Pages

Monday, November 10, 2014

সাফল্য

যে সময়ের কথা বলছি, তখন ষ্টীম এঞ্জিন পুরো মাত্রায় চালু ভারতীয় রেলে । কয়লা যারা ভরতো এঞ্জিনে , তাদের একটা ইউনিয়ন ছিল- কোল অ্যাণ্ড আসেজ ইউনিয়ন বা ওইরকমই একটা কিছু, এখন সঠিক মনে নেই ।
একটা মই বেয়ে, মাথায় ঝাঁকা ভরতি কয়লা নিয়ে ফেলতে হতো এঞ্জিনের কয়লা রাখার জায়গায় ।
সাধারণত বড় ষ্টেশনেই জল এবং কয়লা ভরা হতো । জলের জন্য বিশাল একটা ওল্টানো “এল” য়ের মত মোটা কল থাকতো । দশ বা পনেরো মিনিট ষ্টপেজের মধ্যেই কয়লা আর জল ভরতে হতো এঞ্জিনে ।
জল ভরতো অবশ্য- সেকেণ্ড ফায়ারমান আর ড্রাইভার তদারকী করত সে সবের ।
এঞ্জিনের দুটো ভাগ ছিল । একটা মূল ভাগ আর একটা কয়লা আর জল রাখার জায়গা । মোটা লোহার পাত দিয়ে জোড়া থাকতো দুটো ভাগ ।
এঞ্জিনে বসার একটা ছোট জায়গা থাকতো শুধু ড্রাইভারের জন্য, বাঁদিকের দরজার কাছে কিন্তু ফার্ষ্ট আর সেকেণ্ড ফায়ারম্যানদের বসার জায়গা থাকতো না ।
ওরা পালা করে কয়লার ঢিবির ওপরেই বসতো বিশ্রাম নেবার জন্য ।
শীতকালে, তেমন একটা কষ্ট হতো না কারোই তবে গরম আর বর্ষার দিনে অবস্থা ভয়ঙ্কর হতো ওদের ।
ব্রিটিশরা বিশ্বাস করতো এদের আরামের ন্যূনতম সুযোগ টুকু দেওয়া উচিত নয়, কাজের সময় । ভারতীয়ে রেল সেই ধারাটা ধরে রেখেছিল ।
ডিজেল আর ইলেকট্রিক এঞ্জিন আসার পর অবশ্য অবস্থাটা পাল্টেছে- এটা অনস্বীকার্য।
যাক্ যে কথা বলছিলাম ! এঞ্জিনে কয়লা ভরা ওই নির্ধারিত সময়ে বেশ পরিশ্রমের কাজ, কিন্তু পুরো কাজটাই করতো ঠিকাদার সংস্থা । এই সংস্থাই নিয়োগ করতো মজুরদের ।
সারাদিনে বেশ কয়েকটা এঞ্জিনে কয়লা ভরতে হতো । মজুরী একটা ছিল বটে সরকারি ভাবে, তবে ঠিকাদার তার চেয়ে অনেক কম পয়সা দিত শ্রমিকদের ।
পেটের তাগিদে, সেটাই মেনে নিতো ওরা ।
সালটা ১৯৬৫ ।
সদ্য গতবছর হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা পাশ করেছি , আর বাবা নিয়ে চলে এসেছিলেন ওডিশা আন্ধ্রা সীমান্তের পারলা খেমুণ্ডির কলেজে ।
তাঁর ধারণা ছিল- বড় ছেলে কোলকাতায় থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে ।
এদিকে কোলকাতা ফেরত এক বঙ্গসন্তান কলেজে এসেছে – বাম রাজনীতির গন্ধ গায়ে নিয়ে, ফলে একটা হিরো ইমেজ আমার ।
বলতে দ্বিধা নেই, সেটা বেশ তারিয়ে উপভোগ করতাম ।
এদিকে বারবার কোলকাতা – পারলাখেমুণ্ডি যাবার ফলে, স্থানীয় দুটো ভাষা, তেলগু আর ওডিয়াতে দখলও ছিল আমার ।
(তেলগুতে আর সেই দখলটা নেই আমার অনভ্যাসের ফলে, তবে এখনও মোটামুটি কাজ চালানোর মত কথা বলতে পারি, তবে ওডিয়া এখনও মাতৃভাষার মত বলতে পারি ।)
পলাসা, কোলকাতা – মাদ্রাজ (চেন্নাই) রুটে এখনও বড় ষ্টেশন । পারলাখেমুণ্ডি থেকে বড় লাইনের ট্রেন ধরতে হলে ৩৮ কিমি দূরের ওই ষ্টেশনেই যেতে হতো সবার বাসে চেপে।
