Sunday, June 8, 2014

বেচু বাবু

ওষুধের বেচু বাবু, মানে যাদের পোষাকী নাম- মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, তাদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রায় কিছুই লেখা হয় নি ।
কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেখা আছে বটে, কিন্তু সেগুলো পড়ে বেচুবাবুদের সঠিক বোঝা যাবে না ।
বেচু বাবুদের কাজটা হলো প্রথমে ডাক্তারদের মধ্যে, আমার কোম্পানির ওষুধ কত ভালোসেটা প্রচার করা । তারপর খুচরো বিক্রেতার দোকানে গিয়ে খোঁজ নেওয়া আমার কোম্পানির ওষুধ  চলছে কিনা , চললে কোন কোন ডাক্তার বাবু লিখছেন তার সম্বন্ধে খবরাখবর নেওয়া ।

এর পরে সেই দোকান থেকে অর্ডার নিয়ে ( দিলে ) স্থানীয়  বিতরকের  ( ষ্টকিষ্ট)কাছে পৌঁছে দেওয়া পরিবর্তে সেই বিতরকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কোম্পানির ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজের বেঁধে দেওয়া  সেলস টার্গেট পূরণ করা ।

টার্গেট পূরণ হলে এক্সট্রা ইনসেন্টিভ বা বোনাস মিলত একটা মোটা অঙ্ক । তাই, টাকা কামানোর তাগিদে এই কাজগুলো নিজের স্বার্থেই করতে হতো ।

হ্যাঁ ! ইউনিয়নও ছিল ।

সারা ভারত ব্যাপী প্রথমে একটাই ইউনিয়ন ছিল সিটু সমর্থিত , পরে নানা মতভেদে আরও একটা ইউনিয়ন হয় রাজনীতির কোনো রঙ না রেখে ।

এখন শুনছি আরও একটা ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে বর্তমান শাসক দলের এক দাপুটে মন্ত্রীকে সভাপতি করে, তবে সে ব্যাপারে আমার কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই ।

রাজনীতি বা ইউনিয়ন আমার আলোচ্য নয় আপাতত । আমি লিখতে চলেছি আমার নানা অভিজ্ঞতার কথা। দীর্ঘ ৩৪ বছর এই বৃত্তিতে ছিলাম । একবারের জন্যও মনে হয় নি, এটা আমার যোগ্য কাজ নয় বা দায়ে পড়ে করছি ।

খুব উপভোগ করতাম আমার এই বৃত্তিকে অবাক করার মত অনেক ব্যাপার ছিল।

সাধারণ লোকে ভাবতো, এমন কি ডাক্তার বাবু থেকে শুরু করে পাইকারি বা খুচরো ওষুধ বিক্রেতা- এই সব ছেলেরা ( তখনও মহিলারা এই বৃত্তিতে আসেন নি ) বাপে খ্যাদানো, মায়ে তাড়ানো ।

মদ খায় ( যেন অন্য কেউ খায় না !! ), নারী মাংস লোলুপ , জুয়ার প্রতি আসক্ত এরকম আরও অনেক কিছু ।

আমার বাবা এই চাকরী পাওয়ার কথা শুনে বলেছিলেন - তুই এর চেয়ে , মুচীর কাজ করলে পারতিস । তারা অনেক সন্মান জনক কাজ করে ।

ব্যাপারটা  পুরোপুরি মিথ্যে  ছিল না, কারণ সেই অবস্থা কিছু তো ছিলই ।  কোম্পানির জুলুম সেলস টার্গেট পূরণ করার জন্য, আর একদিকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এই ছিল তখনকার বেচু বাবুদের অবস্থা ।

বিভিন্ন শহরে রেস্ট হাউসতৈরি হলো ( এখনও আছে ) , কারণ হোটেল খুব খরচা সাপেক্ষ । কোম্পানি যে অ্যালাউন্স দেয়, সেটতে ঠিক পোষাতো না ।

টিএ বিল থেকে পয়সা তোলার একটা উপায়ও ছিল তাতেও কুলিয়ে ওঠা যেত না ।

রেস্ট হাউসের ফাণ্ডাটা সেই থাকা খাওয়ার সুলভ বন্দোবস্ত করার চেষ্টায় আবির্ভূত হলো । সেই শহরে ইউনিয়নের একটা আপিস ঘরও হবে- রেস্ট হাউস ।

আমার বা আমার পূর্ববর্তী আমলে তথাকথিত বিদেশী কোম্পানির রমরমা ছিল । দেশীয় কোম্পানিও ছিল, কিন্তু হাতে গোণা ।
বিদেশী কোম্পানির ছেলেদের একটা আপার্থয়েডপলিসি থাকতো । দেশী কোম্পানির লোকেদের দিকে ছিল একটা অনুকম্পা ।
কারন  সেই বিদেশী কোম্পানির ছেলেরা তুলনায় বেশী মাইনেতে চাকুরীরত । প্রথম দিকে তো এই সব ছেলেরা রেস্ট হাউস এড়িয়েই চলতো, কারন এদেশীয় ছেলেদের সাথে থাকলে জাতযাবে  ।

