের মুখে ।
পরে জেনেছি (কিছুটা ইতিহাস পড়ে আর অনেকটা জনাব হুমায়ুন
কবীরের উপন্যাস- এক জীবনের কথা পড়ে) – তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে “মুসলমান” বাঙালিরা চাকরী পেত ১ % , তাও মুচলেকা দিয়ে ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনীতে একই বৈষম্য ছিল
।
অথচ – তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাদের সরকারী চাকরীতে
অবস্থান ছিল, ৩০-৩৫ % মত। রাজার মত ব্যবহার তাদের !
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও ধর্ম এক করতে পারে নি একটা
জাতিকে ।
সেই আমলের পাকিস্তান ছিল – একটা অজানা পাখির মত, যার দুটো
ডানা আছে, দেহটাই নেই।
সেই অদেখা দেহটার মাংস খেতে তখন ব্যস্ত তারা।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিলই দেশভাগের কারণে ।
এমন কয়েকজনের সঙ্গে তখন দেখা হয়েছিল বাংলাদেশে, তাঁরা
হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে আনন্দিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে জিততে পেরে ।
একটা অলীক স্বপ্নও দেখেছিলেন – স্বাধীন “ বাংলাস্তান”গড়বেন দুই বাংলা মিলিয়ে ।
সেটা অসম্ভব ছিল । গঙ্গা- যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে
।
যাই হোক – আমরা পৌঁছলাম সাতক্ষীরা শহরে কোনো রকমে ।খিদে
পেয়েছে ।
( চলবে)
No comments:
Post a Comment