বেচু বাবুদের কয়েকটা কমন টার্ম আছে
। শুধু ওষুধের বেচু নয়, এটা বিভিন্ন পণ্য বিক্রয় প্রতিনিধিরাও ব্যবহার করেন ।
আগে, সে গুলো নিয়ে বলা যাক :-
হেডকোয়ার্টার :- যে জায়গাকে বেস
করে একজন বেচু কাজ করবে ।
এরিয়া :- হেডকোয়ার্টার থেকে কোন
কোন জায়গায় যাবে, সেই বেচু ।
এক্স ষ্টেশন :- হেডকোয়ার্টার থেকে
কোনো জায়গায় গিয়ে কাজ করে আবার ফিরে আসা ।
আউট ষ্টেশন :-হেডকোয়ার্টার থেকে
কোনো জায়গায় গিয়ে সেখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে কাজ করা ।
অ্যালাউন্স :- ছুটির দিন এবং রবিবার বাদে, সব জায়গায় কাজ
করার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা থাকে ।
ট্র্যাভেলিং অ্যালাউন্স :- কোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য যাতায়াত
ভাড়া দেওয়া হয় ।
আগে, ট্রেনে গেলে ফার্ষ্ট ক্লাসের ভাড়া দেওয়া হত । এখন , ক্ষেত্র
বিশেষে এসি, থ্রিটায়ার অথবা কিলোমিটার পিছু
একটা নির্দ্দিষ্ট টাকা ধার্য করা থাকে । অবশ্য অনেক কোম্পানি ফার্ষ্ট ক্লাস
দিতো না ।
এছাড়াও পোষ্টাল চার্জ ( এখন ইনটারনেট চার্জও দেওয়া হয় ,
শুনেছি ), খাম, পেন, এরকম অনেক জিনিস কেনার জন্য টাকা দেওয়া হতো বা হয়, কেনার রসিদ
জমা দিলে ।
প্রত্যেক পনেরো বা এক মাস অন্তর টিএ বিল জমা দিতে হতো/ হয়
একটা ফর্ম ভরে । সেই টাকা চলে আসে সাধারণত মাইনের সাথে আলাদা ভাবে ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট
, মানি ট্রান্সফার এবং এখন সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ।
একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ডাক্তার/ কেমিষ্ট বা এফএমসিজি (
ফাষ্ট মুভিং কনজিউমার গুডস্) বেচুদের দেখতেই হবে প্রতিদিন ।
দেখে এসে একটা ফর্মে সেই নাম গুলো ভরে রিপোর্ট লিখতে হবে,
হয় ফর্মে বা এখন ইন্টারনেটের প্রোফোর্মাতে ।
অনেক কোম্পানিতে খালি ফর্মে ভরে লিখিত ভাবেই পাঠান বেচুরা,
একটা সহমত পোষণ করে ইউনিয়ন ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ।
ওষুধ বেচুদের প্রতি বছর একটা করে নতুন লিষ্ট বানাতে হয়
ডাক্তার বাবু এবং সেই এরিয়ার কেমিষ্টদের এবং অন্যদের ক্ষেত্রে :- দোকান বা
কাষ্টমারের ।
সেই লিষ্ট ধরে কাজ করতে হয় সারা আর্থিক বছর । প্রযোজনে চিঠি
দিয়ে অদল বদল করা যায় কোম্পানিকে জানিয়ে ।
মোটামুটি ভাবে আপনাদের একটা ধারণা দিলাম ।
পরে যাবো, বিভিন্ন ঘটনায় । কোনোটা হাসির, কোনোটা বা দুঃখের
বা অধিকারের লড়াই এবং বঞ্চনা আর কাজের ফাঁকির ( যে কাজে আমি অত্যন্ত দড় ছিলাম )।
এই কাজের ফাঁকির একটা পোষাকী নাম আছে – গুবলু ।
=========================
=========================
এই বেচু বাবুদের ছিল, দুটো শ্রেণী বিভাজন । একদল- ওষুধ বেচতো
আর এক দল কনজিউমার প্রোডাক্ট বা আজকাল যেটাকে বলে ফাষ্ট মুভিং কনজিউমার
গুডস ( এফ এম সি জি ) ।
দুটো আলাদা রেষ্ট হাউস
এই বেচু বাবুদের । একে অপরকে টেক্কা
দেওয়ার প্রবণতা মারাত্মক ভাবে বিদ্যমান।
এরা ভাবে পেশাগত ভাবে
আমরা বড়, আর ওরা ভাবে ঠিক উল্টোটা । তবে, একটা জিনিস এদের মধ্যে ছিল, সেটা হলো নিজেদের কোনো ওষুধ দরকার
হলে ওরা ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেনটেটিভদের
কাছে আসতো আর এরা নিজেদের প্রয়োজন মত কোনো জিনিস কিনতে হলে ওদের শরণাপন্ন হতো ।
ওষুধ তো ফ্রি মিলতোই, আর তেমন হলে কনজিউমার প্রোডাক্টের স্যাম্পেল জুটে যেত মুফতে বা ৫০ %
ডিসকাউন্টে ।
এই আদান প্রদানের
মধ্যেই গড়ে উঠলো এক হওয়ার প্রবণতা । ভারত বর্ষের সব জায়গাতেই এটা ঘটছিল একসাথে ।
“বস
পেটাই” একটা আলাদা মাত্রা এনে দিল এই দুদলের মধ্যে ।
ইতিমধ্যে, কিছু সচেতন ছেলে যোগ দিয়েছে এই বৃত্তিতে । রেষ্ট হাউস
এবং ইউনিয়ন এক হলো ।
আমি যেভাবে অল্প কথায়
সারলাম ঘটনাটা, সেটা কিন্তু সেভাবে ঘটে নি । নানা স্বার্থ, টিক্রমবাজী পেরিয়ে এক হয়েছিল এই দুই দল । অনেক সময় লেগেছিল এক হতে ।
এক তো হলো, গোলোযোগ বাধলো পশ্চিম বঙ্গের বাইরে যেতেই ! মিলিত হবার এবং কোম্পানীর
স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে যখন সরব হওয়ার আহ্বান নিয়ে ছড়িয়ে পড়া হলো ভারতের বিভিন্ন
প্রধান শহরে এবং প্রায় প্রত্যেকের দুয়ারে, তখন
বিরোধিতা এলো পরিবারের পক্ষ থেকে ।
তাঁরা বলতে লাগলেন, কোম্পানী আমাদের “ভাত” দেয়
,
সেই কোম্পানীর বিরুদ্ধে বেইমানী করা “ বঙালি বাবু” দের সাজে । এটা আমাদের সাজে না ।
না, আমি কোন প্রাদেশিকতার কথা বলছি না, এই ঘটনার শুরু
পশ্চিমবঙ্গ থেকেই । নিজের ঘরের ছেলেটা ডাক্তার হতে পারে নি, হতে পারে নি ইঞ্জিনিয়ার !! তাও তো গলায় “ টাই” ঝুলিয়ে সরকারী চাকুরেদের থেকে বেশী পয়সা আনছে
! তখন খুঁচিয়ে ঘা করা কেন বাপু ?
ছেলেও বহিরঙ্গের কথা
পরিবারকে জানায় , কিন্তু
বলতে পারে না, তাকে রোজ ১০ বোতল রক্ত ঝরাতে হয়, নিজের চাকরীটা রাখতে ।
রাতে শুতে যাবার সময়, একান্তে ভাবে :- যাক! আজকের দিনের মত আমার চাকরীটা থাকলো ।
অন্য অঙ্গ রাজ্যে আবার
ভিন্ন সমস্যা । যে সব ঘর থেকে এই বেচু বাবুরা আসতো তখনকার দিনে, তাদের পরিবারে কোনো না কোনো ব্যাবসা/ধান্ধা আছে । সেখানে আবার চাকরি না করলে
বিয়ের বাজারে দর ওঠে না বা সমাজে কল্কে পাওয়া বড় কঠিন ।
টাই ঝুলিয়ে ছেলে যখন
বাড়ীর গাড়ী নিয়ে হুস করে বেরিয়ে যেত অন্য লোকেদের ঈর্ষাকাতর চোখকে উপেক্ষা করে, তখন পরিবার পরিজনের বুক গর্বে ভরে উঠতো ।
এরা করবে, কুলি কামিনদের মত ইউনিয়ন ????? ছ্যা ছ্যা ! ইজ্জত কা সওয়াল !
