ডুয়ার্স কথাটা এসেছে- দুয়ার থেকে । অসমিয়া, বাংলা, নেপালি, মৈথিলি, ভোজপুরি, মাঘাই এবং তেলুগু ভাষায় দুয়ারের অর্থ হলো 'দরজা'। সমতল অঞ্চলের ভারত থেকে ভুটানের
প্রবেশ দরজা । ভুটানের মানুষ সমতল বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারতো বা
পারে আঠেরোটা দরজা দিয়ে, তাই ইংরেজীর বহুবচনে এটা – ডুয়ার্স ।
কোচ রাজাদের অধীনে ছিল এই ডুয়ার্স । রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ভূটান দখল করে
ডুয়ার্স ।
চা-বাগানের পত্তন হচ্ছে ডুয়ার্সে। শ্রমিক চাই। যারা খাটবে খুব।
বদলে যা পাবে তাতেই খুশি। ডুয়ার্সের গাজোলডোবায় ব্রুহাম সাহেব ১৮৭৪ সালে প্রথম চায়ের
বাগানের পত্তন করেন। অবশ্য তার ৩৫ বছর আগে অসমে এবং ২০ বছর আগে দার্জিলিং-এ চা-বাগানের
যাত্রা শুরু। ডুয়ার্সের চা-বাগান তৈরি দেরিতে হওয়ার কারণ, অঞ্চলটা ছিল
ভুটানের অধীনে। ১৮৫৯ সালে কর্নেল জেনকিনস নামের এক ইংরেজ জায়গাটা ঘুরে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, ‘চা তৈরি করতে জরুরি এই অঞ্চল খুব তাড়াতাড়ি ভুটান থেকে নেওয়া প্রয়োজন।’ ইংরেজরা দখল নেয় ১৮৬৪ সালে।
১৮৬৫ সালের ভূটান যুদ্ধে- ক্যাপ্টেন হেদায়ত আলীর নেতৃত্বে
ব্রিটিশরা ভূটান থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে ।
অঞ্চলটি দুভাগে বিভক্ত করে , পূর্ব অংশটি চলে যায়- আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় আর
পশ্চিমাংশটির নাম হয়- পশ্চিম ডুয়ার্স ।
১৮৬৯ সালে এই পশ্চিমাংশটির
নাম হয় – জলপাইগুড়ি জেলা । এখন এটা নতুন আলিপুরদুয়ার জেলার একটি অংশ ।
কিন্তু, চা-বাগানের শ্রমিক কারা হবে? এই অঞ্চলের যাঁরা আদি বাসিন্দা, তাঁদের নানা প্রলোভন দেখিয়েও আকর্ষণ
করা যাচ্ছিল না। কেন? দুটো মত চালু আছে। কেউ কেউ বলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা ছিলেন সংখ্যায় খুব কম। তাঁদের জীবিকা ছিল কৃষিভিত্তিক। চা-বাগানের
কাজে আগ্রহ ছিল না। আর একটি অভিমত, এই আদিবাসীরা, যাঁরা রাজবংশী, কোচ, মেচ সম্প্রদায়ভুক্ত, মূলত শিবের উপাসক ছিলেন। শিবের অবস্থান মাটিতে। সেই মাটিতে চাষ করে তাঁরা খাবার
পান। চা-গাছ চাষ করে কোনও খাবার তাঁরা পাবেন না। না শেকড়, না ডাল, না পাতা, না ফুলফল তাঁদের খাদ্য হতে পারে। তাই এমন হতচ্ছাড়া গাছের
চাষে ঈশ্বর বিরূপ হবেন বলে তাঁরা সরে দাঁড়ালেন।
সেই একশো আঠাশ বছর আগে আড়কাঠিদের সাহায্যে খাবার এবং ভাল থাকার
লোভ দেখিয়ে যে, ওঁরাও, মুণ্ডাদের নিয়ে আসা হয়েছিল ডুয়ার্সে, তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্যে ব্রিটিশরা একই সঙ্গে দুটো শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এক, চাবুক। দুই, ধর্ম।
এই ডুয়ার্সে অকৃপণ প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে সবুজ চাদর। মায়াময়
চায়ের বাগান, প্রায় সব জায়গাতেই খরস্রোতা নদী, ছোট ছোট টিলা, পাহাড়ী দিগন্ত, শাল সেগুনে ঢাকা মেঠো পথ- এসব কিছুই পাগল করে দেবার জন্য
যথেষ্ঠ যে কোন প্রকৃতি প্রেমিককে।
মদেশী- এই কথাটা হলো আদতে নেপালি । অর্থ:- উপজাতি । চা
বাগানে কাজ করার জন্য ব্রিটিশ ভারতের থেকে প্রচুর উপজাতি (মূলত ওঁরাও, মুণ্ডা,)
শ্রমিক আসে। এসেছিল রাঁচি, হাজারিবাগ, সাঁওতাল পরগণা থেকে ।
কালক্রমে, এদের নাম হয়ে যায় মদেশিয়া । এদের ভাষা বিচিত্র ।
বাংলা, নেপালি, হিন্দি এবং আরও কিছু ভাষা মিশিয়ে গড়ে উঠেছে- নিজস্ব ভাষা, সান্দ্রী
।
সরল ও সহজ বলে- এদের বশ করা সহজ । আমার দু বার ঘুরে মনে
হয়েছে- এই শ্রমিকদের তথাকথিত “ দুর্দশার” মূলে কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা ।
ঋণ :- সমরেশ মজুমদার, উইকি ।
No comments:
Post a Comment