অবস্থার পরিবর্তন শুরু হলো- সত্তরের দশক থেকে । পশ্চিম বাংলায় তখন টালমাটাল অবস্থা । চাকরী প্রায় নেই । আবার থাকলেও, পুলিশ ভেরিফিকেশনের ঝামেলা । অধিকাংশই তখন বাম আন্দোলনে যুক্ত বলে, পুলিশ তাদের ভালো চোখে দেখতো না। সেই হিসেবে কোম্পানি গুলোতে চাকরি পাওয়া অনেক সোজা । একটু বলিয়ে কইয়ে হলেই চাকরীটা পাওয়া যেত ।
একটা কারণ আমার মাথায় আজও ঢোকে না, কোম্পানি কিন্তু জেনে শুনেই এই সব ছেলেদের চাকরী দিত ।

কেন দিতো ?
বোধহয় ধারণা ছিল, ডাক্তারদের চমকে এরা ওষুধ লেখাতে পারবে । ঘটনা যেটা, সেটা হলো চমকাতো কিনা জানি না, তবে এই সব ছেলেরা তাদের টার্গেট কিন্তু সহজেই পূরণ করতে পারতো ।

তাই এদের চাহিদা কোম্পানিগুলোতে তুঙ্গে ছিল । ঠিক এদের ওপরেই ছিল সুপারভাইজারএখন যাদের ফার্স্ট লাইন ম্যানেজার বলা হয় ।

অফিসিয়ালি এদের কাজ ছিল বেচুবাবুদের কাজের তদারকি করা ।  বাস্তবে যেটা হতো, ত্যালানি না পেলে চাকরি যখন তখন খেয়ে নিতো ।
চালু কথায়, এদের বসবলা হতো ।

আমি যতদূর জানি এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে প্রথম নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া হয়, সেটা হল- ওডিশার কটকে ।

বস পেটাইঅভিযানের শুরু এই কটকেই । একদিন রাতের বেলায় চন্দন এসে বলল- বস মাল খাওয়াতে বলল । আমি বললাম, মাইনে পাই নি । ব্যস্   ! বস আমাকে খস খস করে লিখে এই চিঠি দিয়ে বলল ইউ আর টারমিনেটেড ফ্রম দ্য জব , বিকজ ইউ আর নট পারফর্মিং ইউর ডিউটি প্রপারলি ।

আমি অনেক কাকুতি মিনতি করলে, বলল একটা বোতল দে তারপর অন্য কথা ।

আমি কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছি রেস্ট হাউসে  । বাড়ীতে অসুস্থ মা আর অবিবাহিতা বোন । বাবা নেই, চাকরি গেলে খাবো কি ?

চট জলদি সিদ্ধান্ত । আমরা কয়েকজন মিলে চললাম, সেই হোটেলে ।  রুমের দরজায় ঠক ঠক করে খোলালাম ।

র‌্যাভেনশ্য কলেজের কাছে প্রকাশ্য রাস্তায় রাত বারোটা পর্যন্ত চললো বেদম ক্যালানি আর খিস্তি ওই বসকে ।

এক বর্ধমানের দাদা বলেছিল- খিস্তি আর ক্যালানির বিকল্প হয় না এই সব লোকেদের ক্ষেত্রে ।

টহলদার পুলিসরা কিছুটা হলেও চিনতো আমাদের কয়েকজনকে । কারণ জিজ্ঞেস করাতে, আমি ওডিয়াতে  সংক্ষেপে খুলে  বললাম ঘটনাটা ।

ওদের সাব ইন্সপেক্টরও ক্ষেপে গিয়ে দু তিনটি রুলের বাড়ি লাগালো সেই বসকে । পরে জেনেছিলাম, সেই সাব ইন্সপেক্টরের দাদাও এই রকম ঘটনার শিকার, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে নি তখন । এক সমকালে সংঘটন শীল ঘটনা এবং অদ্ভুত সমাপতন ।
বসটি ক্যালানি খেয়ে  টার্মিনেশন লেটার তুলে নিলে এবং মুচলেকাও দিল, যে ব্যাপারটা সে করেছে তার পূর্ণ বয়ান, পুলিশ ষ্টেশনে বসে ।

পরে সেই কপি পাঠাতে সেই বসের চাকরী চলে গিয়েছিল । যদিও সে পরে অন্য কোম্পানিতে যোগ দিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করে । চন্দনও বেঁচে যায় ।


নীট ফল বিদেশী কোম্পানির ছেলেরাও বুঝলো দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ ।



---------------------------------
আমি তখন কটক ওয়াই এম সি এ তে থাকি । বাবা টাকা পাঠান, কিন্তু তাঁর অবসরের সময় চলে আসছে ।  বালেশ্বরের বাড়ীতে দুই ভাই এবং বোন । এই তিনজনেরও পড়াশোনার খরচের এক বিরাট ধাক্কা সামলাতে হয় বাবাকে ।
নিজেকে বড় অসহায় বোধ করছি । একটা অর্থকরী ব্যাপার না হলে তো বড় মুশকিল। টিউশনি পেলাম তিন চারটে । বাড়ীতে বারণ করে দিলাম, টাকা পাঠাতে । বাবার কাছে টাকা পাঠাতে না পারি, অন্তত নিজের খরচটুকু চালিয়ে নিতে পারবো ।
মাঝে মধ্যে  র‌্যভেনশ্য কলেজ চত্বরে যাই ।  আমারই সহপাঠী হেমন্ত বলে একটি ছেলে তখন বাজারে সদ্য আসা অটো চালাতে শুরু করেছে । চাকরীর বাজার এতই খারাপ ।
তবুও আড্ডা হয় কলেজ চত্বরে । একদিন দেখি আমাদের অন্য এক সহপাঠী ভাস্কর পট্টনায়ক এক চকচকে ঢাউস পেটমোটা বাদামী ব্যাগ সহ , টাই পরে  আড্ডায় হাজির ।
এসেই -  আড্ডায় হাজির সকলের জন্য ফুল কাপ চা, পরোটা তরকারি আর একটা করে ক্যাপষ্টান সিগারেটের অর্ডার দিল ।
এসব দেখে আমরা প্রত্যেকে একজন করে মূকাভিনয়ের  চরিত্রের মত চিত্রার্পিত । বেশ খানিক পরে, হেমন্ত  জিজ্ঞেস করল তালে তুই চাকরী পেলি ?  ( হেলে, তুঅর চাকিরিখণ্ডে মিলি গলা ? )
ভাস্কর টাইয়ের নট টা আলগোছে ডান হাত দিয়ে একটু নাড়া চাড়া করে বলল-  হ্যাঁ ( হঁ)
আড্ডার মেয়েরাও অন্য টেবিল থেকে ভাস্করের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে  । স্বয়ং শাম্মি কাপুর বা দেবানন্দ্ যেন সামনে বসে আছেন । ভাস্কর এমনিতেই দেখতে         ভারি সুন্দর ছিল, কিন্তু এতদিন বোধহয় সেটা মেয়েদের চোখে পড়ে নি ।
চোখে না পড়ারও কথা । মেয়েরা সেভাবে ছেলেদের সঙ্গে মিশতো না ওডিশায় । আড্ডা তো অনেক দূরের কথা  । তবুও যে কজন আসতো, তারা দুঃসাহসী বলেই পরিচিত ছিল ।
ভাস্করকে জিজ্ঞাসা করা হলো- তুই কি চাকরি পেলি ? ( ততে  কোওন চাকিরই   মিলিলা কি ?)
ঘাড়টা শাম্মি কাপুরের মত হেলিয়ে উত্তর দিলো :- মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ।
আমাদের সমবেত আর্তনাদ ( মেয়েরা ছাড়া ) আমোকু  মিলিব নাহি ? ( আমরা পাবো না?)
ভাস্কর এবারে উত্তমকুমারের মত ভুবন মোহিনী হাসি দিল :- সে অনেক ঝঞ্ঝাট ।
কি রকম কি রকম ?
প্রথমে যেতেই তারা আমাকে একটা ঘরে ঢোকালো । সেই ঘরে চারিদিক দিয়ে জল পড়ছে বৃষ্টির মত । আমি ভিজেই যাচ্ছি   । অনেক ক্ষণ পর বের করে নিয়ে আর একটা ঘরে ঢোকালো । প্রচণ্ড গরমে পুড়ে যাচ্ছি মনে হলো । কতক্ষণ জানিনা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছি, এই সময় আমায় বের করে আর একটা ঘরে ঢোকানো হল ।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মনে হলে জমে যাবো  । এবারে আমাকে বের করে একজন বললেন :- মিঃ পট্টনায়ক, ইউ হ্যাভ সাকসেসফুলি পাসড ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কেন এবং কি ভাবে স্যার ?
আরে, রোদে বৃষ্টি- ঠাণ্ডায় তোমাকে কাজ করতে হবে  । সেটা পারো কিনা, তার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম  । তুমি সফল ।
তোর কোম্পানির নাম কি ? আমার কাতর জিজ্ঞাসা
বারোজ ওয়েলকাম
মানে ?
ফার্স্ট বরো দেন ওয়েলকাম
কথা গুলো বলে ভাস্কর বিল মিটিয়ে চলে গেল ।
হেমন্ত হতাশ হয়ে বলল :- ধ্যাত্ ! অটোই চালাবো । কয়জন আর এমএসসি পাশ করেঅটো চালায় বল দিকি ?
আঙুর ফল টক ( মনে মনে ভেবে ) সবাই বললাম ---- হঁহঁ হঁ !!! 

No comments: