Friday, October 24, 2014

এলোমেলো

সে কবেকার কথা !!!! তখন, আমার বয়স কত আর হবে, এই ধরুন- বারো বা তেরো ।

বাবা ওডিশা আর আন্ধ্রার সীমান্তবর্তী শহর- পারলাখেমুণ্ডির এক কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন ।

কেন ওই শহরে গেছিলেন- সেটা না হয় আরকেদিন বলবো, তবে আজ আমার কথা বলি ।

কোলকাতার বাঘাযতীনে মামাবাড়ীতে থেকে স্কুলে পড়তাম আর ছুটি ছাটায় চলে আসতাম, পারলাখেমুণ্ডিতে ।

ইলেকট্রিক মাত্র কয়েকজায়গায় ছিল ।

আমরা থাকতাম, রাজবাড়ীর কাছেই । প্রশস্ত সেই রাস্তাকে বলা হত- রাজ দাণ্ড ( আজও বলা হয় )- রাজার পথ ।

আমাদের ভাড়া বাড়িতে ইলেকট্রিক ছিল না  ।  মাসিক ভাড়া ২২ টাকা ।

ট্রেনের কামরার মত লম্বা পর পর ঘর । বাড়ীতে ঢুকতে যেতেই একটা বারান্দা, তারপর একটা ছোট ঘর, পরে আরও একটা বড় ঘর । তার ওপরের ডান দিকে একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে ঝড়তি পড়তি জিনিস রাখার জায়গা ।
সিঁড়ি ছিল না । মই লাগিয়ে উঠতে হত । আমি অবশ্য দরজা বেয়েই উঠতাম ।

তার পরে আরও দুটো ঘর । পাশেরটা অপেক্ষাকৃত ছোট । বাবা  সেটাকে পুজোর ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন ।

এরপরে প্রশস্ত বারান্দা । দু পাশে দুই প্রতেবেশী । দুদিকেই দেওয়াল থাকলেও কথা বার্তা সব শোনা যেত ।

একপাশে কুয়ো । ওপাশে বড় একটা রান্নাঘর ।

পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা , চলে গেছে খাটা মলত্যাগের জায়গায় ।

বাঁ পাশের পরিবারটি ওডিয়া । বেশ শিক্ষিত পরিবার । ডান পাশের টি ছিল- তেলগু, সোনার কর্মকারের বাড়ী  ।

বাঁ পাশের বাড়ী থেকে যখন শোনা যেত বিদ্যা চর্চার ধ্বনি, তখন ডান পাশে খালি শাশুড়ি বৌয়ের ঝগড়া ।

এবারে হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা পাশ করে পাকাপাকি ভাবে ভর্তি হলাম- পারলাখে মুণ্ডি কলেজে ।

বাবা আর আমাকে কোলকাতায় রাখতে সাহস করছিলেন না । তাঁর কাছে, খবর ছিল- আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছি ।

 আমি সায়েন্স নিয়ে পড়লেও আমাদের সাথে পড়তো- গিরিধারি গোমাঙ্গ্  আর্টস্ নিয়ে। পরে কেন্দ্রের কয়লা মন্ত্রী এবং ওডিশার মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিল ।

বিরাট দুই পদে থাকলেও- যোগাযোগ দু পক্ষ থেকেই থাকতো ।

গিরিধারি ছিল সৌরাউপজাতিদের রাজপুত্র ।

ভালো ব্যাঞ্জো এবং ঢোল বাজাত । তখন কোনো ষ্ট্রীট কর্ণারিং হলেই- ও আমাদের ওডিয়া বা তেলগু গানের সাথে ঢোল বাজানো ছিল অভ্যাস ।

এ আই এসএফের সদস্য ছিল আমাদের মত । পরে কংগ্রেসে চলে যায় । ওর বাবা তখন রাজা । 

আমার বাবার মাথায় হাত । ছেলে কিনা আবার সেই রাজনীতিতে !

কেন্দ্র থেকে যখন অনিবার্য জয় পাবার জন্য গিরাধারির বাবাকে লোকসভা প্রার্থীর জন্য  সুপারিশ করলে, তখন তিনি গিরিধারির নাম প্রস্তাব করলে, কেন্দ্রের কংগ্রেস মেনে নেয় ।

গিরিধারির বাবা, সৌরা এবং  ওডিয়া ভাষা ছাড়া ইংরেজী বা হিন্দী জানতেন না !‍
তখনকার মত দূরত্ব তৈরি হলো- গিরিধারির সাথে ।

আমরা যাঁকে গুরু বলে মানতাম, সেই নাগভূষণ পট্টনায়েক, ( প্রাক্তন এ আই এসএফের সদস্য)  খবরটা শুনে মুচকি হেসেছিলেন ।

পারলাখেমুণ্ডি থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে গুণুপুর শহরে থাকতেন । আমার বাবার থেকে বেশ ছোট হলেও তিনি শ্রদ্ধা করতেন বাবাকে । প্রায়ই আসতেন পারলাখেমুণ্ডি শহরে ।

পারলাখেমুণ্ডির কলেজেরই ছাত্র ছিলেন তিনি । পরে বেনারস ইউনিভার্সিটির ছাত্র  ।
বাবার নাম তখন বেনারসের লোকের মুখে মুখে ফিরত । একজন ছাত্র দর্শন এবং সংস্কৃত তে ডাবল অনার্স নিয়ে ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট হয়েছিলেন । এম.এ. তেও তাই ।

সেই সুবাদে বাবার পরিচয়, পারলা খেমুণ্ডিতেই ।

নাগভূষণের বাবা ছিলেন ওডিয়া, মা তেলগু । এই রকম বিয়ে এখনও চালু ওদিকে । বাংলা খুব ভালো বলতেন ( জানি না, কি ভাবে শিখেছিলেন ) ।  এনাদের বলা হতো কোম্মা করণঅ

১৯৮৬ সালের ১২ ই ডিসেম্বর  বাবা মারা গেলে, তার একমাস পর একটা চিঠি পেয়েছিলাম- মালদার ঠিকানায় ।


জানি না, কোথা থেকে ঠিকানা পেয়েছিলেন !

উত্তর আর দেওয়া হয়ে ওঠে নি আলস্যের কারণে , যদিও চিঠিতে, তাঁর ঠিকানা দেওয়া ছিল।

১৯৯৮ সালের নভেম্বরে কোলকাতায় বসে শুনেছিলাম- তিনি ৯ ই অক্টোবর মারা গেছেন ।

খবরটা দিয়েছিল ফোনে গিরিধারি হাউ হাউ করে কেঁদে ।

==========
গতকালের ক্লান্তিতে আজ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । স্বপ্নে দেখলাম- বাবা আর  কমঃ নাগভূষণ হেসে আমার ব্যাপারে কথা বলছেন ।

গিরিধারি কোথায় , জানি না আর ।





No comments: