ওষুধের বেচু বাবু, মানে যাদের পোষাকী নাম- মেডিক্যাল
রিপ্রেজেন্টেটিভ, তাদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রায় কিছুই লেখা হয় নি ।
কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেখা আছে বটে, কিন্তু সেগুলো পড়ে
বেচুবাবুদের সঠিক বোঝা যাবে না ।
বেচু বাবুদের কাজটা হলো প্রথমে ডাক্তারদের মধ্যে, আমার কোম্পানির ওষুধ কত “ভালো” সেটা
প্রচার করা । তারপর খুচরো বিক্রেতার দোকানে গিয়ে খোঁজ নেওয়া আমার কোম্পানির
ওষুধ চলছে কিনা , চললে কোন
কোন ডাক্তার বাবু লিখছেন – তার সম্বন্ধে খবরাখবর নেওয়া ।
এর পরে সেই দোকান থেকে অর্ডার নিয়ে ( দিলে ) স্থানীয় বিতরকের
( ষ্টকিষ্ট)কাছে পৌঁছে দেওয়া পরিবর্তে সেই বিতরকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে
কোম্পানির ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজের বেঁধে দেওয়া
সেলস টার্গেট পূরণ করা ।
টার্গেট পূরণ হলে এক্সট্রা ইনসেন্টিভ বা বোনাস মিলত একটা
মোটা অঙ্ক । তাই, টাকা কামানোর তাগিদে এই কাজগুলো নিজের স্বার্থেই করতে
হতো ।
হ্যাঁ ! ইউনিয়নও ছিল ।
সারা ভারত ব্যাপী প্রথমে একটাই ইউনিয়ন ছিল সিটু সমর্থিত , পরে নানা মতভেদে আরও একটা ইউনিয়ন হয় রাজনীতির কোনো রঙ না রেখে ।
এখন শুনছি আরও একটা ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে বর্তমান শাসক দলের এক
দাপুটে মন্ত্রীকে সভাপতি করে, তবে সে ব্যাপারে আমার কোনো স্বচ্ছ
ধারণা নেই ।
রাজনীতি বা ইউনিয়ন আমার আলোচ্য নয় আপাতত । আমি লিখতে চলেছি
আমার নানা অভিজ্ঞতার কথা। দীর্ঘ ৩৪ বছর এই বৃত্তিতে ছিলাম । একবারের জন্যও মনে হয়
নি, এটা আমার যোগ্য কাজ নয় বা দায়ে পড়ে করছি ।
খুব উপভোগ করতাম আমার এই বৃত্তিকে । অবাক করার মত অনেক ব্যাপার ছিল।
সাধারণ লোকে ভাবতো, এমন কি
ডাক্তার বাবু থেকে শুরু করে পাইকারি বা খুচরো ওষুধ বিক্রেতা- এই সব ছেলেরা ( তখনও
মহিলারা এই বৃত্তিতে আসেন নি ) বাপে খ্যাদানো, মায়ে
তাড়ানো ।
মদ খায় ( যেন অন্য কেউ খায় না !! ), নারী মাংস
লোলুপ , জুয়ার প্রতি আসক্ত এরকম আরও অনেক কিছু ।
আমার বাবা এই চাকরী পাওয়ার কথা শুনে বলেছিলেন - তুই এর চেয়ে
, মুচীর কাজ করলে পারতিস । তারা অনেক সন্মান জনক কাজ করে ।
ব্যাপারটা পুরোপুরি
মিথ্যে ছিল না, কারণ সেই
অবস্থা কিছু তো ছিলই । কোম্পানির জুলুম
সেলস টার্গেট পূরণ করার জন্য, আর একদিকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন –এই ছিল তখনকার বেচু বাবুদের অবস্থা ।
বিভিন্ন শহরে “ রেস্ট হাউস” তৈরি হলো ( এখনও আছে ) , কারণ হোটেল খুব খরচা সাপেক্ষ ।
কোম্পানি যে অ্যালাউন্স দেয়, সেটতে ঠিক পোষাতো না ।
টিএ বিল থেকে পয়সা তোলার একটা উপায়ও ছিল । তাতেও কুলিয়ে ওঠা যেত না ।
রেস্ট হাউসের ফাণ্ডাটা সেই থাকা – খাওয়ার
সুলভ বন্দোবস্ত করার চেষ্টায় আবির্ভূত হলো । সেই শহরে ইউনিয়নের একটা আপিস ঘরও হবে-
রেস্ট হাউস ।
আমার বা আমার পূর্ববর্তী আমলে তথাকথিত বিদেশী কোম্পানির
রমরমা ছিল । দেশীয় কোম্পানিও ছিল, কিন্তু হাতে গোণা ।
বিদেশী কোম্পানির ছেলেদের একটা “আপার্থয়েড” পলিসি থাকতো । দেশী কোম্পানির লোকেদের দিকে ছিল একটা অনুকম্পা ।
কারন সেই বিদেশী
কোম্পানির ছেলেরা তুলনায় বেশী মাইনেতে চাকুরীরত । প্রথম দিকে তো এই সব ছেলেরা
রেস্ট হাউস এড়িয়েই চলতো, কারন এদেশীয় ছেলেদের সাথে থাকলে “জাত” যাবে ।
অবস্থার পরিবর্তন শুরু হলো- সত্তরের দশক থেকে । পশ্চিম
বাংলায় তখন টালমাটাল অবস্থা । চাকরী প্রায় নেই । আবার থাকলেও, পুলিশ ভেরিফিকেশনের ঝামেলা । অধিকাংশই তখন বাম আন্দোলনে যুক্ত বলে, পুলিশ তাদের ভালো চোখে দেখতো না। সেই হিসেবে কোম্পানি গুলোতে চাকরি পাওয়া অনেক
সোজা । একটু বলিয়ে কইয়ে হলেই চাকরীটা পাওয়া যেত ।
একটা কারণ আমার মাথায় আজও ঢোকে না, কোম্পানি
কিন্তু জেনে শুনেই এই সব ছেলেদের চাকরী দিত ।
কেন দিতো ?