চাকরী গেলেও এদের দুঃখ
ছিল না, কারণ ততদিনে বিয়ে হয়ে গিয়ে দো/তিন পেটি ডাউরি মিল গয়া
। চলো বরখুরদার, কোই বাত নেহি ! ইস পয়সে মেঁ দুসরা
কোই ধান্দা ঢুঁঢ লে ।
আর না গেলেও “ বসের” পা ধরে মালিস করাটা অবশ্য কর্তব্য । আরও আছে, কিন্তু সে সব ন্যাক্কার জনক কথায় আর গেলাম না ।
এর ওপরে ছিল চুকলি
বাজী । ধরুন আপনি কোনো একটা চিঠি দিলেন কোনো সহকর্মীকে, তারই বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া একটা মিথ্যে কথার স্বপক্ষে লড়ার জন্য ।
অম্লান বদনে সেই চিঠি
তুলে দিত সেই সহকর্মী, কর্তৃপক্ষের হাতে নিজের পিঠ
বাঁচতে।
বলির পাঁঠা তখন আর সে
থাকতো না । এসব ভাবতেও গায়ে এখনও কাঁটা দেয় ।
এসব ঘটনা ঘটেছে খোদ
আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে । এই ভাবে ভাঙতে
জুড়তে যখন একটা ঐক্যের চেহারা এলো, তখনই ঢুকলো সূক্ষ্ম
ভাবে রাজনীতি ।
ততদিনে পশ্চিম বঙ্গে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট । এই বেচু বাবুদের ফন্টে ঢুকতে হবে, যে করেই হোক , এটাই ছিল ধ্যান জ্ঞান ।
শিক্ষিত সব ছেলেদের
একসাথে পাওয়াটা তো লটারি পাওয়া ! যারা এই
বৃত্তির প্রাথমিক নিয়ম কানুনটুকুও জানেন না, তাঁরাই
হয়ে দাঁড়ালেন ইউনিয়নের হর্তা কর্তা ।
নাম করছি না, তবে এর আগেই এক বিখ্যাত বড়
কোম্পানীর প্রতিনিধিকে বিনা কারণে বিহার
থেকে বদলী করা হয়েছিল ওডিশায় । পরে, আন্দোলনের চাপে সেই
কোম্পানি পিছু হটে ।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায়
আসার পর , তাকে সামনে রেখে, বামফ্রন্ট ঝাঁপিয়ে পড়লো এই বেচু বাবুদের জায়গায় ।
আমরাও বোকার মত “ শ্রমিকের স্বার্থ” আদায়ের জন্য লড়ে যেতে লাগলাম ।
আমরা কেউ বুঝলাম না, কেন একটা লোক যে খুব সামান্য টাকা পায়, তাকে
জোর করে আনা হবে মিটিং মিছিলে অন্য বড় কোম্পানির টাকা বাড়ানোর আন্দোলনে ????
যাঁরা বুঝেছিলেন, তাঁরা ভেতরে অনেক লড়েও যখন সুরাহা করতে পারলেন না, তখন
আর একটা ইউনিয়ন করে ফেলেছিলেন এর আগেই, বিনা রাজনৈতিক রঙে, কিন্তু এখানেও নেতৃত্বের লোভে অযোগ্য
চুকলি খোর লোকেরা এসে গেল ।
কয়েকজন বাদে
নেতৃত্বের অনেকেই পাল্টে গেলেন । মুখে বিভিন্ন শ্রমিক দরদী কথা, আর ভেতরে কোম্পানির হয়ে দালালি ।
দুটো ইউনিয়নেই একই
ব্যাপার ! ছাপ আলাদা । বেচু বাবুদের কথা ভুলে এরা হয়ে দাঁড়াল পরস্পরের ঘোর শত্রু ।
লিখতে লিখতে সময়ের হের
ফের হয়ে যাচ্ছে ঘটনার, কিন্তু মোটামুটি ঘটনাটা এই ।
No comments:
Post a Comment