১৯৮২ সাল !
সে সময়, আমি মালদায় । শহরের ঠিক বাইরেই রবীন্দ্রভবন । সেখানে দেখলাম, একটা ছোট টাওয়ার বসানো হচ্ছে , ভবনের মাথায় ।
মাটিতে মাছ ধরার জালের মত, কোকাকোলার একট হাফ সার্কেল । সেটাই নাকি অ্যান্টেনা । ভেতরের দিকে উল্টো করে কি সব যন্ত্র লাগানো ।
মালদায় যে টেলিভিশন সেট ছিল না, তা নয় । তবে, বুষ্টার অ্যান্টেনা দিয়ে বাংলাদেশ টিভি দেখা যেত ।
একটা হাল্কা ঝিরিঝিরি ভাব থাকতো বটে ছবিতে, তবে দূরের ছবি দেখা যাচ্ছে বলে উত্তেজনার বহরে, সেসব কেউ গায়ে মাখতো না ।
কিছু লোকের বাড়ী গিয়ে টিভি দেখতাম । একবার বিশ্বকাপ ফুটবলও দেখেছিলাম, একজন ডাক্তার বাবুর বাড়ী ।
কোন সুদূর দেশে খেলা হচ্ছে, আর মালদায় বসে সেটা সরাসরি দেখছি, এটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল ।
কুল্লে তিন রকম কোম্পানীর সেট পাওয়া যেত, তখন মালদায়। একটা ওয়েবল্, আর একটা ভারত টিভি আর একটা আপট্রন ।
সাদা কালো বেশীর ভাগই ওয়েবল্ সেট আর আপট্রন, আর রঙীন ছিল ভারত টিভি ।
ভারত টিভির আবার সাটার ডোর ছিল ।
এও শুনলাম, বরকত সাহেবের বিশেষ নির্দ্দেশে এই এল.পি.টি. স্টেশন তৈরি হচ্ছে দিল্লির দূরদর্শন দেখানোর জন্য । বাংলা দূরদর্শন আসবে না । তাই সই লোকের ।
এই রকম সময়ে, একদিন নেতাজী রোডের রোগমুক্তি বলে একটা দোকানে ( আমার কোম্পানির ষ্টকিষ্ট) বসে আছি, সেই সময় দেখি একজন রিক্সা করে একটা বিশাল কার্ডবোর্ডের বাক্স নিয়ে যাচ্ছে । সাথে অ্যালুমিনিয়ামের কিছু সরঞ্জাম ।
রোদ্দুরে সে গুলো চকচক করছে । যে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে, তার মুখে গর্বিত মুচকি হাসি ঝুলে ।
আমার মফঃস্বলী কৌতুহলি মন ভরে গেল অনেক অজানা জিজ্ঞাসায় ।
জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, সেইদিন থেকেই সম্প্রসারণ শুরু হবে মালদা শহরে আর দেখা যাবে, বারো কিলোমিটার ব্যাসার্ধের আকাশ পথে যে সব জায়গা পড়বে ।
চলে গেলাম দোকানে । মালিক, পরিচিত ননীদা । দোকানের নাম – বেতার । মূলত রেডিও আর টেপ রেকর্ডার বিক্রি হত সেখানে ।
ঢুকতেই, ননীদা বললেন – কি রামকিসনো বাবু টিভি লিবেন না ?
কি রকম দাম?
স্যানকাচেন ( ভয় পাচ্ছেন) ক্যানে ? লিয়ে যান, মাসে মাসে দাম দিয়েন ।
কেন? আপনার টিভি বিক্রি হচ্ছে না ?
কি আর বুলবো বলেন ? লোকে কহছে, বরকত মিঞাঁর কারবার ! ওই যে দিল্লিতে কি সব খেলা হছে, ওগুলা হতেই ইষ্টিশন তুলে দিবে । তাই বেশী বিক্রি লাই ! এদিকে অনেক সেট কুম্পানি দিয়ে গেছে ।
তা হয় নাকি ? একবার বসলে, এটা আর উঠবে না । বরং আরও উন্নতি হবে ।
ঠিক কহছেন । লিয়ে যান একটা সাদা কালো টিভি । হাপনি কিনছেন দেখলে, অনেকেই লিবে ।
এখন কত দিতে হবে ?
হাজার টাকা হবে ?
তা হবে । কিন্তু, পরে ?
বাকী পাঁচ মাসে হাজার বা পাঁচশো করে দিয়েন । সব লিয়ে ছ হাজার টাকা !
বিরাশী সালে ছ হাজার টাকা বিশাল ব্যাপার । মাইনেই পাই মাত্র বারশো টাকা, টিএ বিল থেকে ম্যানেজ করে মেরেকেটে আরও শ চারেক কি পাঁচেক টাকা ।
তখন কিছু না বলে, ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখি ষোলশ টাকা মত আছে । হিসেব করে দেখলাম- দু চারদিনের মধ্যেই টি এ বিলের টাকা ঢুকবে ।
মাথায় খুন চেপে গেল ।
হাজার টাকা তুলে নিলাম।
অতএব চালাও পানসী বেলঘরিয়া !
ননীদাকে হাজার টাকা দিয়ে বললাম- – পাঠিয়ে দিন বাড়ীতে টিভি সেট্ । বুষ্টার থাকবে তো ?
সব থাকবে, ঘাবড়াছেন কেনে ?
বাড়ীতে গিয়ে শবরীর প্রতীক্ষা । ছেলেরা স্কুলে । সারপ্রাইজ দেবো বলে, বৌকেও কিছু বলি নি ।
অবশেষে তিনি এলেন । সব ঠিকঠাক করে বসার ঘরে টিভি ফিট হলো । বুষ্টারের জন্য একটা বেকেলাইটের চেঞ্জ ওভার ।
এক দিক ওল্টালে বুষ্টার দিয়ে বাংলাদেশ টিভি, অন্য দিকে দিলে দিল্লি দূরদর্শন ।
আমার বৌ বলল :- এসব তো পরের বাড়ীতে থাকে, আমাদের বাড়ীতেও এলো ?
একে একে আমার দুই ছেলে বাড়ী ফিরল । বাড়ীওয়ালা হেমেনদার ছেলে- মনোজ আর বাপী আমার বসার ঘরে বসেই আছে ।
যারা স্কুল থেকে ফিরে, খিদেয় ছটফট করে, তারা আজ সব ভুলে গেছে উত্তেজনায় ।
তাদের বাবাদেরও একই দশা ।
দিল্লি দূরদর্শন শুরু হবে সন্ধে সাতটায় । তাই বাংলাদেশই সই ।
বিভিন্ন খবর দেখতে দেখতেই অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । চেঞ্জ ওভার করতেই দিল্লি দূরদর্শনের লোগো ।
কিছু পরেই শুরু হলো এশিয়ান গেমসের খেল্, মাঝে খবর ।
==========
দিনটা ৩১ শে অক্টোবর ১৯৮৪ ।
সেদিন রাতে আমি কোলকাতায় আসবো, কোম্পানির মাসিক মিটিংয়ে । সকাল সাড়ে নটাতেই বসে গেলাম, কিছু পেপার ওয়ার্কস সারতে ।
পৌনে দশটা হবে- হঠাৎ শুনি রাস্তা দিয়ে একজন মাইকে বলতে বলতে যাচ্ছে – ইন্দিরা গান্ধী – গুলি বিদ্ধ ।
বেরিয়ে এলাম ।
রাস্তায় প্রচণ্ড ভীড় । পুলিস এসে মাইক বন্ধ করে লোকটকে ধরে নিয়ে গেল । আমি একটা রিক্সা নিয়ে চললাম – রেষ্ট হাউসের দিকে ।
চারিদিকে উদভ্রান্ত অবস্থা । নানা গুজব ।
শুনলাম – ইন্দিরার হত্যাকারীরা নাকি শিখ । হাইওয়েতে ধরে ধরে লরী থেকে শিখদের নামিয়ে মারা হচ্ছে ।
কয়েকজন মিলে দৌড়লাম- মঙলবাড়ী গুরুদোয়ারার কাছে ।
এদিকে গুরুদোয়ারাতে ঘন ঘন ইট আর পাথর ছোঁড়া অব্যাহত ।
আমরা হতভম্ভ । কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না । ওই জনতাকে কিছু বলতে যাওয়া মানে মার খাওয়া ।
ভাগ্য ভালো । সেই সময়েই কিছু লোক এসে এদের থামানোর চেষ্টা করল ( পরে শুনেছিলাম – বরকত সাহেব টেলিফোনে নির্দ্দেশ পাঠিয়েছিলেন , যাতে গণ্ডগোল হলে রোখা হয়) ।
একটু দূরের স্থানীয় বি এস এফ ক্যাম্প থেকেও বেশ কিছু জোওয়ান চলে এল ।
সবাই মিলে চেষ্টা করাতে পরিস্থিতি অনেকটা আয়ত্বে । জখম শিখদের তুলে মালদা সদর হসপিটাল । তারা জানেও না – কি জন্য তারা মার খেয়েছে বা খাচ্ছে ।
বিকেলে বাড়ী ফিরে এলাম । সামনের পোষ্ট আপিস থেকে আমার বস হেমেনদার বাড়ীতে ট্রাংক কল বুক করে অনন্ত প্রতীক্ষায় ।
অবশেষে পেলাম লাইনটা । ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এলো হেমেনদার স্ত্রীর । বললেন – এখনও বাড়ী ফেরে নি । কোলকাতার রাস্তা ঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ।
বললাম :- বাড়ী ফিরলে বলবেন, এই অবস্থাতে আমি আর কোলকাতা যাচ্ছি না ।
লাইন কেটে গেল ।
টিভিতে ততক্ষণে বলা হচ্ছে- ইন্দিরা গান্ধীকা নিধন ..............................।
শিউরে উঠে টিভি বন্ধ করেছিলাম ।