ন্যারো গেজ লাইনের ট্রেন ধরে নৌপাদা ষ্টেশনে যাওয়া যেত বটে, তবে সব ট্রেন ওখানে দাঁড়াতো না ।
========
একবার ঠিক হলো পলাসাতে আমাকে পাঠানো হবে, ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি বক্তা হিসেবে ।
তেলগু তে বক্তব্য রাখতে হবে । এক নেতার কাছে, কিছু প্রতিশব্দের জন্য নোটস্ নিলাম ।
পশ্চিমবাংলায় কিভাবে বিভিন্ন আন্দোলন হচ্ছে, তারই একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা জানাতে হবে আমাকে ।
বিপদ বাধলো যেদিন যাবো সেই দিন । একজন বাস ড্রাইভার মারা যাওয়ার জন্য সেদিন মোটামুটি বাস বন্ধ ।
কিন্তু যেতেই হবে । খবর দেওয়া হয়ে গেছে । একজন পরামর্শ দিলেন সাইকেল চালিয়ে পলাসা চলে যাবার জন্য । সাথে আরও একজন থাকবে অন্য আরেকটা সাইকেল নিয়ে আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য ।
অল্প ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে, বাড়ীতে বললাম- পিকনিক করতে যাচ্ছি । ভোর ছটায় বেরিয়ে পড়লাম দুজনে ।
রাস্তাতে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে পলাসা পৌঁছলাম সকাল সাড়ে আটটার সময়।
সভা শুরু হবে বেলা ১০ টায় । তাই বিশ্রাম নিতে গেলাম- একজনের বাড়িতে । হাতে বানানো ইডলি দোসা, চাটনি, সাম্বার খেলাম প্রাণ এবং পেট ভরে ।
বিশ্বাস করুন- ওইরকম স্বাদ, পরে আর কোনোখানে পাই নি আমি । খিদের মুখে তো অনেকবারই খেয়েছি, তবে ওই “টেস” এখনও আমার জিভে ।
১২ ঘন্টা কাজ করে মজুরী পাওয়ার কথা দৈনিক আট টাকা, কিন্তু হাতে পান পাঁচ টাকা। সাইন করতে হয় একটা ভাউচারে আট টাকারই ।
সভার শেষ বক্তা ছিলাম, আমি । এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে গরম গরম কথা প্রাণ ভরে বললাম । উত্তেজনার চোটে তোতলানোও ছিল কারণ, তেলগুতে কথপোকথন এক রকম আর ভাষণ বাজী আরেক রকম ।
প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে, সভা শেষ হলো বেলা তিনটের সময় । দুপুরে গরম ভাত আর ঝাল ঝাল টক টক পাঁঠার মাংস খেয়ে রেডি ফেরার জন্য ।
এর মধ্যেই খবর চলে এলো- ঠিকাদার লোক লাগিয়েছে আমাকে মারবে বলে ।
একটা খালি ট্রাক দাঁড় করিয়ে জানা গেল তারা ফিরছে পারলাখেমুণ্ডিতে । আমাদের দুজনকে সাইকেল শুদ্ধু তুলে দিলেন ওঁরা । সাথে আরও দুজন এলেন আন্ধ্রা সীমান্ত পার করিয়ে দিয়ে তার পর ফিরবেন । ওনাদেরও সাইকেল তোলা হল বেডফোর্ড ট্রাকটাতে ।
সত্যি বলতে কি, গরম বক্তৃতা দিয়ে যতটা গরম হয়েছিলাম, ততটাই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলাম ভয়ে ।
নিরাপদেই বাড়ী ফিরেছিলাম অবশ্য ।
==========

চার পাঁচ দিন পর খবর এসেছিল- আট টাকা না হলেও, মজুরী এক টাকা বেড়ে ছয় টাকা হয়েছিল ।

No comments:

Post a Comment