সে কবেকার কথা !!!! তখন, আমার বয়স
কত আর হবে, এই ধরুন- বারো বা তেরো ।
বাবা ওডিশা আর আন্ধ্রার সীমান্তবর্তী শহর- পারলাখেমুণ্ডির
এক কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন ।
কেন ওই শহরে গেছিলেন- সেটা না হয় আরকেদিন বলবো, তবে আজ আমার কথা বলি ।
কোলকাতার বাঘাযতীনে মামাবাড়ীতে থেকে স্কুলে পড়তাম আর ছুটি – ছাটায় চলে আসতাম, পারলাখেমুণ্ডিতে ।
ইলেকট্রিক মাত্র কয়েকজায়গায় ছিল ।
আমরা থাকতাম, রাজবাড়ীর কাছেই । প্রশস্ত সেই
রাস্তাকে বলা হত- রাজ দাণ্ড ( আজও বলা হয় )- রাজার পথ ।
আমাদের ভাড়া বাড়িতে ইলেকট্রিক ছিল না ।
মাসিক ভাড়া ২২ টাকা ।
ট্রেনের কামরার মত লম্বা পর পর ঘর । বাড়ীতে ঢুকতে যেতেই
একটা বারান্দা, তারপর একটা ছোট ঘর, পরে আরও
একটা বড় ঘর । তার ওপরের ডান দিকে একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে ঝড়তি পড়তি জিনিস রাখার
জায়গা ।
সিঁড়ি ছিল না । মই লাগিয়ে উঠতে হত । আমি অবশ্য দরজা বেয়েই
উঠতাম ।
তার পরে আরও দুটো ঘর । পাশেরটা অপেক্ষাকৃত ছোট । বাবা সেটাকে পুজোর ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন ।
এরপরে প্রশস্ত বারান্দা । দু পাশে দুই প্রতেবেশী । দুদিকেই
দেওয়াল থাকলেও কথা বার্তা সব শোনা যেত ।
একপাশে কুয়ো । ওপাশে বড় একটা রান্নাঘর ।
পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা , চলে গেছে
খাটা মলত্যাগের জায়গায় ।
বাঁ পাশের পরিবারটি ওডিয়া । বেশ শিক্ষিত পরিবার । ডান পাশের
টি ছিল- তেলগু, সোনার কর্মকারের বাড়ী ।
বাঁ পাশের বাড়ী থেকে যখন শোনা যেত বিদ্যা চর্চার ধ্বনি, তখন ডান পাশে খালি শাশুড়ি বৌয়ের ঝগড়া ।
এবারে হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা পাশ করে পাকাপাকি ভাবে
ভর্তি হলাম- পারলাখে মুণ্ডি কলেজে ।
বাবা আর আমাকে কোলকাতায় রাখতে সাহস করছিলেন না । তাঁর কাছে, খবর ছিল- আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছি ।
আমি সায়েন্স নিয়ে
পড়লেও আমাদের সাথে পড়তো- গিরিধারি গোমাঙ্গ্
আর্টস্ নিয়ে। পরে কেন্দ্রের কয়লা মন্ত্রী এবং ওডিশার মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিল
।
বিরাট দুই পদে থাকলেও- যোগাযোগ দু পক্ষ থেকেই থাকতো ।
গিরিধারি ছিল “সৌরা” উপজাতিদের
রাজপুত্র ।
ভালো ব্যাঞ্জো এবং ঢোল বাজাত । তখন কোনো ষ্ট্রীট কর্ণারিং
হলেই- ও আমাদের ওডিয়া বা তেলগু গানের সাথে ঢোল বাজানো ছিল অভ্যাস ।
এ আই এসএফের সদস্য ছিল আমাদের মত । পরে কংগ্রেসে চলে যায় ।
ওর বাবা তখন রাজা ।
আমার বাবার মাথায় হাত । ছেলে কিনা আবার সেই রাজনীতিতে !
কেন্দ্র থেকে যখন অনিবার্য জয় পাবার জন্য গিরাধারির বাবাকে
লোকসভা প্রার্থীর জন্য সুপারিশ করলে, তখন তিনি গিরিধারির নাম প্রস্তাব করলে, কেন্দ্রের
কংগ্রেস মেনে নেয় ।
গিরিধারির বাবা, সৌরা এবং ওডিয়া ভাষা ছাড়া ইংরেজী বা হিন্দী জানতেন না !
তখনকার মত দূরত্ব তৈরি হলো- গিরিধারির সাথে ।
আমরা যাঁকে গুরু বলে মানতাম, সেই
নাগভূষণ পট্টনায়েক, ( প্রাক্তন এ আই এসএফের সদস্য) খবরটা শুনে মুচকি হেসেছিলেন ।
পারলাখেমুণ্ডি থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে গুণুপুর শহরে
থাকতেন । আমার বাবার থেকে বেশ ছোট হলেও তিনি শ্রদ্ধা করতেন বাবাকে । প্রায়ই আসতেন
পারলাখেমুণ্ডি শহরে ।
পারলাখেমুণ্ডির কলেজেরই ছাত্র ছিলেন তিনি । পরে বেনারস
ইউনিভার্সিটির ছাত্র ।
বাবার নাম তখন বেনারসের লোকের মুখে মুখে ফিরত । একজন ছাত্র
দর্শন এবং সংস্কৃত তে ডাবল অনার্স নিয়ে ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট হয়েছিলেন । এম.এ.
তেও তাই ।
সেই সুবাদে বাবার পরিচয়, পারলা
খেমুণ্ডিতেই ।
নাগভূষণের বাবা ছিলেন ওডিয়া, মা তেলগু
। এই রকম বিয়ে এখনও চালু ওদিকে । বাংলা খুব ভালো বলতেন ( জানি না, কি ভাবে শিখেছিলেন ) । এনাদের বলা হতো
কোম্মা করণঅ
জানি না, কোথা থেকে ঠিকানা পেয়েছিলেন !
উত্তর আর দেওয়া হয়ে ওঠে নি আলস্যের কারণে , যদিও চিঠিতে, তাঁর ঠিকানা দেওয়া ছিল।
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে কোলকাতায় বসে শুনেছিলাম- তিনি ৯ ই
অক্টোবর মারা গেছেন ।
খবরটা দিয়েছিল ফোনে গিরিধারি – হাউ হাউ
করে কেঁদে ।
==========
গতকালের ক্লান্তিতে আজ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । স্বপ্নে
দেখলাম- বাবা আর কমঃ নাগভূষণ হেসে আমার
ব্যাপারে কথা বলছেন ।
গিরিধারি কোথায় , জানি না আর ।
No comments:
Post a Comment