বোধহয় ধারণা ছিল, ডাক্তারদের চমকে এরা ওষুধ লেখাতে
পারবে । ঘটনা যেটা, সেটা হলো – চমকাতো কিনা জানি না, তবে এই সব ছেলেরা তাদের টার্গেট কিন্তু সহজেই পূরণ করতে পারতো ।
তাই এদের চাহিদা কোম্পানিগুলোতে তুঙ্গে ছিল । ঠিক এদের
ওপরেই ছিল “ সুপারভাইজার” । এখন যাদের ফার্স্ট লাইন ম্যানেজার
বলা হয় ।
অফিসিয়ালি এদের কাজ ছিল বেচুবাবুদের কাজের তদারকি করা ।
বাস্তবে
যেটা হতো, ত্যালানি না পেলে চাকরি যখন তখন খেয়ে নিতো ।
চালু কথায়, এদের “বস” বলা হতো ।
আমি যতদূর জানি এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে প্রথম নিজের হাতে
আইন তুলে নেওয়া হয়, সেটা হল- ওডিশার কটকে ।
“ বস পেটাই” অভিযানের শুরু এই কটকেই । একদিন রাতের বেলায় চন্দন এসে বলল- বস মাল খাওয়াতে
বলল । আমি বললাম, মাইনে পাই নি । ব্যস্ ! বস আমাকে খস খস করে লিখে এই চিঠি দিয়ে বলল – ইউ আর টারমিনেটেড ফ্রম দ্য জব , বিকজ ইউ আর নট পারফর্মিং ইউর ডিউটি
প্রপারলি ।
আমি অনেক কাকুতি মিনতি করলে, বলল – একটা বোতল দে তারপর অন্য কথা ।
আমি কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছি রেস্ট হাউসে । বাড়ীতে অসুস্থ মা আর অবিবাহিতা বোন । বাবা
নেই, চাকরি গেলে খাবো কি ?
চট জলদি সিদ্ধান্ত । আমরা কয়েকজন মিলে চললাম, সেই হোটেলে । রুমের দরজায় ঠক ঠক করে
খোলালাম ।
র্যাভেনশ্য কলেজের কাছে প্রকাশ্য রাস্তায় রাত বারোটা
পর্যন্ত চললো – বেদম ক্যালানি আর খিস্তি ওই বসকে ।
এক বর্ধমানের দাদা বলেছিল- খিস্তি আর ক্যালানির বিকল্প হয়
না এই সব লোকেদের ক্ষেত্রে ।
টহলদার পুলিসরা কিছুটা হলেও চিনতো আমাদের কয়েকজনকে । কারণ
জিজ্ঞেস করাতে, আমি ওডিয়াতে
সংক্ষেপে খুলে বললাম ঘটনাটা ।
ওদের সাব ইন্সপেক্টরও ক্ষেপে গিয়ে দু তিনটি রুলের বাড়ি
লাগালো সেই বসকে । পরে জেনেছিলাম, সেই সাব ইন্সপেক্টরের দাদাও এই রকম
ঘটনার শিকার, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে নি তখন । এক সমকালে সংঘটন
শীল ঘটনা এবং অদ্ভুত সমাপতন ।
বসটি ক্যালানি খেয়ে
টার্মিনেশন লেটার তুলে নিলে এবং মুচলেকাও দিল, যে
ব্যাপারটা সে করেছে তার পূর্ণ বয়ান, পুলিশ ষ্টেশনে বসে ।
পরে সেই কপি পাঠাতে সেই বসের চাকরী চলে গিয়েছিল । যদিও সে
পরে অন্য কোম্পানিতে যোগ দিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করে । চন্দনও বেঁচে যায় ।
নীট ফল – বিদেশী কোম্পানির ছেলেরাও বুঝলো – দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ ।
---------------------------------
আমি তখন কটক ওয়াই এম
সি এ তে থাকি । বাবা টাকা পাঠান, কিন্তু তাঁর অবসরের সময় চলে আসছে
। বালেশ্বরের বাড়ীতে দুই ভাই এবং বোন । এই
তিনজনেরও পড়াশোনার খরচের এক বিরাট ধাক্কা সামলাতে হয় বাবাকে ।
নিজেকে বড় অসহায় বোধ
করছি । একটা অর্থকরী ব্যাপার না হলে তো বড় মুশকিল। টিউশনি পেলাম তিন চারটে ।
বাড়ীতে বারণ করে দিলাম, টাকা পাঠাতে । বাবার কাছে টাকা
পাঠাতে না পারি, অন্তত নিজের খরচটুকু চালিয়ে নিতে
পারবো ।
মাঝে মধ্যে র্যভেনশ্য কলেজ চত্বরে যাই । আমারই সহপাঠী হেমন্ত বলে একটি ছেলে তখন বাজারে
সদ্য আসা অটো চালাতে শুরু করেছে । চাকরীর বাজার এতই খারাপ ।
তবুও আড্ডা হয় কলেজ
চত্বরে । একদিন দেখি আমাদের অন্য এক সহপাঠী ভাস্কর পট্টনায়ক এক চকচকে ঢাউস পেটমোটা
বাদামী ব্যাগ সহ , টাই পরে আড্ডায় হাজির ।
এসেই - আড্ডায় হাজির সকলের জন্য ফুল কাপ চা, পরোটা তরকারি আর একটা করে ক্যাপষ্টান সিগারেটের অর্ডার দিল ।
এসব দেখে আমরা
প্রত্যেকে একজন করে মূকাভিনয়ের চরিত্রের
মত চিত্রার্পিত । বেশ খানিক পরে, হেমন্ত জিজ্ঞেস করল – তালে
তুই চাকরী পেলি ? ( হেলে, তুঅর চাকিরিখণ্ডে মিলি গলা ? )
ভাস্কর টাইয়ের নট টা
আলগোছে ডান হাত দিয়ে একটু নাড়া চাড়া করে বলল-
হ্যাঁ ( হঁ)
আড্ডার মেয়েরাও অন্য
টেবিল থেকে ভাস্করের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে
। স্বয়ং শাম্মি কাপুর বা দেবানন্দ্ যেন সামনে বসে আছেন । ভাস্কর এমনিতেই
দেখতে ভারি সুন্দর ছিল, কিন্তু এতদিন বোধহয় সেটা মেয়েদের চোখে পড়ে নি ।
চোখে না পড়ারও কথা ।
মেয়েরা সেভাবে ছেলেদের সঙ্গে মিশতো না ওডিশায় । আড্ডা তো অনেক দূরের কথা । তবুও যে কজন আসতো, তারা
দুঃসাহসী বলেই পরিচিত ছিল ।
ভাস্করকে জিজ্ঞাসা করা
হলো- তুই কি চাকরি পেলি ? ( ততে কোওন চাকিরই
মিলিলা কি ?)
ঘাড়টা শাম্মি কাপুরের
মত হেলিয়ে উত্তর দিলো :- মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ।
আমাদের সমবেত আর্তনাদ
( মেয়েরা ছাড়া ) – আমোকু মিলিব নাহি ? ( আমরা পাবো না?)
ভাস্কর এবারে
উত্তমকুমারের মত ভুবন মোহিনী হাসি দিল :- সে অনেক ঝঞ্ঝাট ।
কি রকম কি রকম ?
প্রথমে যেতেই তারা
আমাকে একটা ঘরে ঢোকালো । সেই ঘরে চারিদিক দিয়ে জল পড়ছে বৃষ্টির মত । আমি ভিজেই যাচ্ছি । অনেক ক্ষণ পর বের করে নিয়ে আর একটা ঘরে
ঢোকালো । প্রচণ্ড গরমে পুড়ে যাচ্ছি মনে হলো । কতক্ষণ জানিনা প্রায় অজ্ঞান হয়ে
পড়েছি, এই সময় আমায় বের করে আর একটা ঘরে ঢোকানো হল ।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মনে
হলে জমে যাবো । এবারে আমাকে বের করে একজন
বললেন :- মিঃ পট্টনায়ক, ইউ হ্যাভ সাকসেসফুলি পাসড ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম-
কেন এবং কি ভাবে স্যার ?
আরে, রোদে –বৃষ্টি- ঠাণ্ডায় তোমাকে কাজ করতে হবে । সেটা পারো কিনা, তার
পরীক্ষা নিচ্ছিলাম । তুমি সফল ।
তোর কোম্পানির নাম কি ? আমার কাতর জিজ্ঞাসা
বারোজ ওয়েলকাম
মানে ?
ফার্স্ট বরো দেন ওয়েলকাম
কথা গুলো বলে ভাস্কর
বিল মিটিয়ে চলে গেল ।
হেমন্ত হতাশ হয়ে বলল
:- ধ্যাত্ ! অটোই চালাবো । কয়জন আর এমএসসি পাশ করে, অটো চালায় বল দিকি ?
আঙুর ফল টক ( মনে মনে
ভেবে ) সবাই বললাম ---- হঁহঁ হঁ !!!
No comments:
Post a Comment