অজস্র সাধারণ মানুষের মধ্যে একজন- পেনু সাহা । ঢাকা জেলার কোন এক গ্রামে বাড়ী ছিল দেশভাগের আগে ।
যে সময়ে, এই পারে আসে, তখন নাকি ওনার বয়স ছিল বছর বারো-
তেরো ।
আমার বিবেকানন্দ পল্লী থেকে একটু এগোলেই লাহা কলোনি । লোকমুখে শুনেছি- ওটা নাকি কোনো এক
লাহা পদবীধারী এক এদেশীয় জমিদারের বিরাট বাগান ছিল ।
ঢোকার মুখে মস্ত এক লোহার গেট আর চারপাশ ঘিরে ছিল শক্তপোক্ত
এক ইটের দেওয়াল ।
উদ্বাস্তুরা সেই বাগানের গেট ভেঙ্গে, দখল করে বসতী বানায় ।
শুনেছি- সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড হয়েছিল সেই সময় ।
মালিকও দখল ছাড়তে নারাজ আর এরাও ছাড়বে না । একদিন ঘিরে ধরে
আগুনও লাগিয়ে দেয় বসতীতে, মালিকের লোকেরা ।
ধীরে ধীরে সেই লাহা বাগান এখন লাহা কোলোনীতে রূপান্তরিত ।
বেশ কয়েকবার প্রস্তাব এসেছিল, নামটা পাল্টে- লাহা পল্লী করার, কিন্তু এই প্রজন্মের
ছেলে- মেয়েরাই বাধা দেয় । অতীতের- পাঁচফোড়নের গন্ধ মেশানো লাহা কলোনি বহাল আজও ।
সেই কলোনির মুখের ঠিক উল্টো দিকেই ছিল পেনুদার দোকান ।
মূলত- বিড়ি নিজের হাতে বেঁধে বিক্রি করাই ছিল পেনুদার পেশা ।
বিড়ি সেঁকার মন মাতানো সুবাস অধূমপায়ীদেরও মাতাল করে তুলতো
।
সাথে ছিল চা এবং বিস্কুটের পশরা । হরির দোকান বন্ধ হয়
সন্ধেবেলায়, পেনুদার দোকান রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকতো সব সময়- এমনকি শীত কালেও ।
পাশে দীনেশ-দার দোকানও ছিল একটা আটচালার নীচে , কিন্তু জনতা
ষ্টোভে জল ফোটানো চায়ে অবধারিত ভাবে থাকতো কেরোসিনের গন্ধ ।
পেনুদার চায়ে সেসব থাকতো না বলেই ভিড় আর আড্ডা তো ছিলই ।
কত কি জেনেছি- সেই আড্ডায় বসে !!!!! বিড়ি বাঁধার নিয়ম কানুন
থেকে শুরু করে, পিস্তল আর রিভলভারের ফারাক- সবই শেখা হতো এক লহমায় ।
ফুনাই ভিসিআর না আকাই- কোনটা ভালো, এই নিয়ে চলতো চুলচেরা
বিশ্লেষণ । ফিরিতে শিখতাম সব কিছু ।
ময়লা হাত কাটা
গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা পেনুদা ধারও দিত । সপ্তাহের শেষে পেমেন্ট । হয়তো কোনো একজনের পঞ্চাশ কাপ চায়ের পয়সা বাকী,
কোন জাদুবলে সেটা হতো- পঁচাত্তরটা ।
বিড়ি- চার মুঠোর জায়গায়, আট মুঠো ।
হিসেব চাইলেই- পেনুদার নিজের হাতে হায়ারোগ্লিফিক লিপি তে
লেখা খাতা খুলে যেত ।
কার সাধ্যি চ্যালেঞ্জ করে !!!!! এমনকি- নগদ দিয়েও খেয়ে- শুনতে
হতো :-
রামকৃষ্ণ বাবু- আফনে বোধহয় গেলো সপ্তায় দুয়োটা চায়ের দাম
দেন নাই !
একটু কড়া স্বরে উত্তর দিলে মুখ কাঁচুমাচু করে বলত:- অহনে বুড়া
হইসি, অত কি আর মনে থাহে ?
২০১১ সালে পেনুদার দোকানের বাড়ীটা প্রোমোটার নিয়ে নিল ।
পেনুদাও একটা দোকান পেয়েছিল, তবে দুলাখ টাকায় বেচে দেয় ।
এহেন পেনুদা আমাকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছিল- ওর মেয়ের ঘরের নাতনীর অন্নপ্রাশনের নেমতন্নে ।
খুব ভালো খাইয়েছিল- এটা মনে আছে ।
আমি এর আগে পর্যন্ত জানতাম না, পেনুদার ফ্ল্যাট বাড়ী, হরির
দোকানের উল্টো দিকেই । আশীর দশকের শেষে পেনুদা আর দাদা মিলে প্রোমোটারকে দিয়েছিল ।
==========
==========
লাঠি ঘোরানো, গুণ্ডা তাড়ানো লিকলিকে চেহারার পেনুদা আজ
সকালে মারা গেলেন ।
একটা নীরব ইতিহাসের অবসান হলো ।
No comments:
Post a Comment