আজকাল, ভোরের দিকে শরীরটা শিন শিন করে
অল্প ঠাণ্ডা ঠাণ্ডায় । কুয়াশা না পড়লেও, বেশ একটা মায়াবী পরিবেশ ।
গলির ঢোকার মুখটাতে, কালভার্ট
নতুন করে তৈরি হয়েছে- হরির দোকান ঘেঁসে । একটা ক্রংকিটের স্ল্যাব জোগাড় করে, তার নীচে ইট দিয়ে, দোকানের সামনে বসার জায়গা তৈরি করেছে হরি ।
ষ্টোভে সাঁ সাঁ করে জল ফুটছে । এখনও সে রকম চাতাল রা আসে নি
।
নাগের বাজারের দিক থেকে রিক্সা করে এসে, একজন নামলেন, দোকানের
সামনে ।
সায়েবী পোষাক পরণে, তবে
পুরোনো ধাঁচের । কলারটা উঁচু আর সেই কলারে বাঁধা আছে মোটা টাই । চোখে সেই
আদ্যিকালের গোল গোল চশমা । বেশ রাজপুত্তুর
টাইপ চেহারা ।
বসার জায়গা দেবেন প্লিজ ! অনুরোধ করলেন - রিক্সার ভাড়া
মিটিয়ে । স্বরটা মনে হলো ব্যারিটোন ভয়েস ।
সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিলাম । ভদ্রলোকের চেহারাটা বড়ই
পরিচিত তবে ঠিক কোথায় দেখেছি- মনে করতে পারছি না !
ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম- স্যার ! ( সম্ভাষণটা আপনা আপনি
চলে এলো মুখে) আপনাকে তো এই পাড়ায় দেখিনি ! নতুন এলেন বুঝি ?
নাহে ! আমি ঘুরে ঘুরেই বেড়াই আজকাল । থাকি একটা অজানা
জায়গায়, তবে মাঝে মাঝে আসি কোলকাতায় ।
বুঝলাম না স্যার !
“সাগর যেথা
লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে
আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে।
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে-
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে।”
এই হলো আমার দেশ ।
কবিতাটা বেশ চেনা
চেনা লাগছে, তা স্যার, আপনার নামটা ?
উহ্যনাম পণ্ডিত !
নামটা উহ্য আবার পণ্ডিত ? আমার
মুখটা হাঁ হয়েই রইল ।
হেসে আবার পদ্য আউড়ালেন :-
“এক যে
রাজা”–”থাম্ না দাদা,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা৷”
“তার যে
মাতুল”–”মাতুল কি সে?—
সবাই জানে সে তার পিশে”
“তার ছিল
এক ছাগল ছানা”—
“ছাগলের কি
গজায় ডানা?”
“একদিন তার
ছাতের ‘পরে”—
“ছাত কোথা
হে টিনের ঘরে?”
“বাগানের
এক উড়ে মালী”—
“মালী
নয়তো! মেহের আলী৷”
“মনের সাধে
গাইছে বেহাগ”—
“বেহাগ তো
নয়! বসন্ত রাগ৷”
আমাকে ছাগল বললেন ? রাগই হলো
আমার ।
উদাত্ত হেসে বললেন :- তোমাকে ছাগল বলবো কেন হে ? যে যা, সেটা কখনও
বলতে নেই – শাস্তরে মানা আছে ।
মুখটা গোমড়া হলো আমার ।
একি ! ওমনি গোমড়া থেরিয়াম হয়ে গেল ? হরি ! চা
দাও এই বাবুকে । হরির চা খাও, তবেই মাথা খুলবে, বোয়েচ ?
গোমড়া থেড়িয়াম ? এটা আমার খুব চেনা ! সুকুমার রায়ের
লেখা !
হ্যাঁ হ্যাঁ ! ওই ঢ্যাঙ্গা মাণিকের বাবা সুকুমার রায় ।
ঢ্যাঙ্গা মাণিক ?
আরে, তোমাদের সত্যজিৎ রায় ! ওই যে
কমলবাবু ছিলেন না, সাউথ পয়েন্টের শিক্ষক, তিনি ওই
নামেই ডাকতেন মাণিককে ।
কমল বাবু মানে, কমলকুমার মজুদার ?
হ্যাঁ রে বাবা ! সাউথ পয়েন্টে ছোট ক্লাসে ক্রাফ্ট পড়াতেন ।
আপনি এত জানলেন কি করে ?
জানার কথা নয়, তবে জেনেছি । মাণিকের তিন বছরের
বয়সেই তো আমি গড়পার পার !
হ্যাঁ, সুকুমার রায় সত্যজিৎ বাবুর তিন বছর
বয়সেই মারা গেছিলেন, সেটা শুনেছি ! আপনি সুকুমার রায়ের বন্ধু ছিলেন বুঝি ?
বন্ধু কি হে ? একেবারে হরিহর আত্মা । সুকুমারই তো
উহ্য হয়ে গেছিল ।
কেন স্যার ?
হুঁকোমুখো হ্যাংলা
বাড়ী তার বাংলা, মুখে তার হাসি নাই, দেখেছ ?
নাই তার মানে কি ?
কেউ তাহা জানে কি ? কেউ কভু
তার কাছে থেকেছ ?
ওঃ ! কিছুই বুঝতে পারছি না ।
আজ তারিখ কত ?
ত্রিশে অক্টোবর !
হুম্ ! মনে রেখ এই দিনটাতেই আমি জন্মেছিলাম ।
একটা রিক্সা ডেকে পদ্য আউড়াতে আউরাতে চলে গেলেন :-
এইত সে দুপ'রে
ব'সে ওই উপরে, খাচ্ছিল কাঁচকলা চট্কে-
ওর মাঝে হল কি ?
মামা তার মোলো কি ? অথবা কি
ঠ্যাং গেল মট্কে ?
হুঁকোমুখো হেঁকে কয়,
আরে দূর, তা তো নয়, দেখ্ছ না
কি রকম চিন্তা ?
মাছি মারা ফন্দি এ,
যত ভাবি মন দিয়ে, ভেবে ভেবে কেটে যায় দিনটা।
ভেবেই পেলাম না- ভদ্রলোক কে?
No comments:
Post a